পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

রবিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৩

একাত্তরের স্মৃতি


আমাদের জীবনে এমন সুসময় যেমন আসেনি, তেমনিভাবে দুঃসময়ও কখনো আসেনি। বলছি ১৯৭১ সালের কথা। বাঙালির সবচেয়ে উজ্জ্বল, বর্ণিল ও ঘটনাবহুল দিনগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের অনেকেরই অম্ল-মধুর স্মৃতি। কোনোটা সুখের, কোনোটা বেদনার। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মহাকাব্যিক দিনগুলোকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন, কিংবা যাঁরা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন, তাঁরা প্রত্যক্ষ করেছেন বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় দিনগুলোকে। এমন দিন আর কখনো আসেনি। এমন দিন আর কখনো আসবেও না। কেননা বাঙালি খুঁজে পেয়েছে তার ঈপ্সিত ঠিকানা। পেয়েছে তার নিজস্ব ভূখণ্ড। পেয়েছে লাল-সবুজ পতাকা। ত্রিশ লাখ লোকের জীবনের বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের গর্বিত নাগরিক। অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এলেও স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা এখনো আমাদের হৃদয়ে জেগে আছে উল্কাপিণ্ডের মতো। কতইবা আমার তখন বয়স। ৫/৬ বছর। ঊনসত্তর-সত্তর-একাত্তরের আন্দোলনের তুঙ্গস্পর্শী সময়ে মতিঝিল কলোনিতে থাকতাম। সব স্মৃতি যে ধরে রাখতে পেরেছি তা নয়। টুকরো টুকরো স্মৃতিখণ্ড এখনো বুকে চির-জাগরুক হয়ে আছে। সে সময়কার জনবিরল ঢাকা নগরীতে মতিঝিল কলোনি তখন রাজধানীর কেন্দ্রবিন্দু। আন্দোলনের ঢেউ এসে আমাদের কলোনিতে ধাক্কা মারলে তার স্পর্শে আমরাও উজ্জীবিত হয়ে উঠি। বাসার সামনে দিয়ে যাওয়া মিছিলের স্লোগান আমাদের ছোট্ট বুকে গান হয়ে বেজে ওঠে। একা একা গেয়ে উঠতাম; ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার-আমার ঠিকানা’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘টিক্কা খানের টিক্কি লইয়া স্বর্গে যাবো গো’, ‘একটা-দুইটা বিহারি ধরো সকাল-বিকাল নাস্তা করো’। স্লোগানের সব কথা না বুঝলেও অবুঝ মন আন্দোলনের ঝাঁপটা টের পেত। তাতে কেঁপে কেঁপে উঠতাম। বাবা-মায়ের উৎকণ্ঠিত ও উদ্বিগ্ন চেহারায় বুঝতাম কিছু একটা বিপদ আমাদের সামনে। ঊনসত্তর-সত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোর পর চারদিক কাঁপিয়ে এলো রক্তক্ষয়ী একাত্তর।
মতিঝিলে আমাদের পাশের রুমে সপরিবারে থাকতেন আমার পিতার মামা। অর্থাৎ সম্পর্কে তিনি আমার দাদা। এই দাদা একটা নামজাদা শাড়ির দোকানে চাকরি করতেন। রাত না হলে তিনি ফিরতেন না। সেদিন ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফেরেন। ফিরেই আমার আব্বা ফিরেছেন কিনা জানতে চাইলেন। আব্বার আবার খেলার নেশা। তিনি এমন কোনো খেলা নেই যে, যা থেকে পুরস্কার পাননি। তিনি এক এক সময় এক একটা খেলায় ঝুঁকে পড়েন। সে খেলায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে অন্যটায় হাত বাড়ান। সে সময় তিনি ক্যারম ও ব্রিজ খেলার নেশায় মাতোয়ারা। বাসায় ফিরতেন ঢের রাত করে। ২৫ মার্চ আব্বার ফিরতে দেরি দেখে দাদা আব্বার উদ্দেশে বকাবকি করতে থাকেন। তাঁর কাছে জানতে পারলাম, সময় খুব খারাপ। পরিস্থিতি খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে রাতে ঘুমাতে যাই। কিন্তু চোখে ঘুম এলো না। গুলির শব্দে জেগে উঠি। সে বয়সে গুলির শব্দ কি জানতাম না। বড়দের কথায় বুঝতে পারি এটা গুলির শব্দ। আমরা বাসার সবাই খাটের তলায় আশ্রয় নেই। আমাদের বাসার দেয়াল ভেদ করে গুলি চলে যায়। এর কারণ, আমাদের বাসার সামনে ছিল মতিঝিল গার্লস স্কুল। সে স্কুলে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। যে কারণে আমাদের পক্ষে মতিঝিলে থাকা বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। এমন অবস্থা, ঘরের সামনে বারান্দায় পর্যন্ত উঁকি দিতে সাহস পেতাম না। বাধ্য হয়ে পরদিন আমরা গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু ঘন ঘন কার্ফ্যুর কারণে বাসা থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। একবার বাসস্টেশন পর্যন্ত যেয়ে ফিরে আসতে হয়।
যা হোক, ভালো দিনক্ষণ দেখে সদরঘাট থেকে লঞ্চে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হই। অনেকটা পথ যাবার পর মাঝ নদীতে লঞ্চ নষ্ট হয়ে যায়। নৌকা ছাড়া আর কোনো যানবাহন নেই যে আমরা যাব। বাধ্য হয়ে নৌকায় যাত্রা। ক্ষুধায় সবার পেট চোঁ চোঁ করছে। আশপাশে কোথাও দেরি করার উপায় নেই। একে তো কার্ফ্যু, তারপর আন্দাজে কোথায় আশ্রয় নেব! আমাদের নৌকার মাঝির কাছে চাল-ডাল ছিল। কোনো লবণ-মরিচ-মশলা ছিল না। তা ছাড়াই চাল-ডালের মিশেল দিয়ে রান্না করে কোনোক্রমে পেটের ক্ষুধা মেটাই। নৌকায় যাবার সময় দেখতে পেলাম পাকিস্তানি সৈন্যরা স্পিডবোটে মেশিনগান ফিট করে ছোটাছুটি করছে। তাদের দেখে আব্বা ও আব্বার মামা জিন্নাহ টুপি মাথায় দিয়ে ‘সাচ্চা মুসলমান’ সাজেন। এতে খুশি হয় হানাদার বাহিনী। যে কারণে তারা আমাদের কিছু বলেনি। গ্রামের বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার পর দেখলাম, রাজাকারদের দাপট।

অবশ্য যতই দিন যেতে থাকে, আস্তে-ধীরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। নানাবাড়িতে একদিন ইউসুফ গাজী নামে এক মুক্তিযোদ্ধা আসেন। আমাকে ডেকে বলেন, ভাইগ্না যুদ্ধ করবা নাকি। এই বলে তিনি আমাকে তাঁর বন্দুকটি হাতে দেন। আমি রাইফেলটি ভারি হওয়ায় তুলতে ব্যর্থ হই। একদিন বাড়ির পাশে গুলির শব্দ শুনে মা ও নানী আমাকে খাটের তলায় শুইয়ে দেন। তখন বর্ষাকাল। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি যেতে হয় নৌকায়। আমরা খবর পেলাম, পাশের সর্দার বাড়ির মুক্তিযোদ্ধা হবিকে রাজাকাররা গুলি করে হত্যা করেছে। বিকেলে তাঁকে দেখতে গেলাম। দেখলাম, একটা ফ্লোরে হবি শুয়ে আছেন। তাঁর বুক গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেছে। বুক থেকে রক্ত ঝরছে। রাজাকাররা ছইওয়ালা নৌকায় সর্দার বাড়ির ঘাটে এসে থামে। তারপর হবির পিতাকে বলে, ‘আমরা হবির লোক। তাকে ডেকে দেন।’ হবি এ কথা শুনে বেরিয়ে এলে রাজাকাররা নৌকার সামনের পর্দা সরিয়ে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে। সেই প্রথম আমি নিহত কোনো ব্যক্তির লাশ দেখি। এটা দেখে এসে রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। একদিন আমাদের বাড়ির পাশে মধুমতি নদী দিয়ে পাকবাহিনীর বড় আকারের একটি যুদ্ধজাহাজ যায়। জাহাজটি ঘুরাতে যেয়ে নদীতে আটকে যায়। তখন গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা জাহাজটি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। গ্রামের মুরব্বীরা মুক্তিযোদ্ধাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শান্ত করেন। মুরব্বীরা বলেন, শক্তিতে ওদের সঙ্গে পারা যাবে না। ওদের সঙ্গে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র। আক্রমণ করলে ওরা এসে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে। মুক্তিযোদ্ধারা এ সিদ্ধান্ত মেনে নেন।
আরেক দিন খবর পেলাম, আমাদের ডুমদিয়া গ্রামে মিলিটারি আসছে। এ কথা শুনে আমরা নৌকায় করে দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়র বাড়ি উঠি। সত্যি সত্যি মিলিটারি এসে আমাদের গ্রামের অনেক বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা ও চেয়ারম্যান রাঙ্গু গাজীর বাড়ি। আমার আব্বা মিলিটারিদের দেখে তাঁর সাইকেল নানাদের পুকুরে ডুবিয়ে দেন। মিলিটারিরা চলে গেলে তিনি রাঙ্গু গাজীর বাড়ির আগুন নেভাতে সাহায্য করেন। আমাদের ভাগ্য অনেকটা ভালো। আমরা যেদিন যে গ্রামে আশ্রয় নেই, সেই গ্রাম ছেড়ে নিজেদের গ্রামে চলে আসার পরের দিন ওই গ্রামে মিলিটারিরা আগুন ধরিয়ে দেয়। আমাদের ভাগ্য ভালো হলেও আমার দাদা আসাদ (আব্বার মামা)-এর রাশি ভালো ছিল না। তাঁর পাইককান্দি গ্রামে মিলিটারি এলে আসাদ দাদা পরিবার-পরিজনসহ একটা পরিত্যক্ত ভিটায় আশ্রয় নেন। মিলিটারিরা গ্রামে এসে কাউকে না পেয়ে এক নৌকার মাঝির কাছে পানি খেতে চায়। মাঝি পাকিস্তানিদের উর্দু বুঝতে না পেরে পলাতক অবস্থা থেকে আসাদ দাদাকে ডেকে নিয়ে আসেন। তিনি এসে বাড়ির গাছ থেকে ডাব পেড়ে মিলিটারিদের আপ্যায়িত করেন। আপ্যায়িত হয়ে মিলিটারিরা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। সেই যে গেছেন আসাদ দাদা, আজও আর ফিরে আসেননি। আমরা এখনো তার প্রতীক্ষায় দিন গুনি।

(১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে বিজয় দিবস উপলক্ষে একটি স্মরণিকায় প্রকাশিত।)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন