আমার মতো গুটানো স্বভাবের মানুষ কারো সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়া তো দূরে থাক, সহসা মিশতেও পারে না। সহজাত সেই ক্ষমতাটা আমার নেই। সৃষ্টিকর্তা বোধকরি এমন সব অসামাজিক দুর্লভ প্রজাতির মানুষদের জন্য শাহ আলমগীর ভাইয়ের মতো অন্তরঙ্গ, দিলখোলা ও মিশুক মানুষদের পাঠিয়ে দেন। যাঁরা খুব সহজেই দূরের মানুষকে আপন করে নিতে পারেন। কত মানুষের সঙ্গে যে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তা কেবল একমাত্র তিনিই জানতেন। তারপরও যতটা দেখেছি, তাঁর নেটওয়ার্ক ছিল অনেক দূর বিস্তৃত। সেটা তিনি বরাবরই রক্ষা করতেন। এ বিষয়ে তাঁকে কখনও বিরক্ত হতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বরং প্রতিনিয়ত সম্প্রসারিত হতো তাঁর যোগসূত্র। তাতে যেন তিনি খুশিই হতেন।
আশির দশকের মাঝামাঝি পেরিয়ে দৈনিক বাংলার বাণীতে কর্মরত অবস্থায় আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়। তখনও পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে আমার নবিসি অবস্থা পুরোপুরি কাটেনি। সাংবাদিক হিসেবে তিনি তখন মোটামুটিভাবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন। শিশু-কিশোর সাপ্তাহিক ‘কিশোরবাংলা’ আর দৈনিক জনতা পত্রিকায় হাত মকশো করে এসেছেন। দীক্ষা নিয়েছেন সাংগঠনিকতায়ও। সেটা তাঁর কাজে-কর্মে টের পাওয়া যেত। তাঁর মধ্যে একটা গুছানো স্বভাব ছিল। তিনি যখন কাজ করতেন, তখন তাতে থাকতো গভীর মনোযোগ। সে সময় অন্য কিছুতে আর খেয়াল থাকতো না। নিউজপ্রিন্টের কাগজে তাঁর ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর হস্তাক্ষরে ফুটে উঠতো দেশ-বিদেশের কত না খবর। সাংবাদিকতায় একটু সিনিয়র হলেই সাধারণত এক ধরনের ভারিক্কি ভাব দেখা যায়। জুনিয়রদের কথা বলতে হয় মেপে মেপে। নতুবা কারণে, অকারণে ধমক খেতে হয়। কিন্তু একদমই ব্যতিক্রম ছিলেন আলমগীর ভাই। তিনি ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া। তাঁর কাছে সিনিয়র-জুনিয়রের কোনো মাপকাঠি ছিল না। বরং জুনিয়রদের প্রতি তাঁর এক ধরনের প্রশ্রয় ছিল। তিনি যেভাবে সবার সঙ্গে মিশতে পারতেন, সুহৃদ হয়ে উঠতে পারতেন, বন্ধুত্বের বন্ধন গড়ে তুলতে পারতেন, তেমনটি সংবাদপত্র জগতে খুব বেশি দেখা যেত না। এ কারণে তাঁর সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি।
তখন তো অধিকাংশ সাংবাদিকের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা খুব একটা ছিল না। বেতন যা হোক না কেন, সেটা একবারে পাওয়াটা ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিস্তিতে কিস্তিতে পাওয়া যেত। কিন্তু সেটাইবা কবে পাওয়া যাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। বাড়তে থাকতো বকেয়া বেতনের সঞ্চয়। সঙ্গত কারণে আর্থিক অনটন লেগেই থাকতো। আর অর্থের অনটন থাকলে কি আর আনন্দে থাকা যায়? মজার ব্যাপার হলো, সে সময় পর্যাপ্ত অর্থ না থাকাটাই যেন আমাদের সুখের চাবিকাঠি হয়ে ওঠে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটি কিন্তু মোটেও বাড়িয়ে বলা নয়। এর অন্যতম কারণ, আলমগীর ভাইয়ের মতো সদা সুখী, সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল, যে কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের সান্নিধ্য। তিনি ছিলেন আমাদের কাছে জীয়নকাঠির মতো। যে কারণে আমরা সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনা ভাগাভাগি করে নিতে পারতাম। চারপাশের মালিন্য আমাদের স্পর্শ করতে পারতো না। সেই সময়ে আমাদের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে উঠে, তা কখনো ব্যাহত হয়নি। সেই দলে ছিলেন কবি সোহরাব হাসান, সুধীর কৈবর্ত দাস, দাউদ ভুঁইয়া, সুভাষ চন্দ বাদল, কবি হালিম আজাদ, অসীম কুমার উকিল, প্রণব সাহা, মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু, সায়েদুল আরেফিন, শরীফ সাহাবুদ্দিন, ঝর্ণা বেগম, সাইফুল আমিন, ফরিদা ইয়াসমীন, সাইফুল ইসলাম শ্যাম, নান্টু রায়, জি. এম. জোয়ার্দার প্রমুখ। একসঙ্গে কাজ করি কিংবা না করি, বন্ধনটা চিরদিনের জন্য অটুট রয়ে যায়। এমন বন্ধন অসংখ্য মানুষের সঙ্গে তাঁর গড়ে ওঠেছিল।
১৯৮৭ সালে সরকার দৈনিক বাংলার বাণী নিষিদ্ধ করে দিলে প্রকৃতঅর্থেই আমরা আতান্তরে পড়ে যাই। কবে পত্রিকা প্রকাশিত হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। এমন অবস্থায় সম্ভবত আলমগীর ভাইয়ের উদ্যোগে আমরা কয়েকজন যোগ দেই দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। অত্যন্ত সঙ্গিন অবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করছিল পুরানো ঘরানার এ পত্রিকাটি। এরই অংশ হিসেবে বাংলা দৈনিক পত্রিকার মধ্যে প্রথম কম্পিউটার চালু হয় আজাদে। সেই আর্কষণে মূলত আমাদের সেখানে ছুটে যাওয়া। যদিও সে সময় আমাদের খুব বড় কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল না, তারপরও নতুন একটি পদ্ধতিতে কাজ করার আনন্দ অন্তত ছিল। কম্পিউটারে কোনো গড়বড় হলে কালো রঙের বিকল্প ট্যাক্সি নিয়ে মধ্যরাতেও সাংবাদিক ও প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বারকে দিব্যি হাজির হতে দেখতাম, আজকের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী। আর সেই ইতিহাসের অংশীদার হই আলমগীর ভাইসহ আমরা কয়েকজন। কাজের পরিবেশ যেমনই হোক না কেন, আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা পারিবারিক পর্যায়ে গড়ে ওঠে। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন আলমগীর ভাইয়ের গৃহিণী মায়া ভাবী। তিনিও মায়াডোরে এমনভাবে বেঁধে ফেলেন, তাঁকে ভাবী বলবো না আপা বলবো, সেই দ্বিধা আজও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কোনো ঘোষণা ছাড়াই কখনো কখনো আলমগীর ভাইয়ের পল্টনের ছোট্ট কিন্তু ছিমছাম বাসায় গিয়ে দুপুরের খাবারের অংশীদার হয়েছি। ব্যঞ্জন বেশি না থাকলেও ব্যঞ্জনার কোনো কমতি ছিল না। এছাড়া নববর্ষ, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, জাতীয় প্রেস ক্লাব কিংবা অন্যত্র প্রাণোচ্ছ্বল আড্ডায় কত কত দিন অবগাহন করেছি। আহ্! তখন কী যে আনন্দময় দিন কেটেছে।
দৈনিক আজাদ পত্রিকার পর আমাদের কর্মস্থল বদলে গেলেও আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগাটা কখনোই বিচ্যুত হয়নি। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, জাতীয় প্রেস ক্লাব, হাঙ্গেরীভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব জার্নালিস্ট (আইওজে)-এর সঙ্গে সম্পৃত্ততা তো ছিলই, তাছাড়াও নানাভাবে সংস্পর্শ ও সংযোগ রয়ে যায়। হঠাৎ হঠাৎ ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায় স্রেফ আড্ডা মারতে তিনি চলে আসতেন। এটা যে নিছক আড্ডা ছিল না, সেটা তখন না বুঝলেও এখন বুঝতে পারি, আমাকে আশ্বস্ত করতেই তিনি যেতেন। আমি ‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায় যোগ দিতে না চাইলেও যাঁদের আগ্রহ, উৎসাহ ও পরামর্শে শেষ পর্যন্ত সেখানে যোগ দেই, তিনি তাঁদের অন্যতম। আলমগীর ভাই তাঁর মেধা দিয়ে, তাঁর প্রজ্ঞা দিয়ে, তাঁর কর্মদক্ষতা দিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে থাকেন। দৈনিক সংবাদ হয়ে দৈনিক প্রথম আলোর শুরু থেকেই দায়িত্বপূর্ণ পদ নিয়ে তিনি যুক্ত হন। যেখানেই কর্মরত থাকতেন, সেই প্রতিষ্ঠানের তিনি ছিলেন পরম এক নির্ভরতা। যে কোনো দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হলে অনায়াসেই নিশ্চিত হওয়া যেত। এ কারণে নতুন কোনো মিডিয়া গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হলে তিনি হতেন অটোমিক চয়েজ। যাঁদের হাত ধরে প্রাথমিকভাবে বেসরকারি ইলেকট্রোনিক মিডিয়ার সূচনা হয়, তিনি তাঁদের একজন। আগে থেকেই তিনি ছিলেন খ্যাতিমান শিশু সাহিত্যিক ফরিদুর রেজা সাগর এবং কৃষি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজের একান্তই আপনজন। সঙ্গত কারণে তাঁরা যখন চ্যানেল আইয়ে নিউজ সম্প্রচারের সিদ্ধান্ত নেন, তাঁকে ছাড়া এ ধরনের উদ্যোগের কথা ভাবতে পারেননি। চ্যানেল আই নিউজ সম্প্রচার শুরু করলে আলমগীর ভাই হয়ে উঠেন এর প্রধান কাণ্ডারি। একুশে টেলিভিশনের বিপুল জনপ্রিয়তা আর এটিএন বাংলা সংবাদ সম্প্রচার শুরুর মাঝে তিনি নতুন এক চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যান। সংবাদপত্র জগতের তাঁর চেনা-জানা কিংবা স্বল্প চেনা, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন কর্মহীন, এমন একদল কর্মীকে নিয়ে নতুন এ উদ্যোগের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু তিনি নিজেকে নিংড়ে দিয়ে এ প্রতিষ্ঠানকে দাঁড় করাতে সচেষ্ট হন। তাঁর দিন-রাতগুলো একাকার হয়ে যায়। সেই শুরু থেকে আমরা যাঁরা তাঁর সঙ্গে ছিলাম, তাঁকে দেখেছি কাজপাগল একজন মগ্ন সাধক হিসেবে। সংবাদকে কীভাবে দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায়, তা ছিল তাঁর সর্বক্ষণের চিন্তা। কোনো পরিস্থিতিতে তিনি উত্তেজিত হতেন না। কাজ করতেন ঠাণ্ডা মাথায়। যে কোনো সমস্যার সহজ সমাধান দিতে পারতেন। কঠিন কথাও হালকাচালে বলতেন। দৈবাৎ রেগে গেলেও কখনই কাণ্ডজ্ঞান হারাতেন না। তিনি নিজে যেমন যুক্তি দিয়ে কথা বলতেন, অন্যদের যুক্তিসঙ্গত কথাও তিনি অবলীলায় গ্রহণ করতেন। তিনি গড়ে তোলেন কর্মঠ, উৎসর্গকৃত ও নিবেদিতপ্রাণ একদল সংবাদকর্মী। যে কারণে অল্প দিনের মধ্যে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় চ্যানেল হিসেবে দর্শকদের হৃদয়ে স্থান করে নেয় চ্যানেল আই।
একটা সময় তিনি অন্যত্র চলে গেলেও চ্যানেল আইয়ের সঙ্গে তাঁর আত্মিক বন্ধন কখনো ছিন্ন হয়নি। এটাও তাঁর প্রধান একটি বৈশিষ্ট্য, কোথাও থেকে চলে গেলেও তিনি একদমই বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেন না। কাজের সম্পর্ক না থাকলেও আত্মিক যোগাযোগটা রয়েই যেত। আর সাগর ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা ছিল অন্য মাত্রার। তাছাড়া তাঁদের দুজনের জন্মদিন একই দিনে। এ কারণে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে এ দুজনের জন্মদিন একইসঙ্গে উদযাপিত হতো। এ চ্যানেলের মাধ্যমে তিনি যাঁদের দীক্ষা দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই আজ ইলেকট্রোনিক মিডিয়ায় সর্বেসর্বা। তিনি আসলে সবার মাঝে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পছন্দ করতেন। এ কারণে মিডিয়া জগত তো বটেই, সব ক্ষেত্রেই তাঁর অনুরাগীর সংখ্যা অগণিত। তাঁরা অন্তর দিয়ে তাঁকে ভালোবাসেন।
আলমগীর ভাই একুশে টেলিভিশন, যমুনা টেলিভিশন, মাছরাঙা টেলিভিশন, এশিয়ান টেলিভিশন হয়ে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন নিউ ভিশন টিভিকে। এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। অবশ্য এ টেলিভিশন চালু করার সুযোগ পাননি। প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি)-এর মহাপরিচালক হিসেবে যোগ দেওয়ায় তাঁর ধ্যান-ধারণা হয়ে উঠে এ প্রতিষ্ঠানটি। চাইলে তিনি এ প্রতিষ্ঠানকে আগের মতো ঢিলে-ঢালাভাবে পরিচালনা করতে পারতেন। কিন্তু এটা তাঁর স্বভাবের সঙ্গে যায় না। তিনি যোগ দেওয়ার পর এ প্রতিষ্ঠানটি সত্যিকার অর্থেই তার কাণ্ডারিকে খুঁজে পেয়েছিল। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের দিগন্তকে প্রসারিত করে দিয়েছিলেন। করে তুলেছিলেন সাংবাদিকবান্ধব। পিআইবি’র প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ছড়িয়ে দিয়েছিলেন দেশব্যাপী। এ কারণে তাঁকে প্রতিনিয়ত ছুটতে হতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তারপরও তাঁর কোনো কার্যক্রম কিন্তু থেমে থাকেনি। ঢাকায়ও একের পর এক প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও বিভিন্ন কার্যক্রম দিয়ে সরগরম করে তুলেছিলেন। সাংবাদিকতায় স্মাতকোত্তর ডিপ্লোমা ও মাস্টার্স কোর্স চালু করার মতো সাহস দেখিয়েছিলেন। স্বল্পব্যয়ে পিআইবিতে সাংবাদিকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করেছেন। গবেষণামূলক প্রকাশনার দিক দিয়ে তিনি নতুন এক মাইলফলক গড়ে তোলেন। আসলে সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা থাকলে, সরকারের মন্থর একটি প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে সজীব, সক্রিয় ও সরগরম করে তোলা যায়, তার চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন আলমগীর ভাই। আর এ কারণেই তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে চুক্তির মেয়াদ ক্রমাগত বাড়ানো হতে থাকে। সরকারিভাবে ‘বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট’ গঠন করার পর পিআইবি’র পাশাপাশি একই সঙ্গে এ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বও তাঁকে অর্পণ করা হয়। নতুন এ প্রতিষ্ঠানটিও তার দীপ্তি ছড়াতে থাকে। যথারীতি উপকৃত হতে থাকেন সাংবাদিকরা। পেশাদার সাংবাদিকদের নিয়েই ছিল তাঁর ভাবনা। কীভাবে তাঁদেরকে সমৃদ্ধ করা যায়, সেজন্য তাঁর উদ্যোগের কোনো কমতি ছিল না। এজন্য প্রয়োজনে অভিজ্ঞ ও সিনিয়র সাংবাদিকদের মেধা ও জ্ঞান কাজে লাগাতেন। একইভাবে টেলিভিশন ও রেডিওর সাংবাদিকদের নিয়ে গড়ে উঠা ‘ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার’ (বিজেসি)-এর তিনি ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা।‘ন্যায়পাল’-এর মতো একটি দায়িত্বশীল পদে তিনি অলঙ্কৃত করেন। সাংবাদিকদের যে কোনো সংগঠনের নির্বাচন হলে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে তাঁকে অবশ্যই থাকতে হতো। এর কারণ, সবার কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা।
আসলে তাঁর কর্মপরিধি ছিল অনেক দিকে বিস্তৃত। সাংবাদিক ইউনিয়নের প্রতি তাঁর বরাবরই টানা ছিল। তাঁদের অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন সোচ্চার। এ কারণে তাঁর ছিল বিপুল জনপ্রিয়তা। তাঁর প্রমাণ তিনি নির্বাচিত হয়েছেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। অন্য কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লেওএ সংগঠনটির নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখতেন। শত ব্যস্ততার মাঝে নিয়মিত ঢুঁ মারতেন জাতীয় প্রেস ক্লাবে। শিশুদের প্রতি তাঁর অপরিসীম দরদ ছিল। শিশু ও কিশোরদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান ‘চাঁদের হাট’-এর সঙ্গে তাঁর সম্পৃত্ততা অনেক আগেই ছিল, তারই ধারাবাহিকতায় গড়ে তোলেন ‘জাতীয় শিশু কল্যাণ পরিষদ’। শিশুদের নিয়ে তাঁর কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক ছিল। খ্যাতিমান অভিনেতা ও নির্মাতা সৈয়দ হাসান ইমামের চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। হাসান ইমাম ও ভারতের শক্তি সামন্তের যৌথভাবে প্রযোজিত এবং মিঠুন চক্রবর্তী ও রোজিনা অভিনীত ‘অবিচার’ সিনেমা নির্মাণে তিনি ঘনিষ্টভাবে সক্রিয় ছিলেন।
আলমগীর ভাই আরো একটি বড় কাজ হাতে নিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশে প্রথম টিভি নিউজের আর্কাইভ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। ‘নিউজ অ্যান্ড ইমেজেস’ নামের এ প্রতিষ্ঠানটির জন্য লালমাটিয়ায় একটি অফিসও নেওয়া হয়েছিল।প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দিয়ে সাজানো হয়েছিল দপ্তরটি। এ কাজটা কিছু দূর এগিয়েছিল। কিন্তু কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল এ কাজের জন্য সার্বক্ষণিক সময় দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। এতদিকে তাঁকে জড়িয়ে পড়তে হয়, যে কারণে এ বিষয়ে আর মনোযোগ দিতে পারেননি। তারপরও এটি তিনি বুকের মধ্যে লালন করতেন। অনেক কিছুই তিনি করেছেন। তারচেয়েও বেশি কিছু করতে চেয়েছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, তাঁর আর কিছু করা হবে না।
আলমগীর ভাই ছিলেন মূল্যবোধসম্পন্ন একজন সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ। তিনি একটি আদর্শ, একটি দর্শন ও একটি নীতি মেনে চলতেন। সেই ৩২/৩৩ বছর আগে তাঁকে যেমন দেখেছি, শেষ পর্যন্ত তাঁর খুুব একটা পরিবর্তন দেখিনি। তিনি সুস্থ ও সুন্দর জীবনবোধ এবং সমাজতান্ত্রিক জীবনধারায় বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতিতে। যে কারণে যেখানে গেছেন, সবার সঙ্গে গড়ে তোলেন অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে সম্পর্ক গড়িয়েছে পারিবারিক বন্ধনে।
তিনি একজন নিষ্ঠাবান সাংবাদিক ও সংগঠক ছিলেন না, মানুষ হিসেবেও ছিলেন অতুলনীয়। তিনি যদি বুঝতে পারতেন, কোনো সহকর্মীর চাকরি নেই, তিনি তাঁকে বুঝতে না দিয়ে চেষ্টা করতেন তাঁর কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে। কত কত জনকে যে চাকরি দিয়েছেন, তার কোনো হিসেব নেই। এ কারণে তাঁর প্রতি এই আস্থাটুকু ছিল, আমি যদি কখনো বিপদে বা সংকটে পড়ি, তিনি বাড়িয়ে দেবেন সহযোগিতার হাত। এটা শুধু আমার নয়, নিশ্চয়ই অনেকেই এমনটি মনে করতেন। এ আস্থা তিনি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। মিডিয়ায় তাঁর মতো ব্যক্তি খুব কমই দেখা যায়। তিনি ছিলেন স্বল্পভাষী, কিন্তু কর্মনিষ্ঠ, সৃজনশীল ও পরিশ্রমী। যা করতেন সততার সঙ্গে করতেন। আনন্দের সঙ্গে করতেন। ভালোবেসে করতেন। এ কারণে গণমাধ্যম জগতে তিনি আলাদা একটা অবস্থান গড়ে নিতে পেরেছিলেন।
আমরা শুধু একজন সহযোগী, একজন সহকর্মী ও একজন সহমর্মীকে হারায়নি, হারিয়েছি একজন অকৃত্রিম বন্ধু ও অভিভাবককে। কোনো কিছু হয়তো শূন্য থাকে না। কিন্তু কিছু কিছু শূন্যতা আছে, যা কখনো পূরণ হয় না। আলমগীর ভাইয়ের শূন্যতা অপূরণীয় রয়ে যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন