পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৩

অলৌকিক নয়, চাই লৌকিক ক্ষমতা


ইরাকে মার্কিন-ব্রিটিশ বাহিনীর আগ্রাসন ও দখলদারিত্বে আমাদের একরৈখিক চিন্তার পুকুরে যেন আচানক ঢিল পড়েছে। তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়েছে চিন্তাস্রোত। এতদিন যুক্তিহীনভাবে যে আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠেছি, তা যেন হঠাৎ আমাদের মর্মমূল আমূল কাঁপিয়ে দিয়েছে। আমরা যে সত্যকে পরম নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় বুকের মাঝে লালন করে এসেছি, তা যে এভাবে মিথ্যে হয়ে যাবে, তার জন্য আমরা অনেকেই মানসিকভাবে মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। শুধু সমৃদ্ধ সভ্যতার কারণেই নয়, আধ্যাÍিকতার দিক দিয়েও পুণ্যভূমি ইরাক। এককালের মেসোপটেমিয়ায় শায়িত আছেন যারা মনুষ্যত্বের গান গেয়েছেন, মানব জীবনের মহিমা ও মানুষের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা জ্বালিয়েছেন এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে পথ-প্রদর্শক হয়েছেন- সেসব আধ্যািত্মক, বুজুর্গ ও বরেণ্য ব্যক্তিত্বরা। এই মহামানবদের কেউ কেউ অপরিসীম জ্ঞান, সমুচ্চ মর্যাদা, দূরদৃষ্টি, সূক্ষ্ম চিন্তাশক্তি, উন্নত মানবতাবোধ, সাহস, ধৈর্যশক্তি, অতুলনীয় শারীরিক বল, অফুরন্ত মনোবল, রণ-নিপুণতা এবং কখনো-সখনো আধ্যািত্মক ও অলৌকিক শক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষের হৃদয়-মন জয় করার পাশাপাশি এমন সব অসম্ভব কীর্তি দিয়ে সবাইকে বিস্ময়াভিভূত করেছেন, যে কারণে তারা চিরস্মরণীয় ও কিংবদন্তী হয়ে আছেন। মুসলমানদের পুণ্যতীর্থ এবং বিশ্বের তাবৎ মানুষের কাছে সভ্যতার পাদপীঠ হিসেবে বিবেচিত ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটিশ বাহিনী যখন আগ্রাসন চালানোর হুমকি-ধমকি দিতে থাকে, তখন বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলিম ধর্মানুরাগীরা এক প্রকার ধরেই নেন, আগ্রাসী শক্তির পক্ষে ইরাকে নাক গলানো সম্ভব হবে না। সব নিয়ম-নীতি লংঘন করে যৌথ বাহিনী ইরাকের ওপর হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেও ধর্মানুরাগীদের অটল বিশ্বাসে একটুও টাল খায়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য শক্তির দিক দিয়ে যতই অপ্রতিদ্বন্দ¡ী হোক না কেন, সবার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আগ্রাসী বাহিনীর পক্ষে ইরাককে কাবু করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিমূল ছিল, ইরাকি জনগণের জিহাদি মনোবল, আধ্যাÍিক চেতনা এবং অতীতের সেইসব অলৌকিক কাহিনী- যা বুকের মাঝে অটল পর্বতের মতো চিরঞ্জীব হয়ে আছে। বছরের পর বছর ধরে শিক্ষিত-অশিক্ষিত অধিকাংশ মানুষের মনে এমন একটা ধারণা বা বিশ্বাস গেড়ে বসে আছে- আরব ভূমিতে আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব করতে আসলে হামলাকারীরা হার মানবে আধ্যাÍিক ও অলৌকিক শক্তির কাছে। এমন একটা বিশ্বাস থেকে তাদের মনে এই প্রতীতী সৃষ্টি হয় যে, ইরাককে কখনোই পরাধীন করা যাবে না। এ কারণে যুদ্ধের শুরু থেকেই অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অধিকাংশ পত্র-পত্রিকা মানুষের সস্তা আবেগকে কাজে লাগিয়ে বিভ্রান্ত করার পথ বেছে নেয়। এতে হয়তো পত্র-পত্রিকার কাটতি বেড়েছে; কিন্তু নষ্ট হয়েছে বিশ্বাসযোগ্যতা। বিবিসি, সিএনএনসহ পাশ্চাত্য মিডিয়ার একতরফা প্রচারণায় তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাও অনেকখানি ম্লান হয়ে যায়। মিডিয়ার তথ্য পরিবেশনের মূল কথা হচ্ছে- বস্তুনিষ্ঠতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা। কারো পক্ষাবলম্বন না করে উভয় পক্ষের ঘটনা ও বক্তব্য যথাযথভাবে তুলে ধরা। এমনটি না করায় পাশ্চাত্য মিডিয়া তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও ভাবমূর্তি হারিয়েছে। যে কারণে কিছু কিছু ঘটনা অতিরঞ্জনের পাশাপাশি অনেক সত্য ঘটনা তুলে ধরলেও তা দর্শক ও পাঠকদের আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে পাশ্চাত্য মিডিয়ার একপেশে ভূমিকায় ক্ষোভ ও বিক্ষোভ- দুই-ই হয়েছে। কিন্তু তাদের কাউন্টার করতে যেয়ে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাগুলোর ভূমিকাটাইবা কেমন ছিল? এ প্রশ্নটি সঙ্গত কারণে ওঠাই স্বাভাবিক। মার্কিন-ব্রিটিশ আগ্রাসনের শুরু থেকেই বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাগুলো এমন একটা ধারণা দিতে থাকে যেন ইরাকের মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নেবে দুর্বৃত্ত। আট কলাম শিরোনামে যেসব ব্যানার হেডিং করা হয়েছে, তাতে ইরাকের ছোট-খাট সাফল্যকে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে, তাতে মনে হয়েছে মার্কিন বাহিনী মোটেও সুবিধা করতে পারছে না। তারা ক্রমাগত পিছু হটছে। আতংকে ভুগছে। অস্ত্র ফুরিয়ে বিপদে আছে- ইত্যাদি। এমনকি কিছু কিছু ঘটনায় কাল্পনিক, আধা-কাল্পনিক, আধ্যাÍিক ও অলৌকিকতার মিশেল দিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে এমনভাবে পরিবেশন করা হয়েছে, মানুষ তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। ভেবেছে ইরাকের মাটি বুঝিবা সত্যি সত্যি দুর্জয় ঘাঁটি।


যুদ্ধকালীন সময় ‘মরুঝড়’ শুরু হলে তাকে কেন্দ্র করে এমনভাবে মহিমা প্রচার করা হয়, মরুঝড়কে সবাই অলৌকিক শক্তির আধার হিসেবে মনে করতে থাকে। এই রোমাঞ্চকর ও জিহাদি জোশে সংবাদ পরিবেশনে বাংলাদেশের পাঠকরা আকৃষ্ট ও টগবগিয়ে ফুটলেও ইরাকিদের বিন্দুমাত্র লাভ হয়নি। বরং বলা যায়, তেমন কোনো শক্তিশালী প্রতিরোধ ছাড়াই মাত্র ২০ দিনে ইরাক আগ্রাসী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তারা এখন জুলুম ও জবরদস্তি চালাচ্ছে, তাতে বিশ্ব বিবেক কেঁপে উঠলেও এ জন্য তাদের বিন্দুমাত্র কৈফিয়ৎও দিতে হচ্ছে না। মানুষ যে অলৌকিক আশা নিয়ে প্রহর গুনেছিল, তা আর সত্য হয়নি। এতে কি পত্র-পত্রিকা বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা হারায়নি? আসলে বাংলাদেশসহ অধিকাংশ মুসলিম দেশের মানুষকে এখনো আবেগাক্রান্ত করে ইয়েমেনের অমুসলিম বাদশাহ আব্রাহামের হস্তি বাহিনী দিয়ে পবিত্র কাবা শরীফ দখল করতে এসে ঝাঁকে ঝাঁকে আবাবিল পাখির ছোট ছোট প্রস্তরখণ্ডে বিপর্যস্ত ও পরাজিত হওয়া, মিসরের বাদশাহ ফেরাউনকে লোহিত সাগরে অলৌকিকভাবে ডুবিয়ে মারা ইত্যাদি। আসলে ইতিহাসের সেসব অলৌকিক ঘটনা আমাদের পথ দেখালেও এর কী তাৎপর্য- তা সঠিকভাবে অনুধাবন না করে শুধু শুধু কল্পনায় অসাধ্য সাধন করার কোনো মানে হয় না। তাতে কোনো লাভ হয় না অতীতের সঙ্গে বর্তমানকে গুলিয়ে ফেললে। দশক, শতক কিংবা সহস্র বছর আগে যে ঘটনা বা প্রেক্ষাপট বিরাজ করেছে, বর্তমানে বিশ্ব ব্যবস্থায় তার কতটুকুইবা তাৎপর্য আছে? সত্য কথা বলতে কী আধ্যাÍিকতা বা অলৌকিকত্ব দিয়ে কিছু অর্জন করা আদৌ সম্ভব কিনা- সে প্রশ্নটি কাল থেকে কালান্তরে মানুষের মনে অন্তহীন কৌতূহল হয়ে আছে। তাছাড়া ইরাকের জন্য বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা ও শুভ কামনায় একটুও কি টলেছে বুশ ও ব্লেয়ারের কঠিন হৃদয়? যদি তাই হতো তাহলে ইরাককে এভাবে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয় না। দেখতে হয় না আগ্রাসী বাহিনীর বিকৃত উল্লাস। আরব বা ইসলামের ইতিহাস শুধু আধ্যাÍিকতা ও অলৌকিকত্ব প্রদর্শনের ইতিহাস নয়। কেউ কেউ যুগে যুগে আধ্যাÍিকতা ও অলৌকিকত্ব নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এর মহিমা প্রচার করে এসেছেন। মানুষকে সহজ প্রলোভনে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। এতে কার কি লাভ হয়েছে জানি না, তবে আড়ালে পড়ে গেছে আরব ও মুসলমানদের জ্ঞান চর্চার বিকাশ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, অধ্যয়ন, গবেষণা, দর্শন, বিচক্ষণ, দূরদর্শিতা, বীরত্ব ও সাহসিকতা। আজকের নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় ও বিশ্ব বাস্তবতায় যারা দুর্বল, নির্যাতিত ও পরাধীন, তাদের ভাবনার দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চয়ই পাল্টে যাবে। আত্মরক্ষা ও আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে কারো অনুগ্রহ ও আশ্রিত হয়ে স্বাধীনভাবে বসবাস করা যাবে না। এ জন্য জ্ঞান-গরিমায়, মেধায়-পা-িত্যে এগিয়ে আসতে হবে। সময় তো কখনো থমকে থাকে না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এক সময় মুসলমানদের প্রবল দাপট ছিল। তা নিশ্চয়ই শুধু আধ্যাÍিকতা ও অলৌকিকত্ব দিয়ে অর্জিত হয়নি। শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-গরীমায়, শক্তি-সামর্থ্য, কৌশল-কূটনীতি দিয়ে তারা শাসন করেছে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশ। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর আবির্ভাবের ফলে আরবের বুকে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছিল, তার অভিব্যক্তি এভাবে ব্যক্ত করেছেন মনীষী টমাস কার্লাইল : কমর্ দণ ইরটঠ ভর্টধমভ র্ধ ষট্র ট ঠধর্রদ তরমব ঢটরপভণ্র্র ধর্ভম ফধথর্দ, ইরটঠধট তর্ধর্র ঠণডটবণ টফধশণ ঠহ বণটভ্র মত র্ধ. এই যে অন্ধকার থেকে আলোকের রাজ্যে উত্তরণ তা তো এমনি এমনি হয়নি। তিনি মানবিকতা, ন্যায়পরায়ণতা, অহিংসা, সাহস ও ভালোবাসা দিয়ে মানুষের শ্রদ্ধা, ভক্তি, ভালোবাসা ও আনুগত্য অর্জন করেছিলেন। তারপরের ইতিহাস ইসলামের এগিয়ে চলার ইতিহাস। সব সময় চলার পথ যে মসৃণ ছিল তা নয়। স্বার্থের হীন ষড়যন্ত্র, কায়েমী স্বার্থের চক্রান্ত বা নানা দুর্যোগ-দুর্বিপাকের মাঝেও ইসলামের শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবতার পতাকা উড়িয়েছেন হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ), হযরত উসমান (রাঃ), হযরত আলী (রাঃ), উমাইয়া বংশ এবং ইসলামের গৌরব ফলে-ফুলে আরো বিকশিত হয়ে ওঠে স্পেনে। সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞানের অগ্রগতি বিশ্বকে মুগ্ধ করে রেখেছিল। এ কারণে স্পেনকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের ইউরোপ জয় ইতিহাসে অমলিন হয়ে আছে। শৌর্য-বীর্যে একসময় আরবরা ছিল দোর্দণ্ড প্রতাপশালী। স্পেনে মুসলমানরা প্রায় ৭৫০ বছর রাজত্ব এবং আধুনিক ইউরোপের বিকাশ ঘটান। গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর মুসলিম অধ্যুষিত স্পেন ছিল গোটা ইউরোপের প্রাণকেন্দ্র। স্পেনে মুসলমানরা যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোক-কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তা-ই কালের প্রবাহে উন্নত হয়ে ইউরোপীয় মনীষীগণকে জগতসভায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। এ সময় আরব ও ইউরোপীয় সভ্যতার সংযোগে এক উন্নত সভ্যতার সৃষ্টি হয়। স্পেনে দরিদ্র ও দুর্দশাগ্রস্ত নাগরিক, হতভাগ্য ক্রীতদাস, দৈন্য-প্রপীড়িত ভূমিদাস এবং উৎপীড়িত ও অত্যাচারিত সবাই মুক্তির অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন। এ সময় মুসা ইবনে নাসের আফ্রিকা শাসন করছিলেন। স্পেন ও পর্তুগালের সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন রডারিক। রডারিকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্পেনবাসী আফ্রিকান শাসক মুসার শরণাপন্ন হন। দামেশকে খলিফা ওয়ালিদের রাজত্বকালে ৭১১ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিকায় গভর্নর মুসা ইবনে নাসেরের অধীনস্থ সেনাপতি মহাবীর তারিক ইবনে জায়াদ একদল আরবি ও নবদীক্ষিত ফৌজসহ দক্ষিণ স্পেনের একটি অংশ আক্রমণ করেন। যুদ্ধে জয়লাভ করে তারিক স্পেনের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। এই বাহিনী আরো অগ্রসর হয়ে ফ্রান্স পর্যন্ত অগ্রসর হয়। তবে ফ্রান্স জয় করা সম্ভব হয়নি। ৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের রাজধানী কর্ডোভা দখল করে স্বাধীন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন আব্দুর রহমান। আব্দুর রহমান আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশের বিরাট এলাকাজুড়ে এক বিশাল সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটান। তার বিশাল সাম্রাজ্যের সর্বত্র ছিল শান্তি এবং প্রজাদের বিভিন্ন উন্নতি হয়েছিল। তার রাজধানী কর্ডোভা ছিল সভ্যতা ও সংস্কৃতিসমৃদ্ধ এবং ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ নগরী। ইউরোপীয় জাতিগুলোর নব-জাগরণের জন্য তিনিই প্রথম দরজা খুলে দেন। তবে আব্দুর রহমানের পর বংশানুক্রমে হিশাম, হাকাম ও দ্বিতীয় আব্দুর রহমান সিংহাসনে আরোহণ করেন। দ্বিতীয় আব্দুর রহমানের রাজত্বকালে স্পেনের প্রভূত উন্নতি, রাজধানী কর্ডোভা অপরূপ সৌন্দর্য লাভ করে। রাজ্যের সর্বত্র সুন্দর সুন্দর বাগান, সুপ্রশস্ত রাস্তা, সুদৃশ্য ইমারত গড়ে উঠেছিল। কর্ডোভার রাজ-দরবার ছিল তৎকালীন ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান-কেন্দ্র, উন্নত ও মার্জিত সভ্যতা, আদব-কায়দা এবং রীতি-নীতির মিলনস্থল। খলিফা তৃতীয় আব্দুর রহমানের সময় সেখানে মুসলিম শক্তি অত্যন্ত বৃদ্ধি পায় এবং ইউরোপে মুসলমানদের প্রভাব বেড়ে যায়। কনস্ট্যান্টিপোল, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালির সম্রাটগণ তার দরবারে দূত প্রেরণ করে সখ্য স্থাপন করেন। তিনি যেমন সামরিক শক্তিতে গরীয়ান ছিলেন, তেমনি বিদ্যাবত্তা ও গুণ-গরিমার কদর করতেন। তার আমলেই স্পেন সর্বাপেক্ষা সৌন্দর্যম-িত হয়ে ওঠে। অতুলনীয় শোভামণ্ডিত প্রাসাদ নির্মাণসহ অসংখ্য অবকাঠামো গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে দুর্বল শাসকদের কারণে স্পেনে অনেকগুলো স্বাধীন ক্ষুদ্র রাজ্য সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে গ্রানাডা ছিল সর্বোত্তম। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দুর্বল শাসন ব্যবস্থা ও অদূরদর্শিতার কারণে ইউরোপ মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। এমনকি আটশত বছরে তারা যেসব কীর্তি গড়েছিলেন, তার নাম-নিশানা একে একে সবই মুছে ফেলা হয়। স্পেন থেকে বিতাড়িত হয়ে মুসলিম সভ্যতার শেষ আশ্রয় হয় গ্রানাডায়। মুসলমানরা গ্রানাডায় দু’শ বছর রাজত্ব করেছিলেন। এ সময় তিলে তিলে গড়ে তোলা হয় গ্রানাডাকে। প্রস্রবন, কুঞ্জবন ও পুষ্পরাজি সমম্বিত একটি বিস্ময়কর সৌন্দর্য ও বিলাস-ব্যসন ছাড়াও সব দিক দিয়েই গ্রানাডা ছিল পরিপূর্ণ। গ্রানাডার বিপরীত দিকে একটি পর্বত চূড়ায় চল্লিশ হাজার লোকের বসবাসের জন্য যে দুর্গ বা নগরী নির্মাণ করা হয়েছিল, বিশিষ্ট ইসলামী পণ্ডিত সৈয়দ আমীর আলী তার ‘আরব জাতির ইতিহাস গ্রন্থে’ যে বর্ণনা দিয়েছেন- তা হলো এমন : সুউচ্চ চূড়া, দুর্গ ও প্রাসাদ, সূক্ষ্ম ও সুশ্রী স্থাপত্য, মনোরম বারান্দা ও স্তম্ভ, চাকচিক্যময় বিভিন্ন বর্ণের গম্বুজ ও ছাদ- যার প্রাথমিক চাকচিক্য এতটুকু নষ্ট হয়নি, পার্শ্ববর্তী উদ্যানের সুগন্ধি আসতে পারে- এরূপভাবে প্রস্তুত বাতাস ভরা হলঘরগুলো; এর অসংখ্য ঝর্নাধারা, পানিকে ইচ্ছানুরূপ উচ্চ বা নিচ, দৃশ্যমান ও অদৃশ্য, কখনো বাতাসে নিক্ষিপ্ত, আবার কখনো এমনভাবে বৃহৎ লম্বালম্বি খণ্ডে বিস্তৃত করা যেত যে এতে দালান, ঝরণা ও পরিষ্কার নীল আকাশ প্রতিফলিত হতো- মনোরম আরবি লতাপাতা, চিত্রকলা ও পাথরের কারুকার্য এমন যত্ম ও নির্ভুলভাবে সম্পাদিত ও ক্ষুদ্রতম প্রকোষ্ঠটিও মনোমুগ্ধকর এবং সোনালী, প্যাস্টল, হালকা নীল ও কৃষ্ণাভ বেগুনী প্রভৃতি বর্ণে আলোকিত হতো, বিভিন্ন প্রতিকৃতি ও বর্ণের চীনা কারুকার্যবিশিষ্ট দেয়ালে মনোরম নিম্নাংশ, সুন্দর সিংহপ্রসাদ ও এর ১২৮টি সরু ও সুচারু স্তম্ভবিশিষ্ট নিভৃত প্রকোষ্ঠ, এর নীল-সাদা শানে, লাল, নীল ও সোনালী রংয়ের সমন¦য়, কাশ্মীরী শালের নকশার ন্যায় উজ্জ্বল বর্ণের আরবি লতা-পাতা, এর খিলানের ওপর মনোরম মার্বেল পাথরের কারুকার্য, এর সুরম্য গম্বুজগুলো, এর মধ্যস্থলে অবস্থিত বিখ্যাত শ্বেত প্রস্তরের বাটি, মনবিমোহিনী সঙ্গীত প্রকোষ্ঠ- যেখানে দরবারে বসে ওপরের মঞ্চস্থ গায়কদের সঙ্গীত শ্রবণ করা হতো, মনোরম অন্তঃপুর এবং এর সূক্ষ্ম ও সুশ্রী পিতলের জাফরি কারুকার্য, অপূর্ব সুন্দর ছাদ এবং বৃহদাকার কামরাগুলো চুনের কাজের ও ক্ষুদ্রকায় প্রকোষ্ঠের মোচাকৃতি রেখার চমৎকার বর্ণ। শুধু শৌর্য-বীর্য, বীরত্বে-সাহসিকতায় মুসলমানরা সাফল্যের পরিচয় দেয়নি। একই সঙ্গে রসায়ন ও দর্শন, জ্যোতিষ, চিকিৎসা, কাব্যচর্চা, ইতিহাস, বিজ্ঞান, স্থাপত্য, অংক শাস্ত্রসহ সভ্যতার নানা দিকে আলোর মশাল জ্বালিয়েছেন। ইরাক, মিসর, তুরস্কের সভ্যতার যে উজ্জ্বল নিদর্শনের পাশাপাশি লিপি আবিষ্কার, সাংকেতিক অংক চিহ্ন, সাল গণনা করার পদ্ধতি অথবা মাস নির্ধারণ করার উপায় বের করা হয়। সুমেরীয় সভ্যতায় রাজা হামবুরি যে আইন প্রণয়ন করেন, তা ছিল কঠোর; তবে উন্নত সভ্যতার পরিচায়ক। শক্তিশালী রাজ্য নেব্যুক্যাডনেজার ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান তৈরি করেন। নীল নদের অববাহিকায় গড়ে ওঠে মিসরীয় সভ্যতা। মিসরীয়রা মনের কথা ব্যক্ত করার জন্য হাইয়ারোগ্লিফ আবিষ্কার করে। এক এক রকম সাংকেতিক লিপি। লেখার জন্য বিদেশি কালিও তারা তৈরি করেছিল। জমিতে পানি দেয়ার জন্য খাল কেটে চাষের ব্যবস্থা করা হয়। মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগের শহর বাগদাদ বেড়ে উঠেছিল দজলা নদীর তীরে। দ্বিতীয় আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুরের শাসনামলে বাগদাদ হয়ে ওঠে মুসলিম বিশ্বের বাণিজ্য ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। মুসলিম বিশ্বের হাজার হাজার স্থাপত্যবিদ, দক্ষ কারিগরকে লাগানো হয় শহরটির জাঁকালো প্রাসাদ, প্রসিদ্ধ মসজিদ ও রূপকথার বাগানগুলো গড়ে তোলার কাজে। সব দিক দিয়ে সমৃদ্ধির উৎকর্ষ অর্জন করে বাগদাদ। যে ইসলামী পণ্ডিত সভ্যতা ও জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়েছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- আল বিরুনী, আল ফারাবী, ঈমাম গাজ্জালী, ইবনে সিনা, ইবনে রুশদ, ইবনে খালদুন, ওমর খৈয়াম, জালালউদ্দিন রুমী, জাকারিয়া আল রাজী প্রমুখ। ইতিহাসের পেছনে ফিরে তাকানোর উদ্দেশ্য হলো, একসময় যে দেশগুলো সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, বীরত্বে বিশ্বের সেরা দেশে পরিণত হয়েছিল, ইউরোপে নিয়ে এসেছিল রেঁনেসা, সে দেশগুলো এখন ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। বিশেষ করে আরব দেশগুলো এখন পাশ্চাত্যের অলিখিত উপনিবেশে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিল্প-সাহিত্যে, স্থাপত্যে, এমনকি নিরাপত্তা ব্যবস্থার দিক দিয়েও তারা পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। নিজেদের সম্পদের ব্যবহার করার মতো যোগ্যতা ও ক্ষমতা নেই বললেই চলে। যে তেল সম্পদের ওপর আরব দেশগুলোর চাকচিক্য ও জেল্লা, তার নিয়ন্ত্রণ ক্রমান্বয়ে পশ্চিমাদের হাতে চলে যাচ্ছে। যে জন্য লাভের গুড় পিঁপড়ে খেয়ে গেলেও তাদের কোনো বোধোদয় হচ্ছে না। কোথাও রাজতন্ত্র, কোথাও স্বৈরশাসন কায়েম করে জনগণকে ধর্মের আফিম গিলিয়ে রাখা হয়েছে। ক্রমান¦য়ে তারা পরাধীন হয়ে যাচ্ছে।


সৌদি আরব, কুয়েত, কাতারসহ বেশ কয়েকটি দেশে মার্কিন সেনারা ঘাঁটি গেড়েছে। আরব জাতি আজ দ্বিধা-বিভক্ত। আর এ সুযোগেই ইরাক দখল করে নেয়া হয়েছে। অথচ এ নিয়ে কোনো আরব বা মুসলিম দেশের কোনো ক্ষোভ বা বিকার আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। সবকিছুতেই ক্রমান্বয়ে তলানিতে ঠেকছে। আরবরা তো বটেই, এমনকি বিশ্বের প্রতিটি ইসলামী দেশের চিন্তা-ভাবনাটা এমন : একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তারা যেন অলৌকিক কিছুর আশায় বসে আছে। অথচ ইউরোপীয় দেশগুলো ক্রমশ ধাপে ধাপে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য আগ্রাসন, জবর দখল ও অস্থিতিশীল করার নেপথ্যে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর তেল সম্পদ করায়ত্ত করাটাই একমাত্র অন্যতম লক্ষ্য নয়। ইসরাইল নামক যে বিষফোঁড়া তারা তৈরি করেছে তাকে আরো হৃষ্টপুষ্ট করাটাই তাদের প্রধান লক্ষ্য। যেসব দেশকে পরাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তার মধ্যে ইসরাইলের বিষয়টি আড়াল করে রাখা হয়। অথচ গোপনে গোপনে ইসরাইল ইতোমধ্যে পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। তারা জাতিসংঘের সব নির্দেশ অমান্য করা ছাড়াও যেভাবে মারণাস্ত্র ও পারমাণবিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠেছে, তাদের মুখোমুখি হওয়া যে কোনো দেশের জন্য এখন রীতিমত দুঃস্বপ্ন। আরব দেশগুলো এতদিনে এ বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছে। তারা জানে, ইসরাইলকে রুখতে না পারলে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। এ কারণে আরব দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যকে ব্যাপক মারণাস্ত্র অস্ত্র বিধ্বংসী অঞ্চল ঘোষণা করতে জাতিসংঘে প্রস্তাব আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিরিয়ার উত্থাপিত এ প্রস্তাবটি নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার কৌশল। কেননা, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হলে ইসরাইলকে তার যাবতীয় বিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংস করতে হবে। যদিও এ প্রস্তাব কার্যকর সম্ভব হবে না; কিন্তু কূটনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে এমন একটি প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারাটায় বোঝা যায় আরব জাতির জ্ঞানের ভাণ্ডার একদমই শূন্য হয়ে যায়নি। আরব ও মুসলমানদের ঐতিহ্যের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ফিরিয়ে আনতে হলে অলৌকিক কিছুর আশায় বসে থাকলে চলবে না। এ জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানে, শিক্ষা-দীক্ষায়, সভ্যতায়, আত্মসম্মানে গরীয়ান হতে হবে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য এখন থেকেই নিজেদের তৈরি করা প্রয়োজন। যেভাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নামক ড্রাগনের খপ্পরে পড়ে সবকিছু বিলীন হয়ে যাচ্ছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর এ জন্য নিজেদের সীমিত সামর্থ্যরে পাশাপাশি কৌশল প্রয়োগ করে আস্তে-ধীরে এগিয়ে যেতে হবে। দেশের মাটিতে মেধা ও প্রতিভার সর্বোচ্চ বিকাশ সম্ভব না হলে প্রয়োজনে পাশ্চাত্যের শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করে নিজের দেশের জন্য উৎসর্গীত-প্রাণ হতে হবে। এখন শুধু মারণাস্ত্রের সামনে বৃথাই জীবন দিয়ে ‘শহীদ’ হওয়ার চেয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, বীরত্বে ও সাহসিকতায় এগিয়ে যেতে হবে। গোপনে গোপনে পারমাণবিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ হওয়ার কারণে উত্তর কোরিয়াকে ঘাঁটাতে যুক্তরাষ্ট্রকে হাজারবার চিন্তা করতে হচ্ছে। কেননা,উত্তর কোরিয়া সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। অনুন্নত দেশগুলোকে উত্তর কোরিয়ার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ও সামরিক শক্তিতে স্বনির্ভরশীল হয়ে প্রতিপক্ষকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে হবে। তাহলেই কেবল মাথা উঁচু করে আÍসম্মান নিয়ে পৃথিবীতে বসবাস করা যাবে। নতুবা বেছে নিতে হবে গোলামির জীবন- যে জীবন ‘মৃত’ ও অভিশপ্ত।

দৈনিক বাংলাবাজার : ৮ জুলাই ২০০৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন