তিনি কোনো অভিনেতা নন। তিনি কোনো সংগীতশিল্পী নন। এমনকি তাঁকে সেই অর্থে টিভি তারকাও বলা যাবে না। তারপরও তিনি তারকাদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নন। একজন অভিনেতা, একজন সংগীতশিল্পী কিংবা একজন টিভি তারকা যখন প্রতিষ্ঠিত হন, খ্যাতি অর্জন করেন বা জনপ্রিয় হয়ে উঠেন, তাঁদের কাউকে কাউকে দেখলে মনে হয়, কত কাল থেকে তাঁরা আমাদের চেনা। ধরে নেই, আমাদের চেয়ে নিশ্চয়ই অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ হবেনই। অথচ অনেকের ক্ষেত্রে বয়স হিসেব করলে দেখা যায়, তাঁরা আমাদের কাছাকাছি বয়সেরই। আসলে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন মিডিয়ায় তাঁদের দেখার কারণে এমন একটা বিভ্রম তৈরি হয়। কেউ কেউ খুব অল্প বয়স থেকে টিভি মিডিয়ায় জড়িত হওয়ায় আরো বেশি করে এ রকম মনে হয়।
ছড়া লিখেও যে তারকাদের মতো এমন সুখ্যাতি অর্জন করা যায়, তিনি তাঁর চমৎকার দৃষ্টান্ত। সুপরিচিত অভিনেতা, সংগীতশিল্পী ও টিভি তারকাদের মতো তাঁকেও মনে হয়, কতকাল থেকে তিনিও জ্বলজ্বল করছেন তারকা হয়ে। বয়সে কিছু সিনিয়র হলেও আমাদের শৈশব-কৈশোর থেকে তাঁর নামের সঙ্গে আমার বা আমাদের বয়সীদের পরিচয়। তখন থেকেই তিনি আমাদের কাছে তারকা। আর হবেন না কেন? স্কুলের নিচু ক্লাসের ছাত্র থাকাবস্থায় তিনি উঠে আসেন আলোচনায়। ছড়াতে থাকে তাঁর নাম, পরিচয় ও সুখ্যাতি। তাঁর ছড়ার বিষয়বৈচিত্র্য, সমসাময়িকতা ও গীতলতা পাঠককে সহজেই আকৃষ্ট করে। তাঁর মাথার মধ্যে গিজগিজ করে ছড়া। চট করে তিনি লিখতে পারেন যে কোনো বিষয় নিয়ে। দিন যতই অতিবাহিত হতে থাকে, ততই তিনি আলো ছড়াতে থাকেন। এর মধ্যে তাঁর নামের সঙ্গে যোগ হয়েছে অনেক পরিচয়, তাতে তিনি রাঙিয়ে দিয়েছেন চারপাশ। তাঁর স্মৃতিগদ্য বাংলা সাহিত্যে নতুন এক ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। কথাকার হিসেবেও তিনি অতুলনীয়। সৃজনশীল বিভিন্ন কর্মকান্ড দিয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়ও তাঁর অবস্থান গড়ে তোলেন। তাঁর ব্যক্তিগত ক্যারিশমাও কম উজ্জ্বল নয়। তারপরও তাঁর এক ও অদ্বিতীয় পরিচয় তিনি ছড়াকার। তিনি লুৎফুর রহমান রিটন।
কলেজে পড়ার সময় একটা সাহিত্য সংকলন প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেই। মূলত শূন্য হাতেই আমরা এগিয়ে যাই। বয়সোচিত কারণেই হতে পারে, আমরা স্থির করি, এই সংকলন দিয়ে বাংলা সাহিত্যে তোলপাড় সৃষ্টি করতে হবে। মাঠে নামার পর বুঝতে পারি, যত গর্জে তত বর্ষে না। লেখক তালিকা করতে গিয়েই হিমসিম খেতে হয়। বলতে গেলে কারো সঙ্গেই ব্যক্তিগতভাবে পরিচয় নেই। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করবো কীভাবে? তারপর কার কেমন মেজাজ-মর্জি, সেটাও তো জানা নেই। আমাদের লেখা দেবেন কি-না কে জানে? কি কারণে জানি না, তালিকার একটা নামকে আমাদের খুব আপন মনে হতে থাকে। যদিও তখন তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ একমাত্র ‘ধুত্তুরি’। তাতে কী?
![]() |
ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের সঙ্গে |
লেখক হিসেবে তখন তাঁকে কে না চেনেন? তিনি দু’হাতে লিখছেন। কীভাবে কীভাবে যেন তাঁকে খুঁজে বের করি। সম্ভবত বাংলা অ্যাকাডেমিতে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। আমরা যেমনটি অনুমান করেছিলাম, তারচেয়েও বেশি তিনি আমাদের আপন করে নেন। তাঁর চিরকালীন প্রাণখোলা হাসি দেখে আমাদের মন জুড়িয়ে যায়। এ হাসি দিয়েই শুরুতে তিনি সবার হৃদয় জয় করে নেন। আমরাও আমাদের কাজে আস্থা ফিরে পাই। এরই মধ্যে কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে আমরা হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলাম। কারো ব্যবহার, কারো কথার বরখেলাপ, কারো কারো নেতিবাচক কথাবার্তায় বুঝতে পারি, পথ বড় কন্টকাকীর্ণ। তাঁর সঙ্গে কথা হওয়ার পর আমরা এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাই। অনেকক্ষণ কথা বলে তিনি আমাদের খোঁজখবর নেন। এগিয়ে যাওয়ার পথ বাতলে দেন। সেই সঙ্গে নিজের লেখা দেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন। এটা ১৯৮৩ সালের কথা। তিনিও তো তখন ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্র। যাহোক, তাঁর লেখা আমরা যথা সময়ে পেয়েছিলাম। বলার অপেক্ষা রাখে না, সম্মোহিত করার এমন গুণাবলী লুৎফুর রহমান রিটন ছাড়া আর কার হতে পারে?
প্রকৌশলী নকিব আহমেদ নাদভীর নেতৃত্বে ১৯৮৫ সাল থেকে আমরা ৪/৫ জন্য তরুণ ‘হারজিত' নামে একটি খেলার পত্রিকা প্রকাশ করি। সে বয়সে সেটি ছিল আমাদের জন্য মস্ত একটি চ্যালেঞ্জ। এ ধরনের কাজে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা পাওয়াও খুব কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু লুৎফর রহমান রিটনের মতো প্রতিষ্ঠিত ছড়াকার যখন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন, সেটা হয়ে উঠে আমাদের জন্য অনেক বড় অনুপ্রেরণা। নতুন এ পত্রিকায় তিনি ছড়া দিয়ে আমাদের দারুণভাবে উৎসাহিত করেন। তাঁর প্রতিটি ছড়াই আলোচিত হয়েছিল। এই পত্রিকার সুবাদে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। তা আর কখনোই ব্যাহত হয়নি। সে সময় ‘ফুটবল’ নামে তাঁর একটি গ্রন্থ বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। সে গ্রন্থের জন্য কিঞ্চিৎ তথ্য দিয়ে সহায়তা করায় তিনি আমাকে অটোগ্রাফসহ একটি বই উপহার দিয়েছিলেন।
১৯৯৩ সালে ‘অক্ষরবৃত্ত' নামে আমরা চারজন মিলে একটা প্রকাশনা সংস্থা চালু করি। সে বছর আমাদের প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থ ছিল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমরা বাঙালি না বাংলাদেশী'। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে সেটি ছিল হট টপিকস। যদিও বইমেলায় আমাদের নিজস্ব স্টল ছিল না। তারপরও সে বছর সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের মধ্যে এটি ছিল একটি। রিটন ভাই তখন কর্মরত ছিলেন দৈনিক ‘বাংলাবাজার’ পত্রিকায়। তিনি এ পত্রিকার হয়ে প্রতিদিন বইমেলা কভার করতেন। পত্রিকার পেছনের পৃষ্ঠায় তিনি চমৎকার ফিচার লিখতেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বইটি নিয়ে তিনি আমার একটা মিনি ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। তাঁর মতো ব্যক্তিত্ব আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, এটা ছিল আমার জীবনের একটি আনন্দময় ঘটনা।
তখন তিনি প্রতি বছর চ্যানেল আইয়ের হয়ে বাংলা অ্যাকাডেমির বইমেলা সরাসরি কভার করতেন। ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয় আমার দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘স্টেডিয়ামের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’। এই গ্রন্থটি হাতে নিয়ে আমি বাংলা অ্যাকাডেমিতে গিয়েছিলাম। সে সময় চ্যানেল আইয়ের সম্প্রচার টিমের পরিচিত একজন জোর করে আমাকে রিটন ভাইয়ের সামনে নিয়ে যান। সাক্ষাৎকার দেওয়ার ব্যাপারে আমি বরাবরই মোটেও সাবলীল নই। সেদিনও যথারীতি এড়িয়ে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু রিটন ভাই তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় যেভাবে আমাকে ডেকে নেন, সরে পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আসলে তিনি যেভাবে মানুষকে আপন করে করে নিতে পারেন, সেটাও অনুকরণীয়। এ কারণে তাঁর যে কত অনুরাগী, কত যে ভক্ত, কত যে শুভাকাঙ্খী, দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে আছে, তা তিনিও জানেন না। জানার কথাও নয়।
যে কোনো প্রয়োজনে রিটন ভাইয়ের মুখাপেক্ষী হওয়া যায়। তিনি তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করে দিতে একদমই দ্বিধা করেন না। বছর দশেক আগে বাংলা অ্যাকাডেমির সদস্য হওয়ার জন্য অ্যাকাডেমির দুজন সদস্যের স্বাক্ষরের প্রয়োজন পড়ে। এ ক্ষেত্রে সবার আগে মনে পড়ে রিটন ভাইয়ের কথা। চ্যানেল আইতে দেখা হলে আমার আর্জি জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজে স্বাক্ষর তো করে দিলেনই, আগ বাড়িয়ে আরেকটি সই তাঁর বন্ধু আহমাদ মাযহারকে দিয়ে করিয়ে দেন। মনোভাবটা এমন, যেন তিনি এটা করে দেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন। এটাই তাঁর সহজাত বৈশিষ্ট্য। তাঁর মতো এমন পরম হিতৈষী ও দিলখোলা মানুষ হওয়া অনেক সাধনার ব্যাপার।
১ এপ্রিল ২০২১
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন