পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

রবিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৩

প্লিজ, গাছ কাটবেন না


প্রতিদিন বাসস্থান থেকে কর্মস্থলে যাবার স্বল্প পরিসরের যে পথটুকু, যা যানজটের কল্যাণে বেশ কিছুটা দীর্ঘ হয়ে যায়, চাই বা না চাই, যাত্রাকালীন সময়টুকু গাড়িতে বসে আশপাশের নানা দৃশ্যাবলী কখনো বাধ্য হয়ে, কখনো একরাশ কৌতূহল নিয়ে দেখতে হয়। এ সময় নানা রকম অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। কখনো-সখনো সাত-সকালে সিটি কর্পোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির পিছে পিছে চলতে হয়। নাকে এসে লাগে রাস্তায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধ। কানে তীব্র চিৎকার হয়ে ভেসে আসে পঞ্চাশ ও ষাট দশকে গাছপালা পরিবেষ্টিত অবস্থায় গড়ে ওঠা চমৎকার সব বাড়ি ভাঙ্গার নির্মম শব্দ, দেখতে হয় বহুতল ভবনের শক্ত-গাঁথুনি। শুনতে হয় যানবাহনের অহেতুক হর্ন। ডুবে যেতে হয় নিকষ কালো ধোঁয়ার ধূম্রজালে। যানবাহনের নিয়ম না-মানা তো রুটিনমাফিক দৃশ্য। সড়কগুলোর মানচিত্র বদলে যাওয়া, ট্র্যাফিক সিগন্যালের নিত্য-নতুন নিয়ম-কানুনের ফাঁদে প্রায়শই আটকা পড়তে হয়। সড়কদ্বীপ কিংবা আইল্যান্ডের ওপরে দু’হাত মেলে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষগুলোর মন্দভাগ্যসহ ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাওয়া রাজধানী ঢাকাকে যেন কখনো উত্তরাধুনিক কবিতার মত দুর্বোধ্য, আবার কখনো গীতল কবিতার মতো সহজবোধ্য মনে হয়। এর মাঝে মনটা তখনই বেশি খারাপ হয়ে যায়, যখন দেখি ইট-পাথর-সিমেন্টের অরণ্যে হারিয়ে যাচ্ছে সবুজের নিসর্গ। কিছুদিন কোনো রাস্তায় যাতায়াত না করলে সে এলাকাকে চিনতে কষ্ট হয়। দু’পাশে সটান দাঁড়িয়ে যায় বহুতল ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট ও ঝলমলে মার্কেট। কিন্তু চোখকে স্বিগ্ধ ও মনকে ভালো লাগায় ভরিয়ে দেয়ার জন্য যে গাছগুলো সেখানে ছিল, তার লেশমাত্র চিহ্ন কোথাও থাকে না। প্রতিদিনই নির্মূল হয়ে যাচ্ছে গাছ-গাছালি। এর পাশাপাশি যানজটের সর্বগ্রাসী লাগাম টেনে ধরার জন্য আইল্যান্ডগুলোকে নিয়ে বছরের পর বছর ধরে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, তাতে গাছের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। অথচ সড়কদ্বীপ ও আইল্যান্ডগুলোতে অনেক অযত্ন-অবহেলা আর বাধা-বিঘ্ন ও প্রতিকূলতার মাঝে বেড়ে ওঠে এক-একটি গাছ। কত চারা যে গাছ হয়ে ওঠার আগেই ঝরে যায় অকালে! এর মাঝেও যা গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে এই পচা-গলা-নোংরা শহরের শোভা বর্ধন করে, তারও বলি হতে হয় কথিত সড়ক, সড়কদ্বীপ ও আইল্যান্ডের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। এছাড়াও প্রতি বছর ঝড়, বৃষ্টি ও টর্নেডোয় বিনষ্ট হয় হাজার হাজার গাছ। প্রকৃতির ওপরে কারো হাত না থাকলেও অধিকাংশ গাছই উপড়ে পড়ে আমাদের অবহেলায়। এর কারণ সড়ক উন্নয়ন, গ্যাস-পানি-বিদ্যুৎ-টেলিফোনসহ নানা কারণে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করায় রাস্তার পাশের গাছগুলোর মাটি আলগা হয়ে যায়। এছাড়া অধিকাংশ গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত মাটি নেই। এ কারণে একটুখানি বাতাসে বা ঝড়ে গোড়াসহ হেলে পড়ে প্রাচীন ও নবীন- সব বয়সী গাছ।


এমনিতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে উজাড় হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের মূল্যবান বৃক্ষসম্পদ। তার ওপর জনগণের অজ্ঞতা আর পরিবেশ সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে দিনে দিনে হ্রাস পাচ্ছে গাছ-গাছালির সংখ্যা। একটা সময় এই ঢাকা ছিল বৃক্ষ ও ফুলের শহর। প্রতিটি বাড়ি ছিল বৃক্ষময়। ছিল নানারকম ফুল ও ফলের সমাহার। কবি বুদ্ধদেব বসু কতই না প্রশস্তি গেয়েছেন এই ঢাকা শহরকে নিয়ে। ঢাকার নিসর্গ ও নির্জনতার কথা কখনোই তিনি ভুলতে পারেননি। বুদ্ধদেব বসুর স্বপ্নের ঢাকা শহরকে চিনতে এখন বড্ড কষ্ট হয়। ইট-পাথরের আকাশছোঁয়া কংক্রিটে ঢেকে গেছে ঢাকার খোলা আকাশ। ফুল, ফল ও বৃক্ষ দেখতে হলে চলে যেতে হয় নাগরিক কোলাহল ছেড়ে দূরে কোথাও। তাছাড়া অল্প কিছু বৃক্ষ যে এখনো দেখা যায়, তার অধিকাংশই অপরিচিত- বিদেশি বৃক্ষ। সবকিছুতেই যেখানে বিদেশ-নির্ভরতা, সেখানে গাছই বা বাদ যাবে কেন! বিদেশ থেকে আমদানিকৃত গাছগুলোর না আছে সৌন্দর্য, না আছে কোনো গুণাবলী। বরং কিছু কিছু গাছ পরিবেশ ও মাটির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে। বৃক্ষের পাশাপাশি এখন আর দেখা যায় না নয়নমনোহর ও মাতাল করা বাহারি সুগন্ধী ফুল ও ফলের গাছ। বৃক্ষ, ফল ও ফুল এখন ঢাকা শহরে বিরল হয়ে ওঠায় তা সরকারি উদ্যানে যেয়ে টিকিট কেটে দেখতে হয়। বিশাল বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট বাড়ির টবে, কোনো কোনো বাড়ির ছাদে কিছু কিছু সৌখিন ব্যক্তি গাছ লাগান; নতুবা অধিকাংশ বাড়িতে প্লাস্টিকের গাছ কিংবা ড্রয়িং রুমে শোভা পায় প্রকৃতির দেয়াল চিত্র। সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে হলে প্রকৃতিতে ভারসাম্য বজায় রাখা প্রয়োজন। যে কারণে মরুভূমি এখন মরুদ্যান হয়ে উঠেছে। যেখানে ছিল ধু-ধু বালুকারাশি, সেখানে এখন আশ্চর্যরকমভাবে দিগন্তব্যাপী সবুজের ছোঁয়া। এমন অসম্ভব সম্ভব হয়েছে মানুষের সচেতনতা ও অপরিসীম প্রচেষ্টার কারণে। আর অপরিকল্পিত নগরায়নের নামে ঢাকা শহর বৃক্ষহীন মরু শহরে পরিণত হতে চলেছে। বিশ্বের কোন্ শহরে নগরায়ন হচ্ছে না? সব শহরেই উন্নয়নের পাশাপাশি গাছ, ফল ও প্রকৃতিকে গুরুত্ব দেয়া হয়। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর শহরে বৃক্ষকে সাজানো হয়েছে স্থাপত্য শিল্পের মতো করে। দেখলে জুড়িয়ে যায় চোখ ও মন। আর পুরনো লন্ডন শহরকে উদ্যানের শহর বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না। গাছ, ফল ও প্রকৃতি মানুষের অনেক পুরনো বন্ধু। মানব জীবনের জন্য গাছ অত্যন্ত অপরিহার্য। গাছের কাছে আমরা কী পাই না? খাদ্য, জ্বালানি, পশুসম্পদ, বাড়ি-ঘর তৈরির উপকরণ, ছায়াময় পরিবেশ, মাটির উর্বরতার পাশাপাশি প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত ও প্রবল সামুদ্রিক ঝড় থেকে রক্ষা করে গাছ। সবচেয়ে যেটি গুরুত্বপূর্ণ, চমৎকার নৈসর্গিক দৃশ্যপট ও আবহাওয়া সৃষ্টির মাধ্যমে বেঁচে থাকার জন্য শ্বাস-প্রশ্বাসের মূল উপজীব্য অক্সিজেন আমরা গাছ থেকে গ্রহণ করি। বাংলাদেশে যেখানে ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল বা গাছ-গাছালি থাকা দরকার, সেখানে আছে মাত্র ৬ শতাংশ। যা পরিবেশের জন্য দারুণ বিপজ্জনক। বিবেকবর্জিত এক শ্রেণীর মানুষ অর্থের লোভে নির্বিচারে লোপাট করছে বৃক্ষসম্পদ। এ কারণে সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে জলবায়ু। বাড়ছে রোগ-ব্যাধি। মানুষের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে অস্থিরতা ও চঞ্চলতা। যে জন্য অসুস্থ হয়ে পড়ছে সামাজিক পরিবেশ। অবক্ষয় ঘটছে মূল্যবোধের। আসলে গাছের সঙ্গে মানুষের যে আত্মিক ও হার্দিক সম্পর্ক, তা অনুভবের ও অনুধাবনের বিষয়। জাতীয় পর্যায়ে বৃক্ষরোপণ ও বৃক্ষ পরিচর্যার ওপর গুরুত্ব দেওয়া খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সর্বত্রই গাছ লাগানো প্রয়োজন। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিনামূল্যে কিংবা স্বল্পমূল্যে গাছের চারা সরবরাহ, গাছের পরিচর্যা করা ও গাছের গুরুত্ব তুলে ধরে জনমত গড়ে তুলতে হবে।


ইদানীং অবশ্য কিছুটা সচেতনতা বেড়েছে। গ্রাম এলাকায় গাছ লাগানো হচ্ছে। তবে লাগাতে হবে বনজ, ফলজ, ভেষজ ও ঔষধি গাছ। ফুল, ফল, দারুবৃক্ষ, অশ্বত্থ গাছ শুধু প্রকৃতিকে সুন্দর করে না, ভবিষ্যতের জন্য বড় ধরনের বিনিয়োগ হয়ে থাকে। দারিদ্র্য দূরীকরণে বৃক্ষ হতে পারে অকৃত্রিম বন্ধু। স্কুল-কলেজ, রাস্তার পাশে, হাইওয়ে, ট্রেন লাইনের দু’পাশে, নদীর তীরে, বাড়ির সামনে এবং খোলা জায়গা পেলে গাছ লাগাতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী একটি গাছ কাটলে অন্তত তিনটি গাছ লাগানো প্রয়োজন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুখ ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হলে গাছের কোনো বিকল্প নেই। শুধু গাছ লাগালেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। কেননা, গত কয়েক বছরে কোটি কোটি গাছের চারা লাগানো হয়েছে। সে অনুপাতে তা গাছ হয়ে ওঠেনি। এর কারণ, যথাযথ পরিচর্যার অভাব। এই ঢাকা শহরে সড়কদ্বীপ ও আইল্যান্ডগুলোতে বিভিন্ন সময় গাছের চারা লাগানো হয়েছে। তার বেশিরভাগই গাছ হয়ে ওঠার আগেই ঝরে যায়। অনাদরে ও অবহেলায় যে গাছগুলো বেঁচে যায়, সেগুলো নগরায়ন ও সৌন্দর্যের নামে কেটে ফেলা হয়। ফলে ঢাকা শহর ক্রমশ বৃক্ষ ও ছায়াশূন্য হয়ে যাচ্ছে। নগরপিতার প্রতি অনুরোধ, প্লিজ, যে অল্প কিছু গাছ এখনো অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে, তাকে রক্ষা করুন। আর যাতে কোনো গাছ না কাটা হয়, সে ব্যবস্থা নিন। সে সঙ্গে নতুন নতুন গাছ লাগানোর ব্যবস্থা ও তার যথাযথ পরিচর্যা করে পৃথিবীর অন্যান্য শহরের মতো ঢাকাকেও একটি সুন্দর, নৈসর্গিক ও তিলোত্তমা শহরে পরিণত করুন।

দৈনিক ভোরের কাগজ : ৩০ মে ২০০৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন