রাতে বাসায় ফেরাটা নতুন কিছু নয়। সেই মধ্য আশির দশক থেকে যখন দৈনিক পত্রিকায় কাজ করতাম, কত কত মাঝ রাত পেরিয়ে বাসায় এসেছি। সেই সময়ের রাতগুলোকে মনে হতো গুপ্ত ঘাতকের মতো। ফাঁদে ফেলার জন্য সারাক্ষণ ওৎ পেতে থাকতো। বাসায় ফেরার বাহন ছিল অফিসের ভাড়া করা সবেধন নীলমণি বেবিট্যাক্সি। এক সময়ের জনপ্রিয় এ বাহনকে এখন আর ঢাকায় দেখা যায় না। বাসায় ফেরার সময় চোখে জড়ানো থাকতো ঘুম। একই বাহনের আরোহী সহকর্মীদের নামিয়ে দিয়ে ফিরতে ফিরতে কখনও কখনও ভোররাত হয়ে যেত। চালক কাকে যে কোথায় নামিয়ে দিত, টেরই পেতাম না। তখন ঢাকার কত বিচিত্র রূপ দেখেছি। ঘুম ঘুম চোখে তো আর রোমান্টিকতা থাকতো না। বরং পথের বাধা-বিঘ্নগুলোকে রীতিমতো নির্যাতনই মনে হতো। পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদ, ছিনতাইকারীর ধাওয়া, মাতালের খিস্তি, নিশি পরীদের হুল্লোড়, বেওয়ারিশ কুকুরদের ঘুর ঘুর করা, নৈশপ্রহরীর বাঁশির বুক কাঁপানো তীব্র হুঁইসেল-আরও কত যে কি। অবশ্য রাতের নির্জনতা ভেঙে বিকট শব্দে আমাদের বেবিট্যাক্সি চলার সময় সচকিত হয়ে উঠতো চারপাশ। অনেকে আড়ালে চলে যেতেন। অবৈধ লেনদেনও ক্ষণিকের তরে থেমে যেত। আমার এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তখন একটাই চিন্তা, কতক্ষণে বাসায় গিয়ে দু'মুঠো মুখে দিয়ে বিছানায় ক্লান্ত দেহখানি এলিয়ে দেবো।
এটা অবশ্য বুঝতে পারতাম, রাত কিন্তু কখনও ঘুমিয়ে পড়তো না। তার আলাদা একটা রূপ ছিল। সৌন্দর্য ছিল। মাদকতা ছিল। তার কদর বুঝতেন রসিকজনরা। ‘এই মাতোয়ালা রাইত’ শিরোনামে কবি শামসুর রাহমান তার খানিকটা বর্ণনা দিয়েছেন ঢাকার কুট্রিদের ভাষায়,
হালায় আজকা নেশা করছি বহুত। রাইতের
লগে দোস্তি আমার পুরানা, কান্দুপট্টির খানকি
মাগীর চক্ষুর কাজলের টান এই মাতোয়ালা
রাইতের তামাম গতরে। পাও দুইটা কেমুন
আলগা আলগা লাগে, গাঢ়া আবরের সুনসান
আন্দরমহলে হাঁটে। মগর জমিনে বান্ধা পাও।
আমি সারাজীবনই বেরসিক মানুষ। শিশু বয়স থেকে বসবাস সূত্রে ঢাকার বাসিন্দা হলেও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার মোটেও সমৃদ্ধ নয়। বুকের মধ্যে নেই কোনো কাব্যিকতা। তাই রাতের ঢাকার প্রকৃত রূপ ফুটিয়ে তোলা আমার কর্ম নয়। তবে কখনো কখনো ধবল জোছনা মন উদাস করে দিত। হীরের মতো জ্বল জ্বল করতে থাকা তারাদের ছোটাছুটি দেখে বুকের মধ্যে ভেসে ওঠতো কবি আল মাহমুদের পঙক্তি, ‘তারারা খেলছে তারাদের সাথে’।
এরশাদ সরকারের সেই রাজত্বকালে অনেক রকম অভিজ্ঞতা হয়। সে সময় প্রায়শই ঢাকায় অস্বাভাবিক রূপ পরিলক্ষিত হতো। কারফিউ, জরুরি অবস্থা, নানান রকম বিধিনিষেধের মধ্যে চলাচল করতে হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর বেবিট্যাক্সি থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ, কারফিউ পাস দেখতে চাওয়াসহ কত রকম বায়নাক্কার যে মুখোমুখি হতে হয়েছে। সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার পরও নিরাপত্তা বাহিনীর সন্দেহ দূর হতে চাইতো না। মুখ ব্যাদান করে যেতে দিত। অবশ্য তাতে আমাদের কিছু আসতো যেত না। সাংবাদিকরা আবার কবে কাকে পরোয়া করেছে? এর পরও বিভিন্ন সময়ে কারফিউ, জরুরি অবস্থার মধ্যেই চলাচল করতে হয়েছে। তাতে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি। আমরা তো আর আইন অমান্য করে চলাফেরা করতাম না। পেশার খাতিরে রাস্তায় নামতে হতো। রাত তো বরাবরই গুলজার করে রাখে প্রেস, প্রস আর পুলিশ। তাই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে চলাচল করলেও এক ধরনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি হতো।
ক’দিন হলো, পুরানো সেই রাতগুলো যেন আবার ফিরে এসেছে। পুরোপুরিভাবে না হলেও অনেকটা তেমনই। শব্দ ও তাৎপর্যগত কিছুটা হেরফের হয়তো আছে। যদিও আগের মতো রাতের গভীর-গোপন রহস্যময়তা নেই। অনেক মানুষ, অনেক সড়ক, অনেক যানবাহন আর আলোর ঝলমলানিতে এ শহরে ব্যস্ততার কোনো কমতি নেই। মধ্য রাতেও দীর্ঘক্ষণ সিগনালের অপেক্ষায় থাকতে হয়। পরিবেশও আগের মতো নেই। কিন্তু ইদানিং পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে অবিকল সেই রাতগুলোর অনুরূপ। এখন তো সন্ধ্যা ৬টার পর একদম লকডাউনই হয়ে যায়। রাত বাড়তে থাকলে কেমন যেন একটা গা ছমছম করা ভাব। রাস্তার আলোও মনের ভিতরটাকে রাঙিয়ে দিতে পারে না। বরং ম্লান হলদে রঙের আলোয় ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বড় বড় বিল্ডিংগুলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। পথের পাশের দোকানপাটে থাকে না প্রাণের উত্তাপ।
এ ধরনের নির্জন পরিস্থিতিতে কেন যেন বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা রাস্তাঘাট, অলিগলিতে খুব বেড়ে যায়। তাতে সব কিছু আরো বেশি অস্বাভাবিক লাগতে থাকে। লোক চলাচল থাকে না বললেই চলে। চলাচল করেন একদমই হাতেগোনা কয়েকজন। হয়তো জরুরি কোনো প্রয়োজনে কারো কারো বের না হয়ে উপায় থাকে না। আবার কেউ কেউ অবশ্য কৌতূহলী হয়েও বের হন। আমাদের অকারণ কৌতূহল তো অন্তহীন। যে কারণে লেগে থাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। হঠাৎ হঠাৎ ছুটে যায় বিভিন্ন বাহিনীর গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স, মিডিয়ার তৎপর বাহন। খান খান করে ভেঙে দেয় রাজপথের হিরণ্ময় নীরবতা। এরই মধ্যে হুট করে কোথাও থেকে এসে পড়ে প্রাইভেট কার, মোটর সাইকেল এমনকি রিকশাও। সঙ্গত কারণে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হয়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার এই সময়ে কেউ কারো কাছাকাছি হওয়াটাও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। দায়িত্বের অংশ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অপ্রিয় এ কাজটি করতে হয়। সবার নিরাপত্তার জন্য নিজেদের নিরাপত্তা ব্যাহত করা ছাড়া উপায়ও নেই।
আগেই লিখেছি, রাতের ঢাকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক মেলা দিনের। অতীতের সেই সময়ে রাতের বেলা ভয়ের অনেক কারণ ছিল। কিন্তু কখনও ভয় লাগেনি। অথচ এই সময়ে ভয়ের বড় কোনো কারণ না থাকলেও রাতের ঢাকায় চলাফেরা করতে গিয়ে রীতিমতো আতঙ্কে থাকি। গাড়িতে থাকলেও কেউ কাছাকাছি এলে, কোনো কিছুর ছোঁয়া লাগলে কিংবা কোথাও দিয়ে চলাচল করলে প্রতিনিয়ত মনে হয়, অদৃশ্য সেই শক্তিমান বুঝি কোথাও ঘাপটি মেরে আছেন কিংবা শরীরের ফাঁক-ফোকর দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েছেন। সেই সংশয় কিছুতেই কাটতে চায় না। তখন মনে হতে থাকে, দেহের তাপমাত্রা বোধহয় বেড়ে গেছে, চিরস্থায়ী হয়ে যাওয়া পরিচিত কাশিটাকে একটু অন্যরকম মনে হতে থাকে, শরীরটা কেমন ব্যথা ব্যথা অনুভূত হতে থাকে। লক্ষণগুলো মনে মনে কেমন করে যেন দুয়ে দুয়ে চার হয়ে যায়। এরপর কি আর স্বাভাবিক থাকা যায়। দোয়া-দরূদ পড়ে একটা প্রস্ততি নিতে থাকি।
তারপর চারপাশটাকে শেষবারের মতো পরিপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখতে থাকি। পৃথিবীটাকে মায়াবী হরিণের মতো খুব আপন মনে হতে থাকে। হায়! কেন যে এত মায়া মায়া লাগে?
১২ এপ্রিল ২০২০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন