পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৩

বিশ্বায়নের গোলকধাঁধা


আমরা যারা অনুন্নত, দুর্বল ও শক্তিহীন দেশের অধিবাসী, তারা এখন চাতক পাখির মতো একরাশ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে বসে থাকি, ‘বিশ্বের মালিক’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের মুখের ‘অমৃত বাণী’ শোনার প্রতীক্ষায়। তিনি কখন কি বলেন, সেটাই বিশ্ববাসীর কাছে অপরিসীম কৌতূহলের বিষয়। কেননা, দুনিয়াটা চলছে তো তার কথায়। তার কথার ভারও যেমন আছে, তেমনি আছে ভারিক্কি। সঙ্গত কারণে তার কোনো কথাকে অবজ্ঞা বা উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। ইরাকি জনগণকে মুক্তি দেবেন বলে যে আশ্বাস তিনি দিয়েছিলেন, তা অনেকেই খুব বেশি পাত্তা দেয়ার তাগিদ অনুভব করেননি। ভেবেছিলেন, বাত কি বাত। কিন্তু তার কথাকে গুরুত্ব না দেয়ার পরিণতি আমরা দেখতে পেলাম হলিউডি মারদাঙ্গা ছবির কাহিনীর মতো করে। তাতে অ্যাকশন, ড্রামা ও সাসপেন্সের কোনো কমতি ছিল না। রোমান্সটাও অবশ্য আমাদের দেখার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়নি। প্রেসিডেন্ট বুশ ইরাকি জনগণকে এমনই মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছেন, তাতে তাদের অবস্থা দাঁড়িয়েছে- ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্য দূরীকরণে বিশ্বব্যাপী অবাধ বাণিজ্য বিস্তারের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যে কোনো সমাজে বাণিজ্য হচ্ছে উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিদ্যমান অন্তরায়গুলো নিরসনে আমেরিকা ও ইউরোপকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। অবাধ বাণিজ্য বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। প্রেসিডেন্ট বুশের এ আশাবাদ তৃতীয় বিশ্বের মানুষকে যতটা না আশাবাদী করেছে, তার চেয়ে বেশি সৃষ্টি করেছে আতংক। বুশের কথার মারপ্যাঁচে কী লুকিয়ে আছে, তা এ মুহূর্তে আঁচ করতে না পেরে সবাই কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ইতোমধ্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সর্বত্র নিন্দা, সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। যারা এই অসম বাণিজ্য নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত, তারা তো বটেই; যারা মানবতাবাদী, তারাও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। কেননা, বুশ যে অবাধ বাণিজ্যের কথা বলছেন এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা অবাধ বাণিজ্যের নামে সারা দুনিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের যেসব বিধি-বিধান প্রবর্তন করছে- তার মধ্যে কোনো তফাত নেই। উভয়ই একে অপরের পরিপূরক। ১৯৪৭ সালে বিশ্ব বাণিজ্য পরিচালনার জন্য আইন ও শৃ´খলা প্রতিষ্ঠা, প্রতিযোগিতা বিনষ্ট করে- এমন বাণিজ্যিক বাধা ও অন্যান্য প্রতিকূলতা দূর, বাণিজ্য বিরোধ মীমাংসা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে গঠিত হয় গ্যাট (জেনারেল অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফ অ্যান্ড ট্রেড) অর্থাৎ শুল্ক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত সাধারণ সমঝোতা। কিন্তু মূল বিষয়কে উপেক্ষা করে ধনী দেশগুলো বাজার দখলের খেলায় গ্যাটকে ব্যবহার করে। বর্তমান বিশ্বের একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা নির্মাণের কথা বলে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করেছে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর দ্রুত ও শক্তিশালী সমর্থন পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র গ্যাটকে শুধু পণ্যের শুল্ক কিংবা বাণিজ্যের সীমা থেকে জোর করে বের করে আনার দিকে অগ্রসর হয়। বর্তমান কাঠামোতে সন্তুষ্ট না হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গ্যাটের আওতাকে সেবা, বিনিয়োগ ও মেধাস্বত্বের অধিকার পর্যন্ত বাড়ানো এবং সে সাথে এ বিষয়গুলোকে দেখাশোনা করার জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা গঠনের উদ্যোগ নেয়। গ্যাটের সংশোধিত কাঠামো নিয়ে উন্নত পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের মধ্যে এবং তার সঙ্গে অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো ভয়ংকর বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। এই চূড়ান্ত সংকটের মুহূর্তে গ্যাটের তৎকালীন মহাসচিব আর্থার ড্যাঙ্কেল কিছু আপোষের চিন্তা মাথায় রেখে বিবেচনার জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব হাজির করেন। প্রায় আট বছর তুমুল তর্ক-বিতর্কের পর কিছু রূপান্তর ঘটিয়ে ড্যাঙ্কেল প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে কর্মকর্তা পর্যায়ে এবং ১৯৯৪ সালের মার্চে মন্ত্রী পর্যায়ে এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি গঠন করা হয় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা অর্থাৎ ডব্লিউটিএ। এর পাশাপাশি কৃষিপণ্যসহ অপরাপর পণ্যের শুল্ক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে দেখাশোনা, সেবামূলক খাত, বিনিয়োগ ও মেধাজাত অধিকারের সাথে সম্পর্কিত এবং পারস্পরিক প্রতিশোধমূলক বিধান সংক্রান্ত চুক্তি কার্যকর হয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে চুক্তি হয়েছে, তার কার্যাবলী হচ্ছে : উরুগুয়ে রাউন্ডে গৃহীত সব চুক্তি ও আইনি হাতিয়ারগুলো বাস্তবায়ন সহজতর করে তুলবে, সকল ধরনের সমঝোতার লক্ষ্যে একটি ফোরাম হিসেবে কাজ করবে, বাণিজ্য নীতি পর্যালোচনার পদ্ধতি ও বিরোধ মীমাংসা পরিচালনার নিয়মনীতি সম্পর্কিত আলাপ-আলোচনা পরিচালনা করবে এবং বিশ্ব অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারণে পরস্পরের আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে কাজ করার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্ব ব্যাংককে সহযোগিতা করবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে মূলত লাভবান হচ্ছে শিল্পোন্নত দেশ এবং তাদের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো।


বিশ্বব্যাপী বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর আধিপত্য ক্রমশ দৃঢ়তর হচ্ছে। তারা উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে খবরদারি করছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং মুক্তবাজারের শাসনে বহুজাতিক কর্পোরেশনের আদলে বিশাল আকারের কর্পোরেট পুঁজি এখন বিশ্বের শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ পুঁজি এখন পুঁজিবাদী বিশ্ব শক্তি হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর রাষ্ট্র ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই কর্পোরেট পুঁজির আন্তর্জাতিক চলাচল এবং তাদের উৎপাদিত পণ্য ও সেবার জন্য বিশ্বব্যাপী অবাধ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠার প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন গড়ে তোলার নামই বিশ্বায়ন; যা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিপ্লবকে ধারণ করে দরিদ্র দেশগুলোকে আবারো আরেকটি অদৃশ্য ঔপনিবেশিক শৃংখলে আবদ্ধ করে ফেলেছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর মনোভাব হলো এমন : ‘বিচার মানি, তবে তালগাছটা আমার’। তাদের পক্ষে কোনো নীতি গ্রহণযোগ্য না হলেই তারা মনগড়া এক ফতোয়া দিয়ে বসে। কোনো দেশ যদি তার অর্থনীতি ঠিক করার জন্য কোনো নীতি গ্রহণ করে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা তাতে বাধা দেবে এই বলে যে, এর সাথে উন্নয়নের কোনো সম্পর্ক নেই। অথচ উন্নত দেশগুলোর ম্যাক্রো অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সিদ্ধান্ত হয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে। তাতে ভোটাভুটির কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে শিল্পোন্নত বা ধনী দেশগুলো তাদের কোনো সিদ্ধান্ত অনুমোদন করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হলে সেসব দেশের প্রতিনিধিদের আপোষের মাধ্যমে বা নানা কৌশল প্রয়োগ করে বশ করার পথ বেছে নেয়। ফলে কোনো অগণতান্ত্রিক ও একতরফা সিদ্ধান্ত তারা সহজেই অনুমোদন করিয়ে নেয়। তারপর শিল্পোন্নত দেশের প্রতিনিধির সংখ্যা ইচ্ছেমাফিক বাড়িয়ে নেয়া, যখন-তখন সভা আহ্বান করা- যাতে স্বল্পোন্নত দেশগুলো সহজেই অংশ নিতে না পারে। এমন চালাকি তো আছেই। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা শুধু সারা দুনিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রকই নয়, তারাই হয়ে উঠবে এক বিশ্ব সরকার। যাদের সুতো থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারী এ সংস্থার কার্যক্রম, বিধি-বিধানের ফলে সারা দুনিয়ায় বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। তীব্র হবে বৈষম্য। উন্নত বিশ্ব আর উন্নয়নশীল বিশ্বের মাঝে এবং ধনী আর দরিদ্রের মাঝে ব্যবধান বাড়বে। গরিব আরো গরিব হয়ে যাবে। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় আর্থ-সামাজিক মূল্যবোধ, জীবনযাপন পদ্ধতিতে দ্রুত পরিবর্তন ঘটে যাবে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অগণতান্ত্রিক ও অসম নীতির ফলে বিপদাপন্ন হবে আমাদের মতো দেশের কৃষি, শিল্প ও প্রতিবেশ। তথ্য প্রযুক্তির অভূতপূর্ব বিপ্লব আর গুটিকয়েক রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানের নজিরবিহীন বল প্রয়োগের ক্ষমতা বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনে এক বিশ্বে এখন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং মুক্ত বাজারের শাসন মানবজাতির জন্য একটি স্বাভাবিক ব্যবস্থা। রাজনৈতিক বিশ্বায়ন নয়া উদার নৈতিক ভাবাদর্শের আধিপত্য সৃষ্টি করছে। তথাকথিত গণতন্ত্র ও মুক্তবাজারের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে।


সবকিছুর মাতবর হচ্ছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি। এদের চাপিয়ে দেয়া কাঠামোগত সমন¦য় কর্মসূচি দারিদ্র্য কমানোর নামে বেসরকারিকরণ কর্মসূচিকে ত্বরািন্বত করেছে। ফলে একটি বিশেষ শ্রেণী সেবা-পণ্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক হয়ে এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রীয় সেবা, চাকরি ও খাদ্য নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দরিদ্র দেশের সার্বভৌমত্ব সীমিত এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সরকারগুলোর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। সে তুলনায় এনজিওরা অনেক শক্তিশালী হয়েছে। তাদের সঙ্গে বহির্বিশ্বের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বর্তমান তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বহুপাক্ষিক বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় বিশ্বায়ন ও বাণিজ্য উদারীকরণের গতিকে ত্বরানি¦ত করে উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বৈষম্য হ্রাস করার লক্ষ্যেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত হলেও ২০০৫ সাল থেকে গার্মেন্টস শিল্প কোটা সুবিধা হারিয়ে অন্যান্য দেশের সাথে এক অসম ও কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে। এর ফলে বাংলাদেশের প্রায় ১৫ লাখ নারী শ্রমিক বেকার হয়ে পড়তে পারে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আওতায় টেক্সটাইল ও বস্ত্র চুক্তির ফলে এ খাত দুটো ইউরোপ ও আমেরিকার আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ কোনো কোটা সুবিধা পাবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়মে টেক্সটাইল ও বস্ত্রখাত পরিচালিত হবে। বাংলাদেশ পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে জিএসপি (জেনারেল সিস্টেম অব প্রিফারেন্স) স্কিমের সুবিধা ভোগ করে। এখন থেকে বাংলাদেশকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সুবিধা পেতে হলে মেনে চলতে হবে ‘রুলস অব অরিজিন’-এর শর্তাবলী। এর ফলে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার হারাতে হবে। বেসরকারিকরণের নামে আমাদের জাতির সুষম বিকাশের জন্য জাতি গঠনকারী প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতকে বাজার ব্যবস্থার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। পেটেন্ট রাইটসের নামে কৃষক সমাজের হাজার বছরের লালিত গাছপালা, বীজ ও প্রাণসম্পদকে বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধির কাছে তুলে দিয়ে কৃষক সমাজকে নিঃস্ব করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আমাদের রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করেন না। তাছাড়া আমাদের প্রশাসনিক অবস্থাও শক্তিশালী নয়। যে কারণে আমাদের অসতর্কতা ও অসচেতনতার সুযোগে আমরা ধনী দেশগুলোর পাতা ফাঁদে ক্রমান¦য়ে আটকা পড়ে যাচ্ছি। যখন আমাদের হুঁশ হয়েছে, তখন পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। যা হোক, সেপ্টেম্বরে মেক্সিকোর কানকুন শহরে অনুষ্ঠিত হবে পঞ্চম মিনিস্টারিয়্যাল কনফারেন্স। এ সম্মেলন স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ অবস্থায় উন্নত দেশের বাজারে স্বল্পোন্নত দেশের পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার এবং বিশ্ব শ্রম বাজারে শ্রমিকের অবাধ চলাচলসহ ১৩ দফা দাবির ‘ঢাকা ঘোষণা’র মধ্য দিয়ে ২ জুন স্বল্পোন্নত দেশের বাণিজ্য সম্মেলন শেষ হয়। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনে ১৬ দফা ‘ঢাকা ঘোষণা’য় স্বল্পোন্নত দেশের প্রধান দাবি ১৩টি। দাবিগুলো : ১। বিশ্ব বাণিজ্যে স্বল্পোন্নত দেশের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে দীর্ঘমেয়াদি, নমনীয় এবং সহজতর ‘রুলস অব অরিজিন’ প্রবর্তনের মাধ্যমে এসব দেশের সব পণ্যের জন্য শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা দেয়া; ২। কানকুন সম্মেলনের মধ্যে বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট সব ইস্যুর সমাধান এবং স্বল্পোন্নত দেশের জন্য স্পেশাল ও ডিফারেন্সিয়াল ট্রিটমেন্ট প্রথার ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটানো; ৩। বিশ্ব শ্রম বাজারে অদক্ষ ও আধা-দক্ষ শ্রমিকের অস্থায়ী চলাচল অবাধ করার লক্ষ্যে পেশাগত দক্ষতার স্বীকৃতি প্রদান, ভিসা পদ্ধতি সহজকরণ এবং ইকোনমিক নিড টেস্টের প্রশ্ন উত্থাপন না করা; ৪। স্বল্পোন্নত দেশের নিজস্ব অগ্রগতি, আর্থিক ও বাণিজ্যিক চাহিদা কিংবা প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা অনুসারে প্রতিশ্রুতি প্রদান ও বাধ্যবাধকতা পালনে নমনীয় থাকা; ৫। স্বল্পোন্নত দেশের উৎপাদন ও রফতানিভিত্তিক উন্নয়ন এবং রফতানি ভিত্তির বহুমুখীকরণ ও শক্তিশালীকরণে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি করা; ৬। স্বল্পোন্নত দেশের সরবরাহ ঘাটতি দূর করা, রফতানি ভিত্তির সম্প্রসারণ করা এবং আর্থিক সম্পদ প্রাপ্তি উন্নয়নের প্রক্রিয়া সহজতর করার জন্য অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধির মাধ্যমে সম িন্বত কাঠামো শক্তিশালী করা; ৭। অ্যান্টি জাম্পিং, কাউন্টারডেইলিং ও নিজেদের পণ্য সুরক্ষার পদক্ষেপ থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে অব্যাহতি প্রদান; ৮। এমএফএন শুল্ক কমানোর কারণে প্রেফারেন্স মার্জিন কমার বিষয়টি সমাধানের জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণমূলক পদ্ধতি ও অন্যান্য কার্যক্রম উদ্ভাবন করা; ৯। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় স্বল্পোন্নত দেশের প্রবেশাধিকার নীতিমালা দ্রুত কার্যকর ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন; ১০। স্বল্পোন্নত দেশের উন্নয়নে সিঙ্গাপুর সম্মেলনের প্রভাব নিরূপণের লক্ষ্যে কার্যক্রম ও সমীক্ষা চালু রাখা; ১১। ক্ষুদ্র অর্র্থনীতি ও স্থলবেষ্টিত দেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশ চরম দুর্দশা উত্তরণে সহায়তার লক্ষ্যে কৌশল উদ্ভাবন করা; ১২। জেনেটিক, সম্পদ, প্রচলিত জ্ঞান ও কৃষকের অধিকার সংরক্ষণ এবং সব জীবিত বস্তুর স্বত্বাধিকার ট্রিপস চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত না হওয়া নিশ্চিত করার আন্তর্জাতিক কৌশল বলবৎ করা; ১৩। রোগের ওপর ভিত্তি না করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ওষুধ শিল্পের বাধ্যতামূলক লাইসেন্সিং সমস্যার সমাধান করা। স্বল্পোন্নত দেশের পক্ষ থেকে এসব দাবি আগামী সেপ্টেম্বরে মেক্সিকোর কানকুনে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সম্মেলনে উপস্থাপন করা হবে। ন্যায্য ও পক্ষপাতহীন সুবিধা পেতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জোরালো রাজনৈতিক ইচ্ছা ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ, বিশ্ব বাণিজ্যে স্বল্পোন্নত দেশের অংশগ্রহণ বাড়ানোর অভিন্ন লক্ষ্য অর্জন, এসব দেশের জোরালো রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও একযোগে কাজ করার আকাক্ষা থাকা এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে নিজেদের সামর্থ্য ও বিশেষজ্ঞ জ্ঞান উন্নত করা প্রয়োজন।


বর্তমান বিশ্বের ১২০ কোটি মানুষ দৈনিক এক মার্কিন ডলারেরও কম আয়ে চরম দারিদ্র্যসীমায় বসবাস করছে। এসব মানুষের অধিকাংশের ঠিকানা ৪৯টি স্বল্পোন্নত দেশ। আঙ্কটাড-এর এক হিসাব অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি চরম দরিদ্র। দ্রুত জরুরি কোনো পদক্ষেপ নেয়া না হলে স্বল্পোন্নত দেশে দারিদ্র্য এক-তৃতীয়াংশ বেড়ে যাবে। অর্থনীতির চালিকাশক্তির হিসাবে বাণিজ্যের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জীবিকার প্রধান খাত হচ্ছে কৃষি। বহির্বাণিজ্যে এই খাতটি কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। উন্নত দেশের বাধার কারণে আমাদের কৃষিপণ্য ঢুকতে পারে না। কানকুন সম্মেলনে শিল্পোন্নত ও ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে খুব সহজে সুবিধা আদায় করা সহজ হবে না। তাদের কৌশল, চালাকি ও মেধার কাছে স্বল্পোন্নত দেশের এঁটে ওঠা কঠিন হয়ে পড়বে। স্বল্পোন্নত দেশকে সঠিক নেতৃত্ব প্রদান এবং তীক্ষন মেধা ও যুক্তির ছুরিতে প্রতিপক্ষকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়ার মতো বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দারুণভাবে অনুভূত হচ্ছে। তারপরও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে ন্যায্য ও পক্ষপাতহীন সুবিধা পেতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জোরালো রাজনৈতিক ইচ্ছা ও সমনি¦ত উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে নিজেদের সামর্থ্য মেলে ধরতে হবে। কানকুন সম্মেলনে স্বল্পোন্নত দেশগুলো কতটা কি আদায় করতে পারবে- সেটা বলা মুশকিল। তবে বিশ্বায়নের গোলকধাঁধা থেকে রেহাই পেতে হলে বাংলাদেশকে দাঁড়াতে হবে নিজের পায়ে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজের অবস্থান করে নিতে হলে বাংলাদেশকে তাকাতে হবে সামনের দিকে। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল, আইন-শৃ´খলা পরিস্থিতির উন্নতি, চাঁদাবাজি, মাস্তানি, কথায় কথায় হরতাল, ধর্মঘট বন্ধ, পানি-গ্যাস-বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে গার্মেন্টসসহ রফতানিযোগ্য পণ্যের বাজার শক্তিশালী করা প্রয়োজন। কেননা, বাংলাদেশে শ্রম সহজ, সুলভ ও সস্তায় পাওয়া যায়। এটাকে পুঁজি করে অবাধ শ্রমের বাজারে প্রতিদ্বন্দি্বতা করে টিকে থাকতে চেষ্টা করাটাই হবে বাংলাদেশের জন্য সর্বোত্তম পথ। 

দৈনিক সংবাদ : ৪ জুলাই ২০০৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন