পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২১

বন্ধন






দীর্ঘ দিন খাঁচায় বন্দী পাখি হঠাৎ মুক্তি পেলে কেমন দিশাহারা হয়ে যায়। কী করবে, কী করবে না, ঠিক বুঝতে পারে না। এমনকি ওড়তেও যেন ভুলে যায়। যে খাঁচাটা ছিল তার মুক্তির অন্তরায় কিন্তু সার্বক্ষণিক সঙ্গী, তাকে বোধকরি কিছুতেই ভুলতে পারে না। সেখানেই ফিরে যাওয়ার জন্য মনটা একরকম আকুলি-বিকুলি করে। আবদ্ধ থেকে থেকে স্বাধীনতার ইচ্ছেটাও হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। 

ঈদে কয়েকটা দিন ছুটি পাওয়ার পর মুক্তি পাওয়া অবরুদ্ধ পাখির মতো নিজেকে মনে হতে থাকে মেহরাবের। একটানা কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে হয়ে উঠে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের বাসিন্দা। কারও সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। কোথাও যাওয়া-আসা নেই। কোনও খোঁজ-খবরও নেই। সব ক্ষেত্রে এমন একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, চাইলেও এ ব্যবধান এখন ঘুচানো সম্ভব হয়ে উঠে না। সবাই যখন ছুটির জন্য তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় থাকে, তখন তার কাছে ছুটিটাকে কী এক অদ্ভুত কারণে উপভোগ্য মনে হয় না। 

ছুটির প্রথম দু’দিন পড়ে পড়ে ঘুমানোর পর একঘেয়ে লাগতে থাকে। অভ্যস্ত জীবনের বাইরে মানিয়ে নেওয়াটা একরকম কঠিন হয়ে পড়ে। অন্তর্মুখী, অন্তর্নিবিষ্ট ও সংবেদনশীল স্বভাবের কারণে এমনিতেই মেহরাব কোথাও খাপ খাওয়াতে পারে না। দিনের পর দিন কর্মক্ষেত্রের দায়িত্বশীল কাজের চাপে মানসিকভাবে হয়ে পড়েছে অনেকটা ক্রীতদাসের মতো। কাজের নিচেই চাপা পড়ে যায় তার যাবতীয় আনন্দ, উল্লাস, উচ্ছ্বাস।  

মেহরাব হারিয়ে ফেলেছে সামাজিকতাও। যদিও বিয়ে না করায় কোনও সাংসারিক বন্ধনও নেই। বয়সও অবশ্য কম হলো না। পারিবারিক ও সামাজিক কোনও অনুষ্ঠানে তার যোগ দেওয়া হয় না। কারো সঙ্গে আড্ডা মারা এমনকি ফোনে দু’দণ্ড কথা বলাও হয় না তার। তবে দু’একজনের সঙ্গে ফোনে ফোনে এখনও কদাচিৎ যোগাযোগ হয়, তাদের একজন তাহের। ছোটবেলার অন্তরঙ্গ বন্ধু। কী ভেবে তাকে ফোন করে। অনেকক্ষণ কথা বলার পর তাহের মেহরাবের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে তার বাসায় যেতে বলে। সেখানে যাওয়ার পর তাহের তার প্রাইভেট কার-এ করে তাকে নিয়ে যানজটবিহীন সড়কে ড্রাইভ করতে থাকে। 

অল্প কিছুক্ষণ পর ফাইভ স্টার একটি হোটেলের কার পার্কিং-এ গাড়ি পার্ক করতে করতে তাহের মেহরাবকে বলে, খানিকটা সময় তোর মুহূর্তগুলোকে আনন্দময় করা যায় কিনা চল দেখি। এ ধরনের অভিজাত হোটেলে মেহরাবের খুব একটা আসা হয় না। আসলেও বিভিন্ন কাজে আসতে হয়েছে। সময় কাটানোর জন্য ব্যয়বহুল এমন স্থানে তার আসার প্রশ্নই আসে না। যে কারণে ভিতরের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তার প্রত্যক্ষ কোনও ধারণা নেই। 

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতেই হাসিমুখে তাদেরকে সাদর সম্ভাষণ জানানো হয়। আলো-আঁধারের একটি কক্ষে ঢুকতেই ভিন্ন একটি জগতের সন্ধান মেলে। সব যেন ছায়া ছায়া শরীর। কারও মুখই স্পষ্ঠভাবে দেখা যায় না। কেউ বসে আছেন। কেউ হাঁটছেন। অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়ার পর অবয়বগুলো ধীরে ধীরে পরিস্ফুট হতে থাকে। তাদের মধ্যে খুবসুরত নারীর সংখ্যাই বেশি। সবার পরনে জাঁকালো পোশাক। কড়া মেকআপ। লীলায়িত ভঙ্গিমায় চলাফেরা করছে। অদূরে একটি স্টেজকে ঘিরে রঙিন আলোর ফোয়ারা। বড় স্ক্রিনে বাজছে চড়া সুরের গান। সেই গানের তালে তালে অনেকেই নাচছেন। কেউ এককভাবে। কেউ কেউ যুগলভাবে। 

এমন ঝলমলে পরিবেশে কখনও আসা হয় নি মেহরাবের। সে কিছুই বুঝতে পারছিল না। পেছনের দিকে দেওয়াল ঘেঁষে খালি সোফা পেয়ে মেহরাবরা বসে পড়ে। চুপচাপ বসে থেকে অবস্থা অনুমান করার চেষ্টা করছিল। এমন সময় লাস্যময়ী দুজন তরুণী যেচে এসে তাদের কাছে অনুমতি চেয়ে বলে, ক্যান উই সিট হিয়ার? উত্তর দেওয়ার আগেই তারা চট করে বসে পড়ে। একজনের পরনে হাল ফ্যাশনের টি-শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট। ফিগারটা বেশ আকর্ষণীয়। অন্য জনের পরনে শিফনের ফিনফিনে শাড়ি। ছিপছিপে গড়ন। উভয়েরই উগ্র সাজ। ঠোঁটে মারদাঙ্গা লিপস্টিক। কথা-বার্তায় দারুণ চটপটে। মুখে লেগে আছে সার্বক্ষণিক বিজ্ঞাপনী হাসি। 

মেহরাব কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়। সামনে বসার অনেক খালি আসন থাকা সত্ত্বেও মেয়ে দুজন কেন এখানে এসে বসলো, ঠিক ঠাওর করতে পারছিল না। তাহেরকে দেখে মনে হলো, এসবে সে বেশ অভিজ্ঞ। সে তার পাশে বসা শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পরা অচেনা মেয়েটির সঙ্গে দিব্যি আলাপ চালিয়ে যেতে থাকে। যেন তাদের কত দিনের চেনা। মেহরাব চুপচাপ থাকায় পাশে বসা শাড়ি পরা মেয়েটি তার সঙ্গে কথা বলার জন্য উদ্যোগী হয়। মেয়েটি তার নাম জানতে চাইলে সেটা সে জানিয়ে দেয়। এরপর ভদ্রতা করে মেহরাব পাল্টা নাম জানতে চাইলে মেয়েটি জানায় তার নাম শায়লা। 

কক্ষের একপাশে পানশালা। তারপর ছড়ানো-ছিটানো চেয়ার-টেবিল। বিভিন্ন ডিজাইনের। অধিকাংশ টেবিলে বসা জোড়ায় জোড়ায়। খুবই ঘনিষ্টভাবে। পরস্পরের মধ্যে কুটির শিল্পের মতো চলতে থাকে আদর-সোহাগ। অন্ধকারে যতটা কাছাকাছি হওয়া যায়, সে ব্যাপারে মোটেও কার্পণ্য করা হচ্ছে না। অর্ডার অনুসারে টেবিলে টেবিলে ওয়েটাররা পরিবেশন করছে ধূসর-কমলা-লাল-নীলাভ বেগুনি রঙের উত্তেজক কিংবা অনুত্তেজক বিবর্ণ হলুদ পানীয়। কারও কারও হাতে জোনাকির মতো জ্বলছে সিগারেট। কুণ্ডুলি পাকিয়ে ওড়ছে ধোঁয়া। জ্বালাপোড়া করতে থাকে মেহরাবের চোখ। 

পরিবেশটা কেমন যেন নেশা নেশা লাগানো। জমকালো সাজে অনেক তরুণী ঘুরপাক খেতে থাকে। সবাই চড়ুই পাখির মতো কেন যেন অস্থির। অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে কখনও বসে থাকে। কখনও র‌্যাম্পের মডেলদের মতো অলস ভঙ্গিতে হেঁটে যায়। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কত রকমভাবেই না কসরত চলতে থাকে। চোখে-মুখে এক ধরনের মাদকতা ছড়ানো। মৌমাছি যেভাবে ওড়ে ওড়ে ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহ করে, তাদের দেখে তেমনই মনে হতে থাকে। 

অর্ডার দেওয়ার পর তাহের ও মেহরাবকে পরিবেশন করা হয় ঠাণ্ডা বিয়ার। তাহেরের সম্মতিক্রমে মেয়ে দুটি চেয়ে নেয় হার্ড ড্রিংকস। জিন্স পরা মেয়েটি নিজের পরিচয় দেয় জেনি হিসেবে। ভাব-ভঙ্গিতে বোঝা যায়, বেশ অভিজ্ঞ ও কৌশলী। বিয়ারের ক্যান সাবলীলভাবে ওপেন করে জেনি তাহেরের গ্লাসে আর শায়লা মেহরাবের গ্লাসে পানীয় ঢেলে দেয়। একটু একটু করে ফেনিল গ্লাসে চুমুক দেওয়ার পর টেবিলের পরিবেশটা হয়ে উঠে কেমন মোহময়। 

জেনির ক্রমান্বয়ে নির্লজ্জ হয়ে উঠাটা দৃশ্যমান হতে থাকে। আশকারা পেয়ে কোনও রাখঢাক রাখছিল না। তাহের তার আদর চুটিয়ে উপভোগ করছিল। খুব স্বাভাবিকভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল জেনির নিতম্বে। দু’একটি কথা বলার পর মেহরাবের অন্তরঙ্গ হওয়ার চেষ্টা করে শায়লা। মেহরারেব সাড়া না পেয়ে মেয়েটির মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করতে থাকে। জানতে চায়, মেহরাব কেন এত নির্লিপ্ত? বন্ধুর মতো কেন আমুদে নয়? 

এক ফাঁকে মেহরাব ওয়াশরুমে গেলে একটু পর সেখানে তাহেরও উপস্থিত হয়। তাহের রাগাণ্বিত হয়ে তাকে বলে, কীরে, হাবলার মতো বসে থাকিস কেন? ভড়কে গিয়ে মেহরাব জানতে চায়, কেন, কী করবো? তাহের বলে, এই মেয়েরা এসেছে আনন্দ দিতে। বিনিময়ে ড্রিঙ্ক করবে। যাওয়ার সময় কিছু পারিতোষিকও নিয়ে যাবে। তাহলে বসে বসে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। যতটুকু পারা যায় সময়টাকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ কর। কেউ কিছু মনে করবে না। এমনকি চাইলে তাদের কোথাও নিয়ে শারীরিক প্রয়োজনও মেটানো যায়। এ কথা শুনে মেহরাবের টাসকি লেগে যায়। অভিজাত একটি হোটেলে এভাবে প্রকাশ্যে শরীর কেনা-বেচা যায়, এটা সে ভাবতেও পারে নি। 

নিজের আসনে মেহরাব ফিরে আসার পর শায়লা যেন একটু বেশি আহ্লাদী হয়ে ওঠে। তাকে প্রলুব্ধ করার নিরন্তন চেষ্টা করতে থাকে। জমে উঠে তার রঙিন নেশা। একটু একটু ঢলে পড়তে থাকে। একপর্যায়ে জেনি উঠে অন্য টেবিলে চলে যায়। মেহরাব খেয়াল করে দেখেছে, এই মেয়েরা এক টেবিলে কেউ বেশিক্ষণ বসে থাকে না। ঘন ঘন টেবিল বদল করে। সঙ্গত কারণে আনুপাতিক হারে বাড়তে থাকে পারিতোষিকও। 

একরাশ কৌতূহল নিয়ে মেহরাব শায়লাকে জিঞ্জেস করে, কিছু মনে করো না, তোমাকে দেখে, তোমার কথা শুনে মনে হয়, তুমি ভদ্র পরিবারের সন্তান। তাহলে কেন এখানে এভাবে আসো? এমন প্রশ্নের জন্য শায়লা বোধকরি প্রস্তুত ছিল না। কথাটা শুনে একটু ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ঝাঁজালো কণ্ঠে বলে, তাতে তোমার কী? আমার জীবন। আমি যা খুশি তাই করবো, তুমি আমাকে জিঞ্জেস করার কে? তার এমন রাগাণ্বিত অভিব্যক্তিতে থতমত খেয়ে যায় মেহরাব। কী করবে বুঝতে পারে না। বাদাম আর চানাচুর সহযোগে বিয়ারের গ্লাসে ঘন ঘন চুমুক দিতে থাকে। এই ফাঁকে কোথায় যেন যায় তাহের।  

অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর শায়লা মেহরাবের কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে মৃদুলয়ে কাঁদতে থাকে। যদিও মিউজিকের উদ্দাম বিট আর লীলাচঞ্চলতা নিয়ে সবাই ব্যতিব্যস্ত। কে কী করলো, তা নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। তবুও বিব্রত হয়ে পড়ে মেহরাব। শায়লা দু’হাত দিয়ে তার গলা অন্তরঙ্গভাবে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকে, আজ অব্দি আমার কাছে কেউ এমন কথা জানতে চায় নি। সবাই আসে আমার শরীর নিয়ে লুটাপুটি করতে। আমিও তাদের সেই সুযোগ করে দেই। এখানে আসি স্রেফ অর্থের জন্য। নতুবা নিজের লাজ-লজ্জা বিকিয়ে দিয়ে কেন প্রকাশ্যে এভাবে খোল্লামখুল্লা হতে আসবো? নিয়তি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমি তো আসতে চাই নি। ওর কথা শুনে মেহরাবের বেশ খারাপ লাগতে থাকে। 

অনেকটা সময়ের জন্য সম্ভবত রিফ্রেশ রুম থেকে ফিরে আসার পর শায়লাকে খানিকটা ধাতস্থ মনে হয়। একটু সতেজ সতেজ লাগে। কী যেন ভাবতে থাকে। পান করতে থাকে আনমনে। এরপর দার্শনিকসুলভভাবে হঠাৎ বলতে থাকে, আচ্ছা বলো তো, জীবন এমন কেন? জীবন নিয়ে কত আশা ছিল। কত স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন আজ ভেঙেচুরে গেছে। যা চাই তা পাই না। যা পাই তা চাই না। তবুও জীবনকে তো চালিয়ে নিতে হয়। শায়লাকে কথায় পেয়ে বসে। যেন মৌচাকে টোকা পড়েছে। জীবনের না বলা কথাগুলো বলার জন্য সে নিজেই ছটফট করতে থাকে। 

অনর্গল বলে যেতে থাকে, আমার বয়স হয়তো খুব বেশি নয়। এই জীবনে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি, সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আমি বেড়ে উঠেছি মধ্যবিত্ত এক পরিবারে। আমরা ছিলাম অনেকগুলো ভাইবোন। আমার চেহারা ও সৌন্দর্য ছিল চোখে পড়ার মতো। আমি খুব হৈহুল্লোড় পছন্দ করতাম। কোনও বন্ধন ছিল না। বন্ধু-বান্ধবেরও কোনও কমতি ছিল না। ছেলে বন্ধুর সংখ্যাই ছিল বেশি। তাদের সঙ্গে আড্ডা মারতাম। হৈচৈ করতাম। বিভিন্ন পার্টিতে যোগ দিতাম। বাসা থেকে বারণ করা হলেও পাত্তা দিতাম না। 

বন্ধুদের আয়োজনে একবার একটি হোটেলের জমকালো পার্টিতে অপরিমিত পান করায় কোনও হুঁশ ছিল না। বেসামাল হয়ে যাই। তারপর আমার যখন জ্ঞান ফেরে, নিজেকে হাসপাতালের বেডে দেখতে পাই। জানতে পারি, আমাকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে একের পর এক আমার সম্ভ্রমহানি করে ফেলে রেখে যায়। হোটেল কর্তৃপক্ষ আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমার জীবন নিয়ে দেখা দেয় গভীরতর সংকট। জীবনমৃত্যুর দোদুল্যমান অবস্থা থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য আমার পরিবারকে দেদার অর্থ ঢালতে হয়। এই চিকিৎসা-ব্যয় ছিল তাদের সামর্থ্যর বাইরে। মান-সম্মানের ভয়ে এ নিয়ে কোনও মামলা করা হয় নি। কোনোরকম উচ্চবাচ্যও করা হয় নি। বরং লোকলজ্জার ভয়ে আমরা যে এলাকায় থাকতাম, সেই এলাকাও ছেড়ে দিতে হয়। 

কথা বলতে বলতে শায়লা অনেকক্ষণ গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিল না। মেহরাব তার হাতে গ্লাসটা তুলে দিতেই গলা ভিজিয়ে নেয়। টিস্যু দিয়ে মুখটা আলতোভাবে মুছে নেয়। হোটেলের ডিস্কোথেক তখন জমজমাট। সেদিকে একনজর বুলিয়ে ফের কথা বলতে শুরু করে। বলতে থাকে, আমার আর পড়ালেখা করা হয় নি। অল্প কিছু দিন পর আমাকে বিয়ে দেওয়া হয়। আমার কারণে আমার পরিবার আর্থিকভাবে অনেকটা সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। বিয়ের পর আমিও যেন গ্লানি থেকে মুক্তি পাই। নিজেকে একদমই বদলে ফেলি। সংসার ছাড়া কিছুই বুঝতাম না। এক সন্তান নিয়ে আমার ছিল মোটামুটি সুখের সংসার। 

কিন্ত কপালে সুখ লেখা না থাকলে কি আর সুখি হওয়া যায়? আমার অতীতের কলঙ্কময় অধ্যায় যখন থিতিয়ে আসছিল, তখন সেই ঘটনাটি নতুন করে আমার কপাল পুড়িয়ে দেয়। একদিন আমার হাজব্যান্ড গম্ভীর মুখে বাসায় ফেরে। কোনও কথা না বলে চুপচাপ বসে থাকে। ও এমনিতে খুব হাসিখুশি স্বভাবের। বাসায় আসলে বাচ্চাকে নিয়ে মেতে ওঠে। আমার সঙ্গেও বেশ মজা করে। সেদিন তাকে ঠিক চিনতে পারছিলাম না। এমন রূপে, এমন মেজাজে তাকে কখনও দেখি নি। বুঝলাম, মারাত্মক কিছু একটা হয়েছে। কাছে গিয়ে সহানুভূতির সুরে জানতে চাইলাম, তোমার কী হয়েছে? কোনও উত্তর দিচ্ছিল না। কয়েকবার বলার পর তীব্র রাগে ফেটে পড়ে। চিৎকার করে আমাকে বেশ্যামাগি গালি দিয়ে আমাদের সন্তানকে দেখিয়ে জানতে চাইলো, এই সন্তান কার? কী তার পরিচয়? কেন আমি তার জীবন বরবাদ করে দিলাম? 

আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কী এমন করলাম আমি? ভেবে-চিন্তে কোনও কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না। তখন সে চণ্ডমূর্তি ধারণ করে বেমক্কা আমার চুলের মুঠি ধরে তার মোবাইল ওপেন করলে যা দেখতে পাই, তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। সেই রাতে আমাকে ধর্ষণ করার দৃশ্য ভিডিও করে বন্ধুরা যে ইউটিউবে কবে ছেড়ে দিয়েছে, সেটা জানতাম না। মানুষ যে কতটা নিষ্ঠুর হয়, সেদিন বুঝতে পারি। আমাকে মৃত্যুর মুখে ফেলে দিয়েও তাদের স্বাদ মেটে নি, আমার জীবনটাকে বিপর্যস্ত করে দেওয়ার ব্যাপারেও কোনও কার্পণ্য করে নি। ভিডিও দেখে আমার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। সেই মুহূর্তে আমার আসলে বলার কিছু ছিল না। রাতেই সন্তানসহ আমাকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। বাবা-মায়ের সংসারে ফিরে যাওয়ার পর আমি সেখানেও গলগ্রহ হিসেবে গণ্য হতে থাকি। অবশ্য তাদেরইবা দোষ কি? পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা এমন নয় যে তারা বাড়তি দুজন মানুষকে বহন করতে পারবে। 

অনেক জায়গায় চাকরির সন্ধান করে ব্যর্থ হই। এ অবস্থায় একজনের মাধ্যমে এখানে আসি। অর্থ আয়ের জন্য এরচেয়ে সহজ উপায় আর খুঁজে পাই নি। তারপর থেকে এটাই হয়ে উঠেছে আমার আয়-রোজকারের উৎস। যদিও এখানেও সইতে হয় অনেক অপমান, অনেক লাঞ্ছনা। প্রতিদ্বন্দ্বিতাও কম নয়। এরসঙ্গেও মানিয়ে নিয়েছি। এছাড়া কীইবা করার আছে? এখন আলাদা বাসা নিয়ে থাকি। যদিও বাসা পেতেও বেশ ঝক্কি পোহাতে হয়। বাচ্চাটাকে কাজের বুয়ার কাছে রেখে আসতে হয়। বাড়িওয়ালা জানে, এই হোটেলে আমি দায়িত্বশীল পদে কর্মরত আছি। 

শায়লার সব কথা শোনার পর মেহরাব অনেকক্ষণ নিশ্চুপ বসে থাকে। ভিতরে ভিতরে নিজের সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়া করে। অনেক ভাবনার পর শায়লার কাছে সরাসরি জানতে চায়, আচ্ছা, সব কিছু জেনে কেউ যদি তোমাকে জীবনসঙ্গী করতে চায়, তুমি কি তাকে বিয়ে করবে? শায়লা মেহরারেব চোখের দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকে। অনুভব করার চেষ্টা করে একজন দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন বড় হৃদয়ের সরল মানুষকে। তার ভিতরটা তোলপাড় করতে থাকে। তারপর অনেকক্ষণ ভেবে ধীরেসুস্থে বলে, এ জীবনে আমার কিছু চাওয়ার নেই। কোনও বন্ধনেও আর জড়াতে চাই না। এখন যেভাবে আছি, ভালোই আছি। কারও ওপর নির্ভরশীল নই। জানি, জীবন এভাবে লাগামহীনভাবে চিরদিন বয়ে যাবে না। যত দিন যায়, যাক না। নিয়তি আমাকে যেদিকে নিয়ে যাবে, সেদিকেই যাবো। জেনেশুনে আর কোনও ভুল করতে চাই না। জড়াতে চাই না সম্পর্কের জটিলতায়।  


মেহরাব বুঝতে পারে, তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে কারও কারও কাছে সম্পর্কের বন্ধন কাঙ্খিত নয়। আবার কেউ কেউ সম্পর্কের বন্ধনে জড়াতে চাইলেও ভাগ্য তাকে দূরে সরিয়ে রাখে। তবুও যে মেহরাব কোথাও খাপ খাওয়াতে পারে না, কারও সঙ্গে মিশতে পারে না, কোথাও যেতে চায় না, সেই মেহরাবই এখন সন্ধ্যা হলে নিয়মিতই ছুটে যায় অভিজাত হোটেলের ডিস্কোথেকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন