নীরবতার যে একটা ভাষা আছে, সেটা তাঁকে দেখলে বুঝতে পারা যায়। তাঁর মুখাবয়বে ফুটে ওঠে দৃঢ়তার প্রতিচ্ছবি। তিনি যখন কথা বলেন, তাতে স্পষ্ট হয় একটা অনমনীয় মনোভাব। কিন্তু বলার মধ্যে দার্ঢ্য থাকলেও অশোভনীয়ভাবে কিছু প্রকাশ করেন না। কথা বলেন খুব মার্জিত ও স্মার্টলি। এবং আন্তরিকতার সঙ্গে। তাঁর ব্যক্তিত্বের মধ্যে আলাদা একটা মাধুর্য আছে। তা সহজেই আকৃষ্ট করে। তিনি কবি, সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা হালিম আজাদ।
গৌরব করার মতো তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন। কিন্তু কখনোই নিজের পরিচয় তুলে ধরে অহমিকা করতে দেখিনি। অহমিকা তো দূরে থাক, সগৌরবে নিজের পরিচয় দিতেও তাঁর অপরিসীম কুণ্ঠা। যেখানে যতটুকু প্রয়োজন, তার বাইরে অপ্রাসঙ্গিক কিছু বলা বা করা তার ধাতে নেই। যে কারণে তিনি গ্ল্যামারাস হতে পারেননি। না পারার কারণে তিনি বরাবরই আড়ালে রয়েছেন। অথচ তিনি চাইলে অনেক কিছু করতে পারতেন। প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখাতে পারতেন। নিজের ঢাকঢোল পেটাতে পারতেন। আর্থিক ও সামাজিকভাবে অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পারতেন। একটুখানি আপস ও সমঝোতার মনোভাব থাকলে সুযোগ-সুবিধা করায়ত্ত করতে পারতেন।
তিনি তো সেই ধাচের নন। বেছে নেন সংগ্ৰামী জীবনকে। সেই তারুণ্যে যে আদর্শ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন, তা থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। শিল্প-সাহিত্য-সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি পরিবর্তনের নেশায় বুঁদ হয়ে যান। কিশোর বয়সে করেছেন নাটক ও যাত্রাপালা। পৈত্রিক সূত্রে বুকের মধ্যে দানা বাঁধে সুর। পারিবারিক পরিবেশটাই ছিল সংস্কৃতি চর্চার অনুকূলে। একে একে জড়িয়ে পড়েন প্রতিটি মাধ্যমে। অল্প সময়ের মধ্যে হয়ে ওঠেন নারায়ণগঞ্জের মেধাবী মুখ। একজন মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তা ও মননশীল মানুষ হিসেবে হয়ে ওঠেন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অগ্ৰসেনানী। কখনো মিছিল করেছেন। কখনো গান গেয়েছেন। কখনো আবৃত্তি করেছেন। যেখানে অন্যায় সেখানেই গর্জে উঠছেন প্রতিবাদে। নারায়ণগঞ্জের যে কোনো আন্দোলনে, সংগ্ৰামে তাঁকে দেখতে পাওয়া যায় প্রথম সারিতে। তবে তাঁর জীবনের ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা হয়ে ওঠে সাহিত্যচর্চা। স্কুল বয়সেই কবিতার সঙ্গে গড়ে ওঠে সখ্য। লেখালেখির পাশাপাশি সাহিত্য সংকলন সম্পাদনা ও সাহিত্য সংগঠনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। সম্পাদনা করেছেন বেশ কয়েকটি সাহিত্য ও সংস্কৃতির সংকলন। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে নারায়ণগঞ্জের সাহিত্যের বাগানে বসন্ত নিয়ে আসে 'ড্যাফোডিল'। তাঁর বর্ণে, গন্ধে, সৌরভে সুরভিত হয়ে ওঠে নতুন প্রজন্মের সাহিত্য অনুরাগীরা। এই সংগঠন ও সংকলনের কাণ্ডারিদের অন্যতম ছিলেন তিনি।
রাজধানী ঢাকার প্রলোভন সত্ত্বেও শিকড় থেকে নিজেকে সরিয়ে নেননি। নারায়ণগঞ্জের হালিম আজাদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সেই পরিচয় ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন সবখানেই। পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতাকে। সেই সুবাদে ঢাকার সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ ও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৮৩ সালে দৈনিক 'বাংলার বাণী' পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে শুরু করেন সাংবাদিকতার পথপরিক্রমা। প্রায় আড়াই দশক এই পত্রিকার সঙ্গে সুখে-দুঃখে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ছিলেন। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনকে কখনোই বড় করে দেখেননি। পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে এরপর দৈনিক যুগান্তর, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস), চ্যানেল আই, সাপ্তাহিক বিচিত্রা হয়ে পুনরায় বাসসে কর্মরত ছিলেন। 'বাংলার বাণী' পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। প্রায় চার দশকের সাংবাদিকতার জীবনে মুখোমুখি হয়েছেন কত রকম অভিজ্ঞতার। কত প্রতিকূলতার। কখনো বুঝতে দেননি। শান্তশিষ্ট নিপাট ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়, তিনি তাই। কিন্তু কোনো অন্যায়কে তিনি মেনে নিতে পারেন না। পারেন না বলেই জীবনের ঝুঁকি নিয়েও প্রতিবাদে সরব হন। তোয়াক্কা করেন না কোনো ভয়ভীতির।
সমসাময়িক বিষয়গুলো তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করে। তার প্রতিফলন দেখা যায় তাঁর কবিতায়। তাতে বাঙময় হয়ে ওঠে ভেতরের দুঃখ-কষ্ট-ক্ষোভ-যন্ত্রণাগুলো। যে কথাগুলো তিনি মুখে প্রকাশ করতে পারেন না, তা খুব সাবলীলভাবে কবিতায় ভাষা দেন।
আমি যদি আবার কথা বলি আমার মুখ যদি
আবার খুলে যায়,
তাহলে এক এক করে সকল মায়ের মুখে
সূর্যের রশ্মির মতো আলোকমালা ফোটাবো।
তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে প্রতিবাদের হাতিয়ার। কবিতায় তাঁর প্রতিবাদ পৌঁছে যায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত। এ কারণে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। হুমকি দেওয়া হয়। থাকতে হয় আত্মগোপনে। বঙ্গভবনে নিয়ে গিয়ে তাঁর কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়। কিন্তু তিনি কখনোই নতি স্বীকার করেননি। আত্মসম্মান বিসর্জন দেওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না। কবিতাকে কখনোই পণ্য হতে দেননি। যদিও তিনি পরিচিত সত্তর দশকের কবি হিসেবে। কিন্তু স্কুল বয়স থেকে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখে আসছেন। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় নিমগ্ন হয়ে আছেন কবিতায়। আটকা পড়ে আছেন কবিতার মায়াজালে। তিনি কখনো কবিতাকে ছাড়েননি। কবিতাও তাঁকে ছেড়ে যায়নি। জীবনে অনেক কঠিন ও দুঃসময় এসেছে। সেই সময় আশ্রয় পেয়েছেন কবিতার কাছে। এছাড়াও আরেক জনের কাছে তিনি চিরঋণী হয়ে আছেন। তাঁর সুখ-দুঃখের সহচরী ভালোবাসার মানুষ ফাহমিদা আজাদ। জীবনের চড়াই-উতরাইয়ে সব রকম সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে আসছেন তাঁর এই জীবনসঙ্গিনী। ইদানিং শারীরিক অসুস্থতার কারণে হালিম আজাদের চলার গতি খানিকটা মন্থর হয়ে গেলেও লেখালেখিতে সক্রিয় আছেন অবিরাম। ফেসবুক হয়ে ওঠেছে তাঁর প্রধান মাধ্যম।
![]() |
১৯৮৭ সালে শেরপুরে সুভাষ চন্দ বাদলের বিয়ের অনুষ্ঠানে দুলাল মাহমুদ, গিয়াস কামাল চৌধুরী, কবি হালিম আজাদ ও দাউদ ভুঁইয়া। |
তাঁকে পেয়েছি সহকর্মী হিসেবে। সহমর্মী হিসেবে। ১৯৮৯ সালে নারায়ণগঞ্জের টাউন হলে আয়োজিত তাঁর বৌভাতের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। জীবনের চলার পথে কাছের অনেকেই দূরে সরে গেছেন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের যে বন্ধন গড়ে ওঠে, তা আজও অটুট রয়েছে।
(হালিম আজাদের জন্ম ১৯৫৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার মধ্যনগর গ্ৰামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ :
কবিতা : অদ্ভুত দরোজার কাছে (১৯৮২), ভেঙ্গে দাও নারকীয় দেয়াল (১৯৮৫), পাথরের মানুষ (১৯৮৭), কারে কারাে দিকে অবিরাম চেয়ে থাকা (১৯৮৮), যে তিমির হৃদয় ছুঁয়ে যায় (১৯৮৯), মস্কো টাওয়ারে কিছুক্ষণ (১৯৯১), কবিতা সমগ্র (২০১২), নির্বাচিত ২০০ কবিতা (২০১৩), জলমহালের কাব্য (২০১৭)।
উপন্যাস : দূর্বাঘাস আর গ্রেনেডের কল্প (২০০৪), খনন (২০০৫), মুক্তিস্মান (২০০৬), লড়াই (২০০৬), নীল বাংকার (২০১০), গঙ্গানামা (২০১৮), বেদেস্বর (২০১৯)।
ছোট গল্প : ঘরে ঘরে যুদ্ধ (২০০১), সাবিত্রী ও অন্যান্য গল্প (২০১৭)। প্রবন্ধ : শামসুর রাহমান, শহীদ কাদরী ও অন্যান্য প্রবন্ধ। জীবনীগ্রন্থ : সাংবাদিক-লেখক বেবী মওদুদ (২০১৫)। সম্পাদনা গ্ৰন্থ : পৃথিবীর কাছে নোটিশ (১৯৭৭), চেতনায় তুমি বিপ্লব (১৯৮২), নিরালােকে বসতি (১৯৮৫), ড্যাফোডিল কাব্যগ্রন্থ (১৯৮৪), সুবর্ণ গ্রামের কবিতা (২০১২), সাহিত্য সংকলন সমমনা' র দুটি সংখ্যা (২০১০ ও ২০১২), জনান্তিকে ত্বকী (২০১৪)।
সংগঠন :
জাতীয় কবিতা পরিষদ, পদাবলী ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, বাংলাদেশ পার্লামেন্ট সাংবাদিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম-আহ্বায়ক, নারায়ণগঞ্জ কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সাত বছর সভাপতির দায়িত্ব পালন, জাতীয় প্রেস ক্লাবের স্থায়ী সদস্য।
পুরস্কার :
জাতীয় প্রেস ক্লাব সাহিত্য পুরস্কার ২০০৩, চ্যানেল আই আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার, শ্রুতি সাংস্কৃতিক একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, চারণ সাহিত্য পুরস্কার, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি পদক ২০১৫, পদক্ষেপ সাহিত্য পুরস্কার ২০১১, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সংবর্ধনা পেয়েছেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি এবং মধ্যনগর প্রাক্তন ছাত্র সমিতির, এম. নুরুল কাদের শিশু সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪।
১১ সেপ্টেম্বর ২০২০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন