পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৩

আমাদের শৈশবের দুই কিংবদন্তী

একই দিনে চলে গেলেন আমাদের শৈশবের দুই কিংবদন্তী- রোমেনা আফাজ এবং গ্রেগরি পেক। যদিও দু’জনে দুই ভিন্ন ঘরানা এবং দুই প্রান্তের বাসিন্দা। রোমেনা আফাজের রহস্য সিরিজ ‘দস্যু বনহুর’ আর গ্রেগরি পেক-এর দুর্দান্ত অভিনয় আমাদেরকে শৈশব-কৈশোরকে বুঁদ করে রেখেছিল। চকিতে মনের পর্যায় ভেসে ওঠে ফেলে আসা শৈশব-কৈশোরের সেসব অমলিন স্মৃতি। চটপটি, ঝালমুড়ি ও সস্তার আইসক্রিমের সঙ্গে ‘দস্যু বনহুর’ আর হলিউডি ছবি ছিল আমাদের কৈশোরের দুর্বার আকর্ষণ।



জন্মের পর থেকে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে সেই যে ওতপ্রোত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তার পলে পলে জড়িয়ে আছে কত না অম্ল-মধুর স্মৃতি। শৈশব-কৈশোরের দুরন্তপনা, খেলাধুলা, বই পড়া, নাটক, সিনেমা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, নানা রকম ভেল্কিবাজিসহ এ শহরের বেড়ে ওঠার বাঁকে বাঁকে আমাদের দেহ-মনে ছাপ ফেলে যায় কত না দৃশ্যপট। আমাদের প্রজন্মে, নানাজনের নানা রকম ঝোঁক ছিল। তবে বই পড়ার প্রতি সবারই ছিল অন্যরকম আকর্ষণ। বিশেষ করে, পাঠ্যবই বাদ দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে গল্প, উপন্যাস ও রহস্য সিরিজের বই সে বয়সে কী যে টানতো, তা বলে বোঝানো যাবে না! প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি অতিক্রম করার পর রোমেনা আফাজের রহস্য সিরিজ ‘দস্যু বনহুর’ আমাদের বয়সী বালকরা গোগ্রাসে গিলতাম। ‘দস্যু বনহুর’ ছিল আমাদের স্বপ্ন, কল্পনার নায়ক। যে কোনো বিপদে-আপদে তিনি ঝড়ের বেগে ঘোড়ায় চড়ে এসে হাজির হতেন। যেন অদৃশ্য মানব! রাতের আঁধারে কালো ড্রেসে তার চলাফেরা পাঠক-হৃদয়ে শিহরণ জাগাতো। প্রতিটি বইয়ের শেষটুকু এমনভাবে লেখা হতো, যাতে পরবর্তী বইটি না পড়ে উপায় থাকতো না। প্রতিটি বই এক নিঃশ্বাসে শেষ করার পর পরবর্তী বইটির জন্য আমাদের কী অন্তহীন প্রতীক্ষা! কার আগে কে পড়বো, তা নিয়ে একটা নীরব প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলতো। সে বয়সে ঢাকার শের-এ-বাংলা নগরের বাসিন্দা হিসেবে ওই এলাকাই ছিল আমার বা আমাদের সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। শের-এ-বাংলা নগরের গণ্ডির বাইরে যাওয়ার কথা ভাবলেই আমাদের কেঁপে উঠতো বুক। অথচ ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজের বই পড়ার জন্য আমাদের ছিল কী দুঃসাহসিক অভিযাত্রা! ফার্মগেটের বুকস্টল থেকে নতুন ও আনকোরা বই সংগ্রহ করার জন্য কি ঝড়, কি বৃষ্টিতে সাইকেল চালিয়ে উল্কাবেগে বেপরোয়া ছুটতাম। কোনো ভয়-ভীতি ও পিছুটান আমাদের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারতো না। পাঠ্য বইয়ের প্রতি যতটা আমাদের অনীহা ছিল, ঠিক ততটাই আগ্রহ ছিল পাঠ্য বইয়ের বাইরের বইয়ের প্রতি। তবে এ কথা ঠিক, আমাদের পাঠাভ্যাস গড়ে তুলতে লেখিকা রোমেনা আফাজের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। রোমেনা আফাজ ১২ জুন রাতে হঠাৎ চলে যাওয়ায় উসকে উঠে আমাদের বুকে জমে থাকা শৈশব-কৈশোরের সেই স্মৃতি। প্রচলিত অর্থে রোমেনা আফাজকে জীবনধর্মী লেখিকা বলা যাবে না। তার লেখায় পাণ্ডিত্য বা গভীরতা না থাকলেও চুম্বকের মতো পাঠককে টেনে রাখতো। যে কারণে তার লেখা সব বয়সী পাঠককে সমানভাবে আকর্ষণ করতো। তার সময়ে তিনি ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখিকা। তার বই বিক্রি হতো হট-কেকের মতো।

তবে কথাসাহিত্যিক হিসেবে তিনি যতই না খ্যাতিমান ছিলেন, তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় ছিলেন গোয়েন্দা সিরিজ ‘দস্যু বনহুর’-এর রচয়িতা হিসেবে। আড়াই শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। এর মধ্যে রয়েছে বহু গল্প, কবিতা, কিশোর উপন্যাস, সামাজিক উপন্যাস, গোয়েন্দা সিরিজ ও রহস্য সিরিজের গ্রন্থ। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ দু’দশকে ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজে ১৩৮টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া উপন্যাসের সংখ্যা ৬৯টি। তার উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র হয়েছে : কাগজের নৌকা, মোমের আলো, মায়ার সংসার, মধুমিতা, মাটির মানুষ ও দস্যু বনহুর ছিল সুপারহিট। তার ছবির কাহিনী ও গান মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। এখনো সেসব গান পুরনো দিনের মানুষকে উদাসীন ও স্মৃতিলগ্ন করে তোলে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে গোয়েন্দা সিরিজ ‘দস্যু বনহুর’-এর জন্য আমাদের মতো অনেকের বুকে তিনি চির-জাগরুক হয়ে থাকবেন। রোমেনা আফাজ গোয়েন্দা সিরিজ লেখার শুরুর আগে এ দেশের তরুণ-তরুণীদের প্রিয় ছিল পশ্চিম বাংলার লেখকদের ডিটেকটিভ সিরিজ। তাদের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের মাঝে নিজের প্রতিভা ও মেধা দিয়ে নিজের অবস্থান করে নিতে সক্ষম হন রোমেনা আফাজ। ‘দস্যু বনহুর’ সিরিজ কী পরিমাণ বিক্রি হয়েছে, তা কল্পনাও করা যাবে না। আজ জনপ্রিয় হুমায়ূন আহমেদ যেমনি সুখপাঠ্য উপন্যাস, গল্প, নাটক লিখে অসম্ভব জনপ্রিয়তার পাশাপাশি ঝিমিয়ে পড়া পাঠ্যাভ্যাসকে চাঙ্গা করে তুলেছেন, তেমনিভাবে রোমেনা আফাজ পাঠকদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন। বিশেষভাবে কিশোর, তরুণ, যুবকরা তার বই দিয়ে পাঠাভ্যাস শুরু করে পরবর্তীকালে জীবনধর্মী ও ক্লাসিক বই পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়েছে। যদিও ৭৭ বছর বয়সে রোমেনা আফাজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু ‘দস্যু বনহুর’-এর রচয়িতা হিসেবে তিনি আমাদের হৃদয়ে চিরতরুণ ও চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন। ‘দস্যু বনহুর’-এর স্বপ্নময়তা যখন আস্তে-ধীরে ফিকে হতে থাকে, সে সঙ্গে কৈশোর পেরিয়ে আমরা যখন তারুণ্যে অবগাহন করতে থাকি, ঠিক তখন হলিউডের পুরনো আমলের মারদাঙ্গা ও রোমান্টিক চরিত্র আমাদের ধ্যান-ধারণাকে পাল্টে দিতে থাকে। কিংবদন্তীর যেসব নায়ক-নায়িকা আমাদের চোখে স্বপ্নের অঞ্জন এঁকে দেন, তার মধ্যে গ্রেগরি পেক অন্যতম। গ্রেগরি পেকের দীর্ঘদেহ, স্মার্টনেস, পেটানো চেহারা, চৌকানো চোয়াল, শান্ত কিন্তু গম্ভীর কণ্ঠ আর গভীর ও অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আমাদের হৃদয়ে আলাদা স্থান করে দেয়। পুরুষোচিত ইমেজ আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব দিয়ে তিনি আমাদের হৃদয়-মন জয় করে নেন। ‘রোমান হলিডে’, ‘দ্য গানস অব নাভারন’, ‘ম্যাকেনার্স গোল্ড’ প্রভৃতি চলচ্চিত্রে তার অনবদ্য অভিনয় আমাদের কাঁপিয়ে দেয়। যদিও এ ছবিগুলো পঞ্চাশ ও ষাট দশকে মুক্তি পেয়েছে; কিন্তু তার আবেদন চিরকালীন। নতুবা আমাদের জন্মের আগের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতো না। মধুমিতা হলে বসে দেখা এ ছবিগুলোর দৃশ্যায়ন, ঘোড়ার খুরের শব্দ ও চিঁহি চিঁহি রব এ মুহূর্তে কানে এসে বাজছে। ‘রোমান হলিডে’ ছবিতে অড্রে হেপবার্নের সঙ্গে গ্রেগরি পেকের রোমান্টিক প্রেমের দৃশ্যায়নগুলো সবাইকে আপ্লুত করে দেয়। রোমগামী একটি রাজকীয় বহর থেকে আধুনিক কালের প্রিন্সেস হেপবার্ন ‘পালিয়ে’ গিয়ে নিজের আত্মপরিচয় গোপন রাখেন। এ সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় আমেরিকান সাংবাদিক গ্রেগরি পেকের। তারপর দু’জনে প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকেন। প্রতিটি মুহূর্ত ও কথোপকথন দর্শকদের হাসি-আনন্দে, কৌতুকে ও উত্তেজনায় মজিয়ে রাখে। যুদ্ধকে নিয়ে সর্বকালের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র ‘দ্য গানস অফ নাভারন’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানীর বিশাল অস্ত্রভাণ্ডারকে ধ্বংস করার জন্য গ্রিক আইল্যান্ডে পাঠানো হয় একটি কমান্ডো দলকে। এ কমান্ডো দলের নেতৃত্বে ছিলেন গ্রেগরি পেক। জার্মান ও ব্রিটিশ বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধে যে স্পেশাল অ্যাফেক্ট ব্যবহার করা হয়, তার সাউন্ড এখনো বুকের মাঝে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো প্রতিধ্বনিত হয়। আরিজোনা ভূখণ্ডে কিংবদন্তীর স্বর্ণের গুপ্তভাণ্ডার নিয়ে গ্রেগরি পেক ও ওমর শরিফের যুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘ম্যাকেনার্স গোল্ড’। গুপ্তভাণ্ডারে যাওয়ার পথের সন্ধান জানেন একমাত্র গ্রেগরি পেক। স্বর্ণের গুপ্তভাণ্ডার সন্ধানের পথে মেক্সিকান দস্যু ওমর শরিফের সঙ্গে কখনো সংঘর্ষ, কখনো মিত্রতার খণ্ড খণ্ড দৃশ্য আর ঘোড়ার খুরের প্রতিধ্বনি ও হ্রেষা রব প্রতিটি মুহূর্তকে জমজমাট করে রাখে। আমাদের শৈশবে হলিউডি ছবি সম্পর্কে একটা ধারণা গড়ে ওঠে গ্রেগরি পেকের ছবি দেখে দেখে। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম জনপ্রিয় অভিনেতা গ্রেগরি পেক। তিনি ছিলেন হলিউডের স্বর্ণযুগের অভিনেতা। তার ক্ল্যাসিক, রোমান্টিক ও দুর্ধর্ষ অভিনয় আমাদের কাছে অম্লান হয়ে আছে। এরপর আরো ক্ল্যাসিক, আরো রোমান্টিক এবং আরো দুর্ধর্ষ চলচ্চিত্র ও অভিনয় আমাদের হৃদয় ছুঁয়েছে। কিন্তু তারুণ্যের গ্রেগরি পেক আমাদের বুকে গভীরভাবে দাগ কেটে আছেন। ১২ জুন ৮৭ বছর বয়সে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেও তার যৌবনদৃপ্ত, প্রত্যয়ী ও সেক্স সিম্বল ব্যক্তিত্ব আর অসাধারণ অভিনয় মনের মণিকোঠায় চিরঞ্জীব হয়ে থাকবে। এক সময়ের জনপ্রিয় লেখিকা রোমেনা আফাজ আর এককালের পর্দা কাঁপানো অভিনেতা গ্রেগরি পেক- একটা সময় এসে দু’জনেই কেন জানি হঠাৎ নীরব হয়ে যান। যাবতীয় কোলাহল, আলোর ঝলকানি, মানুষের প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা ও সংস্পর্শ থেকে দূরে সরে গিয়ে একটা দুর্ভেদ্য আড়াল গড়ে তোলেন। নিভৃতের জগতে রচনা করেন নিজস্ব একটা পরিম-ল। একান্তই কাছের মানুষ ছাড়া আর সবার সঙ্গে গড়ে ওঠে একটা দূরত্ব। অতীতের খ্যাতি-অখ্যাতি, কলরব, উজ্জ্বলতা- কোনো কিছুই তাদের স্পর্শ করেনি। ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি, সুখ ও বেদনা নিয়ে জাবর কেটেছেন আপন মনে। রোমেনা আফাজ ও গ্রেগরি পেক- দু’জনে দু’জগতের বাসিন্দা হলেও উভয়ই পরিণত বয়সে একই দিনে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। একজন লিখেছেন গোয়েন্দা কাহিনী ও তার লেখা উপন্যাস নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র এবং আরেকজন চলচ্চিত্রের নায়ক ছিলেন। মৃত্যু এবং চলচ্চিত্র দু’জনকে একাত্ম করলেও দু’জনেই একটা প্রজন্মের কাছে চিরদিন আনন্দময় স্মৃতি হয়ে থাকবেন। 

দৈনিক প্রথম আলো : ২৫ জুন ২০০৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন