পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২১

নবরূপে বাংলা নববর্ষ

 

বাঙালির জীবনে হরেক রকম উৎসব। তবে অধিকাংশ উৎসবই নির্দিষ্ট একটি গণ্ডিতে বাঁধা। তাতে নেই সর্বজনীনতা। দেখা যায়, একটা গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় উৎসব করছে, কিন্তু বড় একটি অংশের তাতে কোনো ভূমিকা থাকছে না। বরং উৎসবে সম্পৃত্ত হতে না পেরে এক ধরনের মন খারাপ করা অনুভূতি নিয়ে প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। অবশ্য অর্থনৈতিক কারণেও সমাজের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যে কোনো উৎসব বা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া থেকে বঞ্চিত হন। এতে সমগ্র দেশের জনগণের মধ্যে আত্মিক বন্ধন গড়ে উঠে না। নিবিড় ও ঘনিষ্ঠ বন্ধন গড়ে তোলার জন্য সর্বজনীন উৎসবের কোনো বিকল্প নেই। বাংলার মানুষ এ দিক দিয়েও অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। তাদের আছে বিভিন্ন ঋতুভিত্তিক, কৃষিভিত্তিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উৎসব। আছে জাতীয় নানান দিবস। 


এই উৎসবে বা দিবসে তারা পরস্পরের হাতে হাত রেখে অংশ নিতে পারেন। অংশ নিতে পারেন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, বয়স নির্বিশেষে সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে, এমন উৎসবের মধ্যে বলা যায়, বাংলা নববর্ষই প্রধানতম। এই ব-দ্বীপে হাজার বছর  ধরে বাংলা ও বাঙালির যে পথ চলা, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পয়লা বৈশাখ। এটি পরিণত হয়েছে বাঙালি সংস্কৃতি ও লোকজ ঐতিহ্যের অংশ। বাংলা সনের প্রথম এই দিনটি বাঙালির লোকায়ত জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পৃত্ত হয়ে আছে। এই দিনটি আসে শুভ বারতা নিয়ে। আসে আনন্দের উপলক্ষ হয়ে। আসে বাঙালিয়ানায় দীক্ষা দিতে। এই দিনটিতে অনুভব করতে পারি, আমরা লোকায়ত গৌরবোজ্জ্বল এক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অধিকারী। সেই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে আছে আমাদের জীবন যাপনের নানান উপাদান। বাঙালির জীবন তো কৃষিভিত্তিক। কৃষিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে জীবনযাপনের নানান ছন্দ ও দোলাচল। আর এই কৃষিকাজকে একটা নিয়মের মধ্যে আনতে মুগল সম্রাট আকবর প্রবর্তন করেন বাংলা সন। এরপর থেকে বাংলা নববর্ষ বাঙালির জীবনে নিয়ে আসে নতুন ব্যঞ্জনা। দিনটি উদযাপিত হয় নানাভাবে। হালখাতা এই উৎসবের অন্যতম অনুষঙ্গ। পুরনো হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে দিয়ে খোলা হয় হিসেবের নতুন খাতা। সেই জমিদারী আমলে এ দিনে কৃষকরা খাজনা পরিশোধ করতেন এবং সেই সুবাদে তাদেরকে করানো হতো মিষ্টিমুখ। আয়োজন করা হতো মেলা ও নানান অনুষ্ঠান। জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হলেও বাংলা নববর্ষের আবেদন কখনোই ফুরিয়ে যায়নি। বরং উজ্জ্বলতা বেড়েছে। বেড়েছে ব্যাপ্তি। বাঙালিত্বের অন্যতম নিয়ামক হয়ে উঠেছে বাংলা নববর্ষ। এটি এখন বাঙালির সর্ববৃহৎ অসাম্প্রদায়িক উৎসব। বাংলার গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে নববর্ষের নিবিড় সম্পর্ক। 


নববর্ষ উপলক্ষে ঘরে ঘরে উৎসবের মেজাজ লক্ষ্য করা যায়। এরমধ্যে আছে নতুন পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করা, বৈচিত্রময় খাওয়া-দাওয়া। তবে প্রধান আকর্ষণ হিসেবে স্থান করে নেয় বৈশাখী মেলা। এই মেলা হয়ে উঠেছে বাংলার লোকায়ত জীবন ধারার নিয়ামক। লোকজ জীবনের প্রতিদিনকার ব্যবহার্য অনুষঙ্গ এই মেলায় বেচা-কেনা হয়। যা মোটামুটি মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে। বাঙালির তো খুব বেশি চাহিদা ছিল না। প্রকৃতির দেওয়া অপার দানকে করে তোলে নিজের প্রাত্যহিক চাহিদার অংশ। মেলায় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, কুটিরশিল্প, মৃৎশিল্প, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী ও শিশুদের খেলনার নানান সমাহার ঘটে। মুখরোচক খাদ্যদ্রব্য’র কোনো কমতি নেই। কত রকমের যে খাদ্যসামগ্রী। টক-ঝাল-মিষ্টির উপস্থিতি থাকলেও মিষ্টি জাতীয় খাদ্যের প্রাধান্যই বেশি। বৈশাখী মেলাকে আনন্দময় করে তোলে নানান রকম সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। বসে নানান রকম গানের আসর। লোকশিল্পীদের কণ্ঠে পরিবেশিত হয় বাংলার লোকজ সহজিয়া সুর। পালা গান, জারি গান, কবি গান, গম্ভীরা গান, বাউল, মারফতি, মুর্শিদী, ভাটিয়ালি। এছাড়া থাকে যাত্রা, নাটক, পুতুল নাচ, নাগরদোলা, সার্কাসসহ আনন্দের নানান উপকরণ।                

সময়ের বিবর্তনে বাঙালির জীবনে ঘটেছে নানান কিছুর সংমিশ্রণ। পরিবর্তন এসেছে পয়লা বৈশাখ উদযাপনেও। যে বাংলা নববর্ষ ছিল গ্রামীণ জনপদের একান্ত নিজস্ব উৎসব, তা এখন নগর সংস্কৃতিরও অংশ হয়ে ওঠেছে। দেশভাগ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গ্রামের মানুষজন শহরমুখী হয়ে উঠায় তাদের বুকের ভিতরে রয়ে যায় নাড়ীর টান। শহরবাসের পর সেই টান তারা অনুভব করেন। শহরেই অনুরণন ঘটে গ্রামীণ সংস্কৃতির। নিজেদের মতো পরিশীলন ঘটিয়ে নতুন রূপ দেওয়া হয় বাংলা নববর্ষের। তাতে অনেক কিছুরই সংযোজন ঘটে। পয়লা বৈশাখের নতুন ভোরের নতুন সূর্যকে বরণ করে নেওয়ার জন্য আয়োজন করা হয় নানান অনুষ্ঠানমালার। রমনার বটমূলে নববর্ষকে স্বাগত জানাতে গানের আয়োজন করে ছায়ানট। সুরে সুরে ভরে উঠে চারপাশ। এতে বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম হয়। নববর্ষের পোশাক হিসেবে প্রচলন হয়ে আসছে মেয়েদের লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোপায় ফুল, কপালে টিপ। আর ছেলেদের পাঞ্জাবি, ফতুয়া। পিঁয়াজ, মরিচ সহযোগে পানতা ভাত খাওয়াটা প্রচলিত হয়ে ওঠেছে। এরসঙ্গে থাকে ইলিশ মাছ, ডিম ভাজা, সব্জি, আচার। 


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বকুল তলায় স্বাগত জানানো হয় বাংলা নববর্ষকে। তবে চারুশিল্পীদের বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা নববর্ষের অন্যতম আকর্ষণ। এই শোভাযাত্রায় স্থান পায় নানা রঙের মুখোশ, আল্পনা, বিচিত্র পোশাক-পরিচ্ছদ, খোল-করতাল, বাদ্য-যন্ত্র। রঙে রঙে রঙিন হয়ে উঠে শোভাযাত্রা। এতে নতুন ব্যঞ্জনা পায় বাংলা নববর্ষ। বাংলা নববর্ষ উদযাপন এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসহ তো বটেই, নানান রকম সংগঠন তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বরণ করে নেয় পয়লা বৈশাখকে। পার্বত্য জেলায় এবং উপজাতীয়দের কাছে নববর্ষ আসে উৎসবের প্রধান উপলক্ষ্য হয়ে। 

বাংলা নববর্ষে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। পয়লা বৈশাখ শিশু-কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মুখাবয়বে কিংবা শরীরে আল্পনা আঁকার চল শুরু হয়েছে। ফ্যাশন ও বুটিক হাউজগুলো বাংলা নববর্ষকে উৎসবের মেজাজ দেওয়ার জন্য নানান রকম পোশাক বাজারে ছাড়ে। বিশেষ করে গরমের কথা বিবেচনা করে বেছে নেওয়া হয় সুতি ও তাঁতের কাপড়। তাতে শোভা পায় ব্লক প্রিন্ট, হ্যান্ড পেইন্ট, ¯েপ্র, স্ক্রিন প্রিন্ট, অ্যামব্রয়ডারি, টাই-ডাই, অ্যাপলিকসহ কত না বাহারি কারুকাজ। শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, থ্রি-পিস, টপস, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, টি-শার্টগুলো যেন উৎসবের মেজাজ নিয়ে আসে। তাতে উঠে আসে বাংলার হাঁড়ি-পটসহ নানান মোটিফ, বাংলা কবিতা ও গানের মন ছুঁয়ে যাওয়া পংক্তি, প্রাচীন টেরাকোটার নিদর্শন, নানান শিল্পকর্ম। ঈদ পার্বণে নতুন পোশাকে সাজতে অভ্যস্ত বাঙালির কাছে পয়লা বৈশাখও হয়ে উঠেছে নিজেকে নতুন রঙে সাজানোর উপলক্ষ্য। নববর্ষের পোশাকে থাকে নিখাদ বাঙালিয়ানার ছাপ। পোশাক-আশাকের পাশাপাশি গহনার সাজ-সজ্জায় আছে নানান বৈচিত্র। পোড়ামাটি, কাঠ, মাটি, পুঁতি, তামা, পিতল দিয়ে কত রকম গহনা তৈরি হয়। কানের দুল, গলার মালা, হাতের বালা, চুড়ির বাহারি ডিজাইন শোভা পায় আধুনিক নারীর দেহে। আর ফুল তো আছে সৌন্দর্যের অন্যতম উপাদান হয়ে। তবে আগের তুলনায় ফুলের কদর যেমন বেড়েছে, বেড়েছে তার নানান রকম ব্যবহার। নববর্ষে প্রতিদিনের জীবনে নিয়ে আসে বৈচিত্র। এ দিনে অনেকেই ঘরে ভিন্ন স্বাদের খাবারের আয়োজন করলেও কেউ কেউ বাইরে থেকে খেয়ে আসেন। অনেকেই চলে যান দূরে কোথাও। 

গানের ক্ষেত্রেও এসেছে পরিবর্তন। লোকজ গান, রবীন্দ্র সংগীতের পাশাপাশি বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে ব্যান্ড দলগুলোও বেশ  সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। নববর্ষে বের করা হয় নতুন নতুন সিডি, অ্যালবাম। শহরের ফোকাল পয়েন্টে আয়োজন করা হয় ব্যান্ড শো। তাতে ব্যাপক সংখ্যায় উপস্থিত হন তরুণ প্রজন্ম। এখন যে কোনো অনুষ্ঠান ও আয়োজনে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। নববর্ষ উপলক্ষেও তারা নানান উদ্যোগ গ্রহণ করে। 


বাংলা নববর্ষ ব্যাপ্তি বেড়েই চলেছে। তা পরিণত হয়ে উঠেছে জাতীয় উৎসবে। সবার কাছে এটি এখন প্রাণের উৎসব। কিছু কিছু স্বার্থান্বেষী মহল বাংলা নববর্ষকে মেনে নিতে পারছে না। তাদের কাছে বাংলা নববর্ষ হুমকি হয়ে ওঠেছে। তারা বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে ম্লান ও অনুজ্জ্বল করার জন্য নানান রকম ফন্দি-ফিকির করে যাচ্ছে। নানাভাবে অপপ্রচার চালিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও ঐতিহ্যবাহী এই উৎসবকে বন্ধ করে দেওয়ার পাঁয়তারা চালাচ্ছে। ২০০১ সালে রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে কাপুরুষোচিত হামলা চালানো হয়। তাতে বেশ কয়েকজনের জীবনহানি হয়। আহত হন অসংখ্য মানুষ। এ ঘটনায় অবশ্য আয়োজকরা মোটেও হতোদ্যম হননি। তারা এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে প্রতি বছর আয়োজন করে যাচ্ছে বাংলা নববর্ষ। সংস্কৃতিবান মানুষও পিছিয়ে যায়নি। বাংলা নববর্ষ তাদের অন্তরে স্থান করে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে তারা ছাড় দিতে নারাজ। তবে হামলার ঘটনার পর থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করার ক্ষেত্রে একটা সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। মনের মধ্যে কিছুটা হলেও একটা ভীতি কাজ করে। এখন তো নানান ঘটনায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন করাটা কঠিন হয়ে ওঠেছে। যে কোনো সময় যে কোনো ঘটনার জন্য প্রস্তুত থাকাটা অমূলক নয়। তারপরও বাংলা নববর্ষকে বাদ দিয়ে বাঙালিকে আলাদা করা যাবে না। এটি মিশে আছে বাঙালির প্রাণে, বাঙালির অন্তরে। বাংলা নববর্ষে বাঙালি খুঁজে পায় নিজেকে। নিজের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে। তাই বাংলা নববর্ষ বাঙালির জীবনে প্রতি বছর আসে নবরূপে, নতুন প্রেরণায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন