পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

রবিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৩

ইরাকে আগ্রাসন এবং আমাদের শিক্ষা


ইরাকে মার্কিন-বৃটিশ হানাদার বাহিনীর আগ্রাসন ও দখলদারিত্বে পরাধীনতার গ্লানিতে ভুগছেন ইরাকের পাশাপাশি আরববাসীরাও। কিন্তু আগ্রাসী ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীকে ইরাকের মাটিতে স্বাগত জানিয়েছে শিয়া সম্প্রদায় ও কুর্দি গোষ্ঠী। মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, কেন তারা এমনতরো নিন্দনীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো? নিশ্চয়ই এর পেছনে এমন কোনো নিগূঢ় কারণ আছে- যে জন্য তাঁরা দখলদার বাহিনীকে বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছে। এই দুই গোষ্ঠী ক্ষমতা থেকে অপসারিত ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের দুই যুগের শাসন ও শোষণে নিপীড়িত, বঞ্চিত এবং এক ধরনের পরাধীন জীবনযাপন করেছে। যদিও শিয়া সম্প্রদায় জনসংখ্যার দিক দিয়ে ইরাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে আচরণ করা হয়েছে সংখ্যালঘুর মতো। দমন-পীড়ন চালিয়ে সর্বদা তাদের ব্যতিব্যস্ত রাখা হয়েছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকসহ মূল স্রোতধারায় তাঁরা কখনই সুবিধা করতে পারেনি। বরং তারা যাতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য তাঁদের ওপর চালানো হয় নানান রকম নির্যাতন ও নিগ্রহ। রাসায়নিক গ্যাস প্রয়োগ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার কুর্দিকে। এ কথা তো সর্বজনবিদিত, শাসক হিসেবে সাদ্দাম হোসেন ছিলেন একরোখা ও স্বৈরাচারী মনোভাবাপন্ন। সামান্য এদিক-সেদিক হলে দূরের মানুষ তো বটেই, রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়-স্বজনকেও পৃথিবী থেকে চিরতরে সরিয়ে দিতে একটুও কার্পণ্য করতেন না। তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, মিসরের জামাল আব্দুল নাসেরের মতো তিনি আরব জাতীয়তাবাদী নেতা হতে চাইলেও তাঁর এসব দুর্বলতার কারণে তিনি ক্রমান্বয়ে ইসলামী দেশগুলোর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন। ইরানের সঙ্গে বছর আটেক ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে এবং কুয়েতে অনর্থক আগ্রাসন চালিয়ে আরব বিশ্বে তিনি রীতিমত আতংকের কারণ হয়ে দাঁড়ান। এ কারণে প্রতিবেশী দেশ ইরান, কুয়েত, সৌদি আরব, জর্ডান, মিসর, তুরস্ক প্রভৃতি আরব দেশগুলোর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা মোটেও স্বাভাবিক ছিল না। মার্কিন-বৃটিশ বাহিনী আগ্রাসী শক্তি হিসেবে নির্লজ্জের মতো ইরাকে হামলা চালালেও এর প্রতিবাদে এক সিরিয়া ছাড়া আর কোনো আরব রাষ্ট্র টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেনি, এমনকি কোনো কোনো দেশ এক ধরনের পুলক অনুভব করেছে। তারা মনে-প্রাণে চেয়েছে সাদ্দাম-যুগের অবসান। সঙ্গত কারণে নিপীড়িত, লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত শিয়া সম্প্রদায় এবং কুর্দিরা তাৎক্ষণিক‘মুক্তি’র উল্লাসে তাদের বরণ করে নিয়েছে। মার্কিন ও বৃটিশ বাহিনী যে মাত্র ২০ দিনে ইরাক দখল করতে পেরেছে, সেক্ষেত্রে তাদের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র এবং ইরাককে জাতিসংঘের মাধ্যমে দুর্বল ও নিরস্ত্রীকরণের বড় ভূমিকা অবশ্যই ছিল। তদুপরি সংখ্যালঘু কুর্দি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়াদের নির্লিপ্ত এবং বিদ্রোহী ভূমিকা ইরাককে পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ করতে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর জন্য সহজ হয়েছে। কোনো কোনো আরব দেশের নীরব সমর্থন এবং শিয়া ও কুর্দিদের উল্লসিত ভূমিকায় মার্কিন-বৃটিশ বাহিনীর আগ্রাসন জায়েজ হয়েছে তা বলা যাবে না। তবে আগ্রাসী বাহিনী যখন একের পর এক ইরাকের ভূখণ্ড দখল করে নিতে থাকে, ঠিক তখন শিয়া ও কুর্দিরা যেভাবে তাদের সুস্বাগতম জানিয়েছে এবং পাশ্চাত্যের টেলিভিশনের পর্দায় তা যেভাবে ঢালাওভাবে সম্প্রচারিত হয়েছে, তা ছিল অবশ্যই দৃষ্টিকটু। তারা যেভাবে লুটতরাজ, ভাংচুর ও সহিংসতার পথ বেছে নেয়, তাতে বিশ্ববাসী বিহ্বল ও হতবাক হয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে এ ঘটনায় তাদের সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী মনে হতে পারে। কিন্তু শিয়া ও কুর্দিদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিশ্লেষণ করলে তাদের উচ্ছৃংখল আচরণের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। দেয়ালে পিঠ ঠেঁকে গেলে মানুষ তখন প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে চরমতম পথ বেছে নিতে দ্বিধা করে না। আবার অবস্থার পরিবর্তন হলে তারা ফিরে আসে স্বাভাবিক জীবনধারায়। তখন হিসাব কষে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করেন। শিয়া ও কুর্দিরা যখন বুঝতে পেরেছে, তারা বাঘের মুখ থেকে সিংহের মুখে পড়েছে, তখনই তাদের মোহভঙ্গ ঘটে যায়। প্রথম কিছুদিন মার্কিন ও বৃটিশ বাহিনীকে স্বাগত জানালেও শিয়া ও কুর্দিরা এখন আর ইরাকের মাটিতে তাদের দেখতে চায় না। ইরাকে দখলদার মার্কিন-বৃটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও বিষোদগার ক্রমশঃ বাড়ছে। তারা মার্কিন বাহিনীকে অবিলম্বে ইরাক ত্যাগের দাবি জানিয়েছে। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা সাদ্দাম হোসেনের পতন কামনা করলেও শাসক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে কখনো মেনে নেবে না। ইরাকের ঘটনায় একটি অভিজ্ঞতা বা শিক্ষা বিশ্ববাসীর অন্তত হয়েছে যে, দেশের একটি অংশকে ক্ষুব্ধ করে কিংবা দমিয়ে রেখে দেশ পরিচালনার বিষয়টি নতুন করে ভেবে দেখার সময় এসেছে। ইরাকে আগ্রাসন-পরবর্তী নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় ‘জোর যার মুল্লুক তার’ মনোভাবের কারণে যে কোনো দেশই যে কোনো সময় আক্রান্ত হতে পারে। সে জন্য দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য যে কোনো হুমকি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট সবার সতর্ক থাকলেই শুধু চলবে না, এ জন্য বৃহত্তর রাজনৈতিক ও জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। আর এ জন্য দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সর্বজনীন চেতনা ও ঐক্যের মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। সে ক্ষেত্রে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ না করে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব-মৈত্রী-সম্প্রীতির সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। সবার আগে ভেবে দেখতে হবে, কোনো রকম বৈষম্য যেন দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা বা অন্তরায় না হয়ে দাঁড়ায়। কোনো জনগোষ্ঠীর মনে যেন পুঞ্জিভূত ক্ষোভের সৃষ্টি না হয়, যাতে তারা নিজেদের অসহায় ও বঞ্চিত মনে করে। বাংলাদেশে নানা সম্প্রদায়ের বসবাস। এ দেশের জনগণের গরিষ্ঠ অংশ মুসলমান। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের আচার-আচরণ ও মনোভাবে এমনটি যাতে প্রতিফলিত না হয়, যেন তারা সর্বেসর্বা। এমনটি হলে সংখ্যালঘুরা মানসিকভাবে হীনমন্যতায় ভুগতে পারে। তাহলে দেশের মধ্যে একটা বিভেদের দেয়াল সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আর তাহলে সেটা হবে নিজের পায়েই কুড়াল মারার শামিল। আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রের ছোট্ট একটি দেশ বাংলাদেশ। অনগ্রসরতা ও সামরিক শক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান খুবই নাজুক। শক্তি ও সামর্থ্যে প্রতিবেশী দেশগুলো আমাদের তুলনায় যথেষ্ট শক্তিশালী বলে আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হয়। যে কোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধ বা সংঘাতে আমরা কতটা কী করতে পারবো- তা বলা দুষ্কর। যদিও ১৯৭১ সালে আমরা পাকিস্তানের বিপক্ষে যুদ্ধ করে জিতেছি। সেটি মুক্তিযুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তখনকার সঙ্গে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির ঢের ঢের তফাৎ। বিশ্বশক্তি এককেন্দ্রিক হয়ে পড়ায় এখন কারো নিঃস্বার্থ সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া সহজ নয়। সামরিক সমর্থন ছাড়া শুধু মানসিক শক্তি দিয়ে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার দিন এখন অতীত হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে দেশের মানুষ যদি এক সূতোয় গাঁথা মালা হয়ে আগ্রাসী শক্তির বিপক্ষে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়, তাহলে আঘাত হানার আগে প্রতিপক্ষকে একাধিকবার ভাবতে হবে। অবশ্য ১৯৭১ সালে আমাদের অভিজ্ঞতাও যথেষ্ট তিক্ততায় ভরা। এদেশের জনগোষ্ঠীর একটি অংশ হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সর্বাত্মক সাহায্য ও সহযোগিতা করে নিজের দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। অতীতের সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের অবশ্যই শিক্ষা নিতে হবে। বিশেষ করে, বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আমাদের সদর্থক ভাবনার দিগন্তকে প্রসারিত করতে হবে। এটা অন্তত বুঝতে হবে- মাতৃভূমির সাথে বেঈমানি করে সভ্য মানুষ হিসেবে নিজেদের দাবি করা যায় না। ইরাকে আগ্রাসনের ঘটনায় আমরা দেখতে পেয়েছি, শান্তির প্রতি এবং নিজ দেশের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ ও ভালোবাসা অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে দেশে দেশে আত্মরক্ষার নতুন কৌশল নিয়ে ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে, ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতাকারী চারটি ইউরোপীয় দেশ ২৯ এপ্রিল ২০০৩ নিজেদের মধ্যকার সামরিক বন্ধনকে অধিকতর সুদৃঢ় করার বিষয়ে আলোচনার জন্য ব্রাসেলসে এক শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে এই দেশ চারটি অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করায় যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেনের সঙ্গে তাদের মন-কষাকষির সূত্রপাত ঘটে। ফ্রান্স, জার্মানি, লুক্সেমবার্গ ও বেলজিয়াম- এই চারটি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশ ইরাকে হামলা এবং তার পরিণতি মূল্যায়নপূর্বক উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিজেদের মধ্যে প্রতিরক্ষার বন্ধন জোরদার করার উদ্যোগ নিচ্ছে।


ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বাধুনিক ও ভয়ংকর সব অস্ত্রের যে প্রদর্শনী করেছে এবং যে উপায়ে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে ঠুঁটো জগন্নাথ ও বিশ্ব জনমতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইরাকে হামলা চালিয়েছে, তাতে ইউরোপীয় এই দেশগুলো বিচলিত ও ক্ষুব্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভয়ংকর আগ্রাসী চেহারাদৃষ্টে এই দেশ চতুষ্ঠয়ের নেতারা উপলব্ধি করেছেন যে, বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় শক্তির ভারসাম্য রচিত না হলে ইরাকের মতোই অন্য সবার জন্য মহাবিপদ অপেক্ষা করবে মাত্র। ইউরোপীয় এই চারটি দেশের এই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা অন্য সবাইকেও স্পর্শ করছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশও নিশ্চয়ই পিছিয়ে থাকবে না। বাংলাদেশের জন্য আশার কথা, মানব সম্পদের দিক দিয়ে দেশটি সমৃদ্ধ। যে কোনো বিচারে ১৪ কোটি লোক বাংলাদেশের জন্য একটি বড় শক্তি। এই শক্তিকে বিভক্ত ও বিভাজন না করে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের আলোকে দেশকে পরিচালনা করা হলে শুধু দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থানেরই উন্নতি হবে না, একই সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লাল-সবুজ পতাকা সমুন্নত থাকবে।

দৈনিক প্রথম আলো : ৪ জুন ২০০৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন