পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

রবিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৩

সার্স : মিশন ইম্পসিবল থ্রি!


ইরাকে মার্কিন আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব থিতু হতে না হতেই ‘সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিনড্রম’ বা ‘সার্স’ ভাইরাস নিয়ে এখন সারা দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসা এই রোগে প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছে অসংখ্য ব্যক্তি এবং মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ইতোমধ্যে বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে ‘সার্স’। একমাত্র কানাডা ছাড়া অধিকাংশই আসিয়ানভুক্ত, আসিয়ান সংলগ্ন কিংবা এশিয়ান দেশ। মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৪০০ ছাড়িয়ে গেছে। আক্রান্তের সংখ্যা ছয় সহস্রাধিক। প্রতিদিনই এর বিস্তার ঘটছে। যে হারে মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে, তাতে অতীতের যে কোনো রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লে পাঁচ কোটি লোকের মৃত্যু হয়েছিল। শুধু গত বছর এইডসে মারা গেছে ৩০ লাখ লোক। একদল বিজ্ঞানী মনে করছেন, স্বাস্থ্যসেবার মান খুবই নিম্ন এমন সব দেশে যদি ‘সার্স’ একবার হানা দেয়, তাহলে বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে। সেক্ষেত্রে ‘সার্স’ এই পৃথিবীকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা কেউ অনুধাবন করতে পারছে না। মরণঘাতী ‘সার্স’-এর আগ্রাসন থেকে কীভাবে বাঁচা যাবেÑ তা নিয়ে বিশ্ববাসী ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার দেশ চীন। আর জনবহুল শহর রাজধানী বেইজিং। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা এই শহরটা ঘড়ির কাঁটা মেপে মেপে চলে। ২৪ ঘণ্টার প্রতিটি সেকেন্ডই কখন যেন কর্মব্যস্ততায় কেটে যায়! সাধারণত বাসস্ট্যান্ড ও বাসে থাকে উপচে পড়া ভিড়। চলতে থাকে সারি সারি সাইকেল। সারাদিন জীবনের উত্তাপে ফুটতে থাকে বেইজিং। সেই বেইজিংয়ে এখন অবিশ্বাস্যভাবে শুনশান নীরবতা। কোথাও ট্রাফিক জ্যাম নেই। রেস্তোঁরা ও শপিং মলগুলো পরিত্যক্ত শ্মশানের মতো ভূতুড়ে। সিনেমা হলগুলোর ফটক শিকল দিয়ে আটকানো। কোনো সংলাপ ভেসে আসে না। নেই কোনো সুর। খাঁখাঁ করছে ইন্টারনেট ক্যাফে। স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। থেমে গেছে বালক-বালিকাদের চপলতা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদের থাকতে দেয়া হচ্ছে না। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে লাখ লাখ ছাত্র-ছাত্রীর জীবন। গুরুতর প্রয়োজনেও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য লবণ, তেল, ইনস্ট্যান্ট নুডুলস ক্রয়ের জন্য দু’একজন লোক মুখোশ এঁটে ঘরের বাইরে যাচ্ছেন। পুরো শহরই যেন মুখোশ পরিধান করে আছে। সবাই স্বেচ্ছায় এক ধরনের বন্দি জীবনযাপন করছেন। খুঁজছেন নির্জনতা। এর মাঝে ব্যতিক্রম রেলস্টেশন। বেইজিংবাসী শহর ছেড়ে চলে যাবার জন্য ভিড় করছেন রেলস্টেশনে। তবে বাইরের লোকজন যাতে ঢুকতে না পারেন, সে জন্য বেইজিং-এর বাইরের গ্রামগুলোতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলছে পুরো সমাজতান্ত্রিক চীন। আর এমনটি হয়েছে ‘সার্স’ নামক এক রহস্যময়ী রোগের প্রাদুর্ভাবে। তবে যতটা না আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, তারচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক। মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। রহস্যজনক এই রোগটি এখন চীনের জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। চীনের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। ধস নেমেছে পরিবহন, বিমান, পর্যটন ব্যবসায়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ক্রমশ নিম্নগামী। ‘সার্স’ ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তিকে দারুণভাবে কাঁপিয়ে দিয়েছে। মাস ছয়েক আগে চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ গুয়ানডঙে ‘সার্স’-এর সূত্রপাত। শুরুতে চীন সরকার বিষয়টিকে হালকা করে দেখে। চীন তার রুদ্ধ দুয়ার নীতি অনুসারে সব কিছু ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা চালায়। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, অজ্ঞাত কোন রোগ যখনই কোথাও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তখন সরকারসহ বিভিন্ন কর্র্তৃপক্ষের মধ্যে ওই রোগটিকে কেন্দ্র করে গঠনমূলক পদক্ষেপের চেয়ে ভীতি, কুসংস্কার, গুজব ছড়ানো ও অজ্ঞতাপ্রসূত মাত্রাতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের প্রবণতা বেড়ে যায়। তাছাড়া পুরো বিষয়টি চেপে রাখার যে প্রবণতা, সেক্ষেত্রে চীনাদের ভূমিকা তো প্রবাদে পরিণত হয়েছে। চীনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঝাং ওয়েনকাং এই রোগটিকে নিয়ে অবজ্ঞা ও উপহাস করতে থাকেন। কিন্তু পরিস্থিতি যখন ভয়াবহ হয়ে ওঠে, তখন তার পক্ষে তা সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এক পর্যায়ে পরিস্থিতির অবনতির কথা স্বীকার করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) প্রতিনিধিদের বেইজিংয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়। হু’র প্রতিনিধিরা বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শনে যেয়ে ঘটনার ভয়াবহতা ফাঁস করে দিলে ফুসে ওঠে বেইজিংবাসী। তাদের বিক্ষোভের মুখে ২০ এপ্রিল স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয়।

১৯৪৯ সালে চীনে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা লাভের পর এই প্রথম সরকার অসততার জন্য কোনো একজন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করলো। একই দিন বরখাস্ত করা হয় বেইজিং-এর মেয়রকে। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা যথাযথভাবে জানতে পেরে পরিস্থিতিকে মহামারী হিসেবে ধরে নিয়ে চীনা সরকার যেসব অফিস-আদালত, হোটেল-রেস্তোঁরায় ‘সার্স’ আক্রান্ত রোগীদের পদস্পর্শ পড়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গরোধ করার জন্য বিচ্ছিন্ন করে রাখার নির্দেশ দিয়েছে। বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে দুই সহস্রাধিক স্বাস্থ্যকর্মীকে। বেইজিং হাসপাতপালে আক্রান্তদের মধ্যে আছেন ৭০ জন চিকিৎসক, নার্স ও ২০ জন রোগী। চীনের একটি স্কুলে ‘সার্স’ রোধে কোয়ারেন্টাইন (রোগ-সংক্রমণ প্রতিরোধে পৃথক বা আটক রাখা) সেন্টার স্থাপনকে কেন্দ্র করে ২৭ এপ্রিল রাতে বন্দরনগরী তিয়ানজিনে ব্যাপক দাঙ্গা বেধে যায়। বেইজিং বিদেশীদের আসা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু যে বেইজিং ‘সার্স’-এ আক্রান্ত হয়েছে এবং তারাই যে কেবল এরকম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে তা নয়। বিশ্বের যেসব দেশ আক্রান্ত হয়েছে, সবারই কম-বেশি একই রকম অবস্থা। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে কী এই ‘সার্স’? যে জন্য দেশে দেশে সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থার। ‘সার্স’-এর ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, মারাত্মক অ্যাকিউট শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে তাপমাত্রা বেড়ে যায় ১০৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। এর সঙ্গে থাকে শুকনো কাশি। শ্বাসকষ্ট, মাথা ধরা, অল্পতেই হাঁপিয়ে ওঠা, শরীরে চাক চাক দাগ, মাংসপেশীতে ব্যথা, কাঁপুনি, পেট খারাপ ইত্যাদি। এই ভাইরাসটি মুখ, নাক ও চোখ দিয়ে শরীরে ঢোকে। আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি কেউ থাকলে হাঁচি-কাশির সঙ্গে বের হওয়া ভাইরাসে সংক্রমণ ঘটে। কোনো স্থানে ভাইরাসে সংক্রমিত হলে, সেখানে তিন থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত তা জীবিত থাকে। সে সময়ের মধ্যে কেউ আক্রান্ত স্থান দিয়ে চলাচল করলে তার দেহেও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে। এ থেকে রক্ষা পেতে হলে মাস্ক, কালো চশমা ও গ্লাভস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
 কিন্তু সব নিয়ম-নীতি ও আইন লংঘন করে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বেপরোয়া আগ্রাসন চালিয়ে যখন ইরাক দখল করে নেয়, ঠিক তখন ‘সার্স’-এর প্রাদুর্ভাব হওয়ার সঙ্গে অনেকে বিষয়টিকে এক সুতোয় গাঁথার চেষ্টা করছেন। যারা এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন, তাদের যুক্তি কি একদমই উড়িয়ে দেয়া যাবে? একসময়ের পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভগ্নাংশ রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা বলেছে, ইরাকের আগ্রাসন থেকে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়া এবং ওই আগ্রাসনের সময় অন্যতম পরাশক্তি চীনকে তার নিজের ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত রাখতে মার্কিনিরাই ‘সার্স’ ভাইরাস ছড়িয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অন্যতম স্থায়ী সদস্য চীন ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের অন্যতম বিরোধিতাকারী শক্তিধর দেশ। চীনকে টার্গেট করার আরেকটি কারণও উড়িয়ে দেয়া যায় না। জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বের পয়লা নম্বর দেশ চীনের প্রতিটি লোকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করা হয়েছে।


চীন যেভাবে সস্তায় ও সুলভে পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করতে পারে, তেমনটি কারো পক্ষে সম্ভব নয়। যে কারণে সারা বিশ্বে ছেয়ে আছে চীনের পণ্যসামগ্রী। এমনকি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজার দখল করে আছে চীন। চীনসহ ১১০টিরও বেশি দেশ গ্যাট (জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অব ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড)-এর সদস্য। ১৯৪৭ সালে প্রথম স্বাক্ষরিত গ্যাটের চুক্তি অনুযায়ী সদস্যভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ২০০৫ সালে মার্কেট উন্মুক্ত হয়ে যাবে। ফলে ট্রেড মার্কযুক্ত এক দেশের পণ্য অন্য দেশসমূহে অবাধে বিক্রি করা সম্ভব হবে। উন্মুক্ত বাণিজ্যের ফলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে চীন। ফলে গ্যাট চুক্তি অনুসারে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে চীন অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠবে। তখন পরাশক্তি হিসেবে চীনের সঙ্গে অন্য যে কারোই টেক্কা দেয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে। এমন এক দূরদর্শী কূট-পরিকল্পনা থেকে চীনকে দুর্বল করা হতে পারে। এক্ষেত্রে রাশিয়ার একাডেমি অব মেডিক্যাল সায়েন্সের বিজ্ঞানী সের্গেই কোলেসনিকভের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ২৫ এপ্রিল সাইবেরিয়ার আর্কতুস্কে এক সংবাদ সম্মেলনে ওই বিজ্ঞানী বলেন, পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী নিউমোনিয়া আদলের রোগ ‘সার্স’-এর ভাইরাস কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে এবং সম্ভবত ব্যাকটেরিয়াঘটিত জীবাণু অস্ত্র হিসেবেই একে প্রয়োগ করা হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসনের সময় চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে ব্যতিব্যস্ত রাখা এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে অগ্রসরমান এ অঞ্চলের দেশগুলোর অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত করার লক্ষ্যে পশ্চিমা শক্তির কোনো ক্রীড়নক সংস্থা কৌশলে তা ছড়িয়ে দিয়েছে। এতে পর্যটন শিল্প ও বিমান পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এর ফলে যুদ্ধের চেয়েও এর ক্ষয়ক্ষতি কম তো নয়ই, বরং অনেক বেশিই হবে। এই বিজ্ঞানী আরো বলেন, ‘সার্স’ ভাইরাস মানুষের সৃষ্ট এবং এটি সম্ভবত একটি জীবাণু অস্ত্র। এই ভাইরাসে এমন উপাদান আছে যা এখনো নির্ণীত হয়নি। এতে যে জেনেটিক উপাদান আছে, তার সঙ্গে মানুষের পরিচিত কোন ভাইরাসের মিল নেই। এগুলো সিনথেটিক ভাইরাস। নিউমোনিয়া ধরনের ‘সার্স’ রোগের ভাইরাস দুটি ভাইরাসের সংমিশ্রণ আর এগুলো হাম, মাম্পসের দুটি ভাইরাসের সংমিশ্রণে গঠিত। প্রাকৃতিকভাবে যা অসম্ভব ধরনের ভাইরাস। এটি কেবল ল্যাবরেটরিতে প্রস্তুত করা হতে পারে। এটা যেহেতু বানানো হয়েছে, তাই এর প্রতিষেধকও তৈরি করা সম্ভব। ‘সার্স’ ভাইরাস দিয়ে চীনে বদ্ধ দুয়ার খোলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টার কমতি নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে দেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে চীন। চীনকে টুকরো টুকরো করে দিতে পারলে একে একে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তরায়গুলো দূর হয়ে যাবে। যদিও বিশ্বে রাজনীতি ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা খুব বেশি আশাব্যঞ্জক নয়, তারপরও ‘বিশালদেহী’ চীন খণ্ডিত হলে ভেঙে পড়বে বিশ্ব ব্যবস্থা। এ কারণে ‘সার্স’কে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের বড়শি ফেলা সহজ হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টির পাশাপাশি চীনের অভ্যন্তরীণ সংকটও সৃষ্টি করতে পেরেছে। প্রাথমিক অবস্থায় চীন তার রীতি অনুযায়ী ‘সার্স’ রোগ নিয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখলেও এই রোগের বিস্তার দ্রুত ঘটতে থাকায় তারা এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার সিদ্ধান্ত নেয়। জনদাবির প্রেক্ষিতে স্বচ্ছতার জন্য ক্যারিয়ার-আমলা ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী দৃঢ়চেতা উ সিকে ‘সার্স’-এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সরকারের তরফ থেকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পাশ্চাত্য ঘেঁষা ও উদারপন্থী এই কূটনীতিককে দায়িত্ব দেয়ায় কমিউনিস্ট পার্টি সংস্কারের পথে অনেকটা এগিয়ে যেতে পারবে। পার্টির বয়োজ্যেষ্ঠরা দীর্ঘদিন যাবৎ সংস্কারের বিপক্ষে লড়াই চালিয়ে আসছেন, পার্টির একজন সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাও টঙ বলেছেন, জনগণের সমর্থন পাবার এইতো চমৎকার সুযোগ। এর ফলে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় হবে।
১৯৮৯ সালে তিয়ানআনমেন স্কোয়ারে অভ্যুত্থানের পর বাও টঙকে পার্টি থেকে অপসারণ করা হয়। তিনি আরো বলেন, উদধভট ডটভ পণণয ফধশধভথ ধভ ট ঠফটডপ ঠমস মভ র্ধ ডটভ ফধশণ ধভর্ দণ ্রলভ্রদধভণ. অত দণ ডটভর্’র্ টপণ টঢশটর্ভটথণ মতর্ দধ্র ্রর্ধলর্টধমভ টভঢ বমরণ ধর্ভমর্ দণ ্রলভ ভমষ.র্ দণভ ষদণভ? অর্থাৎ চীন একটি অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কিংবা রৌদ্রকরোজ্জ্বল আলোয় বসবাস করতে পারে। এ পরিস্থিতিতে প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগাতে এবং আলোয় আসতে যদি না পারে, তাহলে আর কবে পারবে? এ কথাগুলো যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন যাবৎ আকারে-ইঙ্গিতে বলে আসছে। চীনকে গণতন্ত্রের উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চোখে যেন ঘুম নেই। তারা ছলে-বলে-কৌশলে চীনকে গণতন্ত্রের পাঠ দেয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে আসছে। ‘সার্স’কে কেন্দ্র করে তাদের চাওয়াটা যেন চীনের সংস্কারপন্থী নেতাদের মুখে সরব হয়ে উঠেছে। গণতন্ত্র নিশ্চয়ই উত্তম ব্যবস্থা। কিন্তু হালে গণতন্ত্রের যে রূপ ফুটে উঠেছে, তাতে আতংকিত না হয়ে পারা যায় না। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার যেভাবে খর্ব করা হয়েছে এবং বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে যেভাবে ইরাকে আগ্রাসন চালানো হয়েছে, তেমন গণতন্ত্র নিশ্চয়ই কেউ আশা করেন না। এ কারণে চীনে গণতন্ত্র প্রবর্তনের যে তথাকথিত উদ্যোগ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তাতে বিশ্ববাসী সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাবার মতো অবস্থা হয়েছে।
যা হোক, চীনের গণতন্ত্র নিয়ে আপাতত না ভাবলেও চলবে। কিন্তু যেটি ভাবনার বিষয়- সেটি হচ্ছে ‘সার্স’। ‘সার্স’ নিয়ে সারা দুনিয়া আতঙ্কিত হলেও এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন ভাবনা নেই। ছয় মাস পরও যুক্তরাষ্ট্র ‘সার্স’-এ আক্রান্ত হয়নি। এ নিয়ে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কিংবা কোনো গবেষণার খবরও চোখে পড়ছে না। তারা অনেকটা চুপচাপ ও নির্বিকার। বিষয়টি রহস্যজনক নয় কি? এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি)-এর পরিচালক ডা. জুলি গারবার্ডিং যখন বলেন, ‘জানি না, কেন এখনও আমরা সৌভাগ্যবান। তবে আমরা কোনো সুযোগ দেব না’। তখন সেই বাংলা প্রবাদটি কি মনে হয় নাÑ ঠাকুর ঘরে কে রে! আমি কলা খাইনি’র মতো। এখন অবধি বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে ‘সার্স’ ভাইরাস কীভাবে এলো, সেটা আবিষ্কার করতে পারেননি। বরং এটা আবিষ্কার করতে যেয়ে একজন বিজ্ঞানীর অকাল মৃত্যু হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত সবাই ধরে নিয়েছেন, ‘সার্স’ হচ্ছে মানবসৃষ্ট ভাইরাস। কেউ এটা বাজারে ছেড়ে চুপি চুপি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। এটা নিয়ন্ত্রণের চাবিটা নিশ্চয়ই তাদের হাতে। উদ্দেশ্য পূরণ হলে সময়মত চাবি দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হতে পারে। তাছাড়া পৃথিবী ক্রমশ ‘বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’-এর দিকে এগিয়ে চলেছে। শত্রু এলাকায় রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে দিয়ে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার কৌশল এটি। অর্থাৎ জীবাণু যুদ্ধে জয়ী শত্রুপক্ষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু মাটি ও সম্পদের কোনো ক্ষতি হবে না। বিজয়ী দেশের মানুষের প্রয়োজন নেই। দরকার মাটি ও সম্পদ।


 ‘সার্স’ ভাইরাস ঘটনার সঙ্গে হলিউডের ব্যয়বহুল মুভি ‘মিশন ইম্পসিবল-টু’ ছবির কাহিনীর সঙ্গে অনেকটা সাদৃশ্য রয়েছে। পাশ্চাত্যের হাইটেক ও জেমস বন্ড মার্কা ছবি দেখে আমাদের কাছে তা আজগুবি, গাঁজাখুরি ও অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়। আসলে প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর কাছে তেমনটি মনে হতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ পাশ্চাত্য ছবিতে আজ যা দেখানো হয়, আমরা তা ভবিষ্যতে সত্যি হতে দেখি। ২০০০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ১২৩ মিনিটের ‘মিশন ইম্পসিবল-টু’ ছবিটি দেখে এমনটি যে সম্ভব, তা প্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে কল্পনাবিলাস মনে হয়েছে। ছবির কাহিনী অনেকটা এমন : একজন বিজ্ঞানী একটি ভাইরাস আবিষ্কার করেন। যে ভাইরাসে আক্রান্ত হলে দু’দিনের মধ্যে একজন মানুষের দেহের সব সিস্টেম অকেজো হয়ে যায় এবং মৃত্যুমুখে পতিত হন। অবশ্য এই জীবাণু নষ্ট করার জন্য জেনেটিক্যালি পরিবর্তন করার জন্য ফ্লু জাতীয় রোগবীজের ভয়াবহ জীবাণু প্রতিষেধক ওষুধ রয়েছে। সীন আব্রাহামরূপী ওগরে স্কট নামক একজন ভিলেন একটি বায়ো-টেক ফার্ম থেকে এই জীবাণু চুরি করেন। এর ফলে পৃথিবীর মানুষের জন্য তা হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এই ভাইরাস যাদের কাছে থাকে, সেই অল্প ক’জন লোক নিয়ন্ত্রণ করবে পুরো পৃথিবী। এই জীবাণু থেকে বিশ্বকে রক্ষার লক্ষ্যে অ্যামব্রোসকে নিবৃত্ত করার জন্য অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয় ইথান হান্টরূপী টম ক্রুজকে। এ জন্য তিনি ঘটনাস্থল অস্ট্রেলিয়ায় যান। সহযোগিতার জন্য রিক্রুট করেন চুরিই যার নেশা ও পেশা এবং অ্যামব্রোসের সাবেক গার্লফ্রেন্ড নিয়াহ হলরূপী কৃষ্ণাঙ্গ সুন্দরী টান্ডি নিউটন এবং কম্পিউটার জিনিয়াস লুথাররূপী ভিঙ রামেসকে। যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে ইথান হান্ট মুখোমুখি হন অ্যামব্রোসের। পুরো ছবিটি মরণঘাতী ভাইরাসকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। বুদ্ধি, কৌশল ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে সাজানো ছবিটির পরতে পরতে শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা ও রোমাঞ্চকর অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। মারাÍক জীবাণু উদ্ধার এবং অ্যামব্রোসের উদ্দেশ্য নস্যাৎ করার জন্য ইথান হান্ট একের পর এক দুর্ধর্ষ ও বিস্ময়কর অভিযানে শামিল হন। অ্যামব্রোসের সঙ্গে ইঁদুর-বিড়াল খেলা চালিয়ে শেষ অবধি সফল হয় তার মিশন। ভয়াবহ ভাইরাস থেকে বেঁচে যায় পৃথিবীর মানুষ।
‘মিশন ইম্পসিবল-টু’ ছবিতে ভাইরাস থেকে পৃথিবীবাসী রেহাই পেলেও প্রায় একই রকম ভাইরাস ‘সার্স’ একের পর এক ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন দেশে এবং কেড়ে নিচ্ছে নিরীহ মানুষের জীবন। মরণঘাতী এই ভাইরাস থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন ‘মিশন ইম্পসিবল-থ্রি’ নামের একটি অভিযান। অবশ্য এই অভিযান পরিচালনার জন্য থেমে নেই বিজ্ঞানীরা। হংকং-এর একটি হাসপাতালের ডা. হেনরি লিকুয়ান নিজেই আক্রান্ত হয়েছিলেন ‘সার্স’ রোগে। সেরেও উঠেছেন এই যাত্রায়। তিনি বলেছেন, ‘আমি এখন রীতিমত এক আগ্রাসী মানুষ। সার্সকে যেভাবেই হোক, আমি জয় করবো।’ এই বিশ্বে আমরা যারা ভীত ও দুর্বল, তারা ‘মিশন ইম্পসিবল-থ্রি’র অপেক্ষায় আছি। যার মাধ্যমে জয় করা যাবে ভয়াবহ ভাইরাস ‘সার্স’-কে।

 দৈনিক সংবাদ : ৬ মে ২০০৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন