পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২১

মন কেন বুঝতে চায় না

 


কী অদ্ভুত এক জীবন! যে জীবন আমি চাইনি, সেই জীবন আমাকে মেনে নিতে হচ্ছে। না মেনে তো উপায়ও নেই। মেনে নিয়েই একান্ত নিরুপায় হয়ে ঘরবন্দি থাকতে হচ্ছে। যদিও এখনও আমাকে সপ্তাহে তিন দিন বাসা থেকে বের হতে হয়। সেটাইবা কত দিন পারবো, কে জানে? যেভাবে আশপাশ ঘিরে ফেলেছে করোনা বাহিনী, কখন যে শমন জারি হয়? তারপরও নিজেকে মুক্ত বিহঙ্গ ভাবা যাচ্ছে না। কীভাবে ভাববো? যে আমাকে প্রায় সারাদিনই কাজের প্রয়োজনে বাইরে বাইরে থাকতে হয়, তার এভাবে স্বেচ্ছাবন্দি থাকাটাকে ‘দণ্ডকারণ্যে নির্বাসন’-এ পাঠানোর মতো মনে হচ্ছে। অথচ অফুরন্ত এই ‘ছুটি’কে আমার প্রাণভরে উপভোগ করার কথা। তা একদমই উপভোগ্য হয়ে ওঠছে না।

আমাকে যাঁরা ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন বা জানেন, তাঁদের অনেকেই আমার ওপর মাঝে-মধ্যে খুবই বিরক্ত হন। সেটা আমি সহজে বুঝতে পারি। এ বিরক্তিটা কোনো তিক্ততা থেকে নয়, বরং গভীর ভালোবাসা থেকে উৎসারিত। আমার কাজ-কর্মের ধরন দেখে তাঁরাই ফেড-আপ হয়ে যান। নিজেকে সতেজ রাখার জন্য আমাকে তাঁরা মাঝে মাঝে বিশ্রাম বা ছুটি নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে আসতে বলেন। আমিও যৌক্তিক কারণেই সহমত পোষণ করি। ভাবি, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শিষের উপরে, একটি শিশিরবিন্দু’। এমনকি পেশাগত কাজে গিয়ে আমার বন্ধু বা সহকর্মীরা যখন কোপাকাবানা সৈকতে সূর্যাস্ত উপভোগ করেন কিংবা বিলাসবহুল অন্য কোথাও গিয়ে উচ্ছ্বলতায় মেতে ওঠেন, আমারও তখন ইচ্ছে হয়, কাজের ফাঁকে হাতিরঝিলে কিংবা বছিলা ব্রিজে গিয়ে অন্তত দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে আসতে। এর বেশি সামর্থ্য তো আমার নেই। শেষ পর্যন্ত সে ইচ্ছেটাও অপূর্ণ রয়ে যায়। এ অপূর্ণতা নিয়েই জীবনের পরিধি ক্রমশ সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে। তা নিয়ে আমার কোনো আক্ষেপ নেই।

যদিও এই করোনাকালে কোথাও যাবার সুযোগ নেই, কিন্তু বাসায় বসে ছুটিটা অন্তত চুটিয়ে উপভোগ করা যায়। কেন যেন সেটাও পারছি না। আমার স্বভাবটা এমন, মিষ্টি হাসি দিয়ে আমার কাছ থেকে কঠিন কাজ যত সহজে আদায় করা যায়, কোষ্ঠকাঠিন্য মনোভাব দেখিয়ে সহজ কাজটা করে নেওয়া ততটাই কিন্তু কঠিন। যে জন্য মুফতে ছুটি পেলেও এর সঙ্গে মোটেও মানিয়ে নিতে পারছি না। এমন ছুটি তো আমার কাঙ্খিত ছিল না। যে কারণে সব মিলিয়ে একটা অস্থিরতার মধ্যে দিন কাটছে। কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। মানসিক শান্তি যদি না থাকে, তাহলে কীসের ছুটি, কীসের বিশ্রাম আর কীসের প্রশান্তি?  

সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার, সেই স্কুল বয়স থেকে সংবাদপত্র পাঠ করাটা যে কোনও কারণেই হোক অভ্যাসে পরিণত হয়। আর কোনো অভ্যাস বোধকরি এত দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এর কারণ কি জানি না। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি সংবাদবিহীন সরকার ও সরকারবিহীন সংবাদপত্রের একটিকে বেছে নিতে বলা হয়, তবে দ্বিতীয়টি বেছে নিতে আমি এক মুহুর্ত দ্বিধা করবো না’। যদিও সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার কোনো সম্ভাবনা আমার নেই, সঙ্গত কারণে এমন প্রশ্ন কেউ আমাকে করবেনও না। কিন্তু সংবাদপত্রের প্রতি নিখাদ ভালোবাসাটা সহজাতভাবেই গড়ে ওঠেছে। সংবাদপত্রবিহীন একটি দিনও আমি কল্পনা করতে পারি না। আজ অব্দি এ অভ্যাসের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। হাসপাতালে অনেক দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর বাসায় ফিরে এসে না দেখা সংবাদপত্রে একবার অন্তত চোখ না বুলাতে পারলে অস্বস্তিটা কিছুতেই দূর হতে চায় না। মনে হয়, কোথায় যেন অসম্পূর্ণতা রয়ে গেল।

অথচ সেই আমি বেশ কয়েক দিন হলো, কী অদ্ভুতভাবে সংবাদপত্র ছাড়াই দিনগুলো কাটিয়ে দিচ্ছি। সংবাদপত্র যেমন হাতের নাগালে পাচ্ছি না, তেমনিভাবে আমিও সেই তাগিদ অনুভব করছি না। আর কারো এমন মনোভাব হচ্ছে কিনা আমি জানি না। একজন নাগরিক মানুষ, যে নিজেও মিডিয়া ঘরানার, সে কিনা  সংবাদপত্রের সংস্পর্শে নেই! এটা কি সুস্থ জীবনবোধের লক্ষণ? অবশ্য সময়টাও তো সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর নয়। তার আবার জীবনবোধ!

এমনিতেই ভার্চুয়াল জগতের কারণে প্রিন্ট মিডিয়া তো বটেই, ইলেকট্রনিক মিডিয়াও মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এ অবস্থায় করোনাভাইরাস প্রিন্ট মিডিয়ার ভবিষ্যতকে অনেক বেশি অনিশ্চিত করে তুলবে বলে আমার মনে হচ্ছে। অনির্ণেয় এ রোগের কারণে বদলে যাচ্ছে মানুষের অভ্যাস, রুচি ও মন-মানসিকতা। কেবলই মিডিয়া নয়, করোনা পরবর্তী সময়ে বদলে যাবে অনেক কিছুরই খোলনলচে। তা কতটা ও কীভাবে যাবে, আমরা হয়তো কল্পনাও করতে পারছি না। 

না চাইলেও মনের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ হাহাকার করে উঠে, বদলে যাওয়া সেই অচিন সময়টাকে দেখার সুযোগ কি পাওয়া যাবে? এ ভাবনাটা সারাক্ষণ মাথার মধ্যে চেপে বসে আছে। কথায় বলে, ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’। এ শয়তানটা হরদম মাথার মধ্যে শুধু প্যাঁচ কষছে। ঘুমাতে যাবার আগে এবং ঘুম থেকে উঠার পর অনবরত নেতিবাচক ভাবনায় পেয়ে বসে। তা থেকে পরিত্রাণ পাচ্ছি না। এমন ভাবনা না ভাবার জন্য মনকে কত করে বোঝাই। ব্যাটা মন কিছুতেই বুঝতেই চায় না। অবশ্য মন কবেইবা আমাকে বুঝেছিল?

৮ এপ্রিল ২০২০

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন