পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

রবিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৩

বিমল দা’র অকালে চলে যাওয়া

ব্যক্তিগতভাবে আমি দৈনিক পত্রিকার শোক সংবাদের কলাম খুব একটা দেখি না। বলা যায়, দেখতেও চাই না। জানি, মৃত্যু অনিবার্য। তারপরও কাকের মতো চোখ বন্ধ করে রাখতে চাই। ভাবটা এমন, আমি পত্রিকায় চোখ না বুলালে ঝরে যাওয়া জীবনগুলো অটুট থেকে যাবে! কিন্তু তাই কি কখনো হয়? ১৭ মে কেন জানি পত্রিকার শোক সংবাদের কলামে হঠাৎ চোখ চলে যায়। অমনি বুকটা ছেঁক করে ওঠে। পত্রিকায় দেখলাম বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও অধ্যাপক বিমল দত্ত ১৫ মে রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫১ বছর। এ বয়সে তিনি এভাবে চলে যাবেন, ভাবতেও পারিনি। আসলে আমাদের ভাবাভাবি নিয়ে বিধাতার কিইবা আসে যায়! বিমল দা’র মৃত্যু সংবাদটা পড়ার পর বুকের মাঝে একরাশ কষ্টকর অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। আমি যে তার খুব ঘনিষ্ঠ বা কাছাকাছি ছিলাম- তা হয়তো বলা যাবে না। তাছাড়া পরিচয়ের যেটুকু গণ্ডি গড়ে উঠেছিল, নির্মম নাগরিক জীবনে ছেড়ে যাওয়া যানজটে আটকেপড়া বাসের মতো তা আস্তে-ধীরে আমাদের দূরে সরিয়ে দেয়। তার সঙ্গে কবে শেষ দেখা হয়েছিল- সেই স্মৃতিটুকুও স্মরণের জানালা দিয়ে হারিয়ে গেছে। তবে তার সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৮৫ সালের মার্চে; যখন আমি দৈনিক বাংলার বাণীতে শিক্ষানবিশ সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেই। বাংলার বাণীতে যেদিন প্রথম যোগ দেই, সেদিনের বিকেলের পালার শিফ্ট-ইন-চার্জ ছিলেন কবি সোহরাব হাসান, যাঁর হাতে আমার দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি। চমৎকার ও প্রাণখোলা এই মানুষটি খুব সহজেই মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে এবং সহসাই আপন করে নিতে পারেন। আমি দুরু দুরু বক্ষে তার সামনে বসতেই তিনি সহজ-সরল হাসি দিয়ে আমাকে আপন করে নেন। একে একে পরিচয় করিয়ে দেন বিকেলের শিফটে কর্মরত শহীদ আশরাফ, নাহিদ আমিন খান, আবদুল হালিম পলাশ, খান মোহাম্মদ সালেক, সুকুমার সরকার, সায়েদুল আরেফীন, অসীম কুমার উকিল, প্রণব সাহা প্রমুখের পাশাপাশি মফস্বল ডেস্কের ইন-চার্জ বিমল দত্তের সঙ্গে। অমায়িক ও মৃদু হাসি দিয়ে তিনি আমাকে বরণ করে নেন। নিপাট ভদ্রলোক বিমল দা’র উপস্থিতি অফিসে খুব একটা টের পাওয়া যেত না। নীরবে-নিভৃতে চুপিসারে কাজ করতেন। অথচ বিভিন্ন জেলার সংবাদদাতাদের উপস্থিতিতে মফস্বল ডেস্ক সরব হয়ে উঠলেও তার আড়ালে থাকতে চাইতেন বিমল দা। তার এই নিভৃতচারী ও নিঃশব্দ কাজ আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করে। তবে বিমল দা’কে নিয়ে আমার জীবনে একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। আমি তখন তেজগাঁও কলেজের ‘নামমাত্র’ ডিগ্রির ছাত্র। আসলে স্কুল-বয়স থেকেই পত্র-পত্রিকার সান্নিধ্যে আসায় পড়ালেখার প্রতি আমার ঝোঁকটা একদমই চলে যায়। অল্প বয়সেই উড়নচণ্ডি হলেও শহরে বসবাস করে যদি মুর্খ থেকে যাই, সেই লোকলজ্জার ভয়ে পড়ালেখার সঙ্গে সম্পর্কটা থাকে টায়ে টায়ে। এমনিতে ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলাম না, তদুপরি পড়ালেখায় ছিল না কোনো মনোযোগ- এমন লবডঙ্কা মার্কা ছেলেকে ছাত্র বলাটা ঠিক মানায় কিনা সন্দেহ থেকে যায়।


যা হোক, কোনক্রমে এক্কা-দোক্কা করে এক পর্যায়ে তেজগাঁও কলেজের ডিগ্রির ছাত্র হয়ে যাই। কিন্তু কলেজে ক’দিন গিয়েছি, তা হাতে গুনে বলে দেয়া যায়। আমার তখন ধ্যান-জ্ঞান ঢাকা স্টেডিয়ামে খেলা দেখা এবং পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করা। তো একদিন কি মনে করে কলেজে গিয়েছি। ক্লাসের কাউকেই আমি চিনি না। না কোনো সহপাঠীকে, না কোনো শিক্ষককে। যে কারণে কলেজের করিডোরে দাঁড়িয়েছিলাম। এমন সময় দেখি সেখানে বিমল দা এসে হাজির। আগেই বলেছি, বিমল দা তখন বাংলার বাণীতে আমার সহকর্মী। তিনি আমাকে দেখে উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে বললেন, দুলাল তুমি এখানে? আমি বললাম, আমি তো ক্লাস করতে এসেছি। শুনে তিনি মুচকি মুচকি হাসলেন। পাল্টা আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এখানে কী মনে করে? তিনি যে জবাব দিলেন, তাতে আমি লা-জবাব হয়ে যাই। তিনি জানালেন, তিনি এসেছেন ক্লাস নিতে। বিমল দা যে তেজগাঁও কলেজের বিএ’র বাংলার খ-কালীন মাস্টার মশাই, এটা আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। জানার কথাও নয়। কেননা, ক্লাস শুরুর কয়েক মাস পর সেদিনই আমি বিএ’র প্রথম ক্লাসটা করতে কলেজে গিয়েছি। এরপর তিনি আমাকে নিয়ে ক্লাসে ঢুকলেন। আমি যথারীতি ছাত্রদের আসনে। তিনি শিক্ষকের ভূমিকায়। তবে সেদিন প্রায় সারাক্ষণই তার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়। তিনি কিছুটা বিব্রত হয়ে চোখে-মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে ক্লাস নিতে থাকেন। আর আমি আড়ষ্ট হয়ে কোনোক্রমে তার ক্লাসটি কাটিয়ে দেই। এরপর ডিগ্রি পরীক্ষার আগ অবধি কলেজমুখো হয়েছি বলে মনে পড়ে না। বাংলার বাণীতে দেখা হলে আমি তাঁকে এড়িয়ে চলতে চাইলেও তিনি কিন্তু সলাজ হাসিতে আমাকে কাছে টেনে নিতে দ্বিধা করতেন না। অবশ্য বেশিদিন তিনি আর আমাকে বিব্রত হতে দেননি। ‘খবর’ দৈনিক হওয়ার পর তিনি সেখানে চলে যান। তারপর থেকে তার সঙ্গে কদাচিৎ দেখা-সাক্ষাৎ হতো। কিন্তু একদিন জানতে পারলাম তিনি মারাÍক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন এবং হারিয়েছেন একটি পা। সেই থেকে শুরু হয় তার আরেকটি সংগ্রামী ও কঠিন জীবন। পা হারিয়েও তার মনোবলে একটুও চিড় ধরেনি। জীবনের কাছে হেরে যাননি। পঙ্গুত্বকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে তিনি জীবন নৌকায় ভেসেছেন। এরপর আর তার সঙ্গে তেমন যোগাযোগ ছিল না। পথে-ঘাটে হঠাৎ হঠাৎ দেখা হয়ে যেত। শুনেছিলাম, তিনি দৈনিক খবর ও তেজগাঁও কলেজ ছেড়ে থিতু হয়েছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। কর্মরত ছিলেন সহকারী কলেজ পরিদর্শক হিসেবে। জীবনের সঙ্গে সারাটা জীবন যুদ্ধ করে কেটে গেল বিমল দা’র। তরুণ বয়সে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাড়া দিয়েছেন, স্বাধীনতার পর থেকে অর্থনৈতিক অস্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে লড়াই করেছেন, দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে এক পা হারিয়ে জীবনের যুদ্ধ চালিয়েছেন। কিন্তু কখনোই জীবনের কাছে আÍসমর্পণ করেননি। ভেঙ্গে পড়েননি। কিন্তু শেষ অবধি অকালে মৃত্যুর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন বিমল দত্ত। আমাদের বিমল দা। বড় তাড়াতাড়ি চলে গেলেন তিনি।

দৈনিক সংবাদ : ৩০ মে ২০০৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন