পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

রবিবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৩

জাতিসংঘ : নিধিরাম সর্দার


ধ্বংসের মাঝে যেমনভাবে জেগে ওঠে প্রাণের স্পন্দন, তেমনিভাবে বিশ্ব বিবেকের চৈতন্য জাগ্রত করে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মাঝেই অনুভূত হয় পৃথিবীকে ‘একটি শান্তির নীড়’ হিসেবে গড়ে তোলার তাগিদ। এগিয়ে আসেন শান্তিকামীরা। মানবতাবাদীরা। তাঁরা সোচ্চার কণ্ঠে বলেন : ‘আমরা যুদ্ধ চাই না, চাই শান্তি।’ একই সঙ্গে আরেকটি যুদ্ধ রোধের পাশাপাশি নানান সমস্যা সম্মিলিতভাবে সমাধানের কথা ব্যক্ত হয়। এরই আলোকে শান্তি, ন্যায়বিচার ও মানব মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে ‘জাতিসংঘ’ নামের প্রথম ধারণা দেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট। জার্মানি, ইতালি ও জাপানের মিলিত আগ্রাসী শক্তি যখন বিশ্বকে নিজেদের হাতের মুঠোয় বন্দি করতে উদ্ধত, ঠিক তখন ‘জাতিসংঘ’ ধারণা মিত্র জোটের কাছে বাস্তব হয়ে ওঠে। ১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি ‘জাতিসংঘ ঘোষণা’য় স্বাক্ষর করে ২৬টি রাষ্ট্র। এ ঘোষণাকে সুনির্দিষ্টভাবে কার্যকর করে তোলার লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল সানফ্রান্সিসকোতে আহ্বান করা হয় ‘একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন প্রশ্নে জাতিসমূহের সম্মেলন’। ‘বিগ ফোর পাওয়ার’ খ্যাত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনসহ ২৬টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সম্মেলনের শেষ দিন ২৬ জুন গৃহীত হয় ‘জাতিসংঘ সনদ’। ৫১টি সদস্য রাষ্ট্র দিয়ে শুরু হয় জাতিসংঘের যাত্রা। জাতিসংঘের মূল টার্গেট আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখা। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানব কল্যাণের ক্ষেত্রে সমস্যাসমূহ সমাধানে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা। সেই সঙ্গে মানবাধিকার ও মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ জাগানো। তবে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘের কার্যক্রম শুরু হয়। জাতিসংঘের মূল সংস্থার নাম সাধারণ পরিষদ। জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সাধারণ পরিষদ গঠিত হয়।

বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ১৫৯। এছাড়া জাতিসংঘের প্রধান পাঁচটি অঙ্গসংস্থা হলো নিরাপত্তা পরিষদ, আন্তর্জাতিক বিচারালয়, অছি পরিষদ, সচিবালয় এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য সংখ্যা ১৫। এর মধ্যে আবার স্থায়ী সদস্যদের সংখ্যা ৫। এরা হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন। এদের প্রত্যেকের ‘ভেটো’ ক্ষমতা রয়েছে। যে কোনো একটি সদস্য রাষ্ট্র কোনো প্রস্তাবের বিপক্ষে কিংবা ভোটদান থেকে বিরত থাকলে সে সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে না। ১৫ জন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক আদালত সাধারণ পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ বা জাতিসংঘের অন্য কোনো সংস্থাকে আইন সম্পর্কিত ব্যাপারে উপদেশের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের মধ্যে বিরোধের আইনগত দিকটি দেখে থাকে। জাতিসংঘের হাতে অর্পিত আÍনিয়ন্ত্রণ অধিকারবঞ্চিত জাতিসমূহের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং তাদের স্বাধীনতা লাভের যোগ্য হতে সাহায্য করাই অছি পরিষদের কাজ। আন্তর্জাতিক বেসামরিক কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে জাতিসংঘের স্বার্থরক্ষা ও কাজ-কর্ম চালানোর জন্যই জাতিসংঘ সচিবালয়। মহাসচিব সচিবালয়ের প্রধান। নিরাপত্তা পরিষদের সুপারিশক্রমে সাধারণ পরিষদ মহাসচিব নিয়োগদান করে। মহাসচিব বেতনভোগী কর্মচারী হলেও তাঁর পদমর্যাদা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায়, তিনিই দুনিয়ার একমাত্র ‘বৈধ শাসনকর্তা’। অবশ্য বাস্তবক্ষেত্রে শাসন কতটা করতে পারেন সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। ১৯৪৬ সালে জাতিসংঘের প্রথম অধিবেশনের শুরুতে নরওয়ের ট্রিগ্রভি লিকে পাঁচ বছরের জন্য জাতিসংঘের প্রথম মহাসচিব নিয়োগ করা হয়। পরবর্তীতে এই মেয়াদ তিন বছরের জন্য বাড়ানো হয়। কিন্তু এর তীব্র সমালোচনা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। যে কারণে লি ১৯৫২ সালে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৩ সালে তাঁর উত্তরাধিকারী হয়ে আসেন সুইডেনের ড্যাগ হ্যামারশোল্ড। ১৯৫৭ সালে তিনি পুনরায় নির্বাচিত হন। তবে ১৯৬১ সালের সেপ্টেম্বরে রোডেশিয়ার উত্তরাঞ্চলে (বর্তমানে জাম্বিয়া) এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন তিনি। এ সময় মহাসচিব নিয়ে তুমুল বাদানুবাদ চলে। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাব রাখে, তিন সদস্যের কমিটি সচিবালয়ের দায়িত্বে থাকবে। তবে সব বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে বর্মার উ থান্ট সব পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হন। এ কারণে ১৯৬৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য পুনরায় সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের শেষ নাগাদ নির্বাচিত হন অস্ট্রিয়ার কুর্ট ওয়ার্ল্ডহেইম। তিনি দু’মেয়াদে কাজ করেন। তারপর ১৯৮২ সালে আসেন হাভিয়ার পেরেজ দ্য কোয়েয়ার। সবশেষে মিসরের বুয়েট্রেস ঘালি জাতিসংঘ মহাসচিব হিসেবে সবেমাত্র নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন পেয়েছেন।
মহাসচিব পদ নিয়ে কাড়াকাড়ি জাতিসংঘের শুরু থেকেই। নিজেদের প্রভাব ও আধিপত্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে মূল হাতিয়ার মহাসচিব। এই পদ নিয়ে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দীর্ঘদিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে আসছে। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরে দাঁড়ানোর ফলে এবার মহাসচিব নির্বাচনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ঝামেলা দেখা দেয়নি। অনেক প্রতিদ্বন্দ্বীর মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের আশীর্বাদে ঘালি লোভনীয় পদটি বাগিয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দারিদ্রপীড়িত, ক্ষুধার্ত ও নিরক্ষর জনগণের কল্যাণ সাধন করে বিশ্ব শান্তি সুসংহত করাই অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্থার কাজ। আর এ জন্য জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি সংস্থা গঠন করা হয়েছে। এই সংস্থাগুলো অনুন্নত দেশগুলোকে সাহায্য এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষাবিষয়ক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে থাকে। এর মধ্যে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ‘ইউনেস্কো’, খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ‘ফাও’, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ‘আইএলও’, শিশুদের আন্তর্জাতিক তহবিল ‘ইউনিসেফ’, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘হু’, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ‘আইএমএফ’ উল্লেখযোগ্য।
একটি মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জাতিসংঘ গড়ে উঠেছে। এখন জাতিসংঘের নেটওয়ার্ক বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। জাতিসংঘ ভবিষ্যৎ বংশধরদের জীবন সুন্দর, মৌলিক মানবাধিকার ও মানুষের মর্যাদা, সব রাষ্ট্রের সমান অধিকার এবং বিশ্বের জাতিসমূহের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি সাধনের জন্য কাজ করে আসছে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে জাতিসংঘ ‘আশার স্তম্ভ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনগ্রসর দেশগুলোর পাশে জাতিসংঘ বন্ধুর মতো পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। যদিও সীমিত সাধ্য ও ‘পরনির্ভরশীল’ হওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই জাতিসংঘ প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারে না। তবুও এর মাঝে তাদের কার্যক্রম প্রশংসার দাবি রাখে।

জাতিসংঘের ৪৬ বছরের ইতিহাসে সাফল্য যেমন আছে, তেমন ব্যর্থতাও অনেক। কেননা জাতিসংঘের হাত-পা এক জায়গায় বাঁধা। জাতিসংঘ পরিচালিত হয় সাধারণ পরিষদের সদস্যদের চাঁদায়। প্রতিটি রাষ্ট্রের সামর্থ্য ও সাধারণ অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে নির্ধারিত হয় চাঁদার হার। প্রতিটি দেশকেই কম-বেশি চাঁদা দিতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের বৃহত্তম চাঁদাদাতা দেশ। শুরুতে জাতিসংঘের মোট বাজেটের ৪৯ শতাংশ আসতো যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনুরোধে তাদের চাঁদার হার ১৯৮২ সালে নামিয়ে আনা হয়। শেষ অবধি তা ২৫ শতাংশে দাঁড়ায়। ১৯৫৫ সালের পর থেকে জাতিসংঘের সদস্যপদ দ্রুত বাড়তে থাকায় জাতিসংঘের বাজেটে ঘাটতি পড়ে যায়। নতুন সদস্যদের অধিকাংশই অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। সবাই জাতিসংঘের সাহায্যের জন্য উন্মুখ থাকে। সাহায্য প্রদানে সবার ক্ষেত্রে সমান নজর দেওয়া সম্ভব হয় না। এছাড়াও বৃহৎ শক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। বিশেষ করে মার্কিন প্রভাবাধীন দেশগুলো এক্ষেত্রে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছে। এর কারণ আগেই বলা হয়েছে। জাতিসংঘের আয়ের প্রধান উৎস যুক্তরাষ্ট্র। তাদেরকে চটিয়ে জাতিসংঘের পক্ষে কিছু করা কঠিন। এ যাবৎ জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকারীরা ছিলেন মার্কিন আজ্ঞাবহ। তাঁরা স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। মার্কিন স্বার্থকেই বরাবর অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের উদ্দেশ্য এ কারণে অনেকাংশে ক্ষুণ্ন হয়ে পড়েছে। কেননা মার্কিন তাঁবেদার রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান হলে জাতিসংঘের ভূমিকা থাকে এক রকম। আবার মার্কিনবিরোধী দেশে অন্যরকম। এ অবস্থা থেকে জাতিসংঘের বের হওয়া কঠিন। ইউনেস্কো স্বাধীনভাবে একবার কাজ করতে গিয়ে সংকটে নিপতিত হয়। কেননা যুক্তরাষ্ট্র ইউনেস্কো থেকে বেরিয়ে আসে। তাছাড়া সুপার পাওয়ারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ হয়ে পড়ায় তারা এখন এককভাবে খোলা মাঠে গোল দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের একচেটিয়া দাপটের কারণে জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। জাতিসংঘ নিজেদের মতো করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। দেশে দেশে যুদ্ধ বিগ্রহ-হানাহানির ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা অনেকটা অসহায় দর্শকের মতো। আদতে জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো শক্তি নেই। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মনোভাব বুঝে তাকে অগ্রসর হতে হয়। কথায় বলে, ‘ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, নিধিরাম সর্দার’। জাতিসংঘ হচ্ছে অবিকল তাই। তবে নানান সমস্যার মাঝে বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ ভারসাম্যমূলক পরিস্থিতি বজায় রাখছে। অনেক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে জাতিসংঘ। আজ বিশ্বে যে শান্তিময় পরিবেশ বিরাজ করছে তার মূলে জাতিসংঘেরও যথেষ্ট অবদান রয়েছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।


দৈনিক বাংলার বাণী : ২৯ নভেম্বর ১৯৯১

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন