পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৩

কেন রাজনীতি নয়

পলিটিক্স মানে রাজনীতি নয়,
পলিটিক্স মানে ভাঁওতা
পলিটিশিয়ান ডিম পেড়ে বলে
দুই চোখ বুজে দাও তা’।
আমরাও তাই দিলাম
তাইতো আমার ঘটি-বাটি
সব হয়েছে নিলাম।

 ১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত সাহিত্য সংকলন ‘আবাহন’-এ বর্তমানে কানাডা প্রবাসী বিশিষ্ট ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন ‘পলিটিক্স’ শিরোনামে এ ছড়াটি লিখেছিলেন। প্রায় দু’দশক আগে লেখা এ ছড়ার ছত্রে ছত্রে রাজনীতির প্রতি অনাস্থা ও অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছিল। অবশ্য পরবর্তীকালেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। বরং পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। ইদানীং রাজনীতির কথা শুনলে অনেকেই নাক সিঁটকে ওঠেন। সবাই রাজনীতিবিদদের সন্দেহের চোখে দেখেন। সবার মনোভাবটা এমন, এ দেশের সর্বনাশ করছে রাজনীতিবিদরা। রাজনীতিবিদরা যে ধোয়া তুলশি পাতা- এ কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। সে দায়ও আমার নয়। কিন্তু রাজনীতিবিদরা দূরের কোনো গ্রহের বাসিন্দা নন। তারা আমাদেরই নিকটজন। কিন্তু তাদের সঙ্গে সমাজের অন্যান্য মানুষের মধ্যে একটা ব্যবধান গড়ে উঠেছে। নেতিবাচক কর্মকােণ্ডর কারণে তাদের ভাবমূর্তি আজ তলানিতে ঠেকেছে। অধিকাংশই মানুষ তাদের বিশ্বাস করেন না। তাদের কাছে কিছু প্রত্যাশাও করেন না। কিন্তু কেন? দেশের নিয়ন্তা তো রাজনীতিবিদরা। দেশ কীভাবে চলবে, কোথায় যাবে- তার দায়ভার রাজনীতিবিদদের। সঠিক নেতৃত্ব, সঠিক নির্দেশনা দেবেন রাজনীতিবিদরা। রাজনীতিকরা ছাড়া দেশ পরিচালনা কি সম্ভব? তা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে কেন রাজনীতি থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি? রাজনীতি তো করবেন দেশের মেধাবী, ত্যাগী, নিঃস্বার্থ ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিরা। কিন্তু আমরা তো উল্টোটাই দেখতে পাচ্ছি। যাদের রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার কথা, তারা না হয়ে যারা রাজনীতির জঞ্জাল হিসেবে পরিচিত, তারাই এখন রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন। কেন এমন হচ্ছে? একজন রাজনীতিবিদকে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা-শ্রম-মেধা-আত্মত্যাগ করে রাজনীতির পথে হাঁটতে হয়। যিনি রাজনীতিবিদ হবেন, তাকে আজীবন ত্যাগী হতে হয়। গরিবদের দুঃখ-দুর্দশায় বেদনার্ত এবং দেশ ও আর্তের সেবায় মন-প্রাণ সঁপে দিতে হয়। সবরকম সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন এড়িয়ে চলতে হয়। সৎ ও সত্যের পথে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে হয়। তাকে পথভ্রষ্ট করার জন্য কিংবা প্রশাসনিকভাবে হয়রানি, জেল-জুলুম ও নির্যাতন সইতে হয়। অর্থাৎ কিছু পাওয়ার আশা না করে জীবনভর কষ্টকর জীবনযাপন করতে হয়। থাকতে হয় আশ্চর্য আত্মত্যাগ, দৃঢ়চেতা মনোবল ও বীরত্ব। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি, রাজনীতিবিদদের ত্যাগ-তিতিক্ষা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, ভালোবাসা। না খেয়ে, না ঘুমিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে পথে পথে ঘুরে বেড়িয়ে মানুষের সমস্যা-সংকটে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। সহজেই তাদের মন জয় করে নিয়েছেন। বছরের পর বছর কারাগারে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। দ্বীপান্তরিত হয়েছেন। অনশন করেছেন। দেশের মানুষের মুক্তির ব্রত নিয়ে হাসিমুখে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েছেন। যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট সয়েছেন। নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। এমনকি জমিদার নন্দনরাও নিশ্চিত সুখ-শান্তিকে বিসর্জন দিয়ে রাজনীতির পিচ্ছিল পথকে অনায়াসে স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন। কেউ ব্যারিস্টারি পড়ে, কেউবা মাঝ পথে ব্যারিস্টারি পড়া ছেড়ে দিয়ে কিংবা আরাম-আয়েশের জীবন পরিত্যাগ করে দুঃখ-কষ্টের জীবন বেছে নিয়েছেন। কোনো পিছুটান তাদের রুখতে পারেনি। জীবনভর গেয়েছেন মানবতার গান। যাপন করেছেন কঠিন ও কষ্টকর জীবন। কখনো-সখনো মুষড়ে পড়েছেন; কিন্তু ভেঙে পড়েননি। আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন। সেই স্বপ্ন ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার নয়। সাধারণ মানুষের মুক্তির স্বপ্ন। সাহসী, বলিষ্ঠ, প্রতিবাদী ও মেধাবীরা রাজনীতির মঞ্চে এগিয়ে এসেছেন। যেখানে কোনো অন্যায়, অবিচার, অসত্য, জুলুম ও আইনের লঙ্ঘন দেখেছেন, তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে ছুটে গেছেন। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে প্রতিবাদ করেছেন। আন্দোলন করেছেন। মিছিলের পুরোভাগে নেতৃত্ব দিয়েছেন। হয়ে উঠেছেন সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্ষা-আন্দোলনের প্রতীক। সমাজের সম্মানজনক ব্যক্তিরা রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। সব রাজনীতিবিদই যে ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে থেকেছেন, এমনটি হয়তো নয়। কিন্তু তাদের সংখ্যা ছিল সীমিত। সাধারণ মানুষ তাদের বাঁকা দৃষ্টিতে দেখতে। কিন্তু সত্যিকার রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের ভালবাসা ছিল অপরিসীম। রাজনীতিবিদদের কথায় নিজের জীবনকে তুচ্ছ ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। প্রয়োজনে প্রাণ বিসর্জনও দিয়েছেন। দেশ ও দশের মঙ্গলের জন্য যা করা প্রয়োজন, তা করতে রাজনীতিবদরা মোটেও পিছপা হননি। সেই ব্রিটিশ আমলের পরাধীনতা থেকে শুরু করে আজ অবধি প্রকৃত রাজনীতিবিদদের মানুষের ব্যথা-বেদনায় এগিয়ে যেতে দেখেছি। কখনো-সখনো কিছু করতে না পারার যন্ত্রণায় তারা মর্মযাতনা অনুভব করেছেন। নীরবে চোখের অশ্রু ফেলেছেন। তবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ত্যাগী ও নিঃস্বার্থ রাজনীতিবিদদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। প্রলোভনের নানা ফাঁদ থাকা সত্ত্বেও তারা পরাধীনতার শৃংখল ভাঙ্গার জন্য জীবনপণ করে লড়েছেন। এর মাঝে কেউ কেউ ব্রিটিশের গোলামি করে সুযোগ-সুবিধার পথ বেছে নিয়েছেন, খেতাব কুড়িয়েছেন। কিন্তু তারা হারিয়ে গেছেন কালের অতল গহ্বরে। কিন্তু যেসব বিপ্লবী সীমিত সাধ্যের মাঝেও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম করেছেন এবং ব্রিটিশদের দেশত্যাগে বাধ্য করেছেন, তারা ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। সত্য ও ন্যায়ের পথে তাদের যে সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষা, তা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করেছে। অন্তত তাদের আদর্শকে অনুসরণ করা সম্ভব না হলেও বুকের মাঝে অনির্বাণ হয়ে জ্বলেছে আদর্শের আলোকবর্তিকা। যে কারণে অন্যায় ও অসত্যের মাঝে কখনোই তলিয়ে যায়নি আদর্শের নিরন্তর পতাকা। ব্রিটিশের জিঞ্জির ছিন্ন করার ব্রত নিয়ে আর অত্যাচার, বেয়নেট, গুলিকে তুচ্ছ করে কত শত প্রাণ যে দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছেন, তার কোনো হিসাব নেই।


১৭৬০ সালে স্বাধীনচেতা নবাব মীর কাশিম প্রতিরোধের প্রথম যে মশাল জ্বালান, তারই পথ বেয়ে ১৭৯৯ সালে মহীশুরের স্বাধীন নবাব টিপু সুলতানের বীরত্বসূচক আÍত্যাগ, ১৮৩১ সালে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার প্রতিরোধ, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ গোরাদের কামানের গোলায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও জীবনের প্রতি বিন্দুমাত্র মায়া তারা করেননি। আত্মত্যাগ ও বীরত্বে মহিমান্বিত হয়ে আছেন তারা ইতিহাসের পাতায়। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সৈনিক, তাদের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছেন ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী, শ্রী অরবিন্দ, বারীন্দ্র ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, ভগৎ সিং, রাসবিহারী বসু, বাঘা যতীন, মাস্টার দা সূর্যসেন, বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত, দীনেশ গুপ্ত, যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, অশ্বিনীকুমার দত্ত, সুভাষ বোস, মাতঙ্গিনী হাজরা, চট্টগ্রামের বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার প্রমুখ এক ঝাঁক সাহসী সন্তান। এরা ঝাঁপিয়ে পড়েন স্বাধীনতা সংগ্রামে। পরাধীন জাতির বেদনা অন্তর দিয়ে অনুভব করে তারা উৎসর্গ করেন নিজেদের জীবন। এদের মধ্যে কারো ফাঁসি হয়, কেউ কারাবন্দি হওয়ার পরিবর্তে নিজের পিস্তলে আত্মহত্যা করেছেন, কেউ দীর্ঘ অনশন করে আত্মহুতির পথ বেছে নিয়েছেন, কেউ লড়াই করে প্রাণ দিয়েছেন, নির্মম অত্যাচারে অকালে নিভে গেছে কারো কারো প্রাণ প্রদীপ, কেউবা কারাবরণ কিংবা দ্বীপান্তরিত হয়েছেন। এরা দেশকে পরাধীনতার শৃ´খল থেকে মুক্ত করার জন্য রাজনীতি করেছেন। রাজনৈতিক কারণে তারা জীবনের শুরুতে, তারুণ্যে বা যৌবনে এমন এক কঠিন ও দুরূহ পথে আÍনিবেদন করেন, অনেক ক্ষেত্রেই সে পথ থেকে আর ফিরে আসার কোনো সুযোগ ছিল না। অথচ ব্রিটিশরা এসব বিপ্লবীকে নানারকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রাজনীতির পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া এবং রাজনীতির নামে সুবিধাবাদী করে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েও সফল হননি। কেননা, যার অন্তরে একবার দেশপ্রেমের অনির্বাণ শিখা জ্বলে ওঠে, তাকে কখনোই প্রলোভনের ফাঁদ পাতা ভুবনে আটকে ফেলা যায় না। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর ব্রিটিশদের শাসন-শোষণ-নির্যাতনের অবসান ঘটলেও পাকিস্তান নামক দেশটিতে শুরু হয়ে যায় তারই ধারাবাহিকতা। কিছুদিন যেতে না যেতেই ভেঙ্গে যায় পূর্ববঙ্গের মানুষের সুখস্বপ্ন। তৎকালীন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় বিজাতীয় ভাষা উর্দু। শুরু হয়ে যায় ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমিয়ে রাখার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিরা বেছে নেয় অবর্ণনীয় নৃশংস অত্যাচার, নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড। ১৯৪৮ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষার জন্য জীবন দেন রফিক, শফিক, ছালাম, বরকতসহ নাম না-জানা অসংখ্য ভাষা সৈনিক। নির্যাতন ও নির্বিচারে গ্রেফতারের শিকার হন হাজার হাজার ভাষা আন্দোলনকারী।


ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয়ে যায় শাসন-শোষণ-নির্যাতন। ১৯৫০ সালে নাচোল বিদ্রোহের সময় ইলা মিত্রের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন, ১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের দাবিতে ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৬৬ সালে ৬ দফার আন্দোলন, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে কৃষক নেতা আসাদুজ্জামান নিহত হলে জনতা গর্জে উঠলে তা রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। ২৪ জানুয়ারি বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলি চালালে নিহত হয় নবকুমার স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিয়ুর রহমান। ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হককে, ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে নির্মমভাবে হত্যার পর এগিয়ে যেতে থাকে স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তির সংগ্রামে ৩০ লাখ মানুষের আত্মহুতি ও ২ লাখ মা-বোনের নির্যাতনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। তবে এ ২৪ বছরে পাকিস্তানি বাহিনী ও বিহারিরা নির্যাতনের যে ইতিহাস গড়েছে, তার নজির পৃথিবীতে খুবই কম আছে। বিশেষ করে যারা ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, ১১ দফা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা আন্দোলন এবং সর্বোপরি এ দেশের মানুষের সব রকম মুক্তির আন্দোলনে অংশ নিয়ে জনগণের জন্মগত অধিকার, গণতান্ত্রিক ও ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, তারা সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন। তবে পাকিস্তানের ২৪ বছরের আন্দোলনে যত লোক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছেন, আত্মত্যাগ ও বীরত্ব দেখিয়েছেন এবং জীবন উৎসর্গ করেছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। দেশ ও আর্তের সেবায় যেভাবে নিজের জীবন বিলীন করে দিয়েছেন, তার বিনিময়ে তারা শুধু চেয়েছেন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। অনেক স্বেদ-ঘাম-রক্ত ঝরিয়ে পেয়েছেন লাল-সবুজের বাংলাদেশ। অথচ এ দেশেরই অনেক লোক চায়নি বাংলাদেশের স্বাধীনতা। চাননি মানুষের মুক্তি। বরং স্বাধীনতার বিরোধিতা করে ইহজীবনে ফায়দা লুটেছে। কিন্তু ইতিহাসের কাছে তারা চিরদিন ঘৃণিত হয়ে থাকবে। পাকিস্তান আমলে যারা দেশের জন্য রাজনীতি করেছেন, আত্মত্যাগ করেছেন, জীবন উৎসর্গ করেছেন- তাদেরকে অনুপ্রাণিত করেছে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম। তাদের জীবন, সংগ্রাম থেকে যে দীক্ষা তারা নিয়েছিলেন, পাকিস্তানের বিপক্ষে আন্দোলনে, সংগ্রামে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বদলে যেতে থাকে রাজনীতির ধারা। ধীরে ধীরে কলুষিত হতে থাকে রাজনৈতিক পরিবেশ। সমাজবিজ্ঞানীরা নিশ্চয়ই এর কারণ খুঁজে বের করবেন। কেন বাংলাদেশের রাজনীতি আজ নষ্ট ও পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে- তার অনেক কারণ রয়েছে। তবে একটি মহল রাজনীতিকে কলুষিত করার জন্য ভেতরে-বাইরে অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অনুপস্থিতি এবং এর ধারাবাহিকতায় ব্যাঘাত ঘটানোর কারণে রাজনীতির প্রতি সেই নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে নিঃস্বার্থ সংগ্রাম হারিয়ে যাচ্ছে। রাজনীতির বিপক্ষ শক্তি অবৈধভাবে ঢালাও অর্থের ব্যবহার করে প্রকৃত রাজনৈতিক অঙ্গনকে নষ্ট, রাজনীতিবিদদের বিভ্রান্ত এবং অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের রাজনীতির আঙ্গিনায় টেনে আনায় রাজনীতির স্বাভাবিক ধারা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। যে কারণে এখন মানুষ রাজনীতির কথা শুনলেও আঁতকে ওঠেন। কিছু দুর্বৃত্ত মানুষের জন্য বলি হচ্ছে রাজনীতি। প্রতি বছর হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হয়। এদের মধ্যে যারা মেধাবী অর্থাৎ মেধা তালিকায় শীর্ষে থাকে, তাদের সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় দেদারছে ছাপা হয়। তাদের সাফল্যের নেপথ্য কাহিনী, পছন্দ-অপছন্দ, ভবিষ্যতে কী হতে চায় ইত্যাদি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, যখন থেকে পত্র-পত্রিকায় মেধাবীদের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়ে আসছে, তখন থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাদের সবাই প্রকৌশলী, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, সামরিক কর্মকর্তা, সরকারি কর্মকর্তা প্রভৃতি হতে চাইলেও রাজনীতিবিদ হতে চেয়েছে- এমনটি চোখে পড়েনি। যদিও দু’একজন হতে চেয়েও থাকে, তার সংখ্যা এত নগণ্য যে, তা হিসাবের খাতায় ফেলা যায় না। রাজনীতিবিদ তো হতেই চায়নি; বরং তাদের বক্তব্যে রাজনীতির প্রতি এক ধরনের অনীহা, অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। যেন রাজনীতি করাটা একটা অন্যায় ও গর্হিত কাজ। এই যদি হয় দেশের সেরা মেধাবী ছাত্রদের চিন্তা-ভাবনা, তাহলে এ দেশের ভবিষ্যৎ কী? কেননা, রাজনীতিবিদরা হলেন দেশের নীতি-নির্ধারক। তাদের কথামত দেশ চলবে। যেসব মেধাবী ছাত্র শিক্ষা জীবন শেষে কর্মজীবনে বিভিন্ন পেশায় থেকে দেশের কাজ করবে, দেশকে এগিয়ে নেবে, তাদের তো রাজনীতিবিদদের নির্দেশ অনুসারে চলতে হয়। সে ক্ষেত্রে রাজনীতি যদি মেধাহীনদের হাতে চলে যায়, তাহলে তারা মেধাবীদের নেতৃত্ব দেবেন কীভাবে? এই যে রাজনীতির ক্ষেত্রে ক্রমশ মেধাবীদের না আসার ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে, এ জন্য তো আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় দারুণভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। রাজনীতি চলে যাচ্ছে অমেধাবীদের হাতে। সে ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আমরা কতটুকুইবা আশা করতে পারি? রাজনীতির প্রতি অনীহার কারণ শুধু যে রাজনৈতিক নোংরামি বা কারো না কারো প্রতিপক্ষ হয়ে যাওয়ার শংকাই নয়। আসলে এখন মানুষের মন-মানসিকতা ও মূল্যবোধ পাল্টে গেছে। এখন আর কেউ ত্যাগ স্বীকার করতে চান না। রাজনীতি করতে হলে মানুষের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ও নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে সেবা করার আন্তরিকতাটুকু থাকতে হবে; কিন্তু আজকের দিনে তা নেই বললেই চলে। মানুষ এখন স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। নিজের সুখের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। সুখ, শান্তিময় ও নিশ্চিত জীবনকে বেছে নিয়েছে। কীভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় এবং বৈধ-অবৈধভাবে অর্থ-কড়ির মালিক-মোক্তার হওয়া যায়- এ ভাবনাটা সবাইকে পেয়ে বসেছে। তাই কেইবা জেনে-শুনে রাজনীতির কঠিন ও জটিল পথে হাঁটতে চায়? আর এ কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে একটা মারাÍক শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। রাজনীতি এখন টাউট-বাটপার, মাস্তান, অর্থলোভীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনে আমরা এখন আর আদর্শবান ব্যক্তিত্বদের তেমনভাবে দেখতে পাই না। স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নেই বললেই চলে। কেননা, অর্থ ও অস্ত্রের বলি হয়ে তারা একে একে ঝরে পড়ছেন। এমনকি যারা দেশে আইনের শাসন কায়েম করবেন, দেশের সর্বোচ্চ আইনের প্রতিষ্ঠান পার্লামেন্টে যোগ্য রাজনীতিবিদদের সংখ্যা দিনে দিনে লোপ পাচ্ছে। অবৈধ উপায়ে অর্থশালী ও বিত্তশালী এবং ব্যবসায়ীরা এখন পার্লামেন্ট নিয়ন্ত্রণ করছে। এক সমীক্ষায় জানা যায়, জাতীয় সংসদের প্রায় ৬০ শতাংশই ব্যবসায়ী। এদের অনেকেই অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে জাতীয় নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে পার্লামেন্টারিয়ান হয়েছেন। এই যদি হয় জাতীয় সংসদের অবস্থা, তাহলে দেশ কাদের নেতৃত্বে, কোন্ পথে এগোবে? যারা সারা জীবন ত্যাগ-তিতিক্ষা ও নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ করে রাজনীতি করেছেন, ব্রিটিশ আমলে নির্যাতিত হয়েছেন, পাকিস্তান আমলে নিপীড়িত হয়েছেন এবং বাংলাদেশ আমলেও খুব বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন না অর্থাৎ রাজনীতির প্রতি নিবেদিত থেকেও অনাহারে, অবহেলায় জীবনযাপন করেছেন, তা নিয়ে তারা কখনো আক্ষেপ করেননি। কিন্তু এসব আত্মত্যাগী, অন্যায় ও অসত্যের প্রতিবাদকারী, মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গকারী উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বরা যখন চুপিসারে পৃথিবী থেকে চলে যান, তখন তাদের কথা কেউ মনে রাখে না। মিডিয়াও তাদের গুরুত্ব প্রদান করে না। পত্রিকার ভেতরের পৃষ্ঠায় এমনভাবে কভারেজ দেয়া হয়, যা খুব একটা চোখে পড়ে না। যারা সারাটা জীবনে মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের কথা যদি ফলাও করে প্রচার না করা হয়, তাহলে মানুষ কোন্ আদর্শে অনুপ্রাণিত হবে? অথচ সমাজবিরোধী লোকদের নিয়ে যেভাবে মিডিয়ায় ব্যাপক কভারেজ দেয়া হয়, তারাই হয়ে ওঠেন তরুণ প্রজন্মের কাছে হিরো বা বীর। যে কারণে সমাজবিরোধী লোক, মাস্তানরা অবৈধ অর্থ ও অস্ত্রের জোরে সমাজসেবক ও ক্রমান¦য়ে সমাজের নেতা হয়ে ওঠে। এখন তো অর্থ ও অস্ত্রের জোর না থাকলে যে কোনো নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়া বা জনপ্রতিনিধি হওয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অবক্ষয়ের ধস নেমেছে এবং মন্দ লোকের উপস্থিতি বেড়েছে- তা দীর্ঘ একটি প্রক্রিয়ার ফসল। তবে রাজনীতির এই নৈতিক অবক্ষয়ের যুগে যারা সত্যিকার দেশ ও আর্তের প্রতি আন্তরিক এবং অকৃত্রিম, তাদের এগিয়ে আসতে হবে। কেননা, কোনো কিছুর পথই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। আর রাজনীতির পথ তো আরো কঠিন ও জটিল। এ পথে হাঁটতে হলে ত্যাগ-তিতিক্ষা ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থাকা প্রয়োজন। সে ধরনের আবেগ-অনুভূতি না থাকলে রাজনীতিবিদ হওয়া যায় না। সঠিক নেতৃত্ব ও সঠিক নির্দেশনা পেতে হলে মেধাবীদের রাজনীতিতে আসা প্রয়োজন। দেশের মাথা হলো রাজনীতিবিদরা। মাথায় যদি পচন ধরে, তাহলে সে দেশের পচন ধরতে বাকি থাকে না। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের নিয়ে যে বিভ্রান্তি, তা দূর করতে হলে সত্যিকার ত্যাগী ও মেধাবী ব্যক্তিদের রাজনীতিতে এগিয়ে আসার পথ সুগম করতে হবে। অবশ্য রাজনীতির পথ এতটা মসৃণ নয় যে কেউ পথ করে দেবে; সেক্ষেত্রে নিজের জায়গা নিজেই করে নিতে হবে। যদি সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিরা রাজনৈতিক অঙ্গনে এগিয়ে আসেন, তাহলে এ দেশের রাজনীতি একদিন সুন্দর হয়ে উঠবে। তাই রাজনীতির প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি না করে কীভাবে রাজনৈতিক অঙ্গনকে সুষ্ঠু ও সুন্দর করা যায়, সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং সবাইকে সচেতন করতে হবে।

রচনা কাল : জানুয়ারি ২০০৪

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন