মৃত্যু তো অবশ্যম্ভাবী। কবি মাইকেল মধুসূধন দত্তের ভাষায়, ‘জন্মিলে মরিতে হইবে, অমর কে কথা কবে’। কার, কখন, কোথায়, কীভাবে মৃত্যু হবে, সেটা তো কারো পক্ষে আগাম বলা বা জানা সম্ভব নয়। যে কারণে মৃত্যুর জন্য একটা প্রস্তুতি ভিতরে ভিতরে থাকেই। হঠাৎ আসা মৃত্যু নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কোনো সুযোগও থাকে না। আহাজারি যেটুকু হয়, তা কেবল স্বজনদের। তা তো দেখার সুযোগ পাওয়া যায় না। কিন্তু মৃত্যুর আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকা কী যে দুঃসহ যন্ত্রণার, সেটা বিশ্ববাসী পলে পলে অনুভব করছেন। মৃত্যুর নিরন্তর ফিসফিসানি বুকের মাঝে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। আততায়ীর মতো করোনাভাইরাস প্রতি মুহুর্তে আমাদের অনুসরণ করছে। না জেনে ভাইরাসবাহিত কোথাও স্পর্শ করলে, ভাইরাসবহনকারী কারো সংস্পর্শে গেলে অমনি যে কাউকেই চুম্বক লোহার মতো খপ করে ধরে ফেলতে একটুও দ্বিধা করছে না। এ যেন গ্রিক পুরাণের সেই ‘মিডাস টাচ’। লোভী রাজা মিডাস যা কিছু স্পর্শ করেন, তা সোনা হয়ে যায়। নিজের প্রিয় কন্যাও যখন স্বর্ণপিণ্ড হয়ে যায়, তখন তার হুঁশ হয়। রাজা তো লোভের কারণে এমন বর চেয়েছিলেন। দুনিয়ার মানুষ তো ‘করোনা টাচ’ চায়নি। তাহলে এমন হচ্ছে কেন? করোনা ধরলেই যে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলছে, তা অবশ্য নয়। ভয় দেখিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আধমরা করে ফেলছে। আর মারলেও কিছুটা করুণা তো করছে। দয়াপরবশত হয়ে মারার আগে লড়াই করার একটা সুযোগ দিচ্ছে। বাঁচা-মরা অনেকটা নির্ভর করছে প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর। যার শক্তি, সাহস ও প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, সে জিতে যাচ্ছে। প্রতিরোধ ক্ষমতা যেমন নিজের থাকতে হবে, তেমনিভাবে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার ওপর তা অনেকটা নির্ভরশীল।
এ রোগের সংক্রমণ হওয়ার যে কৌশল, তা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। যে ইউরোপ-আমেরিকাকে আমরা সভ্যতার মানদণ্ড হিসেবে নির্ভর করে এসেছি, ভরসা করে এসেছি, মান্য করে এসেছি, করোনাভাইরাস যেভাবে তাদের রীতিমতো ঘোল খাইয়ে দিচ্ছে, তা কোনো হিসেবেই মিলছে না। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে মৃত্যুর সংখ্যা। এখন অব্দি এটা থামানোর কোনো ওষুধ নেই। কোনো প্রতিকার নেই। সবচেয়ে বড় কথা, এটা কোথায় গিয়ে থামবে, তার নিশ্চয়তা তো দূরে থাক, ঘুণাক্ষরে আঁচ করাও যাচ্ছে না। এটি এমন একটি রোগ, কেউ কাউকে সাহায্য করতে গেলেও আক্রান্ত হতে পারেন। এমনকি একটি দেশ অন্য কোনো দেশকে যে সাহায্য বা সহযোগিতা করবে, সে অবস্থাও নেই। বরং কে কতটা দূরত্ব গড়ে তুলতে পারে, সেটাই হয়ে উঠেছে বেঁচে থাকার জিয়নকাঠি। এরচেয়ে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আর কী হতে পারে?
আর আমাদের মতো ঘনবসতির দেশে এর পরিণতির কথা চিন্তা করে অনেকের ঘুমই হারাম হয়ে গেছে। সেটাই হওয়ার কথা। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের যে বৌদ্ধিক মান, জাতীয় অভ্যাস ও অর্থনেতিক অবস্থা, তা এ ধরনের মহামারি সামাল দেওয়ার মতো নয়। অনেকেই এর মর্ম বোঝেন না। যে কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেকে বুঝলেও বেসামাল আচরণ করেন। মনে করেন, পুরো বাজারটা নিজের বাসায় নিয়ে গেলেই তিনি বা তাঁর পরিবার অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন। আবার অনেকে নিজে সচেতন হলেও অন্যকে সচেতন করা কিংবা পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে সংক্রমণমুক্ত করার ব্যাপারে মোটেও উৎসাহী নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, যে কোনো সংকটে প্রথমেই আমরা মানবিক ও বিবেচনা বোধটা হারিয়ে ফেলি। অথচ যে কোনো সমস্যায়, সংকটে সবার আগে সেটাই প্রয়োজন।
জানি, ভাইরাসটি খুবই স্বার্থপর ধরনের। একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। আপনকেও পর করে দিচ্ছে। তারপরও এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে সম্মিলিতভাবে। সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া করোনাভাইরাসকে ঠেকানো যাবে না। কারণ আপনি-আমি এককভাবে চাইলেও ‘করোনা টাচ’ থেকে দীর্ঘ দিন রেহাই পাওয়া মোটেও সহজ নয়।
করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। বরং সর্বত্রই একটা আতঙ্কময় পরিবেশ। মনে হচ্ছে, সবাইকে যত বেশি আতঙ্কিত করা যাবে, তত সুফল পাওয়া যাবে। অনেকেই মহা আনন্দে সেটা করছেন। এ অবস্থা কত দিন অব্যাহত থাকবে, তা তো আমরা জানি না। সেক্ষেত্রে আতঙ্কিত পরিবেশ যদি দীর্ঘদিন চলতে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি কি হিতে বিপরীত হয়ে যাবে না? অনেকের পক্ষে এই মানসিক চাপ সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বাড়ছে মানসিক রোগ।
২১ মার্চ ২০২০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন