গান যে অনুভবের তারে তারে কবে মর্মে পশেছিল, সেটা বলতে পারবো না। তবে সুর যেহেতু যে কারো হৃদয়ে সহজেই দোলা দিতে পারে, আমাকে নিশ্চয়ই দিয়েছিল, একদম শৈশবেই। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে, অনুধাবন করার মতো উপলব্ধি হওয়ার পর থেকেই হৃদয়ে ঠাঁই করে নেন হেমন্ত-কিশোর অর্থাৎ বাংলা গানের অন্যতম দুই প্রবাদপুরুষ হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও কিশোর কুমার। দু’জনের দুই রকম কণ্ঠমাধুর্য মন জয় করে নেয়। তবে হেমন্তকে কেন জানি খুব কাছের ও আপন মনে হয়। বাংলা গানের সোনালি যুগের একজন দিকপাল হয়েও তারমধ্যে কোনো গরিমা ছিল না। নিপাট ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন একদমই তাই। অমায়িক ও অকপট। গানেই নিজেকে পুরোপুরিভাবে সমর্পণ করেছিলেন।
তার উদাত্ত ভরাট কণ্ঠ হৃদয়ে অনায়াসেই দোলা দেয়। যে কারণে তার গাওয়া গানগুলো বুকের গভীরে স্থান করে নেয় চিরদিনের মতো। এখনও তার গান কোথাও বেজে ওঠলে চারপাশটা ভরে যায় ভালো লাগায়। নস্টালজিক হয়ে ওঠে মন। তার দরদমাখা কণ্ঠে প্রতিটি গানই হয়ে আছে দেদীপ্যমান। ‘তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো’, ‘কেন দূরে থাকো শুধু আড়াল রাখো’, ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে নাতো মন’, ‘আমার জীবনের এত খুশি এত হাসি’, ‘আজ দু’জনার দু‘টি পথ’, ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব’, ‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’, ‘বসে আছি পথ চেয়ে’, ‘আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি’, ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না’, ‘পৃথিবীর গান আকাশ কি মনে রাখে’, ‘আজ রাতে ঘুমিয়ে পড়ো না তুমি’, ‘যাবার আগে কিছু বলে গেলে না’, ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম’, ‘আয় খুকু আয়’, ‘সব কথা বলা হলো’, ‘তারপর, তার আর পর নেই’, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’, ‘বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা’, ‘মেঘ কালো আকাশ কালো’, ‘কত দিন পরে এলে একটু বসো’, ‘এক গোছা রজনীগন্ধা হাতে দিয়ে বললাম’, ‘শোনো বন্ধু শোনো’, ‘রানার ছুটেছে’, ‘যে বাঁশি ভেঙে গেছে’, ‘এই বালুকা বেলায় আমি লিখেছিনু’, ‘কোনো এক গাঁয়ের বধুর’, ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা’, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে’, ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’, ‘আমিও পথের মতো হারিয়ে যাবো’-র মতো চিরায়ত গানগুলো কি কখনো ভোলা যায়? অলৌকিক এক সৌন্দর্য রয়েছে গানগুলোর পরতে পরতে। এ কারণে গানগুলো শোনা হচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। তার আবেদন একটুও ম্লান হয়নি। হয়ে ওঠেছে কালজয়ী। সঙ্গত কারণে বাংলা গান বললেই অনায়াসে মনের মণিকোঠায় ভেসে ওঠেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হিন্দি গান গেয়েও তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীতও পেয়েছে অন্য এক মাত্রা। সংগীত পরিচালক হিসেবেও ছিল তার সুখ্যাতি। কিংবদন্তি এই শিল্পীর গান শুনতে শুনতে বেড়ে ওঠেছি। তাই তার গানগুলোকে মনে হয় আমার নিজেরই গান।
তবে তাকে কখনো কাছ থেকে দেখবো কিংবা সামনা-সামনি তার গান শুনবো, এমনটি কখনো ভাবিনি। অথচ কখনো কখনো স্বপ্নও সত্য হয়ে যায়। আমার জীবনেও এই স্বপ্নটি সত্য হয়েছিল। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে এই শিল্পী শেষ বারের মতো বাংলাদেশে আসেন। যদিও তখন তিনি অনেকটাই বেলা শেষের গান। আগের মতো আর গাইতে পারতেন না। শারীরিকভাবেও সুস্থ ছিলেন না। গান গাইতে খুবই কষ্ট হতো। তবুও অনুরোধের ঢেঁকি গিলে জাতীয় প্রেস ক্লাবেও এসেছিলেন গান গাইতে। বিখ্যাত শিল্পী হলেও তার মধ্যে কোনো অহমিকা ছিল না। একদমই সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। পোশাক-আশাকেও ছিলেন অনাড়ম্বর। ক্লাবের দোতলার একটি কক্ষে ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে তার গানের আয়োজন করা হয়। তিনি সেখানেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে স্বভাবজাত ভঙ্গিতে একে একে গাইতে থাকেন তার চিরকালীন ভালোলাগার গানগুলো। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। দেখেছিলামও বিমুগ্ধচিত্তে। সেদিন নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিল। সেই দিনটি এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে স্মৃতিপটে। এই জীবনে একটি বড় পাওয়া কাছাকাছি বসে তার গান শোনা। তাকে কাছ থেকে দেখা। ১৯৮৯ সালের সে সফরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন কবি, লেখক ও অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল। এই অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হওয়ার ক’দিন পরেই মৃত্যু আবু হেনা মোস্তফা কামালকে অকালেই ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আমার কাছে কেন জানি বিস্ময়কর লেগেছে, এর মাত্র দু‘দিন পরই ২৬ সেপ্টেম্বর সংগীত জগতকে শূন্য করে দিয়ে চলে যান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
তিনি চলে গেলেও স্রোতাদের কাছে এখনও তিনি জাগরূক আছেন। তাকে অনুকরণ ও অনুসরণ করে কত জন যে শিল্পী হিসেবে জীবন গড়েছেন, কিন্তু তার স্থান কারো পক্ষে পূরণ করা সম্ভব হয়নি। বাংলা গানের ইতিহাসে এ যাবৎ কত কত শিল্পী গান গেয়েছেন। কিন্তু তারমধ্যে স্ব-মহিমায় অনন্য হয়ে আছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তিনি যে সুরের আকাশে শুকতারা।
তার উদাত্ত ভরাট কণ্ঠ হৃদয়ে অনায়াসেই দোলা দেয়। যে কারণে তার গাওয়া গানগুলো বুকের গভীরে স্থান করে নেয় চিরদিনের মতো। এখনও তার গান কোথাও বেজে ওঠলে চারপাশটা ভরে যায় ভালো লাগায়। নস্টালজিক হয়ে ওঠে মন। তার দরদমাখা কণ্ঠে প্রতিটি গানই হয়ে আছে দেদীপ্যমান। ‘তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো’, ‘কেন দূরে থাকো শুধু আড়াল রাখো’, ‘এই মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকে নাতো মন’, ‘আমার জীবনের এত খুশি এত হাসি’, ‘আজ দু’জনার দু‘টি পথ’, ‘এই রাত তোমার আমার’, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’, ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব’, ‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’, ‘বসে আছি পথ চেয়ে’, ‘আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি’, ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না’, ‘পৃথিবীর গান আকাশ কি মনে রাখে’, ‘আজ রাতে ঘুমিয়ে পড়ো না তুমি’, ‘যাবার আগে কিছু বলে গেলে না’, ‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম’, ‘আয় খুকু আয়’, ‘সব কথা বলা হলো’, ‘তারপর, তার আর পর নেই’, ‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’, ‘বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা’, ‘মেঘ কালো আকাশ কালো’, ‘কত দিন পরে এলে একটু বসো’, ‘এক গোছা রজনীগন্ধা হাতে দিয়ে বললাম’, ‘শোনো বন্ধু শোনো’, ‘রানার ছুটেছে’, ‘যে বাঁশি ভেঙে গেছে’, ‘এই বালুকা বেলায় আমি লিখেছিনু’, ‘কোনো এক গাঁয়ের বধুর’, ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা’, ‘মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে’, ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’, ‘আমিও পথের মতো হারিয়ে যাবো’-র মতো চিরায়ত গানগুলো কি কখনো ভোলা যায়? অলৌকিক এক সৌন্দর্য রয়েছে গানগুলোর পরতে পরতে। এ কারণে গানগুলো শোনা হচ্ছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। তার আবেদন একটুও ম্লান হয়নি। হয়ে ওঠেছে কালজয়ী। সঙ্গত কারণে বাংলা গান বললেই অনায়াসে মনের মণিকোঠায় ভেসে ওঠেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হিন্দি গান গেয়েও তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তার কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীতও পেয়েছে অন্য এক মাত্রা। সংগীত পরিচালক হিসেবেও ছিল তার সুখ্যাতি। কিংবদন্তি এই শিল্পীর গান শুনতে শুনতে বেড়ে ওঠেছি। তাই তার গানগুলোকে মনে হয় আমার নিজেরই গান।
তবে তাকে কখনো কাছ থেকে দেখবো কিংবা সামনা-সামনি তার গান শুনবো, এমনটি কখনো ভাবিনি। অথচ কখনো কখনো স্বপ্নও সত্য হয়ে যায়। আমার জীবনেও এই স্বপ্নটি সত্য হয়েছিল। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরে এই শিল্পী শেষ বারের মতো বাংলাদেশে আসেন। যদিও তখন তিনি অনেকটাই বেলা শেষের গান। আগের মতো আর গাইতে পারতেন না। শারীরিকভাবেও সুস্থ ছিলেন না। গান গাইতে খুবই কষ্ট হতো। তবুও অনুরোধের ঢেঁকি গিলে জাতীয় প্রেস ক্লাবেও এসেছিলেন গান গাইতে। বিখ্যাত শিল্পী হলেও তার মধ্যে কোনো অহমিকা ছিল না। একদমই সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। পোশাক-আশাকেও ছিলেন অনাড়ম্বর। ক্লাবের দোতলার একটি কক্ষে ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে তার গানের আয়োজন করা হয়। তিনি সেখানেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে স্বভাবজাত ভঙ্গিতে একে একে গাইতে থাকেন তার চিরকালীন ভালোলাগার গানগুলো। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। দেখেছিলামও বিমুগ্ধচিত্তে। সেদিন নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিল। সেই দিনটি এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে স্মৃতিপটে। এই জীবনে একটি বড় পাওয়া কাছাকাছি বসে তার গান শোনা। তাকে কাছ থেকে দেখা। ১৯৮৯ সালের সে সফরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন কবি, লেখক ও অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল। এই অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হওয়ার ক’দিন পরেই মৃত্যু আবু হেনা মোস্তফা কামালকে অকালেই ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আমার কাছে কেন জানি বিস্ময়কর লেগেছে, এর মাত্র দু‘দিন পরই ২৬ সেপ্টেম্বর সংগীত জগতকে শূন্য করে দিয়ে চলে যান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
তিনি চলে গেলেও স্রোতাদের কাছে এখনও তিনি জাগরূক আছেন। তাকে অনুকরণ ও অনুসরণ করে কত জন যে শিল্পী হিসেবে জীবন গড়েছেন, কিন্তু তার স্থান কারো পক্ষে পূরণ করা সম্ভব হয়নি। বাংলা গানের ইতিহাসে এ যাবৎ কত কত শিল্পী গান গেয়েছেন। কিন্তু তারমধ্যে স্ব-মহিমায় অনন্য হয়ে আছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তিনি যে সুরের আকাশে শুকতারা।
(জাতীয় প্রেস ক্লাবের স্মরণিকায় প্রকাশিত।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন