রবীন, স্পষ্ট করে বলো তো, তুমি সিগারেট বেশি ভালোবাসো না আমাকে?
এ তুমি কী বলছো? সিগারেটের সঙ্গে তোমার তুলনা হয় কীভাবে? কোথায় সিগারেট আর কোথায় তুমি!
আমি তুলনার কথা বলছি না। বলছি ভালোবাসার কথা।
সিগারেট তো কেবলই ধুয়া। তার তো কোনো শরীরী অবয়ব নেই। তার ভিতরে আছে পরিশোধিত তামাক পাতা। আর তুমি হলে অনিন্দ্যসুন্দর এক মানবী। তোমার মধ্যে আছে অফুরন্ত ভালোবাসা। দুটোর মধ্যে কোনো সাদৃশ্য নেই। তাহলে কীভাবে ভালোবাসার তুলনা হয়?
কথাই তো তোমার প্রধান সম্বল। মার্কেটিংয়ে চাকরি করতে করতে কথা দিয়ে সব বিষয় যুক্তিযুক্ত করার চেষ্টা করো। তোমার কথার মায়াজালে পটে গিয়ে আমিও প্রেমে পড়েছি। কিন্তু সিগারেট নিয়ে বাক্যজাল বোনার কোনো দরকার নেই। এটা আমি একদমই নিতে পারবো না।
শোনো রিয়া, তুমি মানো আর নাই মানো, পৃথিবীর অনেক সৃষ্টিশীল কাজের ক্ষেত্রে সিগারেট অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। চে গুয়েভারা, ফিদেল কাস্ত্রো, উইনস্টন চার্চিল, জন এফ কেনেডি, মার্ক টোয়েন, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, চার্লি চ্যাপলিন, এলভিস প্রিসলির মতো ব্যক্তিত্বরা ধূমপান ছাড়া চলতে পারতেন না। হাল আমলেও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব ধূমপানে আসক্ত। আমার কাজটা সৃষ্টিশীল না হলেও নিকোটিন থেকে আমিও যথেষ্ট প্রেরণা পাই। যে কোনো কাজ সাবলীলভাবে করতে আমার সুবিধা হয়।
বিখ্যাতদের নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আমার অবাক লাগছে, সিগারেটের মতো একটা বিষাক্ত ধুয়ো ছাড়া আর কেউ তোমাকে প্রেরণা দিতে পারলো না! এ কেমন কথা! আর এটা তো একটা বদঅভ্যাস।
পড়ন্ত বিকেলের টিএসসি চত্বর। পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার অপেক্ষায় নির্মাণাধীন মেট্টো রেলপথ। একটু একটু শোনা যায় নির্মাণ কাজের ঠকঠকানি। বয়ে যাচ্ছে মিষ্টি মিষ্টি মৃদু হাওয়া। গাছের পাতায় হিল্লোল। থোকায় থোকায় জমে ওঠেছে আড্ডা। কেউ নাটকের রিহার্সেল করছে। কেউ গানের চর্চা করছে। কেউ আবৃত্তি করছে। কেউ কেউ লেনদেন করছে হৃদয়ের। খানিকটা নিরিবিলি স্থান বেছে নিয়েছে রবীন আর রিয়া। দুজনের সম্পর্কের বিষয়টি উভয়ের পরিবারই জানে। চলছে বিয়ের কথাবার্তাও।
এদিক সেদিক তাকিয়ে একগাল সিগারেটের ধুয়া ছেড়ে রবীন বলে, তুমি চারপাশে তাকিয়ে দেখো, ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও স্মার্টলি ধূমপান করছে। সিগারেটে ক্ষতিকারক তেমন কোনো উপাদান থাকলে ওরা নিশ্চয়ই ধূমপান করতো না।
কিছুটা রাগত স্বরে রিয়া বলে, এসব আমাকে নতুন করে দেখতে হবে না। আমি তোমার কাছে কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা প্রমাণ চাচ্ছি না। আর তুমি এমন সব কথা বলো, যা প্রমাণিত সত্য নয়। সবটাই কল্পিত। কিছু মানুষ আছে, নিজের অন্যায় কাজের সপক্ষে হাজারো যুক্তি তুলে ধরে। আসলে বিভ্রান্ত লোকদের কূট যুক্তির অভাব হয় না।
তুমি আমাকে এমনটা বলতে পারলে? আমি বিভ্রান্ত লোক? কূট যুক্তি করি?
আমি সেই অর্থে বলিনি। অবশ্যই তুমি মেধাবী। ভালো চাকরি করো। সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলো। কিন্তু সিগারেটের পক্ষে তোমার যুক্তিটা মোটেও মানানসই নয়। আর খারাপ কিছুর পক্ষে যারা যুক্তি দেয়, তাদের ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে। ধূমপানের জন্য তুমি শুধু নিজের ক্ষতি করছো না, আমার ও আরো দশ জনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছ।
তুমি একটু আগে বললে না, আমার কথা প্রমাণিত সত্য নয়। একইভাবে আমিও বলতে পারি, তোমার কথাও শতভাগ প্রমাণিত নয়। ধূমপানের বিষয়টি এখনও ধোঁয়াশা হয়ে আছে।
এত কিছু বুঝি না। হয় তুমি সিগারেট ছাড়বে নতুবা আমি তোমার সঙ্গে নেই।
তুমি তো জান, চাকরির প্রয়োজনে আমাকে কত জনের সঙ্গে মেলামেশা করতে হয়। তাদেরকে কনভিন্স করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই মোক্ষম হাতিয়ার হয়ে ওঠে সিগারেট।
এটা একদমই ঠুনকো যুক্তি। সিগারেটের কারণে কেউ কনভিন্স হয় না। এসব বলে লাভ নেই। তুমি সিগারেট ছাড়বে কিনা বলো?
আজ এত ডেসপারেট কেন তুমি? তোমার কি কোনো কারণে মন-মেজাজ খারাপ?
রবীন, তোমাকে আমি অনেক দিন ধরে বলছি। তুমি আমার কথাটা একদমই পাত্তা দিচ্ছ না। এভাবে আর চলতে পারে না।
রাগ করো না। একটা সত্যি কথা বলি। তোমার আগে সিগারেটের সঙ্গে আমার পরিচয়। এত দিনের সম্পর্কটা হুট করে কি চুকিয়ে দেওয়া যায়? কোনো সম্পর্কই আমি এত সহজে ভেঙে দিতে পারি না।
তার মানে আমার চেয়ে সিগারেটই তোমার কাছে অধিক প্রিয়? সিগারেট ছাড়তে তোমার যদি এতই দ্বিধা, তাহলে কী আর করা, আমাকেই হয়তো সরে যেতে হবে।
আচ্ছা রিয়া, একটা কথা সত্যি করে বলবে, সিগারেটের প্রতি তোমার কেন এত ক্ষোভ?
তোমার শিশুসুলভ কথা শুনে আমার অবাক লাগছে। সিগারেট কি ভালো কিছু? সিগারেট যে অত্যন্ত ক্ষতিকারক, এটা তো প্রতিনিয়তই বলা হচ্ছে। তুমি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে যদি না বোঝ, তাহলে কেমন করে হবে? নাকি নেশাখোরদের কোনো বোধ-বুদ্ধি-বিবেচনা থাকে না?
সিগারেটের বিপক্ষে অনেক বেশি প্রচার-প্রচারণা চলছে, তা হয়তো ঠিক। তবে এমন অনেক মানুষের কথা জানি, নিয়মিত সিগারেট টেনেও দিব্যি সুস্থ ও সবলভাবে দীর্ঘায়ু লাভ করছেন। তাদের নিয়েও মিডিয়ায় প্রতিবেদন করা হয়েছে।
দেখ, এক/দুটো অনিয়মের ঘটনা কখনও দৃষ্টান্ত হতে পারে না।
পরিসংখ্যান বলছে, এখনও পৃথিবীতে প্রতিদিন কোটি কোটি লোক ধূমপান করে। তামাকজাত পণ্যের বাজার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের। এগুলো কিন্তু আমার মুখের বানানো কথা নয়। তুমি গুগলে সার্চ দিলে অনায়াসেই এই তথ্য পেয়ে যাবে৷
আমি তো সিগারেট নিয়ে গবেষণা করছি না। এসব জেনে আমার কী হবে? তবে ধূমপান কতটা ক্ষতিকারক, কতটা বিষাক্ত, তার তথ্য পরিসংখ্যান তো প্রতিদিনই দেওয়া হচ্ছে। সেটা কি তোমার চোখে পড়ে না? তুমি আসলে জেনেও না জানার ভান করছো। তুমি বুঝতে পারছো না কেন, সিগারেট আমি একদমই সইতে পারি না।
মজার ছলে রবীন হাসতে হাসতে বলে, এত দিন তো সয়েছো, সিগারেট কী তোমার কোনো ক্ষতি করেছে? নাকি তুমি ধূমপান বিরোধী কোনো সংগঠনে যোগ দিয়েছ?
সয়েছি মানে কি? তোমার সংস্পর্শে থাকার কারণে আমাকে মানসিক এই যন্ত্রণা সইতে হয়েছে। তাছাড়া ভেতরে ভেতরে কতটা ক্ষতি হয়েছে, তা তো বলতে পারবো না। এখন আর এটা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। আর তুমি এত কিছু জানো, এটা জানো না যে, সিগারেটের আগুনে পুড়ে মানব আর সম্পদের কত ক্ষতি হয়? মানবশরীরের তা যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তা নিয়ে তো সন্দেহ নেই।
ক্ষতি তো কত কিছুতেই হচ্ছে। তাই বলে কি মানুষ সব কিছু ছেড়ে দিচ্ছে? এই যে সাকিব আল হাসানের মতো বিশ্বসেরা ক্রিকেটার জানিয়েছে, অনেক ক্রিকেটারকেই দেখেছি সিগারেট খায়, কিন্তু দম আমার চেয়ে ভালো। তাদের যেন এতে কোনো সমস্যাই হয় না! এরচেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে?
সিগারেটখোররাও দেখি জ্ঞানপাপীও হয়। তুমি বক্তব্যের একাংশ উল্লেখ করেছো। কিন্তু তারপর তো সাকিব বলেছে, এই সমস্যা না হওয়াটা যে সাময়িক, সেটা আমরা সবাই জানি। ধূমপান শেষ পর্যন্ত ভালো কিছু বয়ে আনে না।
দেখ, সাকিব প্রথমে যেটা বলেছে, সেটা হলো বাস্তবতা। আর তুমি সাকিবের যে অংশটুকুর কথা উল্লেখ করেছো, তা অনুমান করে বলা। অনেকটা বিজ্ঞাপনমূলক। সান্ত্বনামূলকভাবে এমনটা তারকারা বলেই থাকে৷
এত কথা আমি বলতে পারবো না। সোজা কথা, আমার সিগারেট ভালো লাগে না। এটাই কি তোমার কাছে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়?
তা তো বটেই। তোমার যখন ভালো লাগে না, তখন আর কী করা যাবে? কিন্তু আমি কি জানতে চাইতে পারি না, সিগারেট নিয়ে তোমার কেন এত বিরাগ? সিগারেটের জন্য আমার সঙ্গে সম্পর্ক পর্যন্ত ছেদ করতে চাইছো। আর এতদিন যখন সইতে পারলে, এখন মেনে নিলে কী এমন সমস্যা? নিশ্চয়ই এর পিছনে অন্য কোনো কারণ আছে৷
আগেই তো বললাম, তোমার ধূমপান করা কখনও মেনে নেইনি। বরাবরই আমি আপত্তি করে আসছি। এটা তো নতুন কিছু নয়। তাছাড়া আমাদের বিয়ে নিয়ে চূড়ান্তভাবে কথা-বার্তা হচ্ছে। তার আগে বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া ভালো নয় কি। আমি সিগারেট অপছন্দ করি বলার পরও তুমি কি তাতে সন্তুষ্ট হতে পারছো না?
আমি অসন্তুষ্ট তা কিন্তু বলিনি। তোমাকে তো অনেক দিন ধরে চিনি। তোমার মন-মেজাজও কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। আমার মন বলছে সিগারেট নিয়ে তোমার নিশ্চয়ই কোনো তিক্ত স্মৃতি আছে। যা তুমি বলতে চাইছো না।
রবীন তুমি যেমনটা ভাবছো, আসলে তা নয়।
আশ্চর্য! আমি তো কোনো ভাবনার কথা বলিনি। জানতে চাইছি তোমার না বলা কথা।
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, তুমি হয়তো আমাকে নিয়ে কোনো সন্দেহ পোষণ করছো।
তোমাকে নিয়ে এই হয়েছে এক মুশকিল। ফটাফট নিজের মনগড়া একটা কিছু দাঁড় করিয়ে ফেলো। ধূমপান আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মানুষ তো অভ্যাসের দাস। সেই দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে হলে সময় তো লাগবে। সেক্ষেত্রে তোমার সহযোগিতাও দরকার। সিগারেট নিয়ে তোমার জীবনে যদি খারাপ অভিজ্ঞতা থেকে থাকে, সেটাও জানলে আমাকে মানসিকভাবে একটা ধাক্কাও দিতে পারে। তাতে সিগারেটের প্রতি আমার আসক্তি কাটাতে হয়তো সহায়তা করতে পারে। তোমার পরামর্শ ও অভিজ্ঞতা আমার জন্য থেরাপি হিসেবে কাজও করতে পারে।
তুমি তো আর মাদকাসক্ত নও। সব কিছু জানো, বোঝ। ইচ্ছে করলেই তুমি ধূমপান ছাড়তো পারো। এ নিয়ে এত কথা বলার কি আছে।
সেটা তো আমি অস্বীকার করছি না। তোমার যদি এমন কোনো অভিজ্ঞতা থেকে থাকে, তা জানলে হয়তো ধূমপান ছাড়তে আমি উদ্বুদ্ধ হতে পারি। নিজেকেও একটা প্রবোধ দিতে পারবো।
বুঝতে পারছি, তোমার মনের মধ্যে অনর্থক একটা ধারণা গেড়ে বসেছে। তা থেকে তুমি বের হতে পারছো না। আসলে সিগারেট ছাড়ার জন্য তোমাকে যে কারণগুলো বলেছি, তার সবটাই যুক্তিসঙ্গত। আমাদের সম্ভাব্য সংসার, অনাগত সন্তানের জন্যও তো ধূমপান অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। সেটা তুমি অন্তত বোঝার চেষ্টা করো।
তা না হয় করলাম। তবে তোমার মনের আসল কথাটা আমাকে বলে ফেলো। তাহলে হয়তো সমস্যার চটজলদি সমাধান হতেও পারে। আমি অনুমান করতে পারছি, কিছু একটা তোমার ভিতরে ছটফট করছে, কিন্তু বলি বলি করেও বলতে পারছো না, সেটা আমি বুঝতে পারি। তুমি তো জানো, আমি সাইকোলজির ছাত্র। তাছাড়া মার্কেটিংয়ে কাজ করতে করতে মানুষের ভিতরটা কিছুটা হলেও পড়তে পারি।
তাই বুঝি?
জ্বি ম্যাডাম। সেটা ইতোমধ্যে তোমার অনুধাবন করতে পারার কথা। এ নিয়ে নতুন করে তো কিছু বলার নেই।
তোমার অনুমান ক্ষমতার প্রশংসা করতেই হয়। স্বীকার করছি, তোমার ভাবনাটা একদম অহেতুক নয়। তবে কারণটা একান্তই আমাদের পারিবারিক। আমার পরিবারের কেউ চায় না, আমি ধূমপায়ী কাউকে বিয়ে করি। এ কারণে তোমাকে কথাটা সরাসরি বলতে ইতস্তত করছিলাম। তারা যদি না চায়, তাহলে আমাদের বিয়েটা নিয়ে তো সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
হুম। বুঝতে পারছি। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে এত ডিটারমাইন্ড কেন? কারণটা কী? কোনো বিয়ের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে সিগারেট অন্তরায় হতে পারে, এটা আমি কস্মিনকালেও শুনিনি।
তাহলে নিশ্চয়ই তুমি এর গুরুত্ব বুঝতে পারছো। কতটা অপছন্দ হলে একটা পরিবার এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
সে কথাটাই তো জানতে চাইছি।
সব কথা তোমার শুনতেই হবে?
সে তোমার মেহেরবাণী। বললে সমস্যার জট খুলে যেতে পারে।
আদতে সিগারেটের কারণে আমাদের পরিবারে বড় একটা সর্বনাশ হয়ে যায়।
সেটাই তো এতক্ষণ ধরে ইনিয়ে-বিনিয়ে জানতে চাইছি। একটু খুলে বলো না প্লিজ।
এটা আমাদের পরিবারের একটা আবেগের বিষয়। তা সবাইকে জানাতে ভালো লাগে না। এ কারণে এ বিষয়টা কাউকে বলতে চাই না। বলতে গেলে মনটা খারাপ হয়ে যায়।
আমাকে তো নিশ্চয়ই দূরের ভাবো না?
তা ভাববো কেন?
তাহলে তো বলতেই পারো।
এরপর রিয়া বলতে শুরু করে, আমার দাদু বলেই বলছি না তিনি ছিলেন অসাধারণ একজন ব্যক্তি। শিক্ষকতা করতেন। লালন করতেন প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণা। মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতেন। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। গ্রামের বাড়িতেই তার নিজস্ব পাঠাগার ছিল। যে কোনো বুদ্ধি-পরামর্শের জন্য গ্রামের মানুষ তার স্মরণাপন্ন হতেন। নিজের এলাকায় তিনি বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। স্পষ্টভাষী হওয়ার কারণে কেউ কেউ তাকে ভীষণ অপছন্দও করতেন। তাকে বিভিন্নভাবে নাজেহাল করেন। বিনা দোষেই একাধিকবার জেলও খেটেছেন। গ্রামের প্রভাবশালী মাতব্বরের সঙ্গে জমি-জমা নিয়ে দাদুর বিরোধ লেগেই ছিল। মাতব্বর করতেন সরকারি দল। তিনি তার প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে দাদুর অনেক জমি দখল করে নেন। তবুও নীতির প্রশ্নে দাদু মোটেও আপস করেননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকম সহযোগিতা করতেন। এটাও তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তবে তার একটা বদভ্যাস ছিল। তিনি ছিলেন রীতিমতো চেইন স্মোকার। সিগারেট ছাড়া একদমই থাকতে পারতেন না।
টিপ্পনি কেটে রবীন বলে, দেখছো, তোমার দাদুও সিগারেট পছন্দ করতেন।
আগে শোনো আমার কথা, বলে রিয়া, সেই কারণে আমাদের পরিবারকে দুঃখের স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলতে হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় একদিন সন্ধ্যার দিকে গ্রামে পাকিস্তানি সৈন্যদের আসার খবর পেয়ে দাদু সপরিবারে বাড়ির পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নেন। সৈন্যরা এসে জ্বালাও পোড়াও করতে থাকে। নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকে। সে সময় দাদুর অসম্ভব সিগারেটের নেশা পায়। টেনশনে বা যে কোনো সমস্যার সময় সিগারেট ছাড়া তিনি সুস্থির থাকতে পারতেন না। সৈন্যদের তাণ্ডবলীলা দেখে তিনি ছটফট করতে থাকেন। আর প্রাণ বাঁচাতে এভাবে জঙ্গলে আশ্রয় নিতে হওয়ায় তাকে অস্থিরতায় পেয়ে বসে। কোনো কিছু বিবেচনা না করেই একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে শুরু করেন। তার সিগারেটের নেশার কথা গ্রামের সবাই জানতো।
রিয়া বিষণ্ন কণ্ঠে বলতে থাকে, মাতব্বরই দাদুকে শায়েস্তা করার জন্য সৈন্যদের আমন্ত্রণ জানিয়ে গ্রামে নিয়ে আসে। দাদুকে না পেয়ে বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তারপর দাদুকে খুঁজতে থাকে। তিনি যে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন, মাতব্বর তা জেনে যায়। জঙ্গলের কাছাকাছি গিয়ে সিগারেটের আগুন দেখতে পায়। মাতব্বর ঠিকই বুঝতে পারে, ধূমপান করছে কে? দাদুর অবস্থান দেখিয়ে দিলে সিগারেটের আগুন লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করে সৈন্যরা। তাতে দাদুসহ পরিবারের নয় জন শহীদ হন। সামান্য সিগারেটের কারণে আমাদের পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। শুধু আমার দিদি আর বাবা বেঁচে যান। বাবার তখন কিশোর বয়স। তারপর থেকে আমাদের পরিবারের কেউ সিগারেট পছন্দ করে না। আমার দিদি তো সিগারেট দেখলেই অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ বুঝতে পারার পর থেকে আমিও সিগারেট খুব অপছন্দ করি।
বুঝতে পারছি তোমার সেন্টিমেন্ট। কিন্তু আমি না হয় সিগারেট ছেড়ে দিলাম। তোমার আশপাশের অনেকের মুখেই তো সিগারেট। তাদের কি ছাড়াতে পারছো?
আর কে কী করলো তা নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। তুমি তো আর বাইরের কেউ নও। আমাদের পরিবারের সদস্য হতে চলেছো। তুমি যদি আমাদের পরিবারের আবেগকে গুরুত্ব না দেও, তা আমি সইতে পারবো না। এটা কেবল সিগারেট ছেড়ে দেওয়ার বিষয় নয়, তুমি আমাকে কতটা অনুভব করো, সেটাও বুঝতে চাইছি।
ঠিক আছে, আমার ভালোবাসার মানুষ যখন চাইছে না, আমি প্রমিজ করছি, বিয়ের পর থেকে আমি সিগারেট ছেড়ে দেব।
বিয়ের পর কেন? এখন থেকে কেন নয়?
কারণ হলো, কোনো অভ্যাসই চট করে ছাড়া যায় না। আর আমরা তো খুব সহসাই বিয়ে করতে যাচ্ছি। এই কয়েকটা দিন তুমি আমাকে ছাড় দেবে না?
ঠিক আছে। তোমার সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম। কিন্তু বিয়ের পর দিন থেকে আমি কোনোভাবেই আর মেনে নেব না। মনে রেখো, তোমার কথার যেন নড়চড় না হয়।
মিটমাট হয়ে যাওয়ায় দুজনেই স্বস্তি ফিরে পায়। সিগারেটের কারণে তারা একে অপরের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাবে, এটা তাদের কাম্য ছিল না।
সব কথা কি মানুষ রাখতে পারে? পারে না। ভালোবাসা যত গভীর হোক না কেন কথার বরখেলাপ হয়ে যায়। কিছু করার থাকে না। কথা দিয়েও রবীনের আর কথা রাখা হয়নি। রিয়ার সঙ্গে তার বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়নি। না হওয়ার কারণ সেই সিগারেট। একাকী বাসায় প্রতিদিন লাইট নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ধূমপান করা রবীনের দীর্ঘ দিনের প্রিয় অভ্যাস। বিয়ের আগের দিন রাতে সে একটার পর একটা সিগারেট টানতে থাকে। এক ধরনের টেনশনও ভিতরে ভিতরে কাজ করতে থাকে। রিয়ার সঙ্গে প্রতিশ্রুতি অনুসারে পরের দিন থেকে আর ধূমপান করা হবে না। এটা তার জন্য কঠিন এক সিদ্ধান্ত। নিরূপায় হয়ে তাকে মেনে নিতে হচ্ছে। তার বুকের মধ্যে সুখের মতো একটা কষ্টও হতে থাকে। তারপর সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে প্যাকেটের শেষ সিগারেটটিতে শেষবারের মতো সুখ টান দিয়ে আনমনে ছুঁড়ে ফেলে। তারপর গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় রবীন।
বিছানায় জেগে থাকে তার ছুঁড়ে ফেলা জ্বলন্ত সিগারেট। দূরাগত ধ্বনির মতো কোথাও যেন বাজতে থাকে, 'আমি যেন সেই এক জ্বলন্ত সিগারেট/নিজেরে পুড়ে পুড়ে করি নিশ্বেস।' ধিকি ধিকি করে জ্বলতে জ্বলতে একসময় তা রূপান্তরিত হয় আগুনে। পুড়ে যায় বিছানার চাদর। এরপর ধাপে ধাপে আগুনের লেলিহান শিখায় খাক হয়ে যায় ঘরের সব কিছু। এমনকি রেহাই পায়নি রবীনও।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন