বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয় একটি বিষয়। জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন এর চর্চায়। এ বিষয়ে তাঁর নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও ভালোবাসা তুলনারহিত। নিবিষ্ট সাধকের মতো কত অজানা মণি-মাণিক্য তুলে এনেছেন। সমৃদ্ধ করেছেন শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে। বাংলা নববর্ষ নিয়ে তাঁর আলাদা একটা মুগ্ধতা ছিল। এন্তার লিখেছেন বাংলা নববর্ষ ও বাংলা নববর্ষ সংক্রান্ত নানান বিষয়ে। দৈনিক, সাপ্তাহিকসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় তাঁর লেখা ঋদ্ধ প্রবন্ধগুলো মিটিয়েছে মনের খোরাক। কাকতালীয়ভাবে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনেই চলে গেলেন শামসুজ্জামান খান।
মেধা, মনন ও সৃজনশীলতা দিয়ে সেই ষাট দশকে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তখন থেকেই তিনি বাংলা ও বাঙালিয়ানার দিকে প্রচণ্ডভাবে ঝুঁকে পড়েন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি তার তীব্র অনুরাগ মোটেও লুকোছাপা ছিল না। প্রতিকূল সেই সময়ে এমন মনোভাব ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি তাঁর পরোয়া করেননি। নিজের বিশ্বাসে তিনি বরাবরই ছিলেন অটল ও আত্মবিশ্বাসী। শিক্ষাব্রতী পরিবারের কাছ থেকে জীবনের যে পাঠ তিনি পেয়েছেন, তাতে গড়ে উঠেছেন উদারনৈতিক, অসাম্প্রদায়িক ও সংস্কারমুক্ত মনের মানুষ হিসেবে। জীবনভর লালন করেন এই দৃষ্টিভঙ্গি। সেই আলোকে পথ চলেছেন। শিক্ষকতা দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করলেও বাংলা একাডেমি হয়ে উঠে তাঁর পাদপীঠ। এই প্রতিষ্ঠানটি বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক হয়ে উঠার ক্ষেত্রে তিনিও যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। জীবনের অন্তিম সময় পর্যন্ত তিনি বাংলা একাডেমির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁর জগৎ ছিল বইময়। জ্ঞানের বিকাশেই নিজেকে নিবেদন করেন।
তিনি ছিলেন নিভৃতচারী। দূর থেকেই তাঁর খোঁজ-খবর রাখতাম। মূলত তাঁর মননশীল ও চিন্তা উদ্রেককারী লেখা মন দিয়ে পাঠ করতাম। ১৯৯১ সালের শুরুর দিকে 'সাপ্তাহিক মূলধারা’ পত্রিকার হয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে ভেতরের মানুষটিকে অনুধাবন করতে পারি। জানতে পারি খোলামেলা অনেক কথা। তিনি বিশ্বাস করতেন যুক্তি-তর্কে, অনুসন্ধিৎসায়, বিজ্ঞানে ও গণতান্ত্রিক চেতনায়। মন-মানসিকতায় তিনি ছিলেন অসম্ভব আধুনিক। তাঁর আগ্রহ ছিল সমাজ, রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলাসহ যাবতীয় বিষয়ে। সে সময় তাঁর নিজের কথায়, ‘জ্যাক অব অল ট্রেডস বাট মাস্টার অব নান’।
তারপর তো তিন দশক সময় পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে কত দিকেই না তাঁর ব্যাপ্তি ঘটিয়েছেন। তাঁর মেধাবী কলমে, তাঁর পরিশীলিত কণ্ঠের পাশাপাশি তাঁর নিবিড় পরিচর্যায় ভাষা ও সাহিত্যের প্রসার ঘটেছে। ধীরে ধীরে জাতীয় পর্যায়ে তাঁর সক্রিয়তা টের পাওয়া যায়। অসংখ্য গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি সম্পাদনা ও তত্ত্বাবধান করেছেন কত শত বিষয়ে। তাঁর সুখ্যাতি ছাড়িয়েছে দেশের সীমানা।
খেলাধুলার প্রতি তাঁর ছিল তীব্র অনুরাগ। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলকে নিয়ে তাঁর লেখা ‘দুনিয়া মাতানো বিশ্বকাপ’ গ্রন্থটি তাঁর ক্রীড়ানুরাগের অসাধারণ কীর্তি। খেলাটা যে হৃদয়ের কতটা গভীরে লালন করেন, তা তাঁর গীতিময় ও গতিময় শব্দের বুননে বাঙ্ময় হয়ে ওঠেছিল। ফুটবলের আদ্যোপান্ত ঝরঝরে ভাষায় এমন সাবলীলভাবে তুলে ধরেন, যা পাঠককে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনায়াসে টেনে নিয়ে যায়। অনুরোধে-উপরোধে খেলা নিয়ে হঠাৎ হঠাৎ লিখে মুগ্ধ করলেও খুব বেশি মনোনিবেশ করার সুযোগ পাননি। আলাপ-আলোচনায় খেলার প্রতি তাঁর গভীর অনুভব উপলব্ধি করা যায়।
![]() |
জাতীয় জাদুঘরের চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান খানের হাতে নিজের লেখা গ্রন্থ তুলে দিচ্ছেন দুলাল মাহমুদ |
১৪ এপ্রিল ২০২১
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন