পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১

মর্মঘাতী সেই সুর

সেই সময়টা ছিল বোধকরি বিষণ্নতায় ভরা। রক্তক্ষয়ী এক মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলেও তখনও ভয়াল এক স্মৃতি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে থাকে। পথে-ঘাটেও লেগে ছিল রক্তের দাগ। পূর্বকালীন ঘটনার রেশ তো বুকের মধ্যে রেখাপাত না করে পারে না। এমন এক পরিবেশে বেড়ে উঠার সময় বিষাদাচ্ছন্ন না হয়ে কি উপায় থাকে? তদুপরি জীবনের প্রথম পাঠ যদি হয় মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’, তাহলে কৈশোরকাল তো বেদনাবোধে আক্রান্ত হবেই। এমন সময় আরো বেশি বেদনার্ত করে তোলেন নূরু মিঞা। তাঁকে আমি চিনতাম না। চেনার কথাও নয়। আর তাঁর নাম জানার তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু তাঁর বেহালার ছড় আমার বুকের ভিতরটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। যদিও সুরের ব্যাকরণ আমি বুঝি না। সেভাবে বুঝতে চাইও নি। তবে সুর যে মর্মস্পর্শ করতে পারে, চিত্তকে বিদীর্ণ করতে পারে, হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করতে পারে, সেটা অন্তত অনুধাবন করতে পেরেছি। আর এই অনুধাবনটুকু হয়ে যায় একদম অল্প বয়সেই। সেটা নূরু মিঞার কল্যাণে। 

তখন থাকতাম শের-এ-বাংলা নগরে। কোনো এক বিষাদিত দুপুরে শুনতে পাই মর্মঘাতী সেই সুর। সুরের টানে বের হয়ে আসি ঘরের বাইরে। দেখতে পাই, হালকা-পাতলা গড়নের কালো চেহারার মলিন এক লোককে। তাঁর কাঁধে ঝুলানো থলিতে উঁকি মারতে থাকে একতারা আর দোতারা। হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো তারে তারে বাজাতে থাকেন মর্মভেদী এক সুর। তা যে আমার বুকের মধ্যে চিরকালের জন্য স্থায়ী হয়ে যাবে, সেটা তখন বুঝতে পারি নি। আসলে এমনভাবে কোনো সুর আমাকে আর কখনও বিদ্ধ করতে পারে নি। যে কারণে সেই সুর যে অনেকটা গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের গ্রন্থের নামকরণের মতো ‘মেমোরিজ অব মাই মিলানকোলি ......’ হয়ে যায়, তা থেকে কখনও মুক্ত হতে পারি নি। স্মৃতির অংশ হয়ে যাওয়া সেই অবিনশ্বর সুর আমার বুকে হঠাৎ হঠাৎ বেজে ওঠে। তখন অনুভব করি আত্মঘাতী এক বেদনা। সেই অনুভবটুকু কাউকে বুঝিয়ে বলা যাবে না। 

সেই বয়সে সত্যিকার অর্থেই আমি নুরু মিঞা হতে চেয়েছিলাম। তাঁর কাছ থেকে একটি একতারা কিনে যখন তাতে টান দেই, জীবনে এর চেয়ে বেশি হতাশ আর কখনও হই নি। সেদিন একতারা বাজাতে না পারার বেদনায় যে মনোকষ্ট পেয়েছিলাম, সেই মর্মযাতনা, সেই ব্যর্থতাবোধ আমি কখনও ভুলতে পারি নি। আমি চেয়েছিলাম নুরু মিঞার শিষ্য হয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে। সেই সুযোগও আর পাই নি। নুরু মিঞার সঙ্গে আমার আর কখনও দেখা হয় নি। তাঁকে মনে মনে কতই না খুঁজেছি। সেই থেকে তিনি হয়ে আছেন আমার স্মৃতির অংশীদার। 

অবশেষে, তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হলো। আজ টিএসসি চত্বরে আগের মতো সেই অনুজ্জ্বলতা নিয়ে একাকী বেহালায় সুর তুলতে দেখলাম। কিন্তু সুরে সেই আত্মনাশী অনুভবটুকু কেন যেন পেলাম না। এটাও তো ঠিক, এরমধ্যে তো পেরিয়ে এসেছি কত কত কাল। এ সময়ে কি তাঁর আত্মনিমগ্নতায় খামতি হয়েছে নাকি আমারই অনুভবের অক্ষমতা? আমি বলতে পারবো না। তবে কাছে গিয়ে জানতে পারি তাঁর নাম। তাঁর নিবাস। কিন্তু তাঁকে বলতে পারি নি, তিনি আমার অস্তিত্বের সঙ্গে কতটা মিশে আছেন। এই বলতে না পারার যে অপারগতা, সেটাও সেই বিষণ্নতার কারণে। কৈশোরের সেই বিষণ্নতাবোধ যেভাবে নির্লিপ্ত ও নিঃসঙ্গ করে দেয়, সেটাকেই তো আজও বয়ে নিয়ে চলেছি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন