পয়লা বৈশাখ বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। এ উৎসব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা ও আনন্দ-উৎসবের মধ্য দিয়ে প্রতি বছর আমরা দিনটি উদযাপন করি। বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনটি বাঙালির চিরায়ত উৎসবের দিন। আনন্দের দিন। এই দিনটিকে বরণ করে নেয়ার জন্য প্রতিটি বাঙালির প্রাণে প্রাণে বেজে ওঠে উৎসবের মাদল। কণ্ঠে কণ্ঠে অনুরণিত হয় : ‘মুছে যাক গ্লানি/ঘুচে যাক জরা/অগ্নিøানে সূচি হোক ধরা’। অন্তরে অন্তরে মূর্ত হয়ে ওঠে মঙ্গলাকাক্সক্ষা। নববর্ষ আবাহন ও বর্ষবরণের উৎসবের পাশাপাশি রুদ্র বৈশাখ আমাদের জীবনে নিয়ে আসে প্রতিকূলতার মুখে দাঁড়িয়ে সংগ্রামী ও লড়াকু জীবনের দৃঢ়তা। কেননা, কালবৈশাখীর তা-বে ল-ভ- হয়ে যায় আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা। হঠাৎ দমকা ঝড়ের দাপটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে নাগরিক ও গ্রামীণ জীবন। প্রকৃতির এই খেয়ালিপনার সামনে আমরা কেন, পৃথিবীর সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী দেশগুলোও অসহায় হয়ে পড়ে। তবে তারা যত দ্রুত পরিস্থিতি সামলে নিতে পারে কিংবা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে, আমাদের পক্ষে সেটি সম্ভব হয় না। আমাদের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক অবস্থান তেমন সুদৃঢ় নয়। এ কারণে কালবৈশাখীর হিংস্র ও নৃশংস থাবায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা আমরা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নেই। কালবৈশাখীর রুদ্ররূপ, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। ষড়ঋতুর এ দেশে প্রকৃতির ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাওয়াটা কখনো কখনো চরম ভোগান্তি নিয়ে আসলেও কখনো-সখনো আশীর্বাদ হয়েও দেখা দেয়। আর এটাই সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশের বৈচিত্র্য। যে কারণে কবি আপ্লুত হয়ে লিখতে পারেন : ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাক তুমি/সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’। কালবৈশাখীর রুদ্রমূর্তির কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে আমরা রুখতে না পারলেও আমরা যদি সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন করি, তাহলে বড় বড় দুর্ঘটনা সহজেই এড়াতে পারি। কিন্তু ঋতুচক্র অনুযায়ী প্রতি বছর নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি অনেকটা বর্ষপঞ্জির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রমত্ত কালবৈশাখীর ঝড়ের কবলে পড়ে লঞ্চডুবির ঘটনা। প্রতি বছর লঞ্চডুবিতে প্রাণ হারায় হাজার হাজার মানুষ। এবারো অল্প ক’দিন আগে একই দিনে নারায়ণগঞ্জের পাগলার অদূরে বুড়িগঙ্গায় এবং ভৈরব উপজেলার কাছে মেঘনা নদীতে দুটি লঞ্চডুবিতে মর্মান্তিকভাবে জীবন দিয়েছে প্রায় দু’শর কাছাকাছি লোক। এ ঘটনার পরও লঞ্চ, কার্গো ও ট্রলারডুবি থেমে নেই। সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। আবহাওয়ার যে ধরন-ধারণ, তাতে যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের নৌ-দুর্ঘটনা ঘটলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। পত্রিকার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ২৬/২৭ বছরে ছোট-বড় প্রায় পাঁচ শ’র কাছাকাছি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। যে মানুষগুলো প্রাণ হারাচ্ছে, তারাই শুধু পৃথিবী ছেড়ে চলে যাচ্ছে না, এতিম করে দিয়ে যাচ্ছে তাদের পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনকে। দরিদ্র দেশ হিসেবে আমরা শুধু অসংখ্য মূল্যবান জীবনই হারাচ্ছি না, পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদও। এ মৃত্যু কি আমরা এড়াতে পারি না? যে দুর্ঘটনাগুলো প্রতি বর্ষপঞ্জিতে একইভাবে ঘটে চলেছে, তার কাছে কেন আমরা অসহায় আত্মসমর্পণ করছি? এ থেকে কি আমাদের শিক্ষণীয় কিছু নেই? অবশ্য প্রতি বছর দুর্ঘটনার পরপরই গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। এ পর্যন্ত প্রায় হাজারখানেক তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আলোর মুখ দেখেনি, আর যেগুলোর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। তবে অধিকাংশ লঞ্চ দুর্ঘটনা যতটা না প্রকৃতির খেয়ালে ঘটেছে, তার চেয়ে বেশি ঘটেছে মানুষের বেখেয়ালে। অতি অল্পতেই মুনাফার পাহাড় গড়ার আশায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চলাচলের অনুপযোগী নৌযান রেজিস্ট্রেশনবিহীন অবস্থায় চলাচল, ধারণ ক্ষমতার বেশি যাত্রী ও মালামাল বোঝাই, আবহাওয়ার পূর্বাভাস ও সতর্ক সংকেত উপেক্ষা করে ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চ চালানো, অদক্ষ মাস্টার, সারেং ও সুকানি দিয়ে লঞ্চ চালানো, লাইফ-জ্যাকেটসহ জীবন রক্ষাকারী প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকায় একদিকে যেমন নৌ-দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে, অন্যদিকে সে অনুপাতে বাড়ছে জীবন ও সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। অথচ যাত্রীবাহী প্রতিটি লঞ্চের ফিটনেস সার্টিফিকেট, রুট পারমিট ও চালকের লাইসেন্স পরীক্ষা, লঞ্চের ডিজাইন ও নির্মাণ পদ্ধতির ত্রুটি নির্ণয় এবং যাত্রী নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ যাবতীয় বিষয়াদি লঞ্চ ছাড়ার আগেই পরীক্ষা করার কথা। আর এ জন্য রয়েছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর ও অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সংস্থাসহ নানা বিভাগ। কিন্তু আইনের ফাঁক-ফোঁকর গলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নিবন্ধন ছাড়াই চলাচল করছে হাজার হাজার নৌযান। সঙ্গত কারণে দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। মুনাফালোভী নৌ-মালিকদের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান হয়ে দাঁড়িয়েছে যে কোনোভাবেই হোকÑ অর্থোপার্জন। আমাদের দেশের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম নৌ-পরিবহন। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের যাতায়াতের প্রধান অবলম্বন এটি। বিশেষ করে নিুবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের চলাচলের জন্য সস্তায় ও সহজে এর চেয়ে ভালো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ লোক নৌপথে চলাচল করে। ঝড়-বৃষ্টি-রোদ যাই হোক না কেন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রুটি-রুজি, জীবন-জীবিকার তাগিদে নৌপথে তাদের চলাচল করতে হয়। বছরের পর বছর নৌ-দুর্ঘটনায় তারা জীবন দিচ্ছে। কিন্তু এর কোনো বিহিত হচ্ছে না। এমনকি জীবনের নিরাপত্তা তো দূরে থাক, মৃত্যুর পরও তাদের পরিবার-পরিজনকে কোনো রকম ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। নৌপথে মানুষের জীবন ঝরা পাতার মতো অকালে ঝরে গেলেও এ নিয়ে তাৎক্ষণিক হৈ-হুল্লোড় হলেও তারপর পরিস্থিতি দ্রুত থিতিয়ে যায়। এবারও উপর্যুপরি নৌ-দুর্ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। কালবৈশাখী ঝড়ের কবলে পড়ে দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য সরকার ঝড়ের মৌসুমে বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত লঞ্চ চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ঝড়ের মৌসুমে বিকেল ও সন্ধ্যার দিকে সাধারণত বেশি ঝড় হয় বলে চৈত্র মাসের ১৫ তারিখ থেকে বৈশাখ মাসের শেষ দিন পর্যন্ত যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পরীক্ষামূলকভাবে এ সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবে, তা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে একটা প্রক্রিয়া অন্তত শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তা ভালো কি মন্দ, সেটা অনুধাবন করার আগেই লঞ্চ মালিকদের সংগঠন অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থা সারাদেশে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়। সরকারের এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লঞ্চ চালালে তাদের লোকসান হবে, তাই এ দু’মাস তারা লঞ্চ চালাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। লঞ্চ মালিকদের এ সিদ্ধান্তে লঞ্চ যাত্রীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়। যাত্রীদের এভাবে জিম্মি করাটা কতটা যৌক্তিক, এটা ভেবে দেখা হয়নি। শেষ অবধি লঞ্চ মালিকদের চাপে এবং আলোচনার প্রেক্ষিতে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। লঞ্চ মালিকদের নিশ্চয়ই তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিজস্ব বক্তব্য আছে। কিন্তু তারা কখনো যাত্রীসেবা কিংবা যাত্রীদের মৃত্যুর ঝুঁকি থেকে রক্ষা করার জন্য খুব বেশি ভাবে বলে প্রতীয়মান হয় না। তারা যেহেতু ব্যবসায়ী, তারা ব্যবসা করবেন, এটা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু যাত্রীদের প্রতি তারা মোটেও সহানুভূতিশীল নন। এ ক্ষেত্রে সব লঞ্চ মালিকই যে একই পথের যাত্রী, সেটা বলছি না। কিন্তু অধিকাংশ মালিকই আইনকে ফাঁকি দিয়ে নৌ-চলাচল ব্যবসা করছে। সরকার যখন মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য একটি সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার প্রতিবাদে লঞ্চ মালিকরা ধর্মঘট আহ্বান করলেও তাদের সহযোগীরা যে যাত্রীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, সে ব্যাপারে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অবশ্যই শুধু লঞ্চ মালিকরা যে নিয়ম ভঙ্গ করছে, তা বলা যাবে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও আইনের কার্যকর প্রয়োগ করছে না বলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় অভিযোগ করা হয়েছে। যারা সাধারণ যাত্রী, যাদের জীবন হাতে নিয়ে নৌপথে চলাচল করতে হয়, তারা এখন নিজেদের ভাগ্যকে সঁপে দিয়েছেন অদৃষ্টের হাতে। তারা ধরে নিয়েছেন, লঞ্চ দুর্ঘটনা একটি ‘বাৎসরিক পার্বণ’ হিসেবে বিবেচিত হবে। আর এই ‘পার্বণে’ যাত্রীরা জীবন উৎসর্গ করবেন আর লঞ্চ মালিক ও সংশ্লিষ্ট মহল বসে বসে তা উপভোগ করবেন!
দৈনিক বাংলাবাজার : ১১ জুন ২০০৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন