পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২১

খেপাটে এক কবির কথা

আশির দশকে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির এক অনুষ্ঠানে বাঁ থেকে বসা দুলাল মাহমুদ, দিলু খন্দকার, নকিব আহমেদ নাদভী ও কবি সানাউল হক খান 



দৃশ্যপট-১

আশির দশকের মাঝামাঝি। আমরা কজন তরুণপ্রাণ মিলে প্রকাশ করছি 'হারজিত' নামে একটি ক্রীড়া পত্রিকা। কেউ শিক্ষার্থী। কেউ সদ্য চাকরিজীবী। সামর্থ্য সীমিত। সাধ অফুরন্ত। এই পত্রিকাকে পাঠকের কাছে সমাদৃত করার জন্য আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু আর্থিক অবস্থার সঙ্গে কুলিয়ে ওঠতে পারছিলাম না। এ কারণে সাধারণত নামকরা ছাপাখানা বা উন্নতমানের কাগজে পত্রিকা ছাপা হলেও কখনো কখনো সেই ধারা রক্ষা করা যাচ্ছিল না। এ অবস্থায় একটি সংখ্যার ছাপার মান খুবই খারাপ হয়ে যায়। বেশিরভাগ লেখাই পড়া যাচ্ছিল না। তাতে তো আর আমাদের কোনো হাত ছিল না। ছাপাখানার গাফিলতির কারণে এমনটা হয়। সংখ্যাটি দেখে আমাদের বুক ভেঙে যাচ্ছিল। নিজেদের নিংড়ে দিয়ে এক একটা সংখ্যা প্রকাশ করি। ছাপাখানার কারণে তা যদি পাঠযোগ্য না হয়, তারচেয়ে কষ্ট আর কী হতে পারে? সবে ছাপাখানা থেকে আনা সেই সংখ্যাটির প্রথম কপিটি নিয়ে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতিতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে ছিলাম। চোখে টলমল করছে অশ্রু। এমন সময় এলেন সিনিয়র একজন লেখক। তিনি প্রতিটি সংখ্যায় লেখা দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করে থাকেন। সেই সংখ্যায়ও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা। তিনি আমার হাত থেকে কপিটি নেন। তারপর পাতা উল্টিয়ে দেখতে থাকেন। ভেবেছিলাম, আমার অবস্থা দেখে তিনি একটু সান্ত্বনা দেবেন। সহমর্মিতা প্রকাশ করবেন। সহানুভূতি জানাবেন। বয়সের যে ব্যবধান, তাতে তেমনটাই ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু যা ভেবেছি হয়েছে তার উল্টো। এমনটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি যা করলেন, তাতে তিনি যেন 'কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা' দিলেন । তাঁর লেখাটি দেখার পর তিনি সংখ্যাটি ছুঁড়ে মারেন আমার মুখের উপর। তারপর ক্ষোভের ঝাল মিটিয়েছেন মুখের ভাষায়। যেন আমরা ইচ্ছে করে এমনটি করেছি। এমন অবস্থায় কী আর করার থাকে? অধিক শোকে পাথর হয়ে বসে ছিলাম। 

বাঁ থেকে দিলু খন্দকার, নজমুল আমিন কিরণ, সালমা রফিক, দুলাল মাহমুদ, কবি সানাউল হক খান, মনিরুল ইসলাম কাজল ও আরেকজন



দৃশ্যপট-২

নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়। পাক্ষিক 'ক্রীড়াজগত' পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেওয়ার পর এর প্রসার বাড়ানোর জন্য নানাভাবে উদ্যোগ নেই। তার অংশ হিসেবে পাঠকের ভোটে প্রতি বছর একজন সেরা ক্রীড়াবিদ এবং একজন সেরা ক্রীড়ালেখক বা ক্রীড়া সাংবাদিক নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এজন্য প্রতি সংখ্যায় কুপন ছাপানো হয়। পাঠকরা কুপন কেটে তা পূরণ করে বছরের সেরা ক্রীড়াবিদ এবং সেরা ক্রীড়ালেখক বা ক্রীড়া সাংবাদিকের নাম পাঠিয়ে দেন। সেরা ক্রীড়াবিদ এবং সেরা ক্রীড়ালেখক বা সেরা ক্রীড়া সাংবাদিকের পাশাপাশি পাঠকদের জন্যও ছিল অর্থ পুরষ্কার। যথারীতি পত্রিকার কাটতি বেড়ে যায়। নির্ধারিত সময়ে কুপন গণনা করে সেরা ক্রীড়াবিদ হন ক্রিকেটার আকরাম খান। তখন তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা। আইসিসি ট্রফি জয়ের প্রধান নায়ক তিনি। আর সেরা ক্রীড়ালেখক হন 'ক্রীড়াজগত' পত্রিকায় অস্থায়ীভাবে কর্মরত মাহমুদুল হাসান শামীম। এই পুরষ্কারের ক্রাইটেরিয়া ছিল, 'ক্রীড়াজগত' পত্রিকায় স্থায়ীভাবে কর্মরত কেউ এই পুরষ্কার পাবেন না। একবার কেউ এই পুরষ্কার পেলে আগামীতে তাঁর আর পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। তখন তো ক্রীড়ালেখক কিংবা ক্রীড়া সাংবাদিকদের জন্য কোনো পুরষ্কারের প্রচলন ছিল না। সে কারণে পর্যায়ক্রমে তাঁদেরকে সম্মানিত করাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। যাহোক, বিজয়ীদের হাতে পুরষ্কার তুলে দেওয়ার জন্য পত্রিকার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। একই সঙ্গে এ অনুষ্ঠানে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রথম সচিব কাজী আনিসুর রহমানকে সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। কিন্তু তাঁর অবদানের কথা জানতাম। প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী সংখ্যায় একজন সিনিয়র লেখককে দিয়ে তাঁর ওপর প্রতিবেদন লেখানো হয়। সেই সুবাদে তাঁদের দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন একজন মন্ত্রী। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সম্মানিত অতিথি তাঁর বক্তব্যের সময় সেরা ক্রীড়ালেখক বা ক্রীড়া সাংবাদিক নির্বাচন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আমরা তো রীতিমতো হতভম্ব হয়ে যাই। এটা কোনোভাবেই তো তাঁর এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। এ বিষয়ে তাঁর জানারও কথা নয়। বয়োজ্যেষ্ঠ অতিথির বক্তব্যে প্রভাবিত হয়ে প্রধান অতিথিও একই রকম অভিমত ব্যক্ত করেন। দুজনের এমনতর বক্তব্যে অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও সৌন্দর্য অনেকখানি ম্লান হয়ে যায়। 

অনুষ্ঠানে উপস্থিত অনেকেই বুঝতে পারেন, সম্মানিত অতিথিকে এ বিষয়ে বলতে উদ্বুদ্ধ করেন সিনিয়র সেই লেখক। 'ক্রীড়াজগত' পত্রিকায় 'কর্মরত' হয়েও শামীম কেন পুরষ্কার পেয়েছেন? তাঁর মতো একজন বিশিষ্ট লেখক কেন পুরষ্কার পাননি, সম্মানিত অতিথি সে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। শামীম 'ক্রীড়াজগত' পত্রিকায় অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করতেন। আর পাঠকদের ভোটে সিনিয়র লেখক সম্ভবত দ্বিতীয় হয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে আমাদের করার কী ছিল? সেখানেই সিনিয়র লেখক ক্ষান্ত হননি। এর পর থেকে বেশ কিছু দিন বিভিন্ন জায়গায় তিনি আমার সম্পর্কে এমন সব অপপ্রচার করেন, যা মোটেও শোভনীয় ও সম্মানজনক ছিল না। তাঁর কারণে এরপর থেকে সেরা ক্রীড়াবিদ এবং সেরা ক্রীড়ালেখক বা ক্রীড়া সাংবাদিক নির্বাচন থেকে বিরত থাকি। অন্যকে সম্মানিত করতে গিয়ে নিজেকে যদি অপমানিত ও অসম্মানিত হতে হয়, তাহলে কার দায় ঠেকেছে এমন আয়োজন করার? 

বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভায় একাডেমির সভাপতি শামসুজ্জামান খান, প্রাক্তন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম হুদা, কবি সানাউল হক খান ও দুলাল মাহমুদ 


দৃশ্যপট-৩

২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা। বাংলা একাডেমির সাধারণ সভা। সিনিয়র একজন লেখকের সঙ্গে দেখা হয়। আড্ডাও হয়। দুপুরের মধ্যাহ্নভোজনের সময় আমি তাঁকে বললাম, গুলশানে আমার একটি বিয়ের নিমন্ত্রণ আছে। আমি সেখানে চলে যাবো। গুলশানে যে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ, সেই অনুষ্ঠানের আমন্ত্রক সিনিয়র লেখকেরও পরিচিত। তাঁকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে কিনা সেটা তো আমি জানি না। এ কারণে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাওয়া আমার পক্ষে শোভনীয় ছিল না। এতে দুজনকেই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেওয়া হয়। আর তিনি যদি সে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে থাকেন, তাহলে আমি যখন তাঁকে গুলশানে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা বলি, তাঁর তো বুঝে নেওয়ার কথা। তিনি আমাকে সে বিষয়ে কিছু বলেননি। বললে একসঙ্গে যেতে পারতাম। আমি যথারীতি সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেই। দুদিন পর তিনি আমার অফিসে আসেন। আমাকে কিছু বলেননি। আমার আড়ালে সহকর্মীদের বলে যান, আমি একজন মিথ্যেবাদী। আমি যে পরিচিত জনের সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছি, সেটা আমি তাঁকে বলিনি। সেই অনুষ্ঠানে তিনিও আমন্ত্রিত ছিলেন। আমন্ত্রকের কাছে আমার চেয়েও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। প্রথম কথা, সেই অনুষ্ঠানে তিনি আমন্ত্রিত ছিলেন কিনা আমি কীভাবে জানবো? দ্বিতীয়ত, আমি যখন গুলশানে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা বলি, তিনি তো কিছুই আমাকে বলেননি। তিনি জানতেও চাননি, আমি কোন অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। তৃতীয়ত, তিনি কিন্তু সে অনুষ্ঠানে যোগ দেননি। বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার বিষয়ে তাঁকে জানানো আমারও কোনো দায় ছিল না। তাহলে এ ক্ষেত্রে আমি কীভাবে মিথ্যেবাদী হলাম? আমি যদি অসত্য বলেও থাকি, সে কথা আমার কাছে জানতে না চেয়ে অফিসের সহকর্মীদের কাছে মিথ্যেবাদী হিসেবে অভিহিত করে আমাকে কেন অসম্মানিত করলেন? এর কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না।

যে তিনটি দৃশ্যপটের কথা উল্লেখ করলাম, তিনটি ঘটনার সিনিয়র লেখক কিন্তু একই ব্যক্তি। সাহিত্য জগতে তিনি পরিজ্ঞাত। তাঁর সঙ্গে তো সম্পর্ক তো আজকের নয়। প্রায় চার দশক হতে চলেছে। আমার সঙ্গে তাঁর এমন অসংখ্য অম্ল-মধুর ঘটনা বা দৃশ্যপট রয়েছে। তা নিয়ে অনায়াসেই একখানা গ্রন্থ রচনা করা যায়। আমি যদি তাঁর নামটি নাও লিখি, তাঁকে যাঁরা চেনেন কিংবা জানেন, তাঁরা ইতোমধ্যে ঠিকই বুঝতে পেরেছেন, তিনি কে? তাঁকে অসম্মানিত বা হেয় করার জন্য আমি এই দৃশ্যপটগুলোর কথা উল্লেখ করিনি। তাঁর মতো একজন কৃতী মানুষকে বোঝার জন্য এই দৃশ্যপটগুলো উল্লেখ না করলে তাঁকে পুরোপুরিভাবে চেনা যাবে না। কারণ, তাঁর জীবনী লেখা কিংবা তাঁকে নিয়ে গবেষণা হলে এ বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তিনি তো আসলেই এমনই। অন্য সবার থেকে আলাদা। মেজাজী, মারমুখী ও মেধাবী। মেধাবীরা বোধকরি একটু খেপাটে বা পাগলাটে হয়ে থাকে। তিনি তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আড়ালে-আবডালে তাঁর ঘনিষ্ঠরা তাঁকে 'পাগলা কবি' বলে থাকেন। এটা তিনি জানেনও। আমার ধারণা, ভিতরে ভিতরে এটা তিনি উপভোগ করে থাকেন। মজার বিষয় হচ্ছে, তিনি এমন সব কাণ্ড-কীর্তি করেন, তা সবার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু তাঁকে যাঁরা চেনেন বা জানেন, তাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষুব্ধ হলেও তাঁর এই ধরনের আচরণ মেনে নেন। তিনি এমনটা করবেন, এটাই যেন স্বাভাবিক। তিনি যখন তা না করেন, তখন সেটাই অস্বাভাবিক মনে হয়। তবে তিনি যদি এমনটা না করতেন, তাহলে নানাভাবে আরো সম্মানিত হতে পারতেন বলে আমার ধারণা। আমার কেন যেন মনে হয়, তাঁর ভিতরে একটা না পাওয়ার অতৃপ্তি ও ক্ষোভ কাজ করে। কেন এই অতৃপ্তি, কেন এই ক্ষোভ আমি বলতে পারবো না। এই অতৃপ্তি, এই ক্ষোভ তাঁকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। যে কারণে সেই হতাশা বোধ থেকে সব কিছু ভেঙেচুরে ফেলতে চান। তখন কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক, সেই বোধ আর কাজ করে না। যে কারণে একের পর এক জন্ম দেন বিভিন্ন দৃশ্যপট। এই দৃশ্যপটগুলো যে অনেকের হৃদয়ে কষ্টের ছাপ ফেলে দেয়, সেটা কখনো তিনি অনুধাবন করেন কিনা আমার জানা নেই। 

ক্রীড়াজগত কার্যালয়ে বাঁ থেকে কবি সানাউল হক খান, সব্যসাচী ক্রীড়াব্যক্তিত্ব রনজিৎ দাস ও দুলাল মাহমুদ 


ব্যক্তি জীবনে যেমন, লেখালেখির ক্ষেত্রেও তিনি স্বতন্ত্র একটা ইমেজ গড়তে পেরেছেন। তিনি কবি হিসেবে সুপরিচিত। ষাট দশকের মাঝামাঝি থেকে তিনি নিরন্তর লিখে চলেছেন। ছন্দ নিয়ে তিনি খেলতে পছন্দ করেন।এ ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সাবলীল। ১৯৮০ সালে তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'অন্ধ করতালি'। এরপর বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ইতোমধ্যে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরষ্কার। কিন্তু আমাদের কাছে তিনি ক্রীড়ালেখক হিসেবে অধিক পরিচিত ও সমাদৃত। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে তিনি খেলাধুলা নিয়ে লিখে আসছেন। ক্রীড়াঙ্গনে তিনি আলাদা একটা অবস্থান গড়ে নিয়েছেন। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সেই কৈশোরে যাঁদের লেখা পড়ে ক্রীড়া লেখালেখিতে আকৃষ্ট হই, তিনি তাঁদের অন্যতম। তাঁর লেখার জাদুতে একরকম হিপটোনাইজ হয়ে যাই । প্রতিটি লেখা পড়তাম বুভুক্ষু হৃদয় নিয়ে। তাঁর লেখার বুনন, শব্দের কারুকাজ আর সৌন্দর্যের তুলনা পেতাম না। মনে হতো এক একখানা 'ঢাকাই মসলিন'। অতি মিহি ও সূক্ষ্ণ কাপড় দিয়ে যেভাবে শিল্পীরা আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা নিয়ে বয়ন করতেন জগতবিখ্যাত মসলিন, তিনি যেন তেমনিভাবে আমাদের উপহার দিতেন ঐশ্বর্যময় সব লেখা। লেখার পরিসর সীমিত হলেও তার ব্যঞ্জনা অনেক দূর প্রসারিত। তাতে দ্যুতি ছড়ায় হীরার মতো। তাঁর লেখায় পাওয়া যায় সংগীতের তাল-লয়-সুর। তাঁর উপমা, উৎপেক্ষা, ছন্দ হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। আমার সীমিত জ্ঞানে প্রকৃতঅর্থে ক্রীড়াসাহিত্য বলতে যেটা সাধারণত বোঝায়, বাংলাদেশে অন্তত সেটা তাঁর মাধ্যমে তা চর্চিত হয়। বিকশিত হয়। জনপ্রিয় হয়। নিঃসন্দেহে এ ক্ষেত্রে তিনি পুরোধা। তাঁর ছড়া, তাঁর গদ্য কিংবা তাঁর যে কোনো লেখা পাঠকদের শুধু মুগ্ধ করে না, অভিভূত করে রাখে। কোনো লেখায় তাঁর নাম না থাকলেও সেটা বুঝে নিতে মোটেও অসুবিধা হয় না, লেখাটি কে লিখেছেন? পুরোদস্তুর একজন কবি হয়েও তিনি যে ক্রীড়াসাহিত্যে নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন, এটা আমাদের কাছে অনেক বড় পাওয়া। তিনি লেখালেখি না করলে ক্রীড়াসাহিত্য অনেকখানি অনুজ্জ্বল হয়ে থাকতো। ক্রীড়া বিষয়ক লেখালেখি যে এভাবে করা যায়, তাঁর লেখা না পড়লে কখনো বুঝতে পারতাম না। তবে চাইলেও তাঁকে অনুকরণ এমনকি অনুসরণ করা যায় না। সহজাত যে প্রতিভা নিয়ে তিনি লেখালেখি করেন, সেটা একান্তই তাঁর নিজস্ব ঘরানা। এই ঘরানা বয়ে নিয়ে যেতে দ্বিতীয় কাউকে আমি দেখি না।

ব্যক্তি তাঁকে নিয়ে আমার অনেক তিক্ততা আছে, আছে মিষ্টতাও, কিন্তু  লেখক হিসেবে তাঁর প্রতি মুগ্ধতা কখনো ম্লান হয়নি। এ কারণে সম্পর্কের সাম্পান বেয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। দীর্ঘ সময়ে যোগাযোগটা কখনো পুরোপুরি ছিন্ন হয়নি। অল্প যে কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর এখনও নিয়মিত যোগাযোগ বা আড্ডা হয়, আমি তাঁদের একজন। তাঁর সমস্যা ও সংকট আমাকে দারুণভাবে উদ্বিগ্ন করে। 'ক্রীড়াজগত' পত্রিকাও তাঁর ভালোবাসার অন্যতম নিকেতন। এখানে ঢুঁ না মারলে তিনিও স্বস্তি পান না। তাঁর সমসাময়িকরা বলতে গেলে নিজেদের অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তিনি এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি এখনও অনুভব করেন তারুণ্যের ঝলকানি। 

কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাঁকে আগের মতো উজ্জ্বল লাগে না। শারীরিকভাবে তিনি বরাবরই ফিট। এটা নিয়ে তাঁর এক রকম গর্ব ছিল। কিছু দিন আগে শারীরিকভাবে বড় ধরনের একটা বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠতে সক্ষম হন। এরপর থেকে ফিটনেস নিয়ে আগের সেই গৌরবটা তাঁর নেই। কথা বলার সময় খানিকটা জড়িয়ে যায়। চলাফেরায় এসেছে মন্থরতা। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে কাগজ-কলমের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের সম্পর্কটা। এ কারণে লেখালেখিতে আর আগের মতো সক্রিয় নন। এটা আমাদের জন্য বটেই, কবিতা ও ক্রীড়া সাহিত্যের জন্য অনেক বড় একটা ক্ষতি। তবে ধীরে ধীরে হলেও ফিরে পাচ্ছেন তাঁর সুস্থতা ও তাঁর সক্ষমতা। লেখালেখিতে তিনি দ্রুতই আবার আগের মতো ফিরে আসবেন, এই প্রত্যাশা তাঁর তাবৎ অনুরাগীর। 

আমি যত দূর জানি, বাংলা ভাষায় ক্রীড়া বিষয়ক প্রথম ছড়ার গ্রন্থ তাঁর। বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে অনেকের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৯৩ সালে প্রকাশ করেছিলাম তাঁর 'ছন্দে ছন্দে খেলার আনন্দে' ছড়াগ্রন্থ। কোনো একজনের গ্রন্থ অতীতে তো বটেই, পরবর্তীকালে সমিতি থেকে আর প্রকাশিত হয়নি। তাঁর এই গ্রন্থটি প্রকাশ করতে পেরে আমি গর্ব অনুভব করি। তাঁর ক্রীড়া সংক্রান্ত মূল্যবান লেখাগুলো সব এলোমেলো পড়ে আছে। তা যদি গ্রন্থবদ্ধ করা যেত, তা নতুন প্রজন্মের কাছে সমাদৃত হতে পারতো, একই সঙ্গে সমৃদ্ধ হতো বাংলা ক্রীড়া সাহিত্যের ভাণ্ডার। নিশ্চয়ই কোনো একদিন এ কাজটি সম্পন্ন হবে। তিনি ফরমায়েশি লেখা লিখতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। লেখেন মনের আনন্দে। বড় পরিসরের লেখাও লেখেন না। যে কারণে তাঁর গদ্যের আয়তনের তেমন বিস্তার ঘটে না। এটা জানা সত্ত্বেও কবিতা, খেলাধুলা আর সংগীতের মেলবন্ধন ঘটিয়ে তাঁকে ধারাবাহিকভাবে লিখতে অনুরোধ করেছিলাম। কবিতা তাঁর সহজাত। খেলাধুলা তাঁর সঞ্জীবনী। আর সংগীত তাঁর চিত্তবৃত্তি। এই তিনের সমন্বয়ে তিনি লিখলে বাংলা সাহিত্যে নতুন কিছু সংযোজন হতে পারতো। কিন্তু বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গেছেন। অথচ 'দিশি গান বিলিতি খেলা' শিরোনামে সংগীত ও ক্রিকেটের যুগলবন্দী ঘটিয়েছেন পশ্চিম বঙ্গের লেখক কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সেটা দারুণভাবে সমাদৃত হয়েছে। কিশোর বয়সে সেই পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ঢাকা স্টেডিয়ামের সঙ্গে তাঁর আত্মিক বন্ধন, তিনি অনেক ঘটনার নিবিড় প্রত্যক্ষদর্শী, সেই নস্টালজিয়া তাঁর কাব্যিক কলমে হতে পারতো দারুণ সুস্বাদু, তিনি কেন যেন তা উপেক্ষা করেছেন। এমনকি তাঁর বৈচিত্র্যময় জীবন নিয়ে স্মৃতিকথা লেখার বিষয়ে এখনও তিনি একদমই আগ্রহী হননি।

নানান কার্যকারণের জন্য সমসাময়িক কালের কাউকে মূল্যায়ন করাটা সহজ নয়। বিশেষ করে তাঁর মতো খেপাটে মানুষ, যাঁর সঙ্গে কারো না কারো কারণে বা অকারণে খিটমিটি লেগেই যায়, তাঁকে বিচার-বিশ্লেষণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যক্তিগত সম্পর্ক দিয়ে যাচাই না করে তাঁর সৃষ্টিকর্মের যদি মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে তাঁর অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এক্ষেত্রে তিনি একক ও অদ্বিতীয়। কবি ও ক্রীড়ালেখক হিসেবে সানাউল হক খান সত্যিকার অর্থেই অতুলনীয়। তাঁর জন্মদিনে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

৩ জানুয়ারি ২০২০

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন