পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

বুধবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২১

রাজনীতির আকাশে মহিলা তারকা

১৯৮৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর লিখেছিলাম, 'রাজনীতির আকাশে মহিলা তারকা'।

আধুনিক রাষ্ট্রে রাজনীতি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। রাজনীতির সংস্পর্শে মানুষের মনে সচেতনা বোধের সঞ্চার ও মতামতের প্রতিফলন ঘটে। আর ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনার আলোকে যিনি অধিক মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারেন, তিনিই নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হন। মানুষ তার আহ্বানে সাড়া দিতে কুণ্ঠা বোধ করে না। তবে রাজনীতির পথ বড্ড জটিল ও কণ্টকাকীর্ণ ৷ প্রতি মুহূর্তে অনিশ্চয়তার হাতছানি।

এ কারণেই রাজনীতির বিসর্পিল পথে মহিলাদের বিচরণ সহজলভ্য নয়। বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসের পানে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, মহিলাদের পশ্চাৎপদতা। অবশ্য পুরুষের পাশাপাশি রাজনীতিতে মহিলাদের অবদানের কথা অস্বীকার করার জো নেই। 

সক্রিয় মহিলা রাজনীতিবিদের সংখ্যা অপ্রতুল হলেও অনেকেই নেপথ্যে থেকে রাজনীতির কলকাঠি নাড়িয়ে কিংবা পুরুষকে অনুপ্রাণিত করে রাজনীতি চত্বরকে গতিশীল করেছেন।

এর মাঝেও এমন কিছু মহিলা আছেন যারা শুধুমাত্র রাজনীতিতে কর্মঠ নন পাশাপাশি তারা রাজনীতির অগ্নিকন্যা হিসেবে সারা দুনিয়ায় ঝড় তুলেছেন। টলিয়ে দিয়েছেন - একনায়কতন্ত্র, অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরচারী সামরিক শাসকের ভিত। কোথাও কোথাও তারা শত প্রতিকূলতার মাঝেও আপোষহীন ভাবে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। কারাগার, নির্যাতন, ষড়যন্ত্র, জুলুম, অত্যাচার তাদের আন্দোলনকে পিছপা করতে পারছে না। কেউ কেউ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণ করেছেন। সরকার পরিচালনায় অপরিসীম দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। 

তবে যেখানে নারী স্বাধীনতার উত্তুঙ্গ পরিবেশ, সেই টালমাটাল পাশ্চাত্যের তুলনায় রাজনৈতিক আসরে প্রাচ্যের মহিলারা অনেক এগিয়ে। পশ্চিমা দেশগুলোররা জনীতিবিদরা জনগণকে ব্যক্তিত্বের ইমেজ ও মোহে প্রলুব্ধ করতে পারলেই নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়াক ষ্টসাধ্য নয়। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক ক্ষেত্র বড় বেশি দুর্গম, অমসৃণ ও অনিশ্চয়তায় ভরপুর। জনগণের একচেটিয়া সমর্থনেও ক্ষমতার সিংহাসনে আরোহণ করা যায় না। তাদেরকে ফ্যাসিবাদী সরকার কিংবা বন্দুকের নলের বিরুদ্ধে লড়াই করে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়। এই অবস্থায় যেখানে বলবান পুরুষেরা হিমসিম খেয়ে যান, সেখানে মহিলাদের চলারপ থ পুরোপুরি অসমতল।

এমনিকেই পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় মহিলাদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদাভুক্ত বলে মনে করা হয়। তাছাড়া ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা মহিলাদের রাজনীতি করাটা মোটেও মেনে নিতে পারেন না। এখনও সামন্তবাদের গুরুতর প্রভাব। সামগ্রিক অর্থে তলিয়ে দেখলে তৃতীয় বিশ্বে পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের বিভিন্ন রকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। এত সব প্রতিকূলতার মাঝে মহিলাদের রাজনীতিমুখীন হওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। তা সত্ত্বেও তৃতীয় বিশ্বে মহিলা রাজনীতিবিদদের সংখ্যা ক্রমশঃ বাড়ছে। বরং বলা যায়, তৃতীয় বিশ্বে বার বার মহিলারাই ওঠে আসছেন রাজনৈতিক শিখর দেশে। ফলে পরিবর্তন ঘটছে সনাতন মূল্যবোধের। তবে যুগে

যুগে বিশ্ব রাজনীতিতে মহিলাদের আবির্ভাব ঘটে থাকলেও বর্তমান শতাব্দীতে তারা লাইমলাইটে আসছেন অধিক মাত্রায়। তৃতীয় বিশ্বের একজন মহিলা রাজনীতিবিদকে এখন সারা বিশ্বের লোক চেনেন, জানেন।

তবে মহিলা রাজনীতিবিদদের পথপ্রদর্শক হলেন সুলতানা রাজিয়া। ঘোরতর পশ্চাৎপদ দেশে ও সমাজে তিনি পুরুষদের ডিঙ্গিয়ে দিল্লীর সিংহাসনে আসীন হন। যদিও সিংহাসনে বেশি দিন স্থায়িত্ব পাননি। পুরুষদের চক্রান্তে ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন।

উন্নত পুঁজিবাদী দেশে অনগ্রসর সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবের স্থানে নেই। কোনও পুরুষের দুর্বল ও উজ্জ্বল প্রতিফলন হিসেবে নয়, স্বীয় শক্তি, মেধা ও অধিকারে রাজনীতির জমজমাট হাটে নিজেদের আসনকে পাকাপোক্ত করতে হয়। সামগ্রিক নারী মুক্তির প্রতিফলন কিংবা নারী চেতনায় প্রগতির চিহ্ন হিসেবে তারা রাজনীতির পথে এগিয়ে যান। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক শীর্ষ দেশে মহিলাদের প্রবেশ ও বিকাশ বস্তুত একট সামাজিক ও একটি ব্যক্তিক ঘটনা। কেননা যতটা না সচেতন প্রয়াসের ফল, তার চেয়ে অনেক বেশী আকস্মিক ঘটনা, যতটা না জীবনের দান, তার চেয়ে অনেক বেশী মৃত্যুর। অর্থাৎ তাদের কৃতিত্বের পিছনে প্রাথমিকভাবে পারিবারিক অবস্থানই এত সহজে, এত দ্রুত রাজনৈতিক পাদপ্রদীপের আলোয় আলোকিত করেছে।

হাজার বছরের বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে মহিলারা রাজনীতি সম্পৃক্ত না হয়েও হয়ত প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন কিংবা রাজনীতি সচেতন হয়েও প্রচারণার স্বল্পতার কারণে বন্দী থেকেছেন দেশের সীমানায়।

তাদের সম্পর্কে এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে আলোচনা সম্ভব নয়। মূলতঃ যারা রাজনৈতিক আকাশে মহিলা তারকা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছেন অর্থাৎ যাঁদের কথা দুনিয়ার মানুষ জানেন কম-বেশি জানেন, তাঁদের সম্পর্কেই এখানে বলা হয়েছে।



সিরিমাভো বন্দরনায়েক 

বিশ্বের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হলেন সিরিমাভো ডব্লিউ, আর, ডি, বন্দরনায়েক। ১৯৫৯ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর তাঁর স্বামী শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী এন, ডব্লিউ. আর, ডি, বন্দরনায়েক কলম্বোতে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী দ্বারা নিহত হন। স্বামীর হত্যায় রাজনীতিতে বিকশিত হয়েছেন সিরিমাডো বন্দরনায়েক। প্রায় ১৯ বছর স্বামীর সাথে সংসার জীবন করার পর ১৯৬০ সালে রাজনৈতিক জীবনের দীক্ষা নেন। স্বামীর মুত্যুর ছয় মাস পর তিনি শ্রীলংকা ফ্রীডম পার্টি (এস এল এফ ডি)-র পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় নামেন। একই বছর তিনি এসএলএফডি-র প্রেসিডেন্ট হন। তারপর তাঁর রাজনৈতিক কর্মক্ষেত্র ক্রমশঃ প্রসারিত হয়েছে। ঐ বছরই তিনি সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ১৯৬০ সাল থেকে তিনি একটানা পাঁচ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন, মাঝে একটি মেয়াদ ক্ষমতায় উত্তীর্ণ না হতে পারলেও পুনরায় তিনি ১৯৭০ সাল থেকে ৭৭ সাল পর্যন্ত প্রধান মন্ত্রী ছিলেন। অবশ্য সিরি মান্ডে ৬০ সাল থেকে ৮০ সাল পর্যন্ত একটানা ২০ বছর শ্রীলংকার পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও তিনি প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, পরিকল্পনা, অর্থ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করেছেন। ১৯৬৫ থেকে ৭০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন বিরোধী দলের নেত্রী। ১৯৭৬-৭৭ সালে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের চেয়ারম্যান ছিলেন। বর্ণাচ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী সিরিমাভো বন্দরনায়েক এখন সত্তরোর্ধ বয়সেও শ্রীলংকা ফ্রীডম পার্টর প্রেসিডেন্ট হিসেবে শ্রীলংকার লৌহমানব জয়বর্ধনকে অস্থির করে রেখেছেন। আজও জয়বর্ধন তাঁর সমর্থন সংগ্রহ করতে আগ্রহী। 

ইন্দিরা গান্ধী

পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের সর্বাধিক আলোচিত নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরার উত্থানের ক্ষেত্রে কোনও নাটকীয়তা না থাকলেও তিনি শক্তি সঞ্চার করেছেন পিতা ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কিছুটা আকস্মিক এবং মহান মৃত্যুর ঘটনা থেকে। সেই মৃত্যুতেই উদ্দীপিত করেছে তাঁর পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনকে, অবশ্য মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি ১৯৩৮ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হন। ১৯৫৯-৬০ সালে কংগ্রেস পার্টির প্রেসিডেন্ট, ১৯৬২ সালে সিটিজেন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, ১৯৬৪-৬৬ সালে লোকসভার সদ্স্য হন। ১৯৬৬ সালের ১১ই জানুয়ারী লাল বাহাদুরের রাশিয়ার তাসখন্দে আকস্মিক মৃত্যু হলে ইন্দিরা বিশাল ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। দীর্ঘ ১১ বছর একটানা ক্ষমতাসীন থাকার পর নির্বাচনে বিরোধী দলের কাছে হার মানেন। কিন্তু তিন বছর পর পুনরায় নির্বাচনে জয়ী হয়ে ১৯৮০ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসেন। আততায়ীর তীতে নিহত হওয়ার আগাবধি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। বর্তমানে তাঁরই পুত্র রাজীব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। 

গোল্ডামেয়ার

রাজনীতিবিদ হিসেবে গোল্ডা মেয়ার সাফল্যের শিখরে ওঠার কৃতিত্ব অর্জন করেন। আমেরিকায় শিক্ষার্থী মেয়ার আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরুর পাশাপাশি রাজনৈতিক জীবনেও জড়িয়ে পড়েন। ১৯২৮ সালে শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে রাজনীতির হাতেখড়ি নেন। ইসরাইলী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর প্রথম মন্ত্রী পরিষদে (১৯৪৯-৫৬) তিনি শ্রম ও সামাজিক নিরাপত্তা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৫৬-৬৬) হন। ১৯৬৭ সালে তিনি লেবার পার্টি গঠন করেন। এই পার্টি ক্ষমতায় গেলে (১৯৬৯-৭৪) প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি সরকার পরিচালনার দায়িত্বভার পান। তিনি ৮১ বছর বয়সে ১৯৭৯ সালে মারা যান । গোল্ডা মেয়ার ব্যক্তিগত প্রভাব প্রতিপত্তি দিয়ে ধাপে ধাপে সাফল্যের শিখরে উঠেছেন।

মার্গারেট থ্যাচার 

মার্গারেট থ্যাচার, ইউরোপ-আমেরিকার প্রথম মহিলা সরকার প্রধান। থ্যাচারের ক্ষমতায় আরোহণ কোনও দায়সারাগোছের ঘটনা নয়। বরং মহিলা রাজনীতিবিদ হিসেবে ব্যক্তিত্বের দীপ্তছটা দিয়ে তিনি সফলকাম হয়েছেন। ১৯৭০ সালে তিনি কাউন্সিলর, ১৯৮৩ সালে রয়াল সোসাইটির ফেলো এবং ১৯৫৯ সাল থেকে তিনি কনসারভেটিভ পার্টির এম পি হন। ১৯৭৫ থেকে '৭৯ সাল পর্যন্ত তিনি বিরোধী দলের নেত্রী থাকার পর ১৯৭৯ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতাসীন হন। সম্প্রতি তৃতীয়বারের মতো মার্গারেট থ্যাচার প্রধানমন্ত্রী হয়ে হ্যাটট্রিক করেছেন। বিশ্ব ইতিহাসে এটি একটি দুর্লভ দৃষ্টান্ত। এর ১৮০ বছর আগে বৃটেনেরই লর্ড লিভারপুল ১৮১২ থেকে ১৮২৭ সাল পর্যন্ত তিন দফা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। লৌহমানবী হিসেবে খ্যাত দৃঢ়চেতা, কঠোর ও অনমনীয় থ্যাচার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে তিনি ফকল্যান্ড যুদ্ধে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। ৬২ বছর বয়স্ক থ্যাচার যে কোন সমস্যা মোকাবেলায় এখনও প্রত্যয়ী। 

গারাল্ডাইন ফেরারো

গারাল্ডাইন অ্যান ফেরারো হলেন প্রথম মহিলা যিনি ১৯৮৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ওয়াটার মণ্ডেল। ৫২ বছর বয়স্কা ফেরারো ১৯৭৪-৭৮ সালে নিউইয়র্কের এ্যাসিস্টেন্ট ডিস্ট্রিক্ট এটৰ্নী, ১৯৮১-৮৫ সালে হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেনটিভ-এর সদস্য ছিলেন। 

কোরাজন একুইনো

কোরাজন একুইনো এখন এবং আগামী বহুদিন বিশ্বের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আন্দোলন গণতান্ত্রিক আবেগের জন্ম ও বিকাশভূমি। অথচ ১৯৮৩ সালের ২১শে আগষ্ট ম্যানিলা বিমান বন্দরে বেনিগনো একুইনোর আততায়ীর হাতে মৃত্যু না হলে কোরাজন কখনই ক্ষমতায় আসতেন কিনা সন্দেহ। কেননা স্বামী যত দিন বেঁচে ছিলেন সেই ২৮ বছরের বিবাহিত জীবনে তিনি থেকেছেন আড়ালে আড়ালেই। ১৯৮৪ সালে রাজনীতির আসরে নেমে তিনি প্রথম চোটেই নির্বাচনে জিতে জাতীয় পরিষদে আসন দখল করেন। ১৯৮৬ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারী কোরাজান নির্বাচিত হলেও ২৫শে ফেব্রুয়ারী প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এক ফোটা রক্ত না ঝরিয়ে মার্কোসকে যেভাবে দেশত্যাগে বাধ্য করেন, তা অভাবিত। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এনরিলে এবং ভাইস চীফ অব স্টাফ রামোস তাঁকে সমর্থন করলেও হাজার হাজার লোক কোরাজনের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসেন। আমেরিকায় শিক্ষিতা পাঁচ সস্তানের জননী কোরাজন এই ৫৪ বছর বয়সে প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি একের পর এক বিদ্রোহ দমনে ইস্পাত-দৃঢ় ও একরোখা মনোভাবের স্বাক্ষর রাখছেন।

চিয়াঙ চিঙ 

চীনের গ্যাঙ অব ফোর-এর চিয়াঙ চিঙ (জিয়াঙ কিঙ) মাও সে তুঙ-এর পত্মী হিসেবে যথেষ্ট খ্যাত। চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসেবে জীবন শুরু করলেও পরবর্তীতে তিনি রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩৭ সালে তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতে (সিসিপি) যোগ দেন এবং ১৯৫০ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রী হন। ১৯৬৫-৬৯ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লবে শীর্ষস্থানীয় মাওবাদী কার্যক্রমে প্রচারণায় অংশ নেন। ১৯৬৯ সালে পলিটব্যুরোর নবম জেনারেল কমিটি এবং ১৯৭৩ সালে পলিটব্যুরোর দশম জেনারেল কমিটির সদস্য হন। ১৯৭৬ সালে 'গ্যাঙ অব ফোর' এর সদস্য হিসেবে গ্রেফতার হন। ১৯৭৭ সালের জুলাইতে সিসিপি থেকে বহিষ্কৃত, ১৯৮০ সালের নভেম্বর থেকে ১৯৮১ সালের জানুয়ারী পর্যন্ত মামলায় তাঁর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। কিন্তু পরে ১৯৮৩ সালের জানুয়ারীতে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। 

ইভা পেরণ

আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট (১৯৪৬-৫০) জুয়ান দোমিনগো পেরণের প্রথম স্ত্রী ইভা মারিয়া দুয়ার্তে ডি পেরণ। প্রথম জীবনে একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী ইভা তার অপরিমেয় কর্মক্ষমতা ও উচ্চাকাঙ্খার দরুন রাজনৈতিক ময়দানেও সাড়া জাগাতে সক্ষম হন। 

বিংশ শতাব্দীর লাতিন আমেরিকায় সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক নেতা জুয়ার পেরণকে বন্দী করা হলে ইভা অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি শ্রমিক ইউনিয়নকে চমৎকার কুশলতায় সংগঠিত করে সমগ্র বুয়েন্স আয়ারের্সে র ্যালির আয়োজন করে ১৯৪৫ সালের ১৭ই অক্টোবর জুয়ান পেরণকে কারাগার থেকে মুক্ত করে আনেন। এর কয়েক দিন পর প্ররণ সুদরী ও আকর্ষণীয়া ২৬ বছর বয়স্কা ইভাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি ইভা সামাজিক কার্যক্রমেও যথেষ্ট অবদান রাখেন। ইভা পেরণ মাত্র ৩৩ বছর বয়সে ১৯৫২ সালে ক্যান্সারে মারা যান।

বেনজির ভুট্টো 

"আমার ভাই ও বোনেরা জেনে রাখুন, এই মৃত্যু উপত্যকায় আমি প্রবেশ করেছি সম্পূর্ণ সজ্ঞানে ও স্বেচ্ছায়। ঘাতকরা যখন আমার বাবা আপনাদের প্রিয় নেতা, শহীদ জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন তাঁর জীবনের সেই অন্তিমতম লগ্নে, তাঁরই ব্রত অবলম্বন করে আমি আমি বাঁচবো এবং মরবো। এই মুহূর্তে সেই ব্রতই আমি উদযাপন করছি। জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে আজ আর কোনও ফারাক নেই।" 

এই ব্রত নিয়েই উপমহাদেশের সবচেয়ে আলোচিতা বেনজির ভুট্টোর রাজনীতিতে প্রবেশ। আট বছর আগে বাবার অসহায় বধ্যভূমিতে এবং ভাই শাহ নেওয়াজের বিদেশে আকস্মিকভাবে মৃত্যু বেনজিরকে হঠাৎ জীবনের চেয়েও বড় করে দিল। পৃথিবীর যাবতীয় ক্ষোভ ও বিদ্রোহ এসে শক্ত করে দিল, বেনজিরের রাজনৈতিক মঞ্চকে। ভারতীয় একটি পত্রিকায় তাঁর সম্পর্কে আরো বলা হয় যে, কি তাঁর যাদু! যাতে কেঁপে য্য় পাকিস্তান। পাকিস্তানের এ যাবৎ সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসন। এই সম্মোহন কেন? বেনজির ভুট্টো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় ছাত্র সংসদের সভানেত্রী ছিলেন। সে সময় তাঁর ভূমিকা যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করে। অবশ্য মাত্র ১৬ বছর বয়সে রাজনীতির সাথে তাঁর সখ্যতা গড়ে উঠে।

পাকিস্তানে সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে বেনজিরকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দীর্ঘ দিন তিনি গৃহবন্দী ছিলেন। ১৯৮৪ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনকে জোরদার করতে গিয়ে তিনি অগ্রগামী ভূমিকা রাখেন। বর্তমানে ৩৪ বছর বয়সে তিনি পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান হিসেবে জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে তীব্রতর করে তুলেছেন ।



নূসরত ভুট্টো 

সাবেক ফার্স্ট লেডি নুসরত ভুট্টো স্বামীর মৃত্যুর পর পাকিস্তানী রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান হলেও ৫৩ বছর বয়স্কা নুসরত ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কারণে পার্টির দায়িত্ব কন্যার হাতে বুঝিয়ে দেন। ১৯৮৪ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে নুসরত যথেষ্ট অবদান রাখেন।

মেনেকা গান্ধী 

শাশুড়ি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে মান-অভিমান করে মেনেকা আনন্দ গান্ধী রাজনীতিতে ঝুঁকে পড়েন। পাঞ্জাবের মেয়ে, সাবেক বিউটি কুইনের সাথে ১৯৭৪ সালে ইন্দিরার কনিষ্ঠ সন্তান সঞ্জয় গান্ধীর বিয়ে হয়। ১৯৮০ সালে সঞ্জয় বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর বিধবা মেনেকার সাথে শাশুড়ির মনোমালিন্য শুরু হয়ে যায়। ১৯৮২ সালে তিনি লক্ষৌ কনভেনশনে যোগ দেন এবং ১৯৮৩ সালে রাজনৈতিক দল 'রাষ্ট্রীয় সঞ্জয় মঞ্চ' প্রতিষ্ঠা করেন। ৩১ বছর বয়স্কা মেনেকা গান্ধী বর্তমানে রাজনীতির অঙ্গনে তেমন একটা সরব নন।

শেখ হাসিনা

বিশ্ব মহিলা রাজনীতিবিদের পাশাপাশি বাংলাদেশের মহিলা রাজনীতিবিদদের পদচারণা দীপ্তোজ্জ্বল। উপরন্তু বাংলাদেশের মহিলা রাজনীতিবিদের সংখ্যা অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। সরকার বিরোধী তাদের ভূমিকা অগ্রগণ্য। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রথম সারিতে তাদের অবস্থান। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের পরিবার পরিজনসহ নিহত হন। সেই মৃত্যু সমস্ত জীবনকে শেষ করে দেয়নি। বরঞ্চ মাটি ফুঁড়ে তা বের করে দিয়েছে শেখ হাসিনাকে। অবশ্য ছাত্রী জীবনেই শেখ হাসিনা রাজনৈতিক দীক্ষা পান। ইডেন কলেজের ছাত্রী থাকাবস্থায় তিনি ছাত্রী সংসদের নির্বাচনে সহ-সভানেত্রী হন। এর পর পিতার বিশাল রাজনৈতিক জীবনের সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠায় রাজনীতির সাথে তাঁর নিবিড়তা গড়ে ওঠে। ১৯৮১ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী এবং পরে ১৫ দলের নেত্রী মনোনীত হন। তারপর থেকে সরকার বিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছেন, ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির পরও তিনি তিনটি আসনে জয়ী হন। তিনি জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। 

খালেদা জিয়া

১৯৮১ সালের ৩০শে মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক অঙ্গনে জন্ম হয়েছে বেগম খালেদা জিয়ার। এককালের বাংলাদেশের ফার্স্ট লেডি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারম্যান এবং পরে ৭ দলের নেত্রী মনোনীত হয়ে খালেদা সরকার বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

এছাড়াও বাংলাদেশের মহিলা রাজনীতিতে সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী, আইভী রহমান প্রমুখ দীর্ঘ দিন যাবৎ প্রভাব বিস্তার করে আছেন।

আর সকল ক্ষেত্রের মত রাজনীতিতেও পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারা ক্রমশঃ এগিয়ে আসছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা পুরুষদের স্নান করে দিয়ে স্বীয় প্রতি ভাকে উজ্জ্বল করে তুলছেন।

১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৮৭

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন