পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১

বনলতা সেনের অপেক্ষায়

কেমন আছে বনলতা সেন? কোথায় আছে? কত দিন ধরে খুঁজে চলেছি তারে। কিন্তু তার দেখাই মেলে না। দেখা না মেলাটা লেখা বোধকরি ঠিক হলো না। চলার পথে হয়তো কোথাও না কোথাও তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কাছে কিংবা দূরে। কর্মক্ষেত্রে, রেস্তোরাঁয়, সিনেপ্লেক্সে কিংবা অন্যত্র। এমনকি হতে পারে ফেসবুকের আড়াল থেকে হাসছে দুষ্টু দুষ্টু। কিংবা এমনও তো হতে পারে, দেখা হলেও তারে চিনতে পারছি না। চেনা কি সম্ভব? তার পরিপূর্ণ অবয়ব দেখা কিংবা তারে সামগ্রিকভাবে আজ অব্দি জানা হয়নি। জানবো কীভাবে? তার অন্ধকার বিদিশার নিশার মতো চুল, শ্রাবস্তীর কারুকার্যের মতো মুখ ও পাখির নীড়ের মতো চোখটুকুই সম্বল। আর তার নিবাস নাটোর। এছাড়া তার আর কিছুই তো জানি না। চিনি না। এতটুকু দিয়ে কি এ মহাপৃথিবীতে তারে খুঁজে পাওয়া সম্ভব? তারপরও অন্বেষণ একদমই থেমে নেই। তবে ভরসা একটাই, বনলতা সেন তো একজনাই। তারে চিনে নিতে তো খুব একটা কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এ কারণে নিরন্তর তারে খুঁজে চলেছি। তার প্রতি যে অনুভব, যে অনুরাগ, যে অনুভূতি তা তো একটুও ঠুনকো নয়। সেই কবে হৃদয়মন্দিরে তারে স্থান দিয়েছি। কখনও ভুলতে পারিনি। অকর্র্ষিত হৃদাকাশে যে চিরস্থায়ী ছাপ সে রেখেছে, তারে কি আর ভুলে যাওয়া সম্ভব? আমার মতো নাজুক মনের হলে তো প্রশ্নই আসে না। 

বনলতার সঙ্গে সম্পর্কটা হয়ে ওঠেছে ‘মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়’-এর মতো। আমি কিন্তু অবিকল জীবনানন্দ দাশের কল্পনার বনলতা সেনকে খুঁজছি না। এ সময়ে তো আর সেই সময়ের বনলতা সেনকে পাওয়া যাবে না। সময় কত বদলে গেছে। দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে। পরিবর্তিত হয়েছে চেহারাছবিও। ‘তোমার মুখের মতন অবিকল’ কি আর পাওয়া যাবে? তার সঙ্গে অবশ্যই সাদৃশ্য থাকতে পারে। মনে, মননে, মেজাজে। নাহলে আর তারে খুঁজবো কেন? প্রশ্ন হতে পারে, কেমন ছিল তার মন? কেমন ছিল তার মনন? কেমন ছিল তার মেজাজ? তা তো আর স্পষ্ট করে জানা যায় না। যখন লেখা হয়, ‘আমারে দুদ- শান্তি দিয়েছিল’, তখন কিছুটা হলেও তারে বুঝতে পারা যায়। শান্তি কি আর সবাই দিতে পারে? লাবণ্য দাশ তো পারেনি। বনলতা যখন পেরেছে, বুঝতে পারা যায়, সে সময়ের প্রেক্ষাপটে সে মায়াবী এক নারী, যার অন্তঃকরণ কোমল, স্বভাব নম্র ও সহানুভূতিশীল অন্তর। কিন্তু আমি খুঁজে চলেছি একান্তই আমার বনলতা সেনকে। ‘যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে/অথচ যার মুখ আমি কোনো দিন দেখিনি/সেই নারীর মতো’। কেউ কি আমাকে নীরবে ভালোবেসেছে? সে কি বনলতা সেনের মতো? এটি তো অবিশ্বাস্য। যে আমাকে দেখেনি, সে কীভাবে আমাকে ভালোবাসবে? আমি তো আর জীবনানন্দ দাশ নই। বরং একটু ঘুরিয়ে বলা যেতে পারে, ‘যে আমি চিরদিন ভালোবেসেছি/অথচ যার মুখ আমি কোনো দিন দেখিনি/সেই নারীর মতো’। 

বনলতা সেন তো আমার কাছে হয়ে আছে আধেক শরীরী, আধেক অশরীরী। তারে তো আর অবিকল পাওয়া সম্ভব নয়। তার আবছায়া আদলের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটিয়ে চলেছি লাগামহীন কল্পনার। কল্পনা ছাড়া তো তারে পূর্ণাবয়ব দেওয়া সম্ভব নয়। চিত্রকর যেভাবে কল্পনা আর তুলির সংমিশ্রণে ফুটিয়ে তোলেন কোনো চিত্রপট, তেমনিভাবে কল্পনার তুলি দিয়ে একটু একটু করে গড়ে তুলি এই প্রিয়মুখ। আবার মুছেও যায় সেই অবয়ব। যেমনটি চাই, তা যেন অধরা রয়ে যায়। তারে যেন বাস্তবে পাওয়া যায় না। জীবনানন্দ দাশ অন্য এক কবিতায় যেমনটি লিখেছেন, ‘ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার রাঙা, আপেলের মতো লাল যার গাল/চুল যার শাঙনের মেঘ, আর আঁখি গোধূলির মতো গোলাপী রঙিন/আমি দেখিয়াছি তারে ঘুমপথে, স্বপ্নে কত দিন’। বনলতা সেনকে কি এমনভাবে কল্পনা করা যায়? অবশ্য স্বপ্নে দেখা আর বাস্তবে দেখার মধ্যে তো ঢের ঢের তারতম্য। কল্পনায় কতভাবেই না ধরা দেয় বনলতা সেন। কবি ও দার্শনিক ওমর খৈয়াম প্রিয়ার চিবুকের একটি কালো তিলের বিনিময়ে দুই নগর সমরখন্দ আর বোখারা লিখে দিতে চেয়েছিলেন। তেমন একটি তিল বনলতার চিবুকে শোভা পেলে কেমন লাগবে? লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যেমনটি চেয়েছেন, ‘বেদনা মাধুর্যে গড়া তোমার শরীর’, তেমনটিও তো হতে পারে।   


এ সময়ে যে বনলতা সেনকে খুঁজছি, তারে তো অতীতের অবয়বে পাওয়া যাবে না। সে কর্মজীবী কিংবা গৃহিণী হতে পারে। হতে পারে ড্যাম স্মার্ট কিংবা একান্তই ঘরোয়া এক নারী। হতে পারে ‘পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো’ কেউ। তার পরনে থাকতে পারে শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, কুর্তি, স্কার্ফ কিংবা শার্ট-প্যান্ট। তার বিখ্যাত চোখ হয়তো ঢাকা পড়ে গেছে দামি ব্রান্ডের সানগ্লাসে। মেকআপের আড়ালে অচেনা হয়ে গেছে মুখ। চুলের ফ্যাশনেও পরিবর্তন আসতে পারে। দেখা না হলে তো নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, কী রূপে তারে দেখতে পাওয়া যাবে? এমনও তো হতে পারে, সে আমার চেনা এক নারী। যেভাবেই দেখা হোক না কেন, আমি তো অপেক্ষায় আছি পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে কবে আমাকে বলবে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ বলবে কিনা কে জানে? যদি না বলে তখন কী আর করা যাবে, আমাকেই হয়তো বলতে হতে পারে। কিংবা কিছু তো নাও বলে চুপচাপ থাকতে পারি। আবার জীবনানন্দ দাশের মতো বদলে যেতে পারেন মন, ‘সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি/এখনও কি ভালোবাসি?’ 

কী এক দ্বিধা নিয়ে অপেক্ষায় থাকি তার।

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন