পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষকে নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এগুতে হচ্ছে। পৃথিবীটা সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট অর্থাৎ যোগ্যদের জন্য। আর এই টিকে থাকতে গিয়ে কিংবা শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শন করতে গিয়ে যুগে যুগে দেশে দেশে যুদ্ধ কিংবা মানুষে মানুষে লড়াই ও সংঘাত অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়। হত্যা, ধ্বংসলীলায় শেষ হয়ে গেছে কত মানুষের জীবন ও সম্পত্তি। এসব যদি এড়ানো যেতো, তাহলে এই পৃথিবী হয়ে উঠতে পারতো স্বর্গীয় উদ্যানে। কিন্তু লোভ, স্বার্থপরতাকে মানুষ প্রশমন করতে পারেনি। যে কারণে হত্যা ও ধ্বংসলীলার কারণে এই পৃথিবী কখনো সুস্থ ও সবল হয়ে উঠতে পারছে না। প্রাচীনকালে কিংবা মধ্যযুগে যুদ্ধ সীমাবদ্ধ ছিল দখলদারিত্বের মধ্যে। মানুষকে দাসত্বের শৃ´খলে বন্দি রাখা এবং সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা করে ভোগদখল করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। আধুনিককালে যুদ্ধ হলেও তা ছিল পরাধীনতার নাগপাশ থেকে ছিন্ন হওয়ার সংগ্রাম এবং নানা স্বার্থের টানাপড়েনে সাময়িকভাবে যুদ্ধে বা সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া। এতে অবশ্য জীবন ও সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু কোনো দেশ দখলের ঘটনা ঘটেনি। এসব যুদ্ধ ও সংঘাত সম্ভব হয়েছে আন্তর্জাতিক আইনের বন্ধন শিথিল থাকায়। কেননা, এমনটি হতে পেরেছে কোনো নিয়ম-নীতির বালাই ছিল না বলে। যুদ্ধবাজ হিটলার, মুসোলিনির জবরদস্তিমূলক শাসনের অবসানের পর পৃথিবীর মানুষের মনে ফিরে আসে শান্তি। যুদ্ধ, মৃত্যু, ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শান্তিকামী দেশগুলো একটি আন্তর্জাতিক ফোরামে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাগিদ অনুভব করতে থাকে। সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে আন্তর্জাতিক আইনের সীমারেখা দৃঢ় হওয়ায় দেশগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হয়েছে। বিশেষত ছোট ছোট দেশগুলোও সমান অধিকার নিয়ে বসবাস করছে। বিশ্বের শান্তিকামী সার্বভৌম দেশগুলো নিরাপত্তার লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালে গঠিত হয় ‘জাতিসংঘ’। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা, জাতিতে জাতিতে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সমস্যা সমাধান এবং মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি নিবেদিত থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়ার যে ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদিত হয়, তার ছায়াতলে আশ্রয় খুঁজে পায় প্রতিটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা ও সংস্কৃতি। অবশ্য জাতিসংঘের হালকা নীল ও সাদা পতাকাতলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ সমবেত হলেও যুদ্ধ ও সংঘাতের অবসান হয়নি। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে সোভিয়েত ও মার্কিন বলয়ের ঠা-া লড়াই চলতে থাকে। চার দশকের ঠাণ্ডা লড়াইয়ে উত্তাপ-উত্তেজনা, স্মায়ুযুদ্ধ ও রক্তক্ষরণের ঘটনা ঘটেছে। ১৯৫০ সালে দ্বিতীয় যুদ্ধ-উত্তরকালে দুই কোরিয়ার যুদ্ধ, ১৯৫৬ সালে দুই র্ভিয়েতনামের যুদ্ধ, ১৯৫৮ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ, ১৯৫৬ সালে সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করায় মিসরের সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের নির্লজ্জ সমর্থন, ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ, ১৯৬৩ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধ, ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, ১৯৭৫ সালে লেবাননের গৃহযুদ্ধ, একই বছর অ্যাঙ্গোলায় গৃহযুদ্ধ, ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানের গৃহযুদ্ধ, ১৯৮০ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধ, ১৯৮২ সালে শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধ, ১৯৯০ সালে ইরাকের কুয়েত দখল, ১৯৯২ সালে বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় যুদ্ধ প্রভৃতি ছিল মূলত দুই পরাশক্তির ইন্ধনে আধিপত্য বিস্তার, জবরদখল, গৃহযুদ্ধ, সীমান্ত বিরোধ, গণহত্যা, স্বাধীনতা সংগ্রাম, জাতিগত সংঘাতকে কেন্দ্র করে। এতে লাখ লাখ মানুষের জীবন ঝরেছে। বিনাশ হয়েছে মূল্যবান সম্পত্তির। এর মধ্যে আরব ভূমিতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের জঠর থেকে সৃষ্টি হয়েছে ‘ইসরাইল’ নামক অবৈধ রাষ্ট্রের। ইসরাইলের আরব ভূখণ্ড দখল, চীনের ভারতের লাদাখ অঞ্চল দখল ছাড়া ভূখ- জবরদখলের আর কোনো বড় ধরনের ঘটনা ঘটেনি। এমনটি সম্ভব হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য। এর মধ্যে শুধু আফগানিস্তানে কিছুটা বিতর্কিত ভূমিকা থাকলেও অধিকাংশ যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, জাতিগত সংঘাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল ইতিবাচক। তারা বরাবরই স্বাধীনতাকামী, শান্তিকামী ও দুর্বল শক্তির পক্ষাবলম্বন করেছে।
পক্ষান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সব সময়ই আগ্রাসী, জবরদখলকারী, আধিপত্যবাদী, স্বৈরাচারীদের সপক্ষে। এই দু’পক্ষের মধ্যে একটা স্মায়ুযুদ্ধের উত্তাপ ও উত্তেজনা বিরাজ করলেও পরোক্ষভাবে একটা ভারসাম্যমূলক অবস্থা বিরাজ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র যা খুশি, তা করতে চাইলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন বরাবরই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে বিশ্বব্যবস্থায় বড় ধরনের কোনো সঙ্কট সৃষ্টি হয়নি। এসব যুদ্ধে নীরব ক্ষত ও স্বার্থের টানাপড়েন রয়ে গেলেও পুরো দেশ দখলের ঘটনা ঘটেনি। ঘটলেও তা ছিল সাময়িক এবং সামান্য কিছু ভূখণ্ডের মধ্যে সীমিত। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে বিশ্বব্যবস্থা। এককেন্দ্রিক পৃথিবীতে এখন একক প্রভু যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র একক সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তার স্বস্তিটুকু হারিয়ে গেছে। অতি সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য আগ্রাসন চালিয়ে পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রের ধমকে এবং অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করে যেভাবে ইরাক জবরদখল করে নিয়েছে, তাতে সারা পৃথিবীর মানুষ শুধু স্তম্ভিতই নয়- আতঙ্কিতও হয়ে পড়েছে। ইসরাইলের স্বার্থ অটুট রাখতে এবং তার জন্য যে বা যারা হুমকি, তাদের ঘায়েল করা, মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তার করা ও তেল সম্পদ ভোগদখলের জন্য প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ইরাক গ্রাস করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এটা আধুনিক সভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ এবং কলঙ্কজনক তো বটেই। মানুষের জীবন নিঃসন্দেহে সবচেয়ে মূল্যবান; কিন্তু যুদ্ধ, লড়াই, সংঘাতে জীবনহানি এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এ কারণে পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষ যুদ্ধের বিরোধী। যুদ্ধের হুঙ্কার পাওয়া গেলেই রাজপথে নেমে আসে শান্তিকামী মানুষ। কিন্তু যুদ্ধবাজদের কাছে এসবের কোনো মূল্য নেই। তারা নিজেদের স্বার্থে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে লিপ্ত হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। অবশ্য এতে যুদ্ধবাজদের কিছু না হলেও জীবনহানি ঘটে সাধারণ ও নিরীহ নাগরিক এবং দু’মুঠো অন্নের জন্য সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত দরিদ্র সৈনিকদের। যুদ্ধের নৃশংসতা ও বেদনাদায়ক ঘটনাবলী তাই এড়ানোর কোনো সুযোগ থাকে না। তবে আধুনিক যুগে মানুষ সভ্যতার পাঠ নিয়েছে। গণতন্ত্র, মৈত্রী, শান্তি, মানবাধিকার, আইনের শাসনের প্রতি মানুষ এখন শ্রদ্ধাশীল। যে কোনো বিরোধ পারস্পরিক সমঝোতা কিংবা জাতিসংঘের মাধ্যমে নিরসন করে নিতে পারেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন অখণ্ড অবস্থায় থাকার সময় একটা স্মায়ুযুদ্ধের চাপ ও তাপ বিশ্ববাসীকে উদ্বিগ্ন করে রাখে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর শান্তিকামী মানুষ এই বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছিলেনÑ যাক, আর যুদ্ধ নয়। পৃথিবীতে নেমে আসবে শান্তির নহবত। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে মানুষ জেনে এসেছে নানা জাতি, ধর্ম, আদর্শ, মতবাদ ও গণতন্ত্রের লালনকেন্দ্র হিসেবে- যারা বিশ্বকে দিয়েছে বিজ্ঞান ও সভ্যতার আশীর্বাদ। অথচ তাদের নীতি ও নৈতিকতা যখন ভেঙে পড়ে, তখন আর কীভাবে আশাবাদী হওয়া যায়? নানা সমস্যা থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল মুক্ত স্বাধীনতার দেশ- যা পৃথিবীর জন্য ছিল একটি মডেল। বিভিন্ন সুযোগ, সমৃদ্ধি ও ঝলমলে জীবনধারার টানে বহুজাতিক এই দেশটিতে ছুটে আসে পৃথিবীর নানা প্রান্তের লোক। হ্যামিলনের বংশীবাদকের সুরে সুরে ছুটে আসা এই লোকদের মধ্যে রয়েছে নানা জাতি, ধর্ম ও বংশ পরিচয়ের বিচিত্র ধারার লোক। গণতন্ত্রের শক্তিতে নানা দেশের নানা মানুষকে নিয়ে এক সুতোয় গেঁথেছে বিশ্বের শক্তিমান দেশ যুক্তরাষ্ট্র এবং ১৭৭৬ সালে জন্মের পর থেকে যেভাবে গণতন্ত্রের চর্চা হয়ে এসেছে, তা ছিল তাবৎ পৃথিবীর মানুষের জন্য অভূতপূর্ব। প্রত্যক্ষ ভোটে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কখনোই কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। হয়তো ভেতরে ভেতরে নানা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, প্রলোভন, কূটকৌশল ও রাজনৈতিক দ্বন্দ¡-সংঘাত চলেছে; কিন্তু সবকিছুর নির্ধারক হয়ে দাঁড়ায় সরাসরি ভোটাধিকারপ্রাপ্ত জনগণ। মার্কিন নির্বাচন ব্যবস্থা পৃথিবীর মানুষের কাছে অসীম আগ্রহ ও কৌতূহলের বিষয়। কিন্তু ২০০০ সালের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন মানুষের যাবতীয় আস্থা ও ধারণায় কুঠারাঘাত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে, তা যেন হঠাৎ করে সবার কাছে উন্মোচিত হয়ে যায়। নিপাট ভদ্রলোক হিসেবে পরিচিত গণতন্ত্রের সত্যিকার পূজারী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে আস্থা, জনপ্রিয়তা ও ভালোবাসা দিয়ে আমেরিকানদের মন জয় করেন এবং পপুলার ভোটে তার জয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। সবাই বুঝতে পারেন ভোটাভুটিতে আল গোরকে হারানো সম্ভব হবে না। নির্বাচন চলাকালে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আল গোরের সাফল্যের বার্তা আসতে থাকে। কিন্তু অস্ত্র ও তেল ব্যবসায়ী ইহুদি লবি তখন অন্য হিসাব কষতে থাকে। তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে জুনিয়র জর্জ বুশের জয়ের জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। শেষ খেলাটা দেখান ফ্লোরিডার গভর্নর জর্জ বুশের অনুজ জেব বুশ। ভোট কারচুপির মাধ্যমে এমন একটা ধোঁয়াটে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য দ্বারস্থ হতে হয় আদালতের। সেই আদালতের বিচারক ছিলেন কারা? তাদের নিয়োগদাতা ছিলেন জুনিয়র জর্জ বুশের পিতা সিনিয়র বুশ। আইন, বিচার ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মুখে কালিমা লেপন করে তারা পক্ষপাতমূলক ও নির্লজ্জের মতো জুনিয়র জর্জ বুশের পক্ষে অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে রায় দেন। এমন একটা লজ্জাজনক আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র কেঁপে উঠলেও কেঁপে ওঠেনি আমেরিকান জনগণ। যারা সামান্য কোনো ঘটনায় বিস্ফোরিত হয়ে ওঠেন, তারা কেন জানি সবকিছু নীরবে মেনে নেন। পরবর্তীতেও এ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করেননি। মনে হয় সেদিনই শেষ হয়ে যায় মানুষের বোধ, বুদ্ধি, বিবেক, বিবেচনা, গণতন্ত্র, মৈত্রী, শান্তি, মানবাধিকার, আইনের শাসন, ন্যায়-নীতি। এরই ধারাবাহিকতায় কোনো এক অদৃশ্য শক্তি ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটিয়েছে, আজ অবধি তা নির্ণয় করা না গেলেও তাকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের যে রণহুংকার ও তাণ্ডব তাতে এমনটি মনে হওয়া স্বাভাবিক ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করার নামে যুক্তরাষ্ট্র এখন নিজেই সন্ত্রাসবাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করছে হিংসা ও সহিংসতার মাধ্যমে। আফগানিস্তান, ইরাকে আগ্রাসন, দেশে দেশে ‘লাদেন’ ফোবিয়ার নামে উন্মাদনার সৃষ্টি এবং একের পর এক মানব জাতি, মানবতা ও মানব সভ্যতাবিরোধী নতুন নতুন টার্গেট নির্ধারণ করার ঘোষণা করে চলেছে। পৃথিবীকে তারা কোথায় নিতে চায়- একমাত্র তারা ছাড়া আর কেউ তা জানে না। এতো কিছু বলার উদ্দেশ্য, যুক্তরাষ্ট্র যে রণোন্মাদ হয়ে গেছে- তার মূলে রয়েছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করে জুনিয়র বুশের নির্বাচনী বৈতরণী অতিক্রম। তখন থেকেই শুরু হয়ে যায় বিশ্বকে নিয়ে পুতুল নাচের খেলা। তারা শুধু আগ্রাসন, জবরদখল ও আত্মসাতের খেলায় মেতে ওঠেনি, পাশাপাশি তারা মেতে উঠেছে সভ্যতা বিধ্বংসী খেলায়।
ইরাককে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নেয়ার পাশাপাশি এখন তারা সভ্যতার ইতিহাস ও নিদর্শন মুছে দিতে চাচ্ছে। অথচ যুদ্ধ শুরুর আগে ইউনেস্কোসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রত্মতাত্ত্বিক সংস্থা ইরাকের সভ্যতার নিদর্শনগুলো যাতে যুদ্ধের শিকার না হয়, তা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ইরাক দখল করার পর মার্কিন মেরিন সেনাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্ররোচনায় লুট হয়েছে ইরাকি জাদুঘর, পাঠাগার, প্রত্মতাত্ত্বিক সম্পদ। ভাংচুর, তছনছ ও লুটতরাজ করা হয়েছে ইরাকি সভ্যতার হাজার বছরের নিদর্শন। মানব সভ্যতার সূর্যোদয় ঘটেছিল ইরাকি ভূখণ্ড। দজলা ও ফোরাত নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় বিভিন্ন সময়ে গড়ে ওঠা ব্যাবিলনীয়, সুমেরীয় ও অ্যাসিরীয় সভ্যতার অনেক প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন পরিকল্পিতভাবে চিরতরে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। ৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়া থেকে ইরাকের উদ্ভব। সে সঙ্গে মানব সভ্যতার বিকাশ। সমৃদ্ধ সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু ইরাককে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার জন্য ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনী সুকৌশলে এগিয়ে চলেছে। তারা প্রাথমিক পর্যায়ে ইরাককে একাধিক খণ্ডে বিভক্ত করার চক্রান্ত করছে। এ জন্য তারা বিবদমান শিয়া-সুন্নি ও কুর্দিদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে উসকে দিয়ে আলাদা নামে ইরাককে খণ্ড-বিখণ্ড করতে চাচ্ছে- যাতে ইরাক নামক দেশটির অস্তিত্ব কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। সে সঙ্গে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও পুরাতত্ত্বের ধ্বংসসাধন করে প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন লুট ও ধ্বংস করে আরব সভ্যতাকে মুছে দিতে চাইছে। এমনিতে বিশ্বব্যাপী ইয়াঙ্কিদের জয়জয়কার। শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও মেধার ক্ষেত্রে তারা অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করছে। দুনিয়ার সেরা প্রতিভাবান ও মেধাবীদের প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে নিয়ে গিয়ে তাদের মেধা ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে তথাকথিত পাশ্চাত্য সভ্যতার জয়ঢঙ্কা বাজানো হচ্ছে। ফলে প্রাচ্য ও অনগ্রসর দেশগুলোর জ্ঞানের ভা-ার আরো শূন্য হয়ে যাচ্ছে; ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষা-দীক্ষায়, মেধায়-মননে, বিজ্ঞানে-প্রযুক্তিতে ও যোগাযোগ ব্যবস্থায়। কিন্তু পুরনো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক দিয়ে ইয়াঙ্কি সভ্যতা আরবীয় সভ্যতা, সৌন্দর্যবোধ ও ঐতিহ্যের তুলনায় সমৃদ্ধ নয়। এ কারণে একটি সূক্ষ্ম ক্ষোভ ও প্রতিহিংসা থেকে আরব সভ্যতার বিনাশে ইয়াঙ্কিরা বেছে নিয়েছে চরম পন্থা। আমরা অতীতে দেখেছি, লুটতরাজ চললেও সভ্যতার নিদর্শনগুলো বরাবরই অক্ষত থেকে যায়। এমনকি যুদ্ধ শেষে লুট করে নিয়ে যাওয়া নিদর্শনগুলো ফিরিয়ে দেয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির পাদপীঠ প্যারিসের চিত্রকলা, ভাস্কর্যসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর যুদ্ধ শেষে আগ্রাসী জার্মানরা তা ফিরিয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফিরিয়ে না দেয়া হলে তা যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু এবার আমরা ইরাকে কী দেখছি? ইরাকি সভ্যতার নিদর্শনগুলো শুধু লুটতরাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যাবতীয় সভ্যতার নিদর্শন, প্রতœতাত্ত্বিক সম্পদ, দুর্লভ পাণ্ডুলিপিসহ ইরাকি সভ্যতা ও ইতিহাসের যাবতীয় নিদর্শন ভেঙেচুরে মাটির সাথে এমনভাবে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে বা হচ্ছে, যাতে করে তা উদ্ধার করা না যায়। অর্থাৎ ইরাকি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সভ্যতা সুপরিকল্পিতভাবে মহাকাল থেকে চিরতরে মুছে ফেলা হচ্ছে। হালাকু খান ইরাকি সভ্যতার যে চরম সর্বনাশ করেছিল, বুশ-ব্লেয়ার বাহিনী তার শেষটুকু নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। তারা কি চাইছে ইরাক নামক একটি দেশকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করে দিতে? যে ইরাকি সভ্যতা মানুষের সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করেছে, তাকে বিলীন করে দিতে? ইরাকি সভ্যতাকে তাদের কেন এত ভয়? তার কারণ কি এই নয় যে, আমেরিকান আদিবাসী ইন্ডিয়ান ও উপজাতীয়দের প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে শিকড়হীন বহিরাগতদের নিয়ে যেভাবে মিথ্যে মিথের ওপর গড়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র নামক একটি অভিবাসী দেশ, তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য পৃথিবীর সমৃদ্ধ সভ্যতার সব চিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে! নতুবা বিশ্ববাসীর অনুরোধ-উপরোধ উপেক্ষা করে মার্কিন মেরিন সেনাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকায় কেন ইরাকি জাদুঘর, গ্রন্থাগার ও প্রত্মতাত্ত্বিক সম্পদ লুণ্ঠন ও ধ্বংস করা হয়েছে? কিন্তু চাইলেই কি মুছে ফেলা যায় কোনো সভ্যতা? এই পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে যে সভ্যতার চিত্রলিপি, তাকে তো কখনো মুছে ফেলা সম্ভব নয়। হয়তো নিদর্শনগুলো নিশ্চিহ্ন করা যাবে, সাময়িকভাবে ব্যাহত হবে মানুষের অনুসন্ধিৎসা। কিন্তু এ কথা তো সত্যি- সভ্যতার ইতিহাস বয়ে চলে বহতা নদীর মতো। দৈনিক সংবাদ : ৫ জুন ২০০৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন