তবে সব কিছু ছাপিয়ে ঋতুর পালাবদলটা আমাকে অনেক বেশি আপ্লুত করে। আলোড়িত করে। তাড়িত করে। প্রতিটা ঋতু আমার কাছে নতুন নতুন উপলক্ষ্য হয়ে আসে। আমাকে বদলে দেয়। আবার এ ঋতুকে কেন্দ্র করে বিপরীতমুখী একটা ভাবনাও আমাকে পেয়ে বসে। সেটা বাস্তব কারণেই।
এই যে শীতকাল নিয়ে আমার কত না অপেক্ষা ছিল। একটা সময় কত না আনন্দে কেটেছে। আমেজ পেতাম উৎসবের। পিঠাপুলির গন্ধ নাকে এসে লাগলে মনটা উন্মনা হয়ে যেত। এখনও যে যায় না, তা বললে অসত্য বলা হবে। যদিও আগের মতো হাড়কাঁপানো সেই শীত নেই। হ্রাস পেয়েছে শীতের ব্যাপ্তিকালও। শীতকাল এখন আসে অনেকটা অতিথির মতো। তারপরও বেড়াতে আসা এই শীত এবার রীতিমতো আতঙ্কের কারণ। এই মুহূর্তে তাপমাত্রা ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যখন কুয়াশার চাদরে মুড়ে আছে চারপাশ, গরম কাপড়ে ঢাকা আপাদমস্তক, তখন আর তাকে উপভোগ করা যাচ্ছে না। শীতে যে কাবু হয়ে আছি, তা হয়তো বলা যাবে না। কথায় বলে, মাঘের শীত বাঘের গায়ে। এবার তো শীত পরিণত হয়েছে নখদন্তহীন বাঘে। তাহলে? আসলে এমনিতে ঠাণ্ডা সমস্যা লেগেই আছে, অস্থির হয়ে যাই ধুলাবালির অত্যাচারে। ভোরবেলা আর রাতের বেলায় খানিকটা শীত শীত লাগে। তবে এবার মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে করোনা ভাইরাস। এমনিতেই নাচুনি বুড়ি, তার উপর শীতকালটা যেন ঢোলের বাড়ি হয়ে এসেছে।
অ্যাজমার কারণে চিকিৎসক তো সেই কবেই গাদা-গুচ্ছের ওষুধ ও ইনহেলার ধরিয়ে দিয়েছেন। শীতকালে এলে তার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। নতুবা বেশ ভালোমতোই ভুগিয়ে ছাড়ে। সকালের ঘুম ভাঙার পর শীতকালটাকে উপদ্রব মনে হয়। কম্বলের উষ্ণতা ছেড়ে বাইরে আসতে ইচ্ছে করে না। আড়মোড়াও ভাঙতে ইচ্ছে করে না। বিছানা ছাড়ার পর শীতল যে অনুভূতি হয়, সেটা মোটেও প্রার্থিত নয়। শীতকাল এখন জীবনটাকে সংকুচিত করে দেয়। ঘরের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রলোভিত করে না। কিন্তু জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বাইরে না গিয়ে উপায় আছে? তখন উষ্ণতাকে পরম কাঙ্খিত মনে হয়। কিন্তু কোথায় পাবো সেই উষ্ণতা?
ঠাণ্ডা পানি পরিণত হয়েছে রীতিমতো শত্রুতে। হাতমুখ ধুতে পারি না। গোসল করতে পারি না। এমনকি গলাধঃকরণ করতে পারি না। পানি হলো জীবন। সেটাই যদি এমন বৈরী হয়ে ওঠে, তাহলে শীতকালকে কীভাবে আপন ভাববো? এখন মনে হয়, শীতকালটা না এলেই ভালো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বলতে ইচ্ছে করে, ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই/যাহা পাই তাহা চাই না’।
অশক্ত এই মাঘেও মনে পড়ছে শাওনের কথা। অর্থাৎ শাওন মাসের কথা। এত এত মাস থাকতে কেবল শাওনের কথা কেন মনে পড়ছে? বললাম না, আমার মনের যে কখন কী ইচ্ছে হয়, নিজেই জানি না। এমন হতে পারে, যেহেতু এখন শীত আতঙ্কে কাতর হচ্ছি, সে কারণে বিপরীত মাস শাওন মাসকে স্মরণ হচ্ছে। এমনিতে শাওন আমার অনেক প্রিয়। তার সঙ্গে কত কত স্মৃতি। সেই স্মৃতি হয়ে আছে জীবনের টক-ঝাল-মিষ্টি। ছয়টি ঋতু থাকলেও মোটের ওপর প্রকৃতি তো দুইভাগে বিভক্ত। শাওন মাস আর শীতকাল। যে কারণে এই শীতে ভোগান্তি বেড়ে যাওয়ায় শাওন মাসটাকে খুব মনে হচ্ছে। এই তো সেদিন বর্ষাকাল গেল। অথচ মনে হচ্ছে কত কত দিন তার দেখা পাই না। বৃষ্টি দেখি না। বৃষ্টিতে ভিজি না। কদম ফুলের সুবাস নেই না। অঝোর ধারায় পড়তে থাকা বৃষ্টির সুরেলা ধ্বনি শুনতে পাই না। বর্ষার কবিতা ও গানে মুগ্ধ হওয়া হয় না। শাওনের সবটাই তো রোমান্টিক নয়। যথেষ্ট বদ। ফষ্টিনষ্টিও কম করে না। তার কারণে যথেষ্ট ভোগান্তি পোহাতে হয়। তখন আবার স্মরণের জানালায় উঁকি মারে শীতকাল।
তারপরও শাওনের জন্য আমার এখন তীব্র প্রতীক্ষা। যেহেতু অনেকটা দূরে রয়েছে শাওন মাস, সেজন্য তার জন্য মনটা কেমন কেমন করে। বুকের মধ্যে সুর হয়ে বাজে, ‘আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে/তুমি জান না, আমি তোমারে পেয়েছি অজানা সাধনে’। শাওন কি সেটা জানে?
শাওন, তোমায় অপেক্ষায় এখন কাটে আমার দিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন