মার্কিন ও বৃটিশ বাহিনীর আগ্রাসনে বধ্যভূমিতে রূপ নিয়েছে সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র এবং শ্রেষ্ঠ সংগীত ও ফুলের নন্দনকানন ইরাক। পরাক্রম শক্তির অন্যায় ও অনৈতিক হামলায় প্রাণ দিয়েছেন হাজার হাজার ইরাকী। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বাসস্থান ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র, নিঃশেষ হয়ে গেছে হাজার হাজার বছরের সভ্যতার নিদর্শনসমূহ- সর্বোপরি যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরাও ধুঁকে ধুঁকে এগিয়ে চলেছেন মৃত্যুর পথে। অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে একটি সজীব ও প্রাণোচ্ছ্বল দেশের যে মুমূর্ষু অবস্থা হয়েছে, তা কি এড়ানো যেত? অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ও যুদ্ধ প্রকৌশলে সর্বশক্তিমান যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যখন ইরাকে আগ্রাসন চালানোর হুমকি প্রদান করতে থাকে, তখন তো এটা ধরেই নেয়া হয়, তাদের প্রতিরোধ করার মতো শক্তি ও সামর্থ্য ইরাকের নেই। শুধু ইরাক কেন, পৃথিবীর আর কোন দেশেরই বা আছে? ইরাকী প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনও প্রতিপক্ষের শক্তিমত্তা এবং নিজের দুর্বলতার কথা খুব ভালভাবেই জানতেন। জানতেন বলেই জাতিসংঘের নির্দেশনামা মেনে চলেছেন। হ্যান্স ব্লিক্সের নেতৃত্বে জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শক দলকে ইরাকে সাদর আমন্ত্রণ জানানো হয়। কথিত গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ভাণ্ডার খুঁজে বের করার নামে জাতিসংঘ অস্ত্র পরিদর্শক দল একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য যেটুকু অস্ত্র থাকে- তাও তন্ন তন্ন করে খুঁজে ধ্বংস করে দিয়ে যায়। ইরাক ত্যাগের আগে হ্যান্স ব্লিক্স তাঁর প্রতিবেদনে জানিয়ে দেন, ইরাকে আর কোনো জীবাণু ও রাসায়নিক অস্ত্র নেই। এতে অনুধাবন করা যায়, ইরাকের সামরিক শক্তি অসম্ভব দুর্বল হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য বিশ্বের দণ্ডমুণ্ডের হর্তা-কর্তা তো এমনি এমনি হয়নি। তাদের অর্থ, সম্পদ, রাসায়নিক ও পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডারই যে শুধু সমৃদ্ধ তা নয়, তাদের কূটকৌশলের দক্ষতা সর্বজনবিদিত।
আমরা যেটা আজকে চিন্তা করি, মার্কিনীরা সেটা অনেক আগেই ভেবে রাখে। তারা যে হুট করে ২০ মার্চ ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছে- এমনটি ভাবা বোকামির নামান্তর। তারা দীর্ঘদিন যাবৎ পরিকল্পনা করে এবং সেই অনুযায়ী ছক কেটে একের পর এক ইরাককে একঘরে ও দুর্বল করেছে। তাদের কৌশলী পরিকল্পনায় ইরাক ১৯৯০ সালে নির্বোধের মত কুয়েত দখল করেছে, তারই পথ বেয়ে আরব অঞ্চলে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবেশী দেশ কুয়েত, সৌদি আরব, জর্দান, তুরস্ক, মিশর, ইরান, কাতার, আরব আমিরাত, বাহরাইনের সঙ্গে ক্রমান্বয়ে ইরাকের যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তার নেপথ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নিখুঁত দাবার চাল। পর্যায়ক্রমে বন্ধুহীন ও নিরস্ত্র করার মাধ্যমে ইরাককে শক্তিহীন করে ফেলা হয়েছে। তারপর জাতিসংঘের মাধ্যমে ১৯৯০ সাল থেকে ইরাকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ করে ভেঙে দেওয়া হয়েছে তাদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। নির্দয় অবরোধে, অনাহারে ও বিনা চিকিৎসায় অকালে ঝরেছে ১০ লাখ মানুষের জীবন। সবদিক দিক দিয়ে ইরাক যখন ভেঙে পড়েছে, ঠিক তখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে এবং প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে নিরস্ত্র করার দায়িত্ব নিজ হাতে নিয়ে নখদন্তহীন ইরাকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যৌথ বাহিনী। এক্ষেত্রে তারা কোনো নিয়ম-নীতি ও বৈধতার তোয়াক্কা করেনি। এ প্রসঙ্গে ১৯৯৫ সালে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ী পদার্থবিদ জোসেফ রটব্ল্যাটের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য : ‘একজন কুশাসককে উৎখাত করার জন্য যুদ্ধ শুরু করতে হবে- এটা কোনো বৈধ যুক্তি হতে পারে না। জাতিসংঘের বর্তমান সনদে সুস্পষ্টভাবে প্রত্যেক রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অতএব, কোনো রাষ্ট্র তার ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে যাই করুক, এমনকি সে যদি তার নিজের নাগরিকদের হত্যাও করে, তাহলেও অন্য রাষ্ট্র এসে কোনো যুক্তিতেই তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে পারে না।’
অথচ বিশ্ব সংস্থা, বিশ্ব জনমত ও বিশ্ব বিবেককে তোয়াক্কা না করে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইরাকের ওপর বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সাদ্দাম হোসেনের করারই বা কী ছিল? শেষ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ও তার ছেলেদের নির্বাসনে যেতে অথবা যুদ্ধ ঠেকাতে ৪৮ ঘণ্টার যে চরমপত্র প্রদান করে, তাতে তিনি কী করতে পারতেন? প্রথম যে পথটি খোলা ছিল তা হলো, সাদ্দাম হোসেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় ও অযৌক্তিক দাবির কাছে নতি স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করতে পারতেন। তাতে অন্তত তাৎক্ষণিকভাবে ইরাকি জনগণের জীবন, সম্পত্তি ও সভ্যতার নির্দশনসমূহ রক্ষা পেত। কিন্তু এতে কি সত্যি সত্যি ইরাকি জনগণ ‘মুক্তি’ পেতেন? যুক্তরাষ্ট্র কি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ও তার সহযোগীদের অপসারণে সন্তুষ্ট থাকতো? সেটাই যদি হবে, তাহলে তারা নির্বিচারে ইরাকী নিরীহ মানুষকে হত্যা, ব্যাংক, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয়, দোকানপাট লুট, অগ্নিসংযোগসহ অবকাঠামো ধ্বংস এবং সভ্যতার নিদর্শনসমূহ নিশ্চিহ্ন করছে কেন? সাদ্দাম হোসেন ও তাঁর অনুগতরা যখন দৃশ্যপটে নেই, তখনও কেন লুটপাট, নৈরাজ্য, সহিংসতা, ধ্বংসলীলা ও মৃত্যুর মিছিল চলছে? বেশুমার লুটতরাজে সমগ্র ইরাক বিরান হতে চলেছে, তখন তা প্রতিহত না করে কেন মার্কিন মেরিন সেনারা শুধু তেল স্থাপনাগুলো পাহারা দিচ্ছে?
কেন ইরাকি জাতীয় পতাকার পরিবর্তে ওড়ানো হয়েছে মার্কিন পতাকা? যে উদ্দেশ্যের কথা বলে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইরাকে আগ্রাসন চালিয়েছে, কার্যত সেই উদ্দেশ্যও পূরণ হয়েছে, তাহলে তারা কেন এখনো ইরাকের মাটিতে অবস্থান করছে? তাছাড়া যে ভয়ংকর অস্ত্র ইরাক লুকিয়ে রেখেছে বলে তারা আগ্রাসন চালিয়েছে, কোথায় সেই অস্ত্র? আসলে এটা এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ইরাকি জনগণের মুক্তি বা পরাধীনতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই। থাকার কথাও নয়। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে আমরা দেখতে পাই, যুক্তরাষ্ট্র কখনেই কোনো দেশের বন্ধু বা মিত্র ছিল না। বরং এ কথাটি আমরা বরাবরই সত্যি হতে দেখেছি, যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু তার আর শত্রুর প্রয়োজন নেই। স্বৈরাচারী, গণধিকৃত ও পরাক্রমশালী শাসকদের যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা সাহায্য ও সহযোগিতা করে আসছে। কিন্তু সুদিনের বন্ধুদেরও যুক্তরাষ্ট্র অবলীলায় দূরে ছুঁড়ে দিতে মোটেও কার্পণ্য করে না। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে, সেখানেই তারা ছলে-বলে-কৌশলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আব্রাহাম লিঙ্কনের গণতন্ত্রের কালজয়ী সেই মূলমন্ত্র : ‘বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল অ্যান্ড অফ দ্য পিপল’ এখন কিছু শব্দের কঙ্কালমাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রের জন্য, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে ও যুক্তরাষ্ট্রের সেবায় যারা নিবেদিত, তারাই গণতন্ত্রের মানসপুত্র। যুগে যুগে দেশে দেশে যুক্তরাষ্ট্র এই চণ্ডনীতি অনুসরণ করে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের হুমকি হয়ে দাঁড়ায় ইরাক। কেননা আরব ভূমিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের গর্ভস্রাব থেকে সৃষ্টি হয়েছে ইসরাইল নামক একটি অবৈধ রাষ্ট্রের। ইসরাইলকে কেন্দ্র করে সমগ্র আরব ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বা ছক কাটা হয়েছে। আর এ কারণে অর্থ দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে ও বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে ইসরাইলকে শুধু শক্তিশালী নয়, একটি দুর্ভেদ্য রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। ইসরাইলের কাছে যে পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রের ভাণ্ডার রয়েছে, তা শিল্পোন্নত অল্প ক’টি দেশ ছাড়া আর কারো নেই। সমগ্র আরব জাহান এক ইসরাইলের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। ইরাক, ইরান, সিরিয়াসহ গুটিকয়েক দেশ ইসরাইলের অস্তিত্ব মেনে না নেওয়ায় এখন তাদের নানা ছলে-বলে-কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। নেপথ্যে থেকে ফিলিস্তিনিদের সাহায্য-সহযোগিতা করায় ইসরাইলের ইশারায় ইরাক হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের প্রধান টার্গেট। এক ঢিলে দুই পাখি মারার উদ্দেশ্যে ইরাককে ‘সাইজ’ করার পাশাপাশি বাড়তি পাওয়া হয়ে যায় তাদের অফুরন্ত তেলভাণ্ডার। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলসমৃদ্ধ দেশ ইরাক। তাদের মাটির নিচে সঞ্চিত রয়েছে প্রায় ১১ হাজার ২০০ কোটি ব্যারেল তেল।
সাম্প্রতিক আগ্রাসনের আগে ইরাকের তেল রফতানির পরিমাণ ছিল প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি ডলার। যা মোট রাজস্বের ৯৫ শতাংশ। এই তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রলোভন দীর্ঘদিনের। সাদ্দাম হোসেন ইরাকের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ১৯৭২ সালে তেল সম্পদকে জাতীয়করণ করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের শ্যেন দৃষ্টিতে পড়ে যায় ইরাক। সেই থেকে তারা ইরাককে কব্জা করার জন্যে ভেতরে ভেতরে কলকাঠি নাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র তো সবসময় কৈয়ের তেলে কৈ ভেজে এসেছে। ইরাকে হামলা চালিয়ে মার্কিন অর্থনীতিতে যে আঁচড় লেগেছে, তা পূরণ করা ছাড়া কী যুক্তরাষ্ট্র ইরাক থেকে এক পা নড়বে? এমনিতেই উপসাগরীয় দেশে বছরের পর বছর ধরে তারা যে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে, তার ব্যয়ভার বহন করে আসছে দুই ইসলামী দেশ সৌদি আরব ও কুয়েত। আর যুদ্ধে কোটি কোটি ডলার কী তারা এমনি এমনি ব্যয় করেছে? মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের পাশাপাশি তাদের ব্যয়ভার সুদে-আসলে তুলে নেওয়াটাই তাদের অন্যতম লক্ষ্য। এই লক্ষ্য পূরণে যদি সাদ্দাম হোসেন বাধা হয়ে না দাঁড়াতেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে তিনিও হতে পারতেন ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’। মোদ্দা কথা, সাদ্দাম হোসেন কিংবা ‘থিফ অব বাগদাদ’ খ্যাত আহমেদ শালাবি কোনো ফ্যাক্টর নয়। এক সময় সাদ্দাম হোসেন তো ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জিগিরি দোস্ত। বন্ধুত্বের সেই মোহ হঠাৎ কেন কেটে গেল? আসলে যার দ্বারা স্বার্থ পূরণ হবে, তাকেই বরণ করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। আপাতদৃষ্টিতে সাদ্দাম হোসেন ‘অদৃশ্য’ হয়ে গেলেও তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মাথা-ব্যথা নেই। এখন ইরাককে নিজেদের মতো ‘গড়ে তোলা’ই তাদের প্রধান লক্ষ্য। আর এ কারণেই কট্টর ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত অস্ত্র ব্যবসায়ী অবসরপ্রাপ্ত মার্কিন জেনারেল গার্নারকে ‘বাগদাদের শেরিফ’ বানিয়ে ইরাককে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত করে পুনর্গঠনের যে কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে, তাতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দেওয়া হয়েছে মার্কিন বিভিন্ন কোম্পানিকে। সম্ভবত ইরাক পুনর্গঠন করে পকেট ভারি করার জন্য নানা অজুহাতে ইরাকে অকারণে চালানো হয় বেপরোয়া ধ্বংসলীলা। অবকাঠামো নির্মাণ, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন, বিমানবন্দর, হাসপাতাল, স্কুল-কলেজ নির্মাণের বিশাল অংকের কাজ পেয়ে যায় মার্কিন রিপাবলিকান পার্টির সমর্থনপুষ্ট ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির কোম্পানি অন্যতম। এতে প্রকৃত ইরাকি জনগণের কোনো ভূমিকা থাকছে না।
মার্কিনিদের অসৎ উদ্দেশ্য বুঝতে পারায় জেগে উঠেছে ইরাকের স্বাধীনচেতা জনগণ। তাঁরা আগ্রাসন ও দখলদারিত্বের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। এখন এই প্রতিবাদীদের দমন করার জন্যে তাদের হত্যা করা হচ্ছে ঠাণ্ডা মাথায়। তাহলে এই কি ইরাকি জনগণের মুক্তি? ইরাকি জনগণ অনুধাবন করতে পারছেন, তারা সাদ্দামের শাসনামলে এর চেয়ে অনেক ভালো ছিলেন। কেইবা চায় নিজের মাটিতে প্রতিনিয়ত দখলদারদের হাতে দুর্ব্যবহারের সম্মুখীন হতে? পরাক্রমশীল একটি দেশ অন্যায়ভাবে একটি দেশকে হুমকি দেবে, তা মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণ করাটা স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাশীল একটি দেশের পক্ষে কি সম্ভব? অতীতেও ইরাককে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে, কিন্তু তারা কখনো আগ্রাসন ও পরাধীনতাকে মেনে নেয়নি। পরাধীনতার মতো গ্লানিকর জীবনে আর কিছুই হয় না। এ কারণে যুগে যুগে মানুষ স্বাধীনতার বেদিতে সঁপে দিয়েছে নিজের জীবন ও যৌবন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বছরের পর বছর জীবন ও যৌবন পার করে দিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তী নেলসন ম্যান্ডেলাসহ অসংখ্য ব্যক্তিত্ব। অবলীলায় উপেক্ষা করেছেন প্রলোভনের সহস্র হাতছানি। মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন। তাঁরা পরাধীন সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের ঘেরাটোপে বন্দি হয়েও পরাধীন জীবনযাপন করতে আগ্রহী নয়। প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের ধুন্দুমার কাণ্ডকীর্তি বা তার নৃশংসতা যে কোনো সুস্থ মানুষের পছন্দ না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে ভিনদেশী শাসন, শোষণ ও পরাধীনতার শৃংখলে বন্দি হয়ে থাকাটা ইরাকি নাগরিকদের কাছে মোটেও কাম্য নয়। এটা এক ধরণের আত্মহত্যার শামিল। এ কারণে অবধারিত মৃত্যু ও পরাজয় নিশ্চিত জেনেও সাদ্দাম হোসেন, তাঁর অনুগত বাহিনী ও ইরাকি জনগণ মার্কিন-বৃটিশ বাহিনীর আগ্রাসনের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ায়। যুদ্ধে যুদ্ধে বিধ্বস্ত আর অবরোধে অবরোধে নিঃশেষিত ইরাক শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
যেখানে মার্কিন-বৃটিশ বাহিনী তিন দিনেই ইরাক জয়ের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিল, ভেবেছিল ইরাকিরা তাঁদের ফুল ও সংগীত দিয়ে তাদের বরণ করে নেবে, সেখানে তাদের তিনটি সপ্তাহ রক্তক্ষয়ী মরণপণ লড়াই করতে হয়েছে। সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করা সত্ত্বেও মার্কিন-বৃটিশ বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা নেহাত মন্দ নয়। ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে বেশ। ইরাকিরা পরাজিত হয়েছেন, জীবন দিয়েছেন, ধ্বংসলীলার শিকার হয়েছেন। কিন্তু জয় হয়েছে তাঁদের নীতির। জয় হয়েছে আদর্শের। জয় হয়েছে নৈতিকতার। বিশ্ববাসী দেখেছে, মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্যে ইরাকিরা যেভাবে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, তা ইতিহাসে অমর ও অমলিন হয়ে থাকবে। আত্মসমর্পণ করা কিংবা আগ্রাসী বাহিনীকে বরণ করে নেওয়ার চেয়ে তাঁরা মৃত্যুকে শ্রেয়তর মনে করেছেন। এটা ইরাকিরা অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের মুখে তাদের জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। যে মানুষ স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছে, সে কখনো পরাধীনতাকে মেনে নিতে পারে না। অসম শক্তির কাছে পরাজিত হলেও স্বাধীনতার অগ্নিশিখা সবার বুকেই দেদীপ্যমান থাকে। ইরাকিদের এই পরাজয়ও বোধকরি সাময়িক। তাঁরা একদিন পরাধীনতার এই শৃংখল ভেঙে ফেলবে। কেননা সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ দ্বিতীয় জন পল বলেছেন : ‘আপাতদৃষ্টিতে যদিও মনে হচ্ছে ঈশ্বর দুষ্টুদের হাতে ইতিহাসকে ছেড়ে দিয়েছেন, তারপরও ঈশ্বরের সুবিচার ও দুর্গতদের রক্ষায় তাঁর অসীম ক্ষমতার ওপর আমাদের আস্থা রাখতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, ঈশ্বর নীরবতার মধ্যেও যে কোনো সময় আবির্ভূত হতে পারেন।’ ক্যাথলিক পোপের এই বাণীর মধ্যে যে আশাবাদ সুপ্ত আছে, তা আমরা দেখতে পেয়েছি পৃথিবীর হাজার বছরের ইতিহাসে। কোনো আগ্রাসী শক্তি স্বাধীনতাকামী মানুষকে সাময়িকভাবে দমিয়ে রাখতে পারলেও চিরতরে পারে না।
প্রতিকারহীন শক্তির অপরাধে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদলেও কারো দিনই একই রকম যায় না। তাহলে মহাক্রমশালী বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধঃপতন ঘটত না এবং বর্তমানে পরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও অনায়াসেই পৃথিবীব্যাপী বিস্তার করতো তার সাম্রাজ্য। স্মায়ুযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণ পেলেও শক্তির ভারসাম্যহীনতা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় একক পরাশক্তির হুংকারে কেঁপে উঠেছে পৃথিবীর তাবৎ মানুষ। পৃথিবীকে এমন একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ। হঠাৎ কোথা থেকে এসে ‘পেরেস্ত্রোইকা’ ও ‘গ্লাস্তনস্ত’ নামক কী এক অলৌকিক মন্ত্র পড়ে ভেঙে দিয়েছেন সোভিয়েত ইউনিয়ন নামক একটি স্বপ্নকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় বিশ্বের শক্তিশালী মানুষরা হারিয়ে ফেলেছে নিরাপদ আশ্রয়। জানি না, এ জন্য গর্বাচেভের কোনো অনুশোচনা হয় কি না? আর সেই গর্বাচেভ এখন বলছেন : ‘জগতসংসারের ভিত্তিভূমি আন্তর্জাতিক আইনকেও এ যুদ্ধে (ইরাকে মার্কিন-বৃটিশ আগ্রাসন) মানা হয়নি। আন্তর্জাতিক আইন যদি মূল্য না পায়, এই আইনের সর্বদা মেনে চলার নীতিগুলো এবং তার আলোকে নিষেধাজ্ঞা যদি একক পরাশক্তির জন্যে শুধু ফাঁকা বুলিতেই পরিণত হয়, তাহলে এর পরিণতিতে আমরা দেখতে পাব শক্তির প্রভাব, যথেচ্ছাচার এবং শুধুই নিজের ইচ্ছেমতো কাজ করার ভয়াবহ প্রবণতা আর তাহলে যে বিশাল ঝড়ের উদ্ভব হবে- তা থেকে আমেরিকাও রক্ষা পাবে না।’ আমরা যারা অসহায় ও দুর্বল, তাঁদের কাছে পোপ দ্বিতীয় জন পল এবং মিখাইল গর্বাচেভের বাণীই এখন সান্ত্বনা ও স্বস্তি। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের স্বৈরাচারী শাসক ও তাদের সমর্থকদের পতনের অপেক্ষায় আছি।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি করে ও অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে যে ব্যক্তি পৃথিবীর শান্তি ও স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে, তার প্রতি রয়েছে শান্তিকামী মানুষের তীব্র ঘৃণা। এই ঘৃণার অনলে নিশ্চয়ই পুড়ে যাবে অশুভ শক্তির আস্ফালন। আজ না হোক, একদিন নিশ্চয়ই পৃথিবীর সব অসহায় মানুষের এই আকাক্সক্ষা অবশ্যই পূরণ হবে। পরাধীনতা চিরায়ত নয়। শ্রেষ্ঠ সংগীতের অনুভূতি ও ফুলের মাধুর্য চিরন্তন। অন্তত ইরাকের বেলায় এ কথা চিরসত্য।
দৈনিক সংবাদ : ২২ এপ্রিল ২০০৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন