পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

বুধবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২১

জীবন ঝরছে বাড়ছে দুঃখ

সরকার ১৯৮৭ সালের ১৩ আগস্ট দৈনিক 'বাংলার বাণী' পত্রিকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে কর্মরত আমরা সবাই বলতে গেলে কর্মহীন হয়ে যাই। তবে কয়েক দিনের মধ্যেই পত্রিকার সহযোগী প্রকাশনা চলচ্চিত্র বিষয়ক সাপ্তাহিক 'সিনেমা' পত্রিকায় বাড়তি সংযোজন করা হয় চার পৃষ্ঠার 'সিনেমা প্রবাহ'। তাতে স্থান পায় নানান রকম বিষয়। দৈনিকের পাশাপাশি আমি আগে থেকেই 'সিনেমা' পত্রিকায় কন্ট্রিবিউটর হিসেবে কাজ করতাম। সে সময় দেশের বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে পত্রিকার ১৯৮৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় লিখেছিলাম 'জীবন ঝরছে বাড়ছে দুঃখ'। বেশ বড় লেখাটি অন্য পৃষ্ঠায়ও স্থান পেয়েছিল। 




দেশের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতিতে দেশবাসী নিশ্চল। পাশাপাশি উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতায় সকলেই দিশেহারা, হতচেতন। প্রতিদিনই টুপ-টাপ ঝরে পড়ছে জীবন। বাড়ছে, মানুষের দুঃখ-কষ্ট। গণমাধ্যম দেশব্যাপী চলতি বন্যার যেটুকু সংবাদ বয়ে এনেছে, তাতে সকলেই দারুণ শংকিত। কেননা অর্ধ শতাধিক জেলা প্লাবিত হওয়ায় কম-বেশি সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত।

এমনকি বন্যার পানিতে অরক্ষিত হয়েছে ঢাকা সেনানিবাস, মতিঝিলসহ খোদ রাজধানী। ঢাকার অধিকাংশ আশ-পাশের সড়ক ও আবাসিক এলাকায় জলযান চলতে দেখা গেছে।জানা যায়, সাম্প্রতিক কালে বন্যা পরিস্থিতির এমন অবনতি আর ঘটেনি।

বিবেকের তাড়নায় একটুখানি সহানুভূতির জন্য ছুটে গিয়েছি বন্যা দুর্গত এলাকায়। যদিও গিয়েছি, সীমিত ও বিচ্ছিন্ন কিছু অঞ্চলে। কিন্তু সেসব স্থানে গিয়ে আঁচ করতে পেরেছি সমগ্র দেশের বন্যা পরিস্থিতি। পরিস্থিতি অবলোকন করে অক্ষম যন্ত্রণায় ছটফট করেছি—প্রকৃতি ও মানুষের ছলনায়। হৃদয়ে বন্দী করেছি মানুষের নিদারুণ অসহায়তা।

দু'চোখে জল নিয়ে বিস্তীর্ণ জলের ওপর দিয়ে পথ চলেছি একরাশ অস্থিরতা নিয়ে। দিগন্তব্যাপী অসীম জলরাশির সংস্পর্শে গিয়ে অসহায় মানুষের কাতরতা দেখে দেখে শুষ্ক চোখেও বয়ে যায় জলের ধারা। মানসপটে ভেসে ওঠেছে একটি উর্দু কবিতার চরণঃ


“আসফ আঁখোসে রোয়া ঔর জিগর জলতা হ্যায়। কেয়া কেয়ামৎ হ্যায় কি করসাৎমে ঘর জ্বলতা হায়।” অর্থাৎ চোখ দিয়ে অঝোরে জল করে যাচ্ছে; অথচ হৃদয় জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। কি আশ্চর্য, যেন প্রবল বর্ষণমুখর শ্রাবণধারায় ঘরটা জ্বলে ছাই হয়ে গেল। (শের শায়েরী)।


এই চরণ আওড়াতে আওড়াতে বুকের মাঝে চিন চিন করে ওঠে ব্যথায়। বাংলার সবুজ-শামল প্রকৃতির রূপ হারিয়ে গিয়ে-যেদিকে চোখ যায় দেখেছি, শুধু থৈ থৈ জলতরঙ্গ। যেখানে গতকালও ছিল জীবনের স্পন্দন, আজ সেখানে জলমগ্ন। আর ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

শুনেছি, ভূমণ্ডলের চার ভাগের তিন ভাগ জল। কিন্তু বন্যা প্লাবিত এলাকায় গিয়ে মনে হয়েছে, বিশাল জলরাশির মাঝে একখণ্ড জমিন উঁকি মারছে, অতিকষ্টে। জনপদের কোথাও নেই জনবসতি।

অথচ জলযানে যে যে স্থানে গিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি বন্যার সর্বগ্রাসী দাপট, ঠিক সেখানেই ছিল হাজারো মানুষের বসবাস আর কোলাহল। অতীতের বন্যায় যখন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে, তখন আশ্রয়ের জন্য মানুষ আশ-পাশের সুবিধাজনক স্থানে ঠাঁই নিয়েছে। এবারও আশ্রয় নিয়েছিল তেমনি। যেহেতু চলতি বন্যার চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন, সেহেতু নিকটের নিরাপদ ভূ-খণ্ডটুকুও আশ্রয়হীন করে তোলে, বানভাসীদের।



অনেকে আবার আশ্রয় নিয়েছিল নিজেদের ঘরের উঁচু চালে। কেননা শত বিপর্যয়েও পৈতৃক-ভিটা ছেড়ে কোথাও পরবাসী হতে তাদের মন সায় দেয়নি। এভাবে ক'দিন রজনী কাটায় নিরাপদে। কিন্তু একদিন রাতের অাঁধারে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের একমাত্র আশ্রয়টুকু কখন প্লাবিত হয়ে যায়, তা কেউ টের পায়নি, ঘুণাক্ষরে। ফলে অনেকেই বিলীন হয়ে যায় জলের গহ্বরে। সেই সাথে ঘটেছে দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। 

এমনি একটি ঘটনা চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ঘটেছে। উপজেলার দুরূ খালের পাড় ভেঙ্গে আশ-পাশের এলাকা হয় প্লাবিত। ফলে প্রতি মুহুর্তে বাড়তে থাকে পানি। তবুও একটি পরিবার চায়নি ঘর বাড়ী ত্যাগ করতে। কিন্তু ঘরে পানি ঢুকতে থাকলে এক দম্পতি এগার মাসের সন্তানকে ঘাটে রেখে স্বামী-স্ত্রী মাল-পত্র গুছাতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। এক পর্যায়ে ঘরের মধ্যে কোমর পানি ওঠে যায়। সে সময় পানিতে শব্দ শুনে গৃহকর্তা বড় মাছ মনে করে কিরিচ দিয়ে কোপ দিলে পানি রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ পর দু'টুকরো অবস্থায় সন্তানকে ভেসে ওঠতে দেখে পিতা-মাতা সাথে সাথে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।

প্লাবনে বিলীন হয়েছে, অনেকের সারা জীবনে সঞ্চিত শেষ সম্বলটুকু। নারায়ণগঞ্জের কাশীপুর এলাকার ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ সড়কে গোপচরের শেখ সোমেজ কলাগাছ কেটে কোনো রকমে আশ্রয় নিয়েছেন। এক সময়ের জনবসতি বন্যায় প্লাবিত হয়ে যাওয়ায় তার উপর জলযান বেয়ে বেরে যখন বিভিন্ন সরকারী ত্রাণ শিবিরে পৌঁছেছি, তখন দেখেছি, হাজার হাজার মানুষের আহাজারি। সকলেই শোকাহত। শুনেছি, কারো কারো গগণবিদারী আর্তনাদ, কেউ সন্তান-সন্ততি হারিয়ে, কেউ পিতা-মাতা হারিয়ে, কেউ স্বজন-পরিজন হারিয়ে কিংবা কেউ সব কিছুই হারিয়ে হারিয়ে বোবা যন্ত্রণা নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।



ঢাকার নবাবগঞ্জের ওয়াপদা ভেড়ী বাঁধে বন্যার্তদের দৃশ্য দেখে চোখে পানি রাখা কষ্টকর। স্বামী, দুই পুত্র, কন্যাকে হারিয়ে সকিনা বিবির বাঁধের উপর সেকি আহাজারি ও বিলাপ। শুধু সকিনা নয়, আরো অনেকের আর্তনাদে কণ্ঠরোধ হয়ে আসে। কে দেবে তাদের সান্ত্বনা! সবার চোখেই পানি। চারপাশে পানি। আশ্রয় শিবিরে জায়গা না পেয়ে কেউ কেউ বাঁশের মাচানে পানির ঢেউ আর বিষধর সাপের সাথে লড়াই করছে। সিরাজগঞ্জের বল্লাপাড়া গ্রামের চরণ ঘোষ সর্প দংশনে স্ত্রীকে হারিয়ে বানের পানিতে ভাসিয়ে ঘরে ফিরে নিজেই দংশিত হয়।

অনেকের শোক মিলিয়ে গিয়ে চোখে-মুখে ঝরে পড়ছে, বাঁচার দাবিটকু। কেউ তিনদিন, কেউ চারদিন কিংবা একাধিক দিন অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণছে। অবুঝ শিশুগুলো মাকে জড়িয়ে ক্ষুধার তাড়নায় কাঁদছে ।

সিরাজগঞ্জের লাহিড়ি মোহনপুরের ধান কলের শ্রমিক বিধবা আছিয়া খাতুন দশদিন অনাহারে থেকে ষ্টেশনের প্লাটফরমে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। তার সর্বশেষ খবর জানা সম্ভব হয়নি। ঢাকার গোরান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় শিবিরে অবস্থানরত একজন বৃদ্ধার বক্তব্য : পানির হাত থেকে বাঁচার জন্য এখানে এসেছি। কিন্তু বাঁচবো কিনা আল্লায় জানে। গাইবান্ধার বিভিন্ন গ্রামে তীব্র খাদ্য সংকট। ক্ষুধা মেটাতে মানুষ কলার থোর, কচুলতা, কচুর মুড়ো সেদ্ধ করে খাচ্ছে। এবং এ দৃশ্য দেশের প্রায় সর্বত্র।

বেতার, টেলিভিশন, সংবাদপত্রে সরকারের মন্ত্রী, আমলা, নেতাদের ত্রাণ তৎপরতা সংক্রান্ত কাহিনী শুনলে কিংবা গর্বিত মুখের হাসি দেখলে মনে হতে পারে- বন্যাজনিত পরিস্থিতি বুঝিবা সরকারের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু সব হারানো মানুষের মাঝে এসে দাঁড়ালে চোখ বন্যার পানির মত প্লাবিত হয়ে ওঠে। মূক হয়ে যায় মুখের ভাষা । 



জীবন ধারণের ন্যূনতম চাহিদার জন্য বন্যার্তদের চোখে-মুখে সেকি আকুলতা। একখণ্ড রুটি কিংবা এক মুঠো চাউলের জন্য হাজার হাজার মানুষের মিলিত হাত ধেয়ে আসে। ভাগ্যবান কেউ তাৎক্ষণিকভাবে তা হস্তগত করতে পারলে চোখে তার স্বর্গ জয়ের আনন্দ। অথচ পরক্ষণে সে আনন্দের রেশ যায় মিলিয়ে। 

এদিকে অনাহারে, অর্ধাহারে অখাদ্য-কুখাদ্য এবং দূষিত জল নিরুপায় হয়ে খাওয়ার ফলে মড়ক লেগেছে—রক্ত আমাশয়, পেটের পীড়া, ডায়রিয়ার। প্রায় প্রতি দিনই টুপ-টাপ ঝরে পড়ছে দু’একটি জীবন।

সরকারী হিসেবে বলা হয়েছে, এক লাখের বেশী লোক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। প্রাণ হারিয়েছে ৭৬৷ কিন্তু বেসরকারী হিসেবে ডায়রিয়া, আমাশয়, উদরাময়সহ বিভিন্ন পেটের পীড়ায় দুই লাখেরও বেশী আক্রান্ত। প্রায় ৩০টি জেলায় ডায়রিয়া মারাত্মক সংক্রামক এবং দশাধিক জেলায় মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। মৃতের সংখ্যা অসংখ্য। সরকারী কর্মকর্তারা এই জ্বলজ্যান্ত সত্য স্বীকারে নারাজ। 

এদিকে প্রথমতঃ খাদ্য নেই, দ্বিতীয়তঃ বিশুদ্ধ পানির জন্য মানুষ ছটফটিয়ে মরছে। কবির ভাষায়ঃ “ওয়াটার ওয়াটার এভরিহোয়্যার বাট, নট এ ড্রপ টু ড্রিঙ্ক”। সরকার, তা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

কোথাও কোথাও অনেক মৃতদেহকে দাফন করা যায়নি। কলা গাছের ভেলায় কিংবা পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেক মৃতদেহ হয়েছে কুকুরের আহার্য। দিনাজপুর বিরল উপজেলার ৯নং রানিদীঘি ইউনিয়নের একটি দৃশ্য অবিকল এ রকমঃ মা ও তার দুই শিশু সন্তানকে বাহু বন্ধনে আপন বুকে আগলে রেখেছে। গলিত লাশ থেকে বেরুচ্ছে উৎকট দুর্গন্ধ আর এক পাল কুকুর খাবলে খাবলে খাচ্ছে তার মাংস। এর থেকে একটু দূরের আরো একটি লাশ, এক কিশোরীর। কুকুর শেয়ালের পাল ইতিমধ্যেই সে লাশের অর্ধেক সাবাড় করেছে।

এদিকে সরকার দাবি করছেন, ত্রাণ তৎপরতা অপ্রতুল নয়। প্রয়োজন মাফিক তা সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে। অথচ বাস্তব সে সাক্ষ্য দেয় না। দৃষ্টান্ত হিসেবে একটি দৈনিকের সংবাদদাতার ভাষ্য: রংপুরের বদরগঞ্জে খাদ্য সংকটের পাশাপাশি বস্ত্র সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। পুরুষ মানুষ লুঙ্গীর বদলে চট পরছে, আর মেয়েরা ছিঁড়া কাঁথা পরছে, কেউ শুধু ছায়া পরে আছে। বন্যা বিধ্বস্ত গ্রাম জনপদগুলোতে কমবেশী অঞ্চলের অবস্থা বিরাজমান। ঐ এলাকার শংকরপুর-বেলপাড়া ইউনিয়নের আবুল্লাহ মিয়া বলেন, প্যাটেতে খাবার নাই তবন (লুঙ্গি) কিনি কি দিয়া ?

এ অবস্থায় অনুমিত হয় ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের অবস্থা মোটেও আশানুরূপ নয়। সরকার যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে, সুষ্ঠু বণ্টন হলে মাথাপিছু হিসেবে তা পঞ্চাশ পয়সায় সীমাবদ্ধ। তাছাড়া বরাদ্দকৃত ত্রাণসামগ্রী বন্যার্তদের হাতে পৌঁছানোর আগেই অধিকাংশই আবার ভোজবাজির মত গায়েব হয়ে যায়। ভয়েস অব আমেরিকার ঢাকাস্থ প্রতিনিধি গিয়াস কামাল চৌধুরীর ভাষায়ঃ কাজীর গরু খাতায় আছে, কিন্তু গোয়ালে নেই। একটি সূত্র জানায়, ত্রাণসামগ্রী বিতরণ না করে সরকারের লোকজন বন্যার্তদের কাছ থেকে জোরপূর্বক টিপসই দিতে না চাইলে তাদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। এমন একটি ঘটনা শের-এ বাংলা নগর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের আশ্রয় শিবিরে ঘটেছে। ইতিমধ্যে কালোবাজারে রিলিফের চাল বিক্রির দায়ে গ্রেফতারের খবরও চোখে পড়েছে। এ সংক্রান্ত অসংখ্য মামলা নথিভুক্ত করা হচ্ছে। 

ঢাকাস্থ একটি ত্রাণ শিবিরের খবর। চাল আসছে সকালে দেয়া হবে, বিকেলে দেয়া হবে, এমন আশার বাণী শোনান হয়। আর আশা পূরণের অনিশ্চয়তা নিয়ে দুর্গতরা অধীর অপেক্ষা করেন। খাদ্যের জন্য শিশুদের গলাফাটা আর্ত চীৎকার, সব মিলে পরিবেশ যেমন নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর, তেমনি করুণ ও বেদনাদায়ক। নারায়ণগঞ্জের ইয়ারুন নেছা ক্ষোভের সাথে বলেন, “কই মেম্বার চেয়ারম্যান, হেরা কই, ভোটের আগেতে মা কইয়া পাও ধরে, এহন তো মুখও দেহি না। পাস করলেই গম চুরির চিন্তা।”

সার্বিক হিসেব-নিকেশ করে একটি রেজাল্ট দাঁড়ায়ঃ সহায়-সম্বলহীন বানভাসিদের অধিকাংশই শোচনীয় অবস্থায়। দিনাতিপাত করছে ধুঁকে ধুঁকে। মৃত্যুর পরোয়ানা দুয়ারে হাজির হতে পারে যে কোনো মুহুর্তে ।

দেশের সর্বত্র বন্যা দুর্গতদের আকুল আবেদন আমরা রিলিফ চাই, চাই কোনো মতে বাঁচতে। অথচ অপর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রীর কারণে বন্যার্তদের আবেদন অগ্রাহ্য হচ্ছে।

দেশে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ত্রাণ তৎপরতায় এবং সরকারের সহযোগীদের বিরুদ্ধে রিলিফ চুরির অভিযোগ এনেছেন।

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও সংসদে বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মানুষকে বাঁচানোর দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সরকার এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, জনগণ না খেয়ে মরছে, সেদিকে ক্ষমতাসীনদের কোনো খেয়াল নেই। তারা আখের গোছাতে ব্যস্ত। এ সরকার দুর্গত মানুষের পক্ষের নয়, ধনীক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জনাই ক্ষমতা আঁকড়ে রয়েছে। 

বিএনপি চেয়ারম্যান বেগম খালেদা জিয়া বলেছেনঃ বন্যাদুর্গত বিপন্ন মানুষের ত্রাণ তৎপরতার নামেও দুর্নীতি চলছে। এই দুর্গত মানুষের সাহায্যের জন্য সরকার যে প্রচারণা চালাচ্ছে, তাও মিথ্যায় ভরপুর।দুর্গত মানুষের কাছে সরকারী ত্রাণসামগ্রী পৌঁছছে না।

তিনি আরো বলেনঃ আজ অনাহারে, অর্ধাহারে, অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে ক্ষুধার তাড়নায় হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। তাদের খাবারের কোনো বন্দোবস্ত এবং চিকিৎসার সুযোগ নেই।

বাকশালের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেছেনঃ এই ভয়াবহ দুর্যোগে বিপন্ন মানবতার প্রতি আজও বিশ্ব বিবেক ও সরকারসমূহ তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়নি।

জামাতে ইসলামের আমীর আব্বাস আলী খান বলেছেনঃ এ বন্যা সরকারের পাপের ফসল । 



বন্যার স্রোত আর তৎক্ষণাৎ পরিস্থিতিতে বেশ কিছু জীবন হারিয়ে গেলেও বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সময় পেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে অর্থাৎ বন্যার পানি টান ধরলে, প্রাণহানি ঘটবে অসংখ্য মানুষের। এ অবস্থাকে সামাল দিতে হলে প্রয়োজন পর্যাপ্ত খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়, ওষুধ। অথচ অবস্থা তেমন সুবিধের নয়।

বন্যার্তদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জীবনও ক্রমাগত ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠছে। কেননা পণ্যদ্রব্যের মূল্য পাগলা ঘোড়ার মত ছুটে চলছে। সর্বশেষ বাজার দরে চাল ১৬ টাকায় ঠেকেছে। পর্যবেক্ষক মহলের অভিমত, বন্যাজনিত কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সরকার ব্যর্থ হতে চলেছে । দেশ-বিদেশে দৌড়াদৌড়ি করেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বাংলাদেশস্থ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার কিংবা আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের আবেদন নিবেদন করে এবং সরেজমিনে বন্যা উপদ্রুত এলাকা প্রদর্শন করিয়ে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। উড়িরচরের জলোচ্ছ্বাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সাহায্য পাওয়ার যে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গিয়েছিল এবার তার ছিটে-ফোঁটাও মিলছে না। এমনকি স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক বাহিনীর পক্ষাবলম্বনকারী বর্তমান সরকারে ত্রাণ, পুনর্বাসন ও ধর্মমন্ত্রী মওলানা আবদুল মান্নান সুযোগ পেয়ে দেশের মান-সম্মানকে ভুলুণ্ঠিত করছেন দ্বিধাহীনচিত্তে। মন্ত্রী মুসলিম দেশগুলোর কাছে ভিক্ষা চেয়ে বলেছে, 'আমরা যাকাত পাবার প্রথম কাতারে'। তা সত্ত্বেও ভিক্ষা আসছে না। মন্ত্রীদের দূত হিসেবে বিভিন্ন দেশে পাঠানোর কথা, চেয়েচিন্তে সাহায্য আনতে। সাহায্য চাওয়া হয়েছে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত এসকাপের বৈঠকে। এত উদ্যোগের পর উপ-পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াজেদ আলী খান পন্নী সাংবাদিকদের বলেছেন, বন্যার্তদের জন্য বিদেশী সাহায্যের প্রতিশ্রুতি’ উৎসাহব্যঞ্জক। এই প্রতিশ্রুতি কবে নাগাদ কার্যকর হবে, তা বলতে পারে ভবিতব্য। সাহায্যের একটি নমুনাঃ একটি প্রভাবশালী দৈনিকের খবর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সংগৃহীত গম আগামী ৩০শে সেপ্টেম্বর পৌঁছাতে পারে। এদিকে রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেছেন, দেশে কোনো খাদ্য ঘাটতি নেই। কারণ ১০ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় অন্য সম্পদেরও কোন ঘাটতি আমাদের নেই। অন্যদিকে একটি জাতীয় দৈনিকের সাথে সাক্ষাৎকারে বাণিজ্যমন্ত্ৰী মেজর জেনারেল এম, মুনীম দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে নিয়ে বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি আমরা কার্যকরভাবে সফল করতে পারিনি। সরকার পরিচালিত একটি সাপ্তাহিকীর সম্পাদকীয়তে স্বীকার করা হয়েছে, সারাদেশ ভয়াবহ বন্যায় নিমজ্জিত। মানুষ ক্ষুধার্ত, নিরাশ্রয়, অসহায়। প্রায় সারাদেশ জলবন্দী। বন্যায় ভেসে গেছে ঘর-বাড়ি, শস্যক্ষেত্র, আমন ধান। ভেসে গেছে গবাদিপশু, সহায় সম্পত্তি। বন্যা তাই শুধু মানুষের বর্তমান কেড়ে নেয়নি, একই সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও শংকিত করে তুলেছে। অপর দিকে উত্তরাঞ্চলের বন্যার পানি দক্ষিণাঞ্চলে ধেয়ে আসছে। ফলে দুঃখ-দুর্দশাও ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। দেশব্যাপী চলতি বন্যায় সবশেষ সরকারী হিসেবঃ ৫২টি জেলা প্লাবিত। প্রাণহানির সংখ্যা পাঁচ শত ছুঁই ছুঁই। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দু'কোটি লোক । ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক তিন হাজার কোটির দিকে অগ্রসরমান। তবে দেশী-বিদেশী গণমাধ্যম ও বেসরকারী হিসেবের সাথে সরকারের দুস্তর ব্যবধান।

সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আনলে বন্যা-উত্তর পরিস্থিতি ভয়াবহ। তা সামাল দেয়ার জন্য সরকার এখন পর্যন্ত কার্যকর কিছু করতে পারেনি। যে কারণে প্রতি দিনই জীবন ঝরছে, বাড়ছে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। একটি প্রশ্ন এখন সবার মনে, দুর্ভিক্ষ কি আসন্ন? 

২৮শে আগষ্ট ১৯৮৭

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন