আমি কি কাউকে কোনো কথা দিয়েছিলাম? কোনো প্রতিশ্রুতি? কিংবা কোনো অঙ্গীকার কি করিনি? হতে পারে একান্তে, নিভৃতে কিংবা প্রকাশ্যে। আবেগময় কোনো মুহুর্তে, খোশমেজাজে কিংবা প্রয়োজনের অংশ হিসেবে। করতেই তো পারি। না করাটাই তো অস্বাভাবিক। সমাজে বসবাস করলে কত কিছুই তো করতে হয়। সম্পর্ক হয়। সম্পর্ক ভেঙেও যায়। নানাভাবে লেনদেন হয়। সবটাই যে নিয়ম মেনে হয়, তা তো নয়। অনিয়মও হয়ে যায়। বেলা তো আর কম বয়ে গেল না? এখন একদমই কিছু মনে থাকে না। কখন, কোথায় কার সঙ্গে কী কথা বলেছি, কী করেছি কিছুই মনে করতে পারছি না। আর আমার স্মৃতিশক্তি তো মাশাল্লাহ! একদম ঝরঝরে। অনেক সময় সকালে কী নাস্তা করি, দুপুরবেলাই মনে করতে পারি না। যেটুকু স্মৃতিশক্তি অবশিষ্ট ছিল, এই করোনাকালে সব যেন লেপেপুছে গেছে। করোটির মধ্যে এখন একটা বিষয়ই কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে।কাকে কখন, কোথায় কী বলেছি, কী করেছি, হঠাৎ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ প্রসঙ্গ উত্থাপন করার কী এমন হলো? প্রশ্ন হতেই পারে, লাজ-লজ্জা কি সব ধুয়েমুছে গেল নাকি? আর লাজ-লজ্জা? আসলে সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। কী করবো, কী করবো না, কী করা উচিত, কী উচিত নয়, একদমই বুঝতে পারছি না। মাঝ রাতে ঘুম ভাঙার পর আচমকা ভাবনা হলো, আমাকে যদি চলে যেতে হয়, এটা মনে হওয়ার পর বুকের মধ্যে হু হু করে বইতে থাকে কান্নার প্রবল স্রোত, সেটা নিরুত্তেজ হওয়ার পর মনে হতে থাকে, তাহলে আমার তো নিশ্চয়ই কিছু দায়-দায়িত্ব রয়ে গেছে? রয়ে গেছে হিসাব-নিকাশ। সময়-সুযোগ থাকতে থাকতে তার একটা বিহিত তো অন্তত করে যেতে পারি। তাই না? সেই ভাবনা থেকে তার একটা তালিকা করতে গিয়ে কোনো দিশা পাচ্ছিলাম না। কোনটা রেখে কোনটা করবো? তখনই মনে হলো, প্রথমত আমি কাকে কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম? সেটা আমি সবার আগে রক্ষা করতে চাই। কথা দিয়ে কথা না রাখাটা আমার সবচেয়ে অপছন্দের। কথা দিলে পারতপক্ষে আমি কথা রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু আমি তো কোনো মহামানব নই। নিজের অজান্তেই ভুল হয়ে যেতে পারে। হতে পারে আমি সেই সময়ে গুরুত্বও দেইনি। যেহেতু এখন আত্মোপলব্ধি হচ্ছে, ভুলগুলো তো অন্তত শুধরে নেওয়া যায়। যদিও এ জীবনে যত জনের সঙ্গে পরিচয় ও যোগাযোগ হয়েছে, এই ফেসবুকে তো তাদের সবাইকে পাওয়া যাবে না। তারপরও এর মাধ্যমে অনেকের কাছে পৌঁছে যাবার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। ফেসবুকও তো অনেকটা করোনাভাইরাসের মতো। কিছু একটা লিখলে বা আপলোড করলে চট করে দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আর ভাইরাল হলে তো কথাই নেই। আমার অনুরোধের কথা কোনোভাবে তাঁরা যদি জানতে পারেন, তাহলে সাড়া তো দিতেই পারেন। প্রতিশ্রুতির বিষয়ে সরাসরি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন, ফোন করতে পারেন কিংবা গোপন কিছু হলে মেসেঞ্জারে জানাতে পারেন। সাধ্যে কুলালে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে চেষ্টার অন্তত কসুর করবো না। এ বয়সে সবটাই তো পারা যাবে না। যতটুকু পারি আরকি। আর যা পারবো না, তা না হয় আলোচনা কিংবা চ্যাটিং-এর মাধ্যমে সুরাহা করে নেওয়া যাবে। কিন্তু কারো সঙ্গে চিটিং করতে চাই না। আপনারা কী বলেন?
আপাতদৃষ্টিতে আমাকে শান্ত-সুবোধ মনে হয়। মূলত তেমনটি থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু সব সময় সেটা পেরে ওঠি না। পারিপার্শ্বিক অনেক কিছুর সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারি না। কষ্টকর ব্যাপার হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিবাদও করতে পারি না। যে কারণে ভিতরে ভিতরে ক্ষতবিক্ষত হই। রক্তাক্ত হই। তাতে যা ক্ষতি হওয়ার নিজেরই হয়। তবুও কথিত ভদ্রলোকের মতো চুপচাপ থাকি কিংবা নখ কামড়িয়ে কামড়িয়ে আঙুলের রক্ত বের করে ফেলি। আমাকে যাঁরা ক্ষতবিক্ষত করতে চান, সেটা তাঁরা মনের সুখ মিটিয়ে করেন। আবার অনেক সময় নিজেকে সামলাতে পারি না। অনেক ছোট-খাট বিষয়েও রাগে ফেটে পড়ি। ভিতরের অসুরটা সুযোগ পেয়ে বেরিয়ে আসে। তখন আমাকে ঠিক চেনা যায় না। সেই সময় অনেকেই আমাকে ঠিক মেলাতে পারেন না। ভাবেন, এই আমি কি সেই আমি? আসলে আমি কিন্তু এমন করতে চাই না। তারপরও কেন যে এমন করি, বুঝতে পারি না। বোঝার পর অনুতপ্ত হই। অনুশোচনা হয়। মুষড়ে পড়ি। তখন তো আর কিছু করার থাকে না। এটা তো জানা কথা, মুখের কথা আর তীর একবার ছুটে গেলে কখনো ফেরানো যায় না। এটা আমারও খুব ভালো করে জানা। কিন্তু রাগের সময় এই বোধ থাকে না। আবার অন্যভাবেও কাউকে মানসিকভাবে আঘাত কিংবা অপমান করা যায়। আমি হয়তো জানি বা জানি না, আমার কথায়, আচরণ বা ব্যবহারে কেউ আঘাত পেয়েছেন বা অপমানিত হয়েছেন, তিনি হয়তো বুঝতে দেননি বা কখনো প্রকাশ করেননি। এমন তো অহরহই হতে পারে।
এখন মনে হচ্ছে, অনেকের সঙ্গে রাগারাগি করেছি, খারাপ ব্যবহার করেছি কিংবা দুর্ব্যবহার করেছি। কার কার সঙ্গে এমনটা করেছি, সেই হিসাব তো এখন আর মেলানো যাবে না। তাঁদের কাছে মনে মনে ক্ষমা চাইলে কেমন হয়? কিন্তু তাঁরা তো বুঝতে পারবেন না। এমনও তো হতে পারে, তাঁদের হয়তো মনেও নেই। থাকলেও ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু কেউ যদি ক্ষমা না করে থাকেন? সে ক্ষেত্রে আমার করণীয় কী?
হঠাৎ মনে হলো, আরে! এ জীবনে কিছুই তো করা হলো না। কিছু একটা না করে গেলে কেমনে হয়? এমন একটা কিছু করতে চাই, অন্তত কাছের মানুষের স্মৃতিপটে যাতে রয়ে যেতে পারি। জানি, এ ধরনের আশা করা মোটেও বাস্তবোচিত নয়। কে যে কাছের মানুষ আর কে যে দূরের মানুষ! আর কে যে কাকে মনে রাখে? দম ফুরালেই তো সব শেষ। তুরস্কের বিশ্বখ্যাত কবি নাজিম হিকমতের ভাষায়,
বিংশ শতাব্দীতে
মানুষের শোকের আয়ু
বড় জোর এক বছর।
সেও তো বিখ্যাতদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমার মতো অভাজনদের জন্য নয়। আমার জন্য সেটা কত মিনিট, কত ঘণ্টা বা কত দিন কে জানে? এটাও ঠিক, কে শোক করলো, কে করলো না, সেটা তো আর জানার সুযোগ থাকবে না। আর এখন এই করোনাকালে জীবিত থাকতেই তো এক রকম মৃত্যু হয়ে যাচ্ছে। কেউ আক্রান্ত হলে তিনি হয়ে যাচ্ছেন নিঃসঙ্গ এক দ্বীপের বাসিন্দা। কারো সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ থাকে না। যদিও কতকাল আগে মানুষের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে ইংরেজ কবি জন ডান লিখে গেছেন,
No man is an island,
Entire of itself,
Every man is a piece of the continent,
A part of the main.
Any man's death diminishes me,
Because I am involved in mankind,
হায়! এ ধরনের অনুভূতির এখন আর গুরুত্ব নেই বললেই চলে। সবচেয়ে অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে মানুষ ও মানবিকতা। এমন এক ভাইরাস এসেছে, মানুষকে ক্রমান্বয়ে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। ইচ্ছে থাকলেও করোনাবন্দির সঙ্গে সুযোগ নেই দেখা-সাক্ষাৎ করার। ‘স্বেচ্ছাবন্দি’ হয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে এলেই কেবল তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হবে। নতুবা সামাজিক দূরত্ব থাকাবস্থায় মৃত্যু হলে শেষ দেখা তো দূরে থাক, জানাজা ও দাফনেও অংশ নেওয়া যাবে না। এ কারণে কেউ কাছে ঘেঁষতেই সাহস পান না। কোথাও কোথাও নাকি গণকবর দেওয়া হচ্ছে। এরচেয়ে দুঃখজনক ও নির্মম আর কী হতে পারে? এই করোনাকালে মৃত্যু হওয়া মানে কেবলই একটা সংখ্যার বেশি কিছু নয়। তাহলে এ অবস্থায় কাছের মানুষদের হৃদয়ে দাগ কাটার সুযোগ কোথায়? তবুও মন মানে না।
কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন,
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক
এ তো ইহলোকের ভালোবাসার কথা। পরলোকে চলে যাবার সময় তো আর কাউকে অপেক্ষা করার কথা বলে যাওয়া যায় না। বাস্তব বড় নিষ্ঠুর। তারপরও কেন যেন মনে হয়, চলে যাবার পর কাছের মানুষরা আমার জন্য একটু শোক করুক। আমাকে কিছুটা হলেও মনে রাখুক। মনে মনে ভালোবাসুক। নিরালায় বসে একটুখানি না হয় কাঁদুক। দুনিয়াটা তো মায়ার বাঁধনে জড়ানো। যদিও এর কোনো যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যা নেই। কে শোক করবে, কে মনে রাখবে, কে ভালোবাসবে, কে কাঁদবে, তা নিয়ে আক্ষেপ করে আর কীইবা হবে? সেটা তো জানতেই পারা যাবে না। কিন্তু মন তো অদ্ভুত এক খেয়াল। তার যে কখন কী ইচ্ছে হয়, বুঝতে পারা যায় না। তাছাড়া বেঁচে থাকার যে মোহ, তা থেকে মুক্ত হওয়া কি এত সহজ? কোনোভাবে বেঁচে থাকা এবং বন্ধনে জড়িয়ে থাকার জন্য মানুষ কত কিছুই করে বা করতে চায়।
সে কারণে মানুষের হৃদয়ে দাগ কাটার জন্য কিছু একটা করতে মনটা ছটফট করে। কিন্তু করবোটা কি? আমার সামর্থ্যইবা কী আছে? না আছে মেধা, না আছে বিদ্যা, না আছে ক্যারিশমা, না আছে কোনো ক্ষমতা। তাহলে? সেক্ষেত্রে যেটুকু যা আছে, নিধিরাম সর্দারের মতো তা নিয়ে যদি কিছু একটা করা যায়। কিন্তু ইচ্ছে হলেও উদ্যম যেন হারিয়ে গেছে। না হারিয়ে করবোটা কি। করোনা তো কাউকে একদমই স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। মৃত্যু ভাবনায় বার বার জারিত হতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। কিছুই তো করা হচ্ছে না। হবেও না। অথচ বুকের মধ্যে কত যে ইচ্ছের ছটফটানি। এ জীবনে যা যা করতে চেয়েছি, কিন্তু করতে পারিনি, এখন সব কিছু করার ইচ্ছে জাগছে। মনে হচ্ছে, আমি চাইলেই সব করে ফেলতে পারি। ধন্য আশা কুহকিনী।
আচ্ছা, আমি যে অনেক কিছু লিখতে চেয়েছি বা পরিকল্পনা করেছি, তার কী হবে? কত কত বিষয় লিখবো বলে মাথার মধ্যে সাজিয়ে রেখেছি। যদিও আমার লেখার কীইবা গুরুত্ব থাকবে? আমি তো কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক নই। এমন সব বিষয় লিখি, যার কোনো গুরুত্ব নেই। তদুপরি আমি যদি না থাকি, আমার পাঠকও তো থাকবে না। তাহলে লিখে কী হবে? ওই যে বললাম, মন নামক এক অনুভূতি আমাকে নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। তার অবাধ্য হতে পারি না। কেন যেন আমাকে লিখতে প্ররোচিত করে। আমি জানি, আমার লেখা কেউ পড়তে পারে, কেউ নাও পড়তে পারে। তাতে তো আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। মন আমাকে বোঝায়, সেক্ষেত্রে আর কিছু না হোক, অন্তত নিজের জন্য লিখতে তো কোনো অসুবিধা নেই। নিজের লেখার পাঠক হয়ে নিজেই তো আত্মতৃপ্তি পেতে পারি। চলে যাওয়ার আগে বা পরে কে পড়লো, কে পড়লো না, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী হবে? কিন্তু অশান্ত মন নিয়ে কি লেখা যায়? এত এত মৃত্যুর মিছিলের মধ্যে কীভাবে সেটা সম্ভব? কিছু পড়তেই তো পারি না। পড়তে গেলে অক্ষরগুলো ম্যাজিক রিয়ালিজম হয়ে যায়। কত সব উল্টাপাল্টা বিষয় মাথার মধ্যে ভেসে ওঠে। তাহলে লিখবো কীভাবে?
এই করোনাকালে আমার যেন ইচ্ছের শেষ নেই। ইদানিং নানান জায়গায় ঘুরতে যাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করছে। এর কারণ হতে পারে, এখন তো কোথাও যাবার সুযোগ নেই। বিদেশের কথা না হয় বাদ দিলাম, তা আমার সামর্থ্যরে মধ্যে পড়ে না, দেশের মধ্যেই কত জায়গায় ঘুরতে চেয়েছি। ঘুরি ঘুরি করেও সময়ের দোহাই দিয়ে যাওয়া হয়নি। এখন মনে হচ্ছে, পরিকল্পিত সে সব স্থানে যেতে না পারলে শান্তি পাবো না। নানান জনের কাছে ভ্রমণের স্থানগুলোতে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা শুনতে শুনতে একপ্রকার মোহাচ্ছন্ন হয়ে আছি। সিলেটের বিছানাকান্দিতে সুউচ্চ ঝরনাধারা থেকে নেমে আসা জলরাশিতে অবগাহন, জোছনা রাতে বিশাল রকেট লঞ্চে বরিশাল ঘুরতে যাওয়া, প্রাকৃতিক বনভূমি সুন্দরবনের অপরূপ সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করা, দেশের সর্ববৃহৎ হাকালুকি হাওরে ভরা বর্ষায় গা ছমছম করা অনুভূতি নেওয়া, হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপে চিত্রা হরিণের দুরন্তপনা দেখা, কুয়াকাটায় সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখার দুর্লভ সুযোগ, বান্দরবানের নীলগিরি পাহাড়ে উঠে মেঘ যদি না ছোঁয়া যায়, তাহলে এ জীবন তো অপূর্ণ রয়ে যাবে। স্বপ্ন দিয়ে তৈরি এ দেশটির এ রকম কতনা সৌন্দর্য অদেখা হয়ে আছে। তা কি কেবল স্বপ্ন হয়ে থাকবে?
হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়, এমন সব স্থানেও তো যাওয়া হয়নি। ঢাকার আশপাশে ইতিহাসখ্যাত নান্দনিক ডিজাইনের কত বাড়িঘর দেখা, নদী-বিল-জলাশয়ের মনোরম শোভায় বিভোর হওয়া, প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে তোলা দ্বীপ বা রিসোর্টে অবস্থান করার অনুভূতিও হলো না। অথচ খুব বেশি দূরে তো নয়। চাইলেই দিনে দিনে ঘুরে আসা যায়। কিন্তু যাওয়া হয়নি। এমনকি যে ঢাকায় পুরো জীবন কেটে যাচ্ছে, সেই শহরটাই তো অচেনা রয়ে গেছে। পুরানো ঢাকা, নতুন ঢাকা কোনোটার সঙ্গে ঠিকমতো চিনপরিচয় হলো না। এত এত প্রত্যাশার পদ্মা ব্রিজ, মেট্রোরেল কি দেখতে পারবো? এই শহরে রয়েছে চমৎকার সব রেস্তোরাঁ। কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে দেখা যায় চুঁইয়ে পড়া চাঁদের ঘোর লাগা আলো। সেই আলোয় নাকি দুলে উঠে মায়াবী হৃদয়। হায়! এই সামান্য রোমান্টিকতাটুকুও অনুভব করা হলো না। আরো যে কত কিছু করা হলো না।
কবি হেলাল হাফিজের মতো কোমল হৃদয়ের হলে না হয় বলতাম,
হলো না, হলো না।
সুন্দর হলো না, অসুন্দরও না
জীবন হলো না, জীবনেরও না, কার যেন
কিছুই হলো না, কিচ্ছু হলো না।
হলো না। না হোক,
আমি কী এমন লোক
আমার হলো না তাতে কী হয়েছে?
তোমাদের হোক।
কিন্তু স্বার্থপর মন তো। নিজের না হওয়াগুলো নিয়ে বেশি ভাবছি। আর না ভেবেইবা কী করবো? এখন সময়টাই তো অন্য রকম। যে কারণে ভাবনার দোলাচলে প্রতিনিয়ত হাবুডুবু খাচ্ছি। এছাড়া তো কিছু করার নেই। যথেষ্ট অবসর পেয়ে নিজের জমা-খরচের খুচরা হিসাব মিলাচ্ছি। সব হিসাব তো আর আমার কাছে নেই। সেটা মেলানোর জন্য তো আলাদা নিয়োগ দেওয়া আছে। আমি আমার মনের খসড়া খাতার ছোট-খাট বৈষয়িক বিষয়ে বোঝার চেষ্টা করছি। এই সামান্য হিসাবও মিলাতে পারছি না।
তাই চলে যাবার যে দুর্ভাবনা ও দুঃস্বপ্ন, তার আগে আমার যত অপারগতা, আমার যত অসম্পূর্ণতা, আমার যত না পূরণ হওয়া অভিলাষ নিয়ে মোটেও স্বস্তি পাচ্ছি না। অথচ এ জীবনে এ মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার তেমন সুযোগ নেই বললেই চলে। কারণ, যখন সুযোগ আসে, তখন তা গ্রহণ করা হয় না। আর যখন সুযোগ থাকে না, তখন তার অপেক্ষায় থাকি। এ ধরনের মনোভাব নিয়ে কিছু করা যায় না। তবে বেঁচে থাকলে আশায় আশায় তো থাকা যায়। একদিন না একদিন হয়ে যেতে পারে। কথায় আছে না, পাগলের সুখ মনে মনে। আমারও সেই অবস্থা।
তবুও সুস্থ, সুন্দরভাবে নতুন নতুন স্বপ্ন নিয়ে সবাই বেঁচে থাকতে চায়। কখনো কখনো হার মানতে হয় জীবনের মোহের কাছে। আর যাঁরা হার মানেন না, তেমন মহামানব কি আর সবাই হতে পারেন?
২২ এপ্রিল ২০২০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন