পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৩

তবে কী আমরা পরাধীন হয়ে গেলাম!


যা কিছু সুন্দর, তার প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তেই হোক না কেন, সুন্দর কিংবা আকর্ষণীয় কিছু দেখলে মানুষ মুগ্ধ হয়। ইরাককে নিয়ে অনুভূতিপ্রবণ কিংবা সৌন্দর্যপিয়াসী যে কোনো মানুষই আবেগাক্রান্ত হয়ে যান। সভ্যতার সূতিকাগার এককালের মেসোপটেমিয়ার জলে-স্থলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সভ্যতা ও ইতিহাসের নানা নিদর্শন। দজলা ও ফোরাত নদের তীরে পৃথিবীর প্রথম সভ্যতার উন্মেষ ঘটায় তার কালস্রোত এখনো আমাদের উন্মনা করে দেয়। ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যানের সুরভি কিংবা বসরার গোলাপের সুগন্ধী আমাদের নাকে এসে লাগে ও চোখে ধরা দেয় অধরা স্বপ্ন হয়ে। ইরাকে মার্কিন-ব্রিটিশ বাহিনীর আগ্রাসনে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন- ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোর কথা ভেবে মনটা খুবই খারাপ হয়ে যায়। হালাকু খানরা যেভাবে ধ্বংস করেছিল বাগদাদ, তৈমুর লঙরা যেভাবে ইরাকিদের রক্তে লাল করেছিল দজলা নদীর পানি, তেমনিভাবে তাদের উত্তরসূরি জর্জ বুশ, টনি ব্লেয়াররা কী শেষ করে দেবে ইতিহাস ও সভ্যতার সব নিদর্শন? এমনটি যাতে না হয়, কায়মনোবাক্যে সে প্রার্থনা করেছিলাম। কিন্তু অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের আঘাতে যখন একের পর এক উড়ে যেতে থাকে কোনো শিশুর হাত, পা, চোখ কিংবা মাথা, তখন কীইবা মূল্য থাকে বসরার লাল গোলাপের, ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যানের কিংবা সভ্যতার নিদর্শনের? জ্ঞান-বিজ্ঞানে, সভ্যতায় পৃথিবী অনেক দূর এগিয়েছে বলে দাবি করা হয়। ঠিক তখন সব নিয়ম-নীতি লংঘন করে, আসরিক শক্তি প্রয়োগ করে যখন জবর দখল করা হয় একটি দেশ, তখন শুধু সেই দেশ বা দেশের জনগণই পরাধীন হয়ে যায় না, পরাধীন হয়ে যায় দুনিয়ার তাবৎ শান্তিকামী মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত, ভয়ংকর ও বলদর্পী যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের সাঙ্গাত এককালের ঔপনিবেশিক শক্তি যুক্তরাজ্য মধ্যযুগীয় আমলের রাজ্য দখলের মতো আমাদের সবার চোখের সামনে বলে-ক’য়ে ইরাকের ওপর অনৈতিক ও বীভৎস যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে মেতে ওঠে হত্যা ও ধ্বংসের উৎসবে। আমরা যারা দুর্বল ও অসহায়, তাদের ক্ষীণ কণ্ঠের প্রতিবাদ এবং দুর্বলের আরো দুর্বলতর প্রতিষ্ঠান ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার’ জাতিসংঘকে উপেক্ষা করে তারা ইরাকি জনগণের ‘মুক্তিদাতা’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ কেমন মুক্তিদাতা? যারা নির্বিচারে হত্যা করছে মানুষ, ধ্বংস করছে যাবতীয় অবকাঠামো, নষ্ট করছে সভ্যতার নিদর্শনগুলো। ইরাকি পতাকা নামিয়ে উত্তোলন করছে মার্কিন পতাকা। মার্কিন পতাকা কী ইরাকি জনগণের ‘স্বাধীনতার’ প্রতীক? ইরাক দখলের আগে জর্জ বুশ ও টনি ব্লেয়াররা বলেছিলেন, ইরাকি জনগণ মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনীকে ফুল ও মালা দিয়ে বরণ করে নেবেন। তেমনটি কি তিন সপ্তাহের যুদ্ধে কখনোই ঘটেছে? আধুনিক মারণাস্ত্রের বিপক্ষে দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে জীবনবাজি রেখে লড়াই করে ইরাকী জনগণ বুঝিয়ে দিয়েছে- পরাধীনতাকে তারা কখনো মেনে নেবে না। মেনে নেয়ওনি। এ কারণে বিক্ষিপ্তভাবে হলেও তাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম অব্যাহত আছে। মার্কিন ও ব্রিটিশ বাহিনীকে তারা একটুও স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। বরং প্রতিরোধ সংগ্রামের তীব্রতা দিনে দিনে বাড়ছে। ইরাকিদের মনের কথাগুলো চমৎকার ভাষায় ব্যক্ত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো ট্রিবিউন পত্রিকার কলামিস্ট স্টিভ চ্যাপম্যান : ‘গণতন্ত্রের মর্মবাণী যদি হয়ে থাকে শাসকের কর্মকা- নিয়ন্ত্রণে সাধারণ জনগণের অধিকার, তবে জাতীয়তাবাদের মর্মবাণী হচ্ছে নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণে জনগণের অধিকার। বাইরের কারো খবরদারি এতে চলবে না। ইরাকি জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রের বাসনার চেয়ে জাতীয়তাবাদের তাড়না বেশি শক্তিশালী হওয়ায় বিদেশিদের উপনিবেশে পরিণত হওয়ার চেয়ে তারা বরং স্বদেশী অপশাসনের খপ্পরে পড়ে থাকার ভাগ্যবরণ করাই শ্রেয় মনে করে।’ সব আন্তর্জাতিক আইন, সভ্যতা আর মানবতাকে পায়ে দলে মার্কিন-ব্রিটিশ বাহিনী শুধু ইরাককে পরাধীনই করেনি, এর মাধ্যমে জর্জ বুশ ‘নয়া বিশ্ব ব্যবস্থা’র নামে পৃথিবীব্যাপী গড়ে তুলছে ‘গণতান্ত্রিক উপনিবেশবাদ’। বুশের আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষ নানাভাবে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করলেও তা একদমই পাত্তা পায়নি। কেননা, খুব কমসংখ্যক দেশের সরকারই ইরাকে আগ্রাসনের প্রতিবাদ করেছে। যারা করেছে, তাদেরও কণ্ঠ ছিল খুবই ম্রিয়মান। রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্সের মতো একসময়ের শক্তিমান দেশগুলো ইরাকে যুদ্ধের প্রতিবাদে সোচ্চার হলেও এক পর্যায়ে তাদের কণ্ঠও স্তিমিত হয়ে যায়। সবাই কম-বেশি নতজানু হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। ইরাকের ওপর জাতিসংঘ আরোপিত দীর্ঘ ১৩ বছর স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সংশোধিত প্রস্তাবটি নিরাপত্তা পরিষদে অনুমোদন পেয়েছে। প্রস্তাবটি পাস হওয়ায় ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন প্রশাসন ইরাকি তেলের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক বৈধতা পায়। এর মধ্য দিয়ে ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসনকেই বৈধতা দেয়া হয়েছে। একটি রাষ্ট্র হিসেবে টিম টিম করে আশার পিদিম হয়ে যেটুকু জ্বলছিল, তাও যেন শেষ হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কাছে রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্সের মতো দেশগুলো এভাবে আত্মসমর্পণ করবে, তা মোটেও ভাবা যায়নি। তাহলে আর ভরসার স্থল থাকে কোথায়? সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে পৃথিবীতে একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সে থেকে তাদের দোর্দ- দাপটে অসহায় হয়ে পড়েছে প্রতিটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। দেশে দেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূতরা অলিখিতভাবে পালন করছে ‘দখলদার গভর্নর’-এর ভূমিকা। অভ্যন্তরীণ যে কোনো বিষয়ে তারা নাক গলায় অবলীলায়। কোনো কোনো দেশ তো নিয়ন্ত্রিত হয় সরাসরি তাদের তত্ত্বাবধানে। যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে একসময় সূর্য অস্ত যেতো না, সেই ব্রিটিশের প্রধানমন্ত্রী বলা যায় এখন জর্জ বুশের ‘ফরেন সেক্রেটারি’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইরাক দখল হয়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে। সবার প্রশ্ন- এর পরের টার্গেট কে? যে ক’জন সরকার প্রধান ইরাকে মার্কিন-ব্রিটিশ আগ্রাসনের খোলস উন্মোচন করে ধিক্কার জানিয়েছেন, তাদের অন্যতম হলেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। বেশ কিছুদিন আগে তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রতি হুমকি- এমন কোনো দেশকে শেষ করার মিশন নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালিয়েছে। একই সঙ্গে তারা চাইছে ইরাকের তেলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে। যুক্তরাষ্ট্র ইরাক যুদ্ধে জয়লাভ করলে অন্যান্য দেশ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী টার্গেট সিরিয়া, পাকিস্তান ও ইরান।’ মাহাথির মোহাম্মদের বক্তব্যে স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থে কাউকেই স্বস্তিতে থাকতে দেবে না। একের পর এক তারা তাদের টার্গেট পূরণে এগিয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনকে যদি নীরবে মেনে নেয়া হয়, তাহলে সবাই কি এক ধরনের পরাধীন নয়? তাছাড়া পরাশক্তির কর্ণধার জর্জ বুশ হুংকার দিয়ে যখন বলে, ‘হয় আমাদের পক্ষে থাক, নতুবা বিপক্ষে যাও’; তখন যারা শক্তিহীন, তারা এক ধরনের অসহায় আত্মসমর্পণ করে বসে থাকে পরাধীনতার গ্লানি নিয়ে। যদিও পরাধীনতার নাগপাশে বন্দি হয়ে অক্ষম মানুষের মতো বুকের মাঝে জ্বলতে থাকে ক্রোধ আর ক্ষোভের আগুন। আমাদের মতো দেশ ও দেশের মানুষ না হয় পরাধীনতা ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। কিন্তু মার্কিন ও ব্রিটিশ জনগণ কি স্বাধীন? ইরাকি যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এ প্রশ্নটি তীব্রতর হয়ে উঠেছে। আমরা বাক-স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও মূল্যবোধহীনতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও মার্কিন ও ব্রিটিশ জনগণের জীবনে উদারতা, গণতান্ত্রিকতা ও মানবতার প্রতিফলন দেখতে পেয়ে আমরা আশ্বস্ত হয়েছি। ভেবেছি, সভ্যতার অর্জনগুলো কোথাও না কোথাও কার্যকর হচ্ছে। তাদের কাছ থেকে আমরা পাঠ নিচ্ছি সাম্য, মৈত্রী ও গণতন্ত্রের। বুঝতে শিখছি সভ্যতার মাপকাঠি। কিন্তু ইরাকে মার্কিন-ব্রিটিশ যৌথ বাহিনীর আগ্রাসনে যেন ধস নেমেছে যাবতীয় মূল্যবোধে। ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির ব্রিটিশ এমপি জর্জ গ্যালাওয়ে যখন তীব্র ও ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ইরাকে বাক-স্বাধীনতা চান, ব্রিটিশ পার্লামেন্টে চান না’, তখন কেঁপে ওঠে সভ্যতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার। ব্রিটিশ ও মার্কিন কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বাক-স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের বিষয়টি বরাবরই সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে। তাদের প্রতিবাদে কেঁপেছে সরকার ও রাষ্ট্র। আর এখন যুদ্ধ বা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা ও হাউস অব কমন্সের নেতা শ্রদ্ধাভাজন রাজনীতিক রবিন কুক, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফিলিপ হান্ট, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জুনিয়র মন্ত্রী জর্জ ডেনাস, এমপি জর্জ গ্যালাওয়ের মতো ব্যক্তিত্বরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিগৃহীত হয়েছেন, সত্য কথা বলায় চাকরিচ্যুত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এনবিসি টেলিভিশনের পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া সাংবাদিক পিটার আর্নেট, আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলায় নাজেহাল হতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী ও সঙ্গীত শিল্পীকে। যে বিবিসি, সিএনএন-এর মতো আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম সবার কাছে ছিল আস্থা ও বিশ্বাসের অবলম্বন, তাতেও এখন দারুণভাবে চিড় ধরেছে। ইরাকে মার্কিন-ব্রিটিশ আগ্রাসনে মানুষের যা কিছু অর্জন, তা যে এভাবে ভেঙ্গে পড়বে- তা ছিল সত্যিই অভাবনীয়। বিশ্বখ্যাত জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘অবাক লাগে এটা কী সেই আমেরিকা, যাকে আমরা সন্তুষ্ট চিত্তেই অনেক বিষয়ে প্রাধান্য দিয়েছি?’ তার মানে কি এই নয় যে, পরাধীনতার শিকলে আটকা পড়েছে বোধ, বুদ্ধি ও বিবেচনাসম্পন্ন মানুষও। যা কিছু ভালো, তার পক্ষে বলা এবং যা কিছু মন্দ, তার নিন্দা জানানো যদি অসম্ভব হয়ে পড়ে, তাহলে তো সব মানুষই পরাধীন হয়ে যায়। ছোট কিংবা বড়- যে কোনো দেশের অধিবাসী যেভাবেই হোক না কেন, সবাই এখন এক পরাধীন বিশ্বের নাগরিক।

দৈনিক বাংলাবাজার : ১৪ জুলাই ২০০৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন