মেঘের 'পরে মেঘ জমেছে,
আঁধার করে আসে,
আমায় কেন বসিয়ে রাখ
একা দ্বারের পাশে৷
এই মুহূর্তে কেন যেন মনের গহিনে উচ্চারিত হতে থাকে রবীন্দ্রনাথ। জীবনের কিছু কিছু মুহূর্ত আসে, যখন মন হয়ে যায় উদাসী মেঘ। কোথায় যে ছুটে চলে, তার নাগাল পাওয়া যায় না। সম্ভবত এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে প্রকৃতির খেয়াল। না হলে কেন এমন হয়? বোধকরি বৃষ্টির সঙ্গে মনের একটা গোপন লেনদেন আছে। অঝোরে বৃষ্টি হতে থাকলে মনটা যেন কোথায় হারিয়ে যায়। চারপাশে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। কি যে ঘন, কি যে নিবিড়, কি যে মায়াবী। ভিজিয়ে দিতে থাকে ভিতরটাকে। ধুয়ে যেতে থাকে বুকের মধ্যে জমে থাকা কষ্টগুলো। বারান্দায় একাকী বসে আছি। টবের গাছগুলো বৃষ্টির পানি পেয়ে খুশিতে আটখানা। মনের আনন্দে হেলছে, দুলছে। গানও কি গাইছে? গ্রিলের ফাঁক গলে গায়ে এসে লাগতে থাকে বৃষ্টির ছাঁট। দুষ্টু মেয়ের মতো আমাকে আদরে, ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে থাকে। স্মৃতির আরশিতে উঁকি মারে ফেলে আসা সেই দিনগুলো।
রিকশায় ঘোরাঘুরি করাটা ছিল আমাদের কাছে পরম আনন্দ। সেদিন ছিল শাওন মাসের সকালবেলা। আকাশ ছিল নির্মেঘ। ঘণ্টা চুক্তিতে রিকশা নেই। সঙ্গে শুচিতা। ঢাকার উপান্ত ছুঁয়ে বছিলা ব্রিজ পেরিয়ে যাই। আমাদের কোনো গন্তব্য ছিল না। উদ্দেশ্যহীনভাবে চলা। দুই পাশে গ্রামীণ আবহ। ছোট ছোট বাড়িঘর। গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা। কোনো কোনো বাড়ির আঙ্গিনায় টলটলে পুকুর। কত বছর আগের কথা। তখনও কেরানীগঞ্জে উন্নয়নের তেমনভাবে ছোঁয়া লাগেনি। রাজধানীর এত কাছে যে গ্রামীণ পরিবেশ, না এলে বোঝা যেত না। রাস্তা কোথাও কোথাও ভাঙাচুরা। ঝাঁকুনি খেতে হয়। কখনো কখনো রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াতে হয়। তারপরও কোনো প্রতিবন্ধকতাই আমাদের উচ্ছ্বাসকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তখন যে ভালোবাসার গভীর জলে আমরা হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। যা দেখি তা-ই লাগে ভালো। টিনের হোটেলের সস্তা দুধের চা, ঠাণ্ডা শিঙারা কিংবা মাছি পরিবেষ্টিত জিলাপি অমৃত মনে হয়েছে।
কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ পথিমধ্যে শুরু হয় তুমুল বর্ষণ। যেন আকাশ ভেঙে পড়তে থাকে। এমন বর্ষণের মাঝে রিকশা চালানো একদমই অসম্ভব হয়ে পড়ে। রিকশায়ও বসে থাকাও কঠিন হয়ে যায়। যে কোনো সময়ে উল্টে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়। বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আশেপাশে আশ্রয় নেওয়ার জায়গা ছিল না। রিকশা থেকে নেমে একটু ভিতরের দিকে যাই। সামনে একটা গুদাম ঘরের মতো। কিন্তু দরজা-জানলা বন্ধ। আশপাশে বড় বড় গাছপালার ছাউনি। তার নিচে গিয়ে দাঁড়াই। আমরা ভিজে চুরচুর। তবে বৃষ্টির ধাক্কা সামলানোর জন্য বিকল্প আর কিছু ছিল না। চারপাশে শুনশান নীরবতা। কেবল একটানা বেজে চলে উচ্চাঙ্গ সংগীতের মতো বৃষ্টির ধুন। তার সঙ্গে সঙ্গত করে কোলাব্যাঙ। পরিবেশটা বেশ রোমান্টিক। যদিও দুজনেই তখন ঠাণ্ডা হাওয়ায় রীতিমতো কাঁপছি। শুচিতার অবস্থা খুবই কাহিল। তার জন্য মায়া হয়। কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। মুখ মোছার জন্য আমার ভেজা রুমালটা বাড়িয়ে দেই। উষ্ণতা দেওয়ার জন্য তার হাত আমার হাতে নিয়ে ঘষতে থাকি। শুচিতার চোখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ে চাপা খুশির আভা। কখন যেন একে অপরের ভেজা ঠোঁটে ঠোঁট রাখি। আমরা যেন এমন কিছুর অপেক্ষায় ছিলাম। সেটাই ছিল আমাদের প্রথম চুম্বন। বৃষ্টি বেশ নাজেহাল করলেও স্মরণীয় হয়ে আছে রোমাঞ্চকর সেই স্মৃতি।

শুচিতাকে নিয়ে কত কত জায়গায় ঘুরতে গিয়েছি। কত রকম অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। যা আমার জীবনের পরম সম্পদ হয়ে আছে। একবার বিকেলবেলা বাদামতলী ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া নিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে ঘুরতে যাই। দুজনের কেউই সাঁতার জানতাম না। আসলে তখন কোনো ভয়ভীতি আমাদের মধ্যে কাজ করতো না। শুচিতার কোলে মাথা রেখে সূর্যাস্ত দেখেছিলাম। প্রকৃতি যে কত বড় চিত্রকর, তা পলে পলে অনুভব করেছি। আকাশের বুকে মেঘের শিল্পকর্ম চিরকালীন এক ভালো লাগার আবেশ ছড়িয়ে দেয়। মেঘের যে কত বিচিত্র রূপ, কত যে সৌন্দর্য, কত যে মাধুর্য তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি। অবশ্য শুচিতার নিবিড় সান্নিধ্যের কারণে সবটাই আরো বেশি মনোমুগ্ধকর লেগেছে। সূর্য ডুবে গেলে ঝপ করে অন্ধকার নেমে আসে। মনে হয়েছে গভীর রাত। যাত্রাপথ থেকে আমরা অনেকটাই দূরে চলে যাই। হুট করে বইতে থাকে ঝড়ো হাওয়া। সঙ্গে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। নৌকার উথালপাথাল বুকের মধ্যে কেমন কাঁপন ধরিয়ে দেয়। শুচিতা ভয় পেয়ে যায়। আমার হাত ধরে নির্ভরতা খোঁজে। আমি মোটেও সাহসী নই। তবে ভয় পেলেও সেটা বুঝতে দেইনি। মনে হলো, ইচ্ছে করলে তো মাঝিও আমাদের বিপদে ফেলতে পারতো। কিছুই তো করার ছিল না। ভয় কাটাতে মাঝির সঙ্গে নিরন্তর কথা বলি। ধীরে ধীরে নৌকা বয়ে যায়। নদীর দুই পাশে আলোর মালা দেখে সাহস ফিরে পাই। ক্রমান্বয়ে দৃশ্যমান হয় অদ্ভুত এক মায়াবী জগত। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা করলে যে এমন দৃশ্যপট দেখা যায়, সেই অভিজ্ঞতা প্রথম হয়। নদীর পানিতে তখন ঢেউ হয়ে দুলছিল আলোছায়ার প্রতিফলন। উভয় পাড়ে ঝিকিমিকি আলোর নাচন। ঘাটে ফিরে আসার পর স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ি। প্রাণের স্পন্দন দেখে বুঝতে পারি, সবে সন্ধ্যা নামছে মৃদু মন্থরে।
বর্ষাকালেই আমরা বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করি। আমাদের বিয়ে তো আর যেমন-তেমনভাবে হতে পারে না। নারায়ণগঞ্জের পাগলায় মেরি অ্যান্ডারসনের একটি স্পিডবোটে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত হয়। তখন ছোটখাট চাকরি করি। যে কারণে শুচিতার অভিভাবকরা আমার সঙ্গে তাদের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতেই পারেনি। তাই বলে কি আমাদের ভালোবাসা মিথ্যে হয়ে যাবে? বাধ্য হয়ে আমরা নিজেরাই বিয়ের আয়োজন করি। বিয়ের আয়োজনের দায়িত্ব নেয় ঘনিষ্ঠ তিনজন বন্ধু। শুচিতা তার দুই বান্ধবীকে নিয়ে নির্ধারিত সময়ে চলে আসবে। পাগলায় যাওয়ার পথে দেখতে পাই আকাশের মন খারাপ। কালো মেঘে ছেয়ে যায় চারপাশ। তারপর শুরু হয়ে যায় তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গন্তব্যে পৌঁছে যাই। আমার বন্ধুরাও বিয়ে পড়ানোর কাজী নিয়ে হাজির। সঙ্গে স্পিডবোট সাজানোর বিভিন্ন উপকরণ। শুচিতা তখনও এসে পৌঁছতে পারেনি। ধরে নেই, বৃষ্টির কারণে আসতে বিলম্ব হচ্ছে। তবে ফোনে শুচিতার সঙ্গে যোগাযোগও করা যাচ্ছিল না। কেমন টেনশন হতে থাকে। অবিরাম ধারায় ঝরতে থাকে বৃষ্টি। থামাথামির কোনও লক্ষ্মণই নেই। বয়ে যায় সময়। আমরা অপেক্ষায় থাকি। সেই অপেক্ষা যেন কিছুতেই ফুরাতেই চায় না।
অ্যাই কী এমন ধ্যান করছো? কফি নেও। স্ত্রীর ঝাঁজালো কণ্ঠে বাস্তবে ফিরে আসতে হয়। তখনও বৃষ্টি ঝরতেই থাকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন