পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২১

করোনাভাইরাস পরবর্তী দুনিয়া কেমন হবে

 

মানুষ তো বোধকরি প্রকৃতিরই সন্তান। তার অস্থায়ী আবাসভূমি এই বসুন্ধরা। এই প্রকৃতি, এই বসুন্ধরাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় জীবন ও জগত। সেই শুরু থেকেই মানুষ নিজের প্রয়োজনে প্রকৃতির কাছ থেকে অকৃপণভাবে গ্রহণ করে আসছে। একইসঙ্গে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ধ্বংসও করছে। মানুষের সংখ্যা যেমন বেড়ে চলেছে, তেমনিভাবে আনুপাতিক হারে বাড়ছে চাহিদা ও ধ্বংসলীলা। এ চাহিদা যেন অন্তহীন। ধ্বংসলীলাও অপরিসীম। যদিও মানুষকে কোথায় থামতে হবে, তার হয়তো সুনির্দিষ্ট কোনো সীমারেখা টানানো নেই। তবে সেই বিবেচনাবোধ থাকার কথা মানুষের অন্তরে। অনেক কাল পেরিয়ে আসার পর একটা পর্যায়ে মানুষ নিজেকে সভ্য হিসেবে দাবি করতে থাকে। সমাজ ও ধর্মের অনুশাসন তার সীমারেখার একটা মাপকাঠিও মোটামুটিভাবে শনাক্ত করে দেয়। সর্বোপরি জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, চিন্তাশক্তি দিয়ে সব কিছু অনুধাবন করতে পারার কথা। কিন্তু সেটা কি মানুষ পারছে? বরং মানবসভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নির্মমতার ইতিহাস।

আর এখন তো চারপাশে ভোগবাদিতার চরম উল্লাস। তার নিরন্তর হাতছানির পেছনে অবিরাম ছুটছে মানুষ। তাতে কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকছে না। জীবনে সাফল্যের মাপকাঠি হয়ে উঠেছে ভোগবিলাস। একইসঙ্গে নিজের শক্তিমক্তা প্রমাণ করার জন্য কত না ধ্বংসাত্মক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। আর এর খেসারত দিতে হচ্ছে সৃষ্টির উৎসভূমি প্রকৃতি ও নিরীহ বসুন্ধরাকে। ইশপের বহু কথিত সেই গল্পের মতো। একটা রাজহাঁস সোনার ডিম পাড়তো। অনেকগুলো ডিম একসঙ্গে পাবার আশায় রাজহাঁসটাকে জবাই করে লোভী মালিক। এরপর আর ডিম পাওয়া যায়নি। লোভী রাজহাঁসের মালিকের মতো সোনার ডিম পাড়া প্রকৃতিকে আমরা ক্রমাগতভাবে রিক্ত ও নিঃস্ব করে দিতে চাইছি। এভাবে যে চলতে পারে না, এই বোধটুকু আমরা বোধকরি হারিয়ে ফেলেছি। এর অন্যতম কারণ, আমরা অনেক স্বার্থপর ও লোভী হয়ে ওঠেছি। সবাই বর্তমান ও নিজেকে নিয়ে এত বেশি বিভোর যে ভবিষ্যত সম্পর্কে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই বললেই চলে। এ কারণেই সম্ভবত আমাদের একটা ধাক্কা খাওয়া ও বোধোদয় হওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল। এখন তো সব কিছুই স্তব্ধ হয়ে গেছে। ঘরবন্দি হয়ে মানুষকে ভাবতে হচ্ছে তার পরিণতির কথা। জীবন বাঁচানোটাই হয়ে উঠেছে একমাত্র ধ্যান-জ্ঞ্যান-সাধনা। তবে বিপদ কেটে গেলে হয়তো কোনো কিছুই আমাদের মনে থাকবে না।

প্রকৃতি তো রহস্যের অপরিমেয় এক আধার। তার কতটুকুই আমরা জানি? হঠাৎ হঠাৎ প্রকৃতি তার ভাণ্ডার থেকে এমন সব অস্ত্র বের করে, তাতে বেসামাল হয়ে যায় মানবসভ্যতা। মাঝে-মধ্যে প্রধানত ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বকে অনেকাংশে সত্য প্রমাণ করে দিয়ে যায়। এছাড়াও বোধোদয়ের জন্য নানানভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। কিন্তু সেটা আমরা কখনও বুঝতে চাইনি। তারই ধারাবাহিকতায় এবার সমগ্র ধরণী কাঁপিয়ে অনেক বেশি বুঝিয়ে দিচ্ছে তার অপরিসীম ক্ষমতার খানিকটা দাপট। দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় নিয়ে করোনাভাইরাস যেভাবে কাঁদিয়ে ছাড়ছে মানবকুলকে, এর আগে এমন নজির নেই বললেই চলে। কোনো মানুষই নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন না। এর চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে?


করোনাভাইরাস থেকে কবে মুক্তি পাবো, আমরা এখনও জানি না। আজতক তার দুর্জ্ঞেয় ও রহস্যময় মনোভাব বুঝতে পারা যায়নি। তবে হাবভাবে মনে হচ্ছে, বিদ্যমান ব্যবস্থাপনায় মোটেও সন্তুষ্ট নয়। মানুষের অপ্রয়োজনীয় ভোগবাদিতার প্রতি তার যথেষ্টই ক্ষোভ আছে। সেটা থাকা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। ‘সমাজতান্ত্রিক’ আদর্শের প্রতি তার এক ধরনের সমর্থন স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। যে কারণে কে প্রধানমন্ত্রী, কে কোটিপতি, কে প্রলেতারিয়েত সেটা বিবেচনা করছে না। বলা হচ্ছে, the virus does not discriminate - rich and poor alike, we are all in this together.  যদিও আপাতদৃষ্টিতে আমার মনে হচ্ছে, এখন পর্যন্ত চর্বিহীন গরীবদের প্রতি তার এক ধরনের পক্ষপাত দেখা যাচ্ছে। কত দিন এমনটা থাকবে, কে জানে? 

বিপরীতে মেদবহুল এ রোগটা বেশ ব্যয়বহুলও। অর্থবান না হলে তাকে সামাল দেওয়া খুবই কঠিন। এই অতিমারী মানুষকে বোঝাতে চাইছে, জীবন যাপনের জন্য খুব বেশি কিছুর তো প্রয়োজন নেই। যার যতটুকু প্রয়োজন, তাকে ততটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। প্রকৃতিকে ভাবতে হবে মায়ের মতো আপন। তাকে একদমই অবহেলা করা যাবে না। যুগে যুগে মহাপুরুষরাও আমাদের এ কথা বোঝাতে চেয়েছেন। আমরা তার গুরুত্ব দেইনি। তার প্রতিফল এখন আমরা পাচ্ছি। তাছাড়া এত এত মানুষের চাপে এই ভূপৃষ্ঠ বোধকরি খানিকটা অবসন্ন, ন্যুব্জ ও ভারাক্রান্ত। সে ক্ষেত্রে এই চাপ কমানোর কথাও মানুষকেই ভাবতে হবে। 

বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে স্বেচ্ছাবন্দি হওয়ার পর্যাপ্ত জায়গা কোথায়? এ ইঙ্গিত কি যথেষ্ট নয়? হয়তো আগামীতে দেখতে পাওয়া যাবে ভিন্ন এক দুনিয়াকে। কেন যেন মনে হয়, একটা সুন্দর ও সুখী পৃথিবীর নিদান দিতেই সম্ভবত করোনাভাইরাসের এভাবে আসা। আর তেমন কিছু পেতে হলে কাউকে না কাউকে ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। 

কথা হলো, স্বপ্নের সেই পৃথিবী কি আদৌ গড়ে ওঠবে? উঠলেও সেখানে আমরা কে কে থাকবো?

৫ এপ্রিল ২০২০

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন