ইংরেজ লেখক-দার্শনিক স্যার ফ্রান্সিস বেকন ১৫৯৭ সালে বলেছিলেন, ‘নলেজ ইজ পাওয়ার’। তাঁর কথাটাকে একটু বদলে এখন বলা হয়, ‘ইনফরমেশন ইজ পাওয়ার’। এটা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না, আজকের পৃথিবীতে তথ্যের অমিত শক্তি। চারপাশেই তা অনুভব করা যায়। বিশ্বায়নের খোলা জানালা দিয়ে আমরা যে ‘বিশ্বগ্রাম’-এর বাসিন্দা হয়ে ওঠেছি, সে তো তথ্যের শক্তির ওপর ভিক্তি করে। প্রিন্ট, ইলেকট্রোনিক মিডিয়ার পাশাপাশি অনলাইনের মাধ্যমে তথ্যের অনেক বেশি বিকাশ ঘটছে। একই ধারায় ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নেওয়া ও জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রেও মিডিয়া রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে যে কোনো খেলা হোক না কেন, মিডিয়ার কল্যাণে তার সর্বশেষ তথ্য নিমিষেই সবার কাছে অনায়াসেই পৌঁছে যায়। এ ম্যাজিকটা সম্ভব করেছেন ক্রীড়া সাংবাদিকরা।
মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম হলো না। ব্রিটিশ ভারতে সূচনা ঘটে ক্রীড়া সাংবাদিকতার। একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় ১৮৫৪ সালের এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে একটি ফুটবল ম্যাচের খবর প্রকাশ হয়। এ দিয়ে শুরু এ অঞ্চলে ক্রীড়া সাংবাদিকতা। ছোট্ট পরিসরের খেলার এ খবর প্রকাশ করাটা ছিল বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত। তারপর তো কলকাতা ফুটবলের তীর্থকেন্দ্র হয়ে ওঠলে সংবাদপত্রেও তার প্রতিফলন ঘটে। শুরুতে ফুটবলকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয় বাংলা ক্রীড়া সাংবাদিকতা। অবশ্য ফুটবলের পাশাপাশি অন্য খেলাগুলোও স্থান করে নেয়। সে সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত হতো অসংখ্য পত্র-পত্রিকা। তাতে ক্রীড়াঙ্গনও গুরুত্ব পেতে থাকে। ব্রিটিশদের সঙ্গে ভারতীয়দের ফুটবল ম্যাচ হয়ে ওঠে ক্রীড়া সাংবাদিকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। ম্যাচ রিপোর্টের পাশাপাশি ছাপা হয় সাদা-কালো ছবি। তবে সব কিছুই কলকাতাকেন্দ্রিক হওয়ায় তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় সংবাদপত্রের প্রসার খুব একটা ছিল না।
সে সময় ঢাকায় পত্র-পত্রিকার বিস্তার ছিল খুবই কম। হাতেগোনা যে কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়, তার সঙ্গে খেলাধুলার খুব একটা সম্পৃত্ততা ছিল না। ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ঢাকা নিউজ’ ১৮৫৬, ‘বেঙ্গল টাইমস’ ১৮৬০ সালে ও ১৮৬০ সালে প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক ‘কবিতাকুসুমালী’ প্রকাশিত হয়। ১৮৬১ সালে বের হয় ‘ঢাকা প্রকাশ’। খেলাধুলার সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে দীর্ঘায়ুর এ পত্রিকাই ছিল সবেধন নীলমণি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম দৈনিক ‘দ্য হেরাল্ড’, বাজারজাত হয় ১৯১৬ সালে। এ ধরনের পত্রিকায় কদাচিৎ খেলার খবর হয়তো থাকতো। তবে তার কোনো হদিস এখন মেলে না। যে কারণে ব্রিটিশ ভারতে ঢাকায় ফুটবল লিগ আয়োজিত হলেও সে সংক্রান্ত তথ্য নেই বললেই চলে। কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় ঢাকার ক্রীড়াঙ্গনের খবর মাঝে-মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। তা খুব বেশি উল্লেখ করার মতো নয়। ১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত দৈনিক আজাদ-এর ঢাকাস্থ প্রতিনিধির পাঠানো খেলার খবর কালেভদ্রে ছাপা হতো। আজাদ-এর পাশাপাশি দৈনিক ইত্তেহাদ, ডেইলি মর্নিং নিউজ ঢাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘সওগাত’ পত্রিকা ক্রীড়া সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভালোই ভূমিকা রাখে। কলকাতা মোহামেডান ক্লাবকে কাভারেজ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ পত্রিকাটির অবদান বেশি। খেলোয়াড়দের ছবি ও প্রোফাইল প্রকাশ করে সাড়া জাগায়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের ক্রীড়াঙ্গনের পালে লাগে নতুন হাওয়া। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ক্রীড়া সাংবাদিকতার অবয়ব। তখন তো সংবাদপত্রের সংখ্যা ছিল খুবই সীমিত। উল্লেখযোগ্য হলো সৈনিক, জিন্দেগী, ডেইলি অবজারভার, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক। তবে আজাদ, মর্নিং নিউজ, অবজারভার, সংবাদ, ইত্তেফাক-এর মতো দীর্ঘস্থায়ী পত্রিকাগুলো সমাজমানসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মূলত এ পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে বিকশিত হয় ক্রীড়া সাংবাদিকতার ধারা। সে সময় থেকে প্রথমে খ-কালীন, পরবর্তীতে সার্বক্ষণিক ক্রীড়া সাংবাদিক নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রথম ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে মনে করা হয় দৈনিক আজাদ-এর সৈয়দ জাফর আলীকে। তিনি এ পত্রিকার চিফ রিপোর্টারের পাশাপাশি স্পোর্টস রিপোর্টিং করতেন। বাংলা পত্রিকায় খেলাধুলার খবর খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হতো না। এক কলামের বেশি নিউজ প্রকাশ হওয়াটা ছিল অনেক বড় ব্যাপার। অধিকাংশ দিন কোনো নিউজই থাকতো না। তবে ইংরেজি পত্রিকায় খেলার খবর যথেষ্ট গুরুত্ব পেত। ১৯৪৯ সালের ১৯ মার্চ প্রকাশিত অবজারভার প্রথম খ-কালীন স্পোর্টস রিপোর্টার নিয়োগ দেওয়া হয় কানু কবির (নুরুল কবির)কে। ১৯৫৪ সালে সার্বক্ষণিক স্পোটস রিপোর্টার হিসেবে কুতুবউদ্দীনকে নিয়োগ দেয় মর্নিং নিউজ। এরপর থেকে স্পোর্টস রিপোর্টার নিয়োগের ধারাও গড়ে ওঠে। ভারতের মাটিতে নিজেদের দ্বিতীয় টেস্টেই প্রথম এবং স্বাগতিক ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাকিস্তানের জয় আর ফজল মাহমুদ, নজর মোহাম্মদ, মাহমুদ হুসাইনের বিস্ময়কর পারফরম্যান্স দারুণভাবে সে সময় সাড়া জাগায়। সংবাদপত্র জগতও নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয়। পত্রিকার সীমিত পরিসরের বড় একটি অংশ স্থান করে নেয়। এমনকি প্রথম পৃষ্ঠায় ব্যানার হেডিংও হয়। ১৯৫৫ সালে ভারত, নিউজিল্যান্ড, ১৯৫৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অস্ট্রেলিয়া, ১৯৬২ সালে ইংল্যান্ড, ১৯৬৯ সালে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে পাকিস্তানের টেস্ট ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ায় ক্রিকেটের রূপ-রস-গন্ধে পল্লবিত হয় ক্রীড়া সাংবাদিকতা।
পর্যায়ক্রমে ঢাকা প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগও গুরুত্ব পেতে থাকে। তদানীন্তন পাকিস্তানের ফুটবলের তীর্থকেন্দ্র ছিল ঢাকা। অর্থের প্রলোভনে ঢাকা লিগে খেলার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটে আসতেন ফুটবলাররা। জমজমাট হয়ে ওঠে ঘরোয়া ফুটবল। পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানিদের খেলা হলে তা উত্তেজনার বারুদ ছড়াতো। পাঠকদের আগ্রহের কারণে সংবাদপত্রে খেলাধুলার স্পেস বাড়তে থাকে। পঞ্চাশ দশকের শেষদিকে মর্নিং নিউজ আর অবজারভার-এ খেলার জন্য এক পৃষ্ঠা বরাদ্দ করলে ক্রীড়া সাংবাদিককতার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হয়। সে সময় স্পোর্টস এডিটরও নিয়োগ দেওয়া হয়। সবার আগে সাপ্তাহিক খেলার পাতা চালু করে মর্নিং নিউজ। ষাটের দশকের শুরুতে বাংলা পত্রিকার মধ্যে প্রথম এ ধারা অনুসরণ করে দৈনিক আজাদ। ১৯৫৪ সালে ঢাকা স্টেডিয়াম গড়ে উঠলে ক্রীড়াঙ্গনে উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। স্টেডিয়াম এলাকায় ক্রীড়া সাংবাদিকদের আনাগোনা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। তার প্রতিফলন দেখা যায় সংবাদপত্রের পাতায়। ঢাকা লিগ ছাড়াও রোনাল্ডশে শিল্ড, ১৯৫২, ’৫৭, ’৬২ সালে পাকিস্তান ন্যাশনাল ফুটবল, ১৯৫৫ সালে ৪ জাতির কোয়াড্রাঙ্গুলার, ১৯৫৮ সাল থেকে শুরু আগা খান গোল্ড কাপ, ১৯৬৭ সালে আরসিডি টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে ঢাকার ফুটবলে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ঢাকার মাঠে খেলতে আসে ভিন দেশি শক্তিশালী বিভিন্ন ফুটবল দল। ফুটবল হয়ে ওঠে সংবাদপত্রের প্রধান আকর্ষণ।
১৯৫৫, ’৬০, ’৬৪, ’৬৮ সালে পাকিস্তান ন্যাশনাল গেমস, ১৯৫৫ সালে ঢাকায় অ্যাথলেট জিনাত আহমেদ ও ১৯৫৬ সালে লাহোরে লুৎফুন্নেছা হক বকুলের স্বর্ণ জয়, ১৯৫৮ সাল থেকে ’৬১ সাল পর্যন্ত সাঁতারু ব্রজেন দাসের ৬বার ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করে সাড়া জাগান। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাথলেটিকস, সাঁতার সহ বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ক্রীড়া সাংবাদিকদের আকৃষ্ট করে। প্রতিটি ইভেন্টই ক্রীড়া সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। তবে বিদেশি খেলার খবর টাটকা প্রকাশের সুযোগ ছিল না। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার মাধ্যমে নিউজ পাকিস্তানের করাচি হয়ে আসতো। পঞ্চাশের দশকে থেকে পত্র-পত্রিকায় খেলার ছবিও প্রকাশিত হয়। যদিও সার্বক্ষণিক কোনো ক্রীড়া বিষয়ক আলোকচিত্রী ছিল না। পত্রিকায় ১/২জন যে আলোকচিত্রী থাকতেন, তাঁরাই হতেন সকলের কাজের কাজী। ষাট দশকের মাঝামাঝি দৈনিক পাকিস্তান প্রকাশের পর বাংলা পত্রিকায় অনেক বেশি গুরুত্ব পেতে থাকে খেলাধুলা। সেই সঙ্গে দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক জনপদ এগিয়ে আসে।
স্বাধীনতার পর ক্রীড়া সাংবাদিকতায় মৌলিক একটা পরিবর্তন আসে। যদিও নিদিষ্ট সংখ্যক পত্রিকায় অল্প কয়েক জন ক্রীড়া সাংবাদিক দীর্ঘ দিন সংশ্লিষ্ট ছিলেন। যে কারণে খুব একটা বৈচিত্র্য ছিল না। তবে ব্যক্তিগতভাবে কারো কারো উদ্যোগ ও উৎসাহ নজর কাড়তে সক্ষম হয়। পাশাপাশি সাপ্তাহিক, পাক্ষিক পত্রিকাগুলোও ক্রীড়াঙ্গনকে গুরুত্ব দিয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে ক্রীড়া বিষয়ক পত্রিকা। তবে আশির দশক থেকে লেখালেখির ক্ষেত্রে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
ক্রীড়া সাংবাদিকতায় দুটি ধারা বরাবরই ছিল। কেউ কেউ এটাকে নিয়েছিলেন পেশা হিসেবে। আবার কারো কারো কাছে এটি ছিল নিছক শখ। অন্য পেশার পাশাপাশি সন্ধ্যার পর ঢাকা স্টেডিয়ামে কিছু সময়ের জন্য ঢু মারতেন। আবার বিনা পয়সায় খেলা দেখতে পারবেন, সেই প্রলোভনেও নাম লেখাতেন ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে। নব্বই দশকেও দেখতে হয়েছে প্রেস রিলিজ সাংবাদিকতা। কোনো ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হলে সেই ফেডারেশনের প্রেস রিলিজের জন্য অন্তহীন অপেক্ষা। কোনো কারণে প্রেস রিলিজ না পেলে কিংবা প্রেস রিলিজের সংখ্যা কম হলে অনেকেই হাপিত্যেশ করতেন। কীভাবে পৃষ্ঠা ভর্তি করা যাবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যেতেন। এখনও সে ধারা একেবারেই বিলীন হয়ে যায় নি। অনেক মিডিয়ায় কম টাকায় সাংবাদিক নিয়োগ দেওয়া হয়। ইদানিং ক্রীড়া সাংবাদিকতায় যোগ দিচ্ছেন মেধাবারী। ক্রীড়ালেখনির একটি শক্তিশালী ধারাও রয়েছে। যাঁরা খেলাকে সাহিত্য রসে সিঞ্চিত করে পাঠকদের মুগ্ধ করে যাচ্ছেন।
১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর একটা পালাবদল ঘটে। সংবাদপত্র প্রকাশের কঠিন যে বিধি-নিষেধ ছিল তা শিথিল হয়। এরফলে নিত্য-নতুন যে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়, তাতেও পরিবর্তন আসে। দৈনিক আজকের কাগজ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে নতুনত্বের একটা ছোঁয়া লাগে। লিটার্যালি জার্নালিজমের যে ধারাটা অনুসরণ করা হয়, কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজার, আজকাল পত্রিকা আগেই তা প্রচলন করে। প্রতিবেশী রাজ্যের পত্রিকায় রিপোর্টে যতটা না তথ্য থাকে, তারচেয়ে বেশি থাকে গল্প। সে দিক থেকে ব্যতিক্রম আজকের কাগজ এবং পরবর্তীকালে এ ধারার পত্রিকাগুলো। সাহিত্য রস থাকলেও তাতে তথ্যও থাকে। নতুন ধারার এ ক্রীড়া সাংবাদিকতা পাঠকরাও লুফে নেন।
তবে এক একটি পত্রিকাকে কেন্দ্র করেও আবর্তিত হয়েছে ক্রীড়া সাংবাদিকতা। তৈরি হয়েছে নিজস্ব ঘরানা। সময়ের পরিক্রমায় সংবাদপত্রে খেলার পৃষ্ঠা বেড়েছে। কোনো কোনো পত্রিকায় তো রয়েছে চার পৃষ্ঠাও। আগে সংবাদপত্রে ক্রীড়া সাংবাদিকদের খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হতো না। হারাধনের দশটি ছেলের অনাদৃত একটি ছেলে হয়ে থাকতো হতো। কেউ খোঁজ নিতে চাইতো না। এখন ক্রীড়া সাংবাদিকদের সম্মান বেড়েছে। বেড়েছে বিত্ত-বৈভব। প্রথম পার্ট টাইম স্পোর্টস রিপোর্টার যেখানে ৫০ রূপি পেতেন, এখন কোনো কোনো ক্রীড়া সাংবাদিক যে সুযোগ-সুবিধা পান, তা রীতিমতো ঈর্ষাণীয়। ক্রীড়া সাংবাদিক ছাড়া কোনো মিডিয়া এখন ভাবাই যায় না। আগে যেখানে এক-আধজন ক্রীড়া সাংবাদিক দিয়ে কাজ চালানো হতো, এখন দৈনিক প্রথম আলোতে ১৩ ও একাত্তর টিভিতে ১৪ জন কর্মরত আছেন। আশঙ্কাজনক হলো, সংবাদপত্রের সংখ্যা দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে। ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট টিভির ব্যাপক প্রসার ঘটায় প্রিন্ট মিডিয়ার জন্য তা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সার্বিকভাবে সংবাদপত্রের এখন আগের মতো কদর নেই। নতুন প্রজন্মের কাছে এটি অনেকটাই উপেক্ষিত। বিশ্বব্যাপী চলছে প্রিন্ট মিডিয়ার মন্দা। অনেক বনেদি পত্রিকা হয় বন্ধ নতুবা ইন্টারনেট সংস্করণ বের হচ্ছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। ওয়েবসাইট, ব্লগ, ফেসবুক, টুইটারের সঙ্গে পাল্লা দিতে হচ্ছে সংবাদপত্রকে। ক্রমশ গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। পাঠক কমছে। বাধ্য হয়ে সংবাদপত্রগুলোও অনলাইনে ঝুঁকছে।
প্রিন্ট ও টেলিভিশনের পাশাপাশি বেতার সাংবাদিকতাও ক্রীড়া ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় বেতার সম্প্রচার শুরু হয়। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বেতারে কোনো কোনো খেলা সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। দীর্ঘ দিন যাবৎ বেতার ক্রীড়াঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। হাল আমলে নতুন মেজাজের বেতারে ক্রীড়া সাংবাদিকতা আলাদা একটি স্থান করে নিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ক্রীড়া সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে টেলিভিশন। মার্কিন এক গবেষণায় জানা যায়, মানুষ যা পড়ে তার ১০ শতাংশ মনে রাখে আর যা দেখে তার ৩০ শতাংশ মনে থাকে। এ থেকে টিভির গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, সংবাদপত্র পড়তে হলে শিক্ষিত হতে হয়। টিভি দেখতে হলে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই। টিভি এমন একটি মাধ্যম, যা সহজেই দর্শকদের আকৃষ্ট করতে পারে। বাইরের পৃথিবীকে দেখার জন্য টিভি খোলা জানালার মতো। এ জানালা দিয়ে কোথায় কী ঘটছে, তা আমরা জানতে পারি। দেখতে পারি। এর মাধ্যমে ক্রীড়া সাংবাদিকরা ক্রীড়াঙ্গনকে এনে দিচ্ছেন হাতের মুঠোয়।
বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টিভি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে নিতে পেরেছে। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় ‘পাকিস্তান টেলিভিশন’-এর সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯৮০ সালে শুরু হয় বিটিভির রঙিন সম্প্রচার। একক টিভি হিসেবে দীর্ঘ দিন আধিপত্য বিস্তার করেছে বিটিভি। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক ইভেন্ট সম্প্রচারের কৃতিত্ব বিটিভির। বেতবুনিয়ার ভূ-উপগ্রহের মাধ্যমে বাংলাদেশের দর্শকরা প্রত্যক্ষ করেছেন আন্তর্জাতিক ফুটবল, বক্সার মুহাম্মদ আলীর প্রজাপতি নৃত্য ইত্যাদি। দেশীয় ফুটবলের অনেক ম্যাচও সম্প্রচার করেছে। যদিও এ ক্ষেত্রে ক্রীড়া সাংবাদিকতার সরাসরি ভূমিকা ছিল না। তবে অবদান রেখেছেন ক্রীড়া ধারাভাষ্যকাররা। তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন ক্রীড়া সাংবাদিক।
নব্বই দশকের মাঝমাঝি নতুন যুগের সূচনা হয় স্যাটেলাইট টিভির। প্রথম প্রতিষ্ঠিত স্যাটেলাইট টিভি হিসেবে ১৯৯৭ সালের ১৫ জুলাই যাত্রা শুরু করে ‘এটিএন বাংলা’। ১৯৯৯ সালে এটি অ্যানালগ থেকে ডিজিটালে রূপান্তর হয়। বিটিভির পর ২০০০ সালের ১৪ এপ্রিল প্রাইভেট টেরিষ্টিয়াল চ্যানেল হিসেবে সম্প্রচার শুরু করে একুশে টেলিভিশন অর্থাৎ ইটিভি। দেশে বর্তমানে স্যাটেলাইট টিভিগুলো যে ধারায় সংবাদ পরিবেশন করে, তার পথিকৃৎ একুশে টিভি। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন ব্রিটিশ সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। ক্রীড়া সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও প্রচলিত ধারাও বদলে দেয় একুশে টিভি। এরপর তো চ্যানেলের ঢল নেমেছে। প্রতিনিয়ত নিত্য-নতুন চ্যানেল আত্মপ্রকাশ করছে।
স্পোর্টস আর স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল যেন একে অপরের পরিপূরক। শুরু থেকে ক্রীড়াঙ্গনকে গুরুত্ব দিয়ে আসছে চ্যানেলগুলো। এ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আজ যে জমজমাট অবস্থা, তার পেছনে রয়েছে চ্যানেলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অতীতে খেলাধুলা আটকে ছিল একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে। সেটাকে বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে এসেছে চ্যানেলগুলো। খেলাধুলা এমন একটি বিনোদন, যা মানুষের মনকে প্রসারিত করতে পারে। দেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ খেলাকে ভালোবাসেন। খেলাধুলার খোঁজ-খবর রাখেন। চ্যানেলগুলো ক্রীড়াপ্রেমী এই দর্শকদের কাছে খেলাধুলাকে সহজেই পৌঁছে দিচ্ছে। তাদের মাধ্যমে পাওয়া যায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনের সর্বশেষ খবর। প্রায় সব রকম খেলার খবর দিচ্ছে কিংবা সরাসরি সম্প্রচার করছে। সেটি বিশ্বের যে কোনো প্রান্তেই হোক না কেন। একজন ক্রীড়াবিদ যত না দেশে খেলতে যান, তার চেয়ে বেশি দেশে কাভার করতে যান অনেক ক্রীড়া সাংবাদিক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাগতিক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের সাংবাদিকদের উপস্থিতি থাকে বেশি। এমনকি যে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অংশ গ্রহণ থাকে না, সেখানেও ক্রীড়া সাংবাদিকরা পৌঁছে যান।
অনলাইন সাংবাদিকতা যেভাবে দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে, আগামীর মিডিয়া মূলত নিয়ন্ত্রণ করবে এই মাধ্যমটি। ক্রীড়া সাংবাদিকদের জন্য এটি এসেছে চ্যালেঞ্জ হিসেবে। আগে কাগজ আর একটি কলম ছিল ক্রীড়া সাংবাদিকদের সম্বল। প্রযুক্তির এ যুগে কাগজ-কলম অনেকটাই হারিয়ে যাচ্ছে। কী বোর্ডের সঙ্গে আঙুলের খেলা তো আছেই, সেইসঙ্গে নতুন অনেক কিছু রপ্ত করতে হচ্ছে। আর ইলেকট্রোনিক মিডিয়ার সাংবাদিক হলে তাকে রীতিমতো প্রকৌশলী হয়ে ওঠতে হয়। প্রিন্ট মিডিয়া যেভাবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, ইলেকট্রোনিক মিডিয়াকেও নিরাপদ ভাবার সুযোগ নেই। প্রযুক্তি যেভাবে হাতের মুঠোয় সব কিছু এনে দিচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতের ইলেকট্রোনিক মিডিয়াও বড় ধরনের পরিবর্তন আসার লক্ষণ ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। প্রযুক্তি যতই অত্যাধুনিক হয়ে ওঠছে, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষতা প্রদর্শন করে চলেছেন ক্রীড়া সাংবাদিকরা। আর এভাবেই এগিয়ে চলেছে ক্রীড়া সাংবাদিকতার বর্ণিল ধারা। আর তাতে সমৃদ্ধ হচ্ছে ক্রীড়াঙ্গন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন