পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

শুক্রবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২১

পদ্মা নদীতে তোলা সেলফি

 

দোস্ত, মেয়েটা কে রে?

মেয়েটা কে রে মানে!

এমন ভাব করছিস যেন কিছুই জানিস না।

কি যে বাজে বকিস না।

এখন আর সাধু সেজে কী হবে বন্ধু? সারা দুনিয়া তো জাইনা গেছে। আর তোর মনোভাব দেখে মনে হচ্ছে, যেন এইমাত্র জানলি। তোর এই ভাজা মাছ উল্টে খেতে না পারার স্বভাবটা গেল না।

এমনিতেই আজ ঘুমাতে দেরি হয়ে গেছে। দেরি হলে সহজে ঘুম আসতে চায় না। আর এই অসময়ে হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধুর ফোন। তার ভাবভঙ্গিতে মনে হচ্ছে, অনর্থক গ্যাঁজানোই ওর উদ্দেশ্য। থাকে লন্ডনে। ওর ওখানে এখন সন্ধ্যা। অনেক দিন পর ফোন করেছে। ভদ্রতার খাতিরে তাকে এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।

তাই বিরক্তি চেপে রেখে বললাম, দোস্ত, কী মনে করে এত দিন পর ফোন করলি?

করলাম এই কারণে যে মেয়েটাকে তুই কিস করেছিস, সে কে? মেয়েটার সঙ্গে সম্পর্কটা কি এখনও আছে?

খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়ে বললাম, বয়স হয়েছে। তবুও তোর উল্টাপাল্টা স্বভাব আজও বদলালো না।

খানিকটা রেগে গিয়ে বন্ধু পাল্টা জবাবে বললো, আমি না হয় উল্টোসিধা কথা বলি। আর তুই তো এই বয়সে স্ফূর্তি মেরে যাচ্ছিস। মজা তো ভালোই নিচ্ছিস। আর দোষ হলো আমার স্বভাবের!

মেজাজটা বেশ খারাপ হয়ে যায়। অথচ জোরেও কথা বলতে পারছি না। পাশের বিছানায় স্ত্রী ঘুমিয়ে আছে। আমি সোফায় বসে কথা বলছিলাম। তাছাড়া যে বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে, তা তার কানে গেলে ঘুমের বারোটা বেজে যাবে। তাই নিজেকে সংযত করে বললাম, এই মধ্যরাতে কি আবোল-তাবোল বকছিস? তুই শালা বারে বসে নিশ্চয়ই মাল টানছিস। আর কাউকে না পেয়ে এখন আমাকে নিয়ে মজা মারছিস।

দোস্ত, মজা মারার সুযোগ তো তুমিই কইরা দিছ। খামোখা আমারে দোষারোপ করতাছো ক্যান?

অনুচ্চ কণ্ঠে বললাম, ভেবেছিলাম, এত রাতে যখন ফোন করেছিস, নিশ্চয়ই জরুরি আলাপ আছে। তুই যে এখন গাঁজাখুরি গল্প নিয়ে ফালতু বকবকানি করবি, সেটা তো বুঝতে পারিনি। দোস্ত, আমি এখন ঘুমাতে যাবো। আরেক দিন সময় নিয়ে কথা বলবো। এখন তাহলে রাখি। কিছু মনে করিস না।

ঘুমাতে যাওয়ার আগে একবার বইলা যা, মাইয়াটা কে?

কি যে বলিস না, এই রাতদুপুরে মাইয়া এলো কোথা থেকে?

জাস্ট আ মোমেন্ট স্যার। এই বলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপে একটা ছবি পাঠায়। ছবিটি দেখার পর আমার সারা শরীরে যেন রীতিমতো ভূমিকম্প হয়ে যায়। দিশেহারা লাগতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে উদ্বিগ্ন হয়ে নিম্ন স্বরে তোয়াজের ভঙ্গিতে বন্ধুকে বললাম, দোস্ত, এই ছবি তুই পাইলি কই?

বন্ধু বললো, এখন তো ঠিকই লাইনে আইছো। এই ছবি তো পাইতে হয় না। সবার কাছেই পৌঁছে যাচ্ছে।

কী যে বলিস না। যার কোনও মাথামুণ্ডু নেই। এই ছবি সবার কাছে পৌঁছবে কীভাবে?

এখন তো সবার কাছে পৌঁছনোর সহজ উপায় একটাই।এই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হইছে। আমি ভেবেছি, তুই জানোস কিংবা তুই হয়তো দিছোস। আমার দোস্ত ভাইরাল হইছে, সেই খুশিতে তো তোরে ফোন দিলাম।

তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে বন্ধু, এই ছবি আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিতে যাবো কোন দুঃখে। এই ছবি তো আমি নিজেই এই প্রথম দেখলাম। তুই না দিলে তো জানতে পারতাম না।

কস কি? তারমানে এই ছবি কি অরজিনাল না? তবে কি সফটওয়্যার দিয়ে জোড়া লাগানো হয়েছে? এখন তো এসব অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু ছবিটা দেখলে মনে হয় রিয়েল। বেশ কিছু দিন আগের ছবি মনে হচ্ছে। সবাই হয়তো নাও চিনতে পারে। কাছের মানুষদের চিনতে খুব একটা সমস্যা হবে না। দোস্ত, কিছু একটা গড়বড় তো আছে। নইলে এই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইলো ক্যামনে? তোকে নিয়ে কে এমন করলো? তুই কি কিছু আঁচ করতে পারছোস?

বন্ধুর প্রশ্নে নিরুত্তর থাকা ছাড়া সে মুহূর্তে কিছু করার ছিল না।

চলমান লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে সায়ন্তনীকে গভীরভাবে কিস করছি। পিছনে বিস্তৃত নদী আর গ্রামীণ দৃশ্যপট। কোন এক রোমান্টিক সিনেমার মেজাজটাকে অনুকরণ করার চেষ্টা যে আছে, তা বোঝা যায়। যদিও সেলফিতে তেমনটা ফুটে উঠেনি, তারপরও ছবিটা খুব সুন্দর হয়েছে। দুজনের চোখ আবেশে বোজা থাকলেও কাউকে চিনতে তেমন একটা সমস্যা হচ্ছে না। ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, যেন সেই সময়টা বাস্তবে ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে সেই আবেশ। সেই আবেগ। সেই অনুভূতি।

সায়ন্তনীর সঙ্গে সম্পর্কটা গভীর হওয়ার পর আমরা হালবিহীন নৌকার মতো ভেসেছি। আমাদের নির্দিষ্ট কোনও গন্তব্য ছিল না। কখনও উত্তর। কখনও দক্ষিণ। কখনও পূর্ব। কখনও পশ্চিম। সময়টাও ঘড়ির কাঁটায় বাধা ছিল না। কখনও সকাল। কখনও দুপুর। কখনও রাত। ইচ্ছের ঘোড়ায় চড়ে আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে যাই। স্থলেই বেশি। মাঝে মধ্যে জলে। অন্তরীক্ষে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও কার্যকর করার সুযোগ হয়নি।

তারমানে এই নয় যে, আমাদের কোনও পারিবারিক, সামাজিক, সাংসারিক বন্ধন ছিল না। আমাদের দুজনেরই সংসার আছে। সন্তান আছে। পরিবার আছে। চাকরি আছে। দায়িত্ব আছে। দায়িত্ববোধ আছে। সব কিছুই ম্যানেজ করতে হয়েছে। সায়ন্তনীকে তার সংসারের সব কাজ-কর্ম একহাতে সামাল দিতে হয়েছে। আমাকেও নিয়মিত অফিসে যেতে হয়েছে। তারপরও কীভাবে দুজনের পক্ষে যখন-তখন উড়াল দেওয়া সম্ভব হয়েছে?

আসলে ভালোবাসার সম্পর্ক এমন এক ম্যাজিক, তা যদি দুজনের বুকের মধ্যে থাকে, তাহলে কোনও কিছুই অসম্ভব হয় না। সব কিছু যেন জাদুর মতো হয়ে যায়। কোনও কিছুই দমিয়ে রাখতে পারে না। আমাদের মধ্যে ম্যাজিকটা পুরো মাত্রায় ছিল। আর খামখেয়ালিপনার দিক দিয়ে সায়ন্তনী তো মাষ্টারপিস। এই জিনিষ দ্বিতীয়টি দেখা যায় না। এমনিতেই নাচুনি বুড়ি, তার ওপর ঢোলের বাড়ি পড়লে তো কথাই নেই। ঢোলের বাড়ি দিতে তো আমারও জুড়ি নেই। কথায় আছে না, রতনে রতন চিনে। আমাদের দুজনেরই সেই অবস্থা।

এরফলে অবশ্য মনে হতেই পারে, পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি/আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী৷ চলতি হাওয়ার পন্থী হলেও পথ কিন্তু কখনোই সুগম ছিল না। নানান রকম প্রতিবন্ধকতা আমাদের আটকে দিতে চেয়েছে। দমিয়ে দিতে চেয়েছে। সেটা যেভাবেই হোক ম্যানেজ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু খামখেয়ালি কোনও মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হলে তারচেয়ে সুখী আর কেউ নেই। আবার তারচেয়েও দুঃখীও কেউ নেই। আনন্দের পাশাপাশি জীবন তেজপাতা হতেও বেশি সময় সময় লাগে না। সায়ন্তনীর মধ্যে আছে বিপরীতমুখী দুই গুণের সমাহার। এই রোদ, এই বৃষ্টি। কখন যে কী মুড ধারণ করবে, তা বিধাতার পক্ষেও বোঝা মুশকিল।

আর আমি তো বিধাতার সৃষ্টি সামান্য একজন মানুষ। তারপরও যে সায়ন্তনীর মন-মেজাজের সঙ্গে দিনের পর দিন তাল মিলিয়ে চলেছি, সেটাকে মোটেও হালকা করে দেখার অবকাশ নেই। বুঝতে হবে আমার ধৈর্য, নিষ্ঠা, আন্তরিকতার কোনও খামতি ছিল না। না হলে তার মতো উড়নচণ্ডী একটা মেয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব হতো না।

সায়ন্তনীর মেজাজ-মর্জি ভালো থাকলে আমরা প্রায় দিনই এলোমেলোভাবে কোথাও না কোথাও ছুট লাগাতাম। সেদিন আমরা সিএনজি রিজার্ভ করে পদ্মা নদী দেখার সিদ্ধান্ত নেই। আমাদের ভালোবাসা ছিল পদ্মা নদীর মতো বিস্তৃত। আর নদীর কাছে গেলে তো মনটা বড় হয়ে যায়। তখন পর্যন্ত পদ্মা সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা হলেও কোনও কর্মযজ্ঞ শুরু হয়নি। সেখানে দেখার মতোও খুব একটা আকর্ষক কিছু ছিল না। তবে নদী মানেই তো ছন্দিত প্রাকৃতিক জলধারা। তার নৈসর্গিক আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোনও তুলনা চলে না। আর পদ্মা নদী তার উদ্দামতা, তার উচ্ছ্বলতা, তার উচ্ছৃঙ্খলতা নিয়ে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল। নদীর সান্নিধ্যে যাওয়াটাও কম আকর্ষণীয় ছিল না। পদ্মা নদীর তাজা ইলিশ দিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়া ছিল আমাদের অন্যতম একটি লক্ষ্য।


মাওয়া ঘাটে পৌঁছে দেখতে পাওয়া যায় কল্ললিত জনপদকে। বেশ জমজমাট। এই ঘাট দিয়ে অনেক লোক যাতায়াত করছে। ফেরি ছাড়াও লঞ্চ, স্পিডবোট, নৌকায় চলাচল করা যায়। নানান পেশার মানুষের আনাগোনা। আমরাও তাদের সঙ্গে মিশে যাই। মাথার মধ্যে ঘূর্ণিপোকা। পরিণাম নিয়ে কোনও ভাবাভাবি নেই। অকারণেই স্পিডবোটে মাদারীপুরে রওয়ানা হই। সাঁতার না জেনেও আমরা উত্তাল নদী পাড়ি দেই। নদীর স্পর্ধিত ঢেউ এসে আমাদের ভিজিয়ে দিতে থাকে। তাতে পাওয়া যায় ভালো লাগার অনুভূতি। কিন্তু স্পিডবোট উথালপাথাল করতে থাকলে বুকের ভিতর ভীতির সঞ্চার হয়। আমি ভয়ে সায়ন্তনীর হাত দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরি। তার কোনও হেলদোল নেই। ঢেউয়ের মতো উপচে পড়ে মুখভর্তি দুষ্টু দুষ্টু হাসি। পুরো বিষয়টি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে থাকে। যেন এমনভাবে নিয়মিত চলাচল করতে সে অভ্যস্ত। বরং আমাকে সে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে।

আমি ভয় পেয়ে ফেরার সময় মন্থর গতির লঞ্চে ফিরি। সে সময় আমরা খুব মজা করি। নানান ভঙ্গিমায় সায়ন্তনীর কত যে ছবি তুলেছি। সমানতালে সেলফিও। তখনই দুজনের কিস করাসহ অন্তরঙ্গ কিছু ছবি তোলা হয়। আমাদের ঘনিষ্ঠতা দেখে লঞ্চযাত্রী গ্রামের মহিলারা সায়ন্তনীর কাছে জানতে চায়, আমরা স্বামী-স্ত্রী কিনা। সে এমনভাবে মাথা দোলায়, তাতে তারা কে কী বুঝেছেন, তারাই জানেন। আমি কিছু বুঝতে পারিনি।


মাওয়া ঘাটে ছিল সারি সারি খাবারের দোকান। রান্না করা ইলিশ মাছের ঘ্রাণ আমাদের প্রলুব্ধ করতে থাকে। প্রতিটি দোকানেই নানান পদের ইলিশের আইটেম। সঙ্গে নানান রকম ভর্তা। দোকানদাররা তাদের রান্নার ফিরিস্তি দিয়ে ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে থাকে। আমরা দ্বিধা-দ্বন্দে পড়ে যাই। সায়ন্তনীর সিদ্ধান্তে আমরা একটা রেস্তোরাঁ বেছে নেই। সিএনজির ড্রাইভারকেও ডেকে আমাদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করাই। তার খাওয়ার বিল থেকে শুরু করে নানান বিষয়ে যথেষ্ট খাতির-যত্ন করা হয়। দূরের পথ। তাকে আস্থায় রাখার বিষয়টি মাথায় ঘুরপাক খায়। খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করি।

তারপর খোশ মেজাজে ঢাকায় ফিরি। সিএনজিতে টুকটাক আদর বিনিময় হয়। লুকিং গ্লাস দিয়ে লুকিয়ে-চুরিয়ে আমাদের প্রেম দেখে ড্রাইভার। তার চাহনির ভঙ্গি ভালো লাগেনি। যাহোক কোনও অঘটন ছাড়াই ঢাকায় ফিরে আসি। আগেই নির্ধারিত থাকায় সেই অনুযায়ী সিএনজি ড্রাইভারকে ভাড়া দেই। সে কোনও কারণ ছাড়াই ভাড়া নিয়ে খেচামেচি শুরু করে দেয়। সে যে এমনটা করবে, ভাবতেই পারিনি। তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করায় সে যেন পেয়ে বসে। নাকি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। মেজাজ খুব খারাপ হয়ে যায়।

ঠিক সেই সময় উপস্থিত হয় পরিচিত এক ব্যক্তি। যা সায়ন্তনী ও আমার জন্য খুবই অস্বস্তিকর। ওই লোকের সায়ন্তনীদের বাসায় যাতায়াত আছে। আমি তাকে চিনি দূর থেকে। বুঝতে পারি, আমাদের দুজনকে এভাবে দেখে ফেলায় পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। এমন একটা বিব্রতকর অবস্থায় বাড়তি ভাড়া দিয়ে রাগ করে তাড়াহুড়ো করে সিএনজি থেকে নেমে যাই। সায়ন্তনী বাসায় চলে যায়। আমি আমার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই।

তখন হঠাৎ খেয়াল হয়, আরে, আমার মোবাইল ফোন কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে কাছাকাছি ফোনের একটা দোকান থেকে আমার নম্বরে কল করি। ফোনের সুইচড অফ। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ফোনটি চিরদিনের জন্য হাতছাড়া হয়ে গেছে। ফোন হারিয়েছে, তারজন্য যতটা না মন খারাপ হয়, তারচেয়েও বেশি খারাপ লাগে ছবিগুলোর জন্য। ওই সময়, ওই স্মৃতি, ওই মুহূর্তগুলো তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। ছবিগুলো থাকলে আমাদের জীবনের উজ্জ্বলতম সন্ধিক্ষণটুকু উদ্ভাসিত হয়ে থাকতো।

তারপর তো সায়ন্তনীর সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ছাড়াছাড়ি শব্দটা যথার্থ প্রয়োগ হয়েছে বলা যাবে না। আমরা তো বিবাহিত ছিলাম না। বরং হাল আমলের ভাষায় বলা যায়, আমাদের ব্রেকআপ হয়ে যায়। এর কারণ, সেদিন যে লোকটা আমাদের একসঙ্গে দেখে, প্যাঁচটা সম্ভবত সে-ই লাগায়। সায়ন্তনীকে এমন ফাঁদে ফেলে, আমার সঙ্গে তার আর সম্পর্ক রাখা সম্ভব হয়নি। তখনই সেটা সায়ন্তনীর কথায় আঁচ করতে পেরেছিলাম। সায়ন্তনীর মঙ্গলের জন্য আমাকে সরে যেতে হয়। সে না হয় সম্পর্ক থাকলো না। তাই বলে সামান্য যোগাযোগ থাকবে না?

অনেক দিন সায়ন্তনীর খোঁজ-খবর আমি জানি না। তবে তাকে তো আমি কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। আমার খবর রাখবে, সে তেমন রক্ত-মাংসের মেয়ে নয়। অদ্ভুত স্বভাবের এক মেয়ে। একজন মানুষ তার জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল, সেটা বোধকরি কখনোই তার মনেই পড়ে না। পড়ার কথাও না। যা তার জীবন থেকে অতীত হয়ে যায়, তার দিকে ফিরে তাকানোকে সে ডিসক্রেডিট মনে করে। সেটা তো এত দিনে বুঝে নিতে পেরেছি। এমন মেয়ের সঙ্গে যেচে যোগাযোগ করতে চাইলে অপমানিত হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

তাহলে সায়ন্তনীর সঙ্গে আমার কিস করার ছবি ভাইরাল হওয়ায় এখন কী হবে? সেই কবেকার কথা। মাওয়া ঘাট আর আগের মতো নেই। সেখানে এখন নির্মাণের শেষ পর্যায়ে রয়েছে পদ্মা সেতু। এই সেতুকে কেন্দ্র করে বদলে গেছে সেখানকার জীবনধারা। বদলে গেছে আমাদের সম্পর্কও। ছবিতে আমাদের ভালোবাসা অম্লান হয়ে থাকলেও আমরা পরস্পরের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেছি। কেউ কারও খবর রাখি না।

তাহলে এত দিন পর পর ছবিটা কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়েছে? যে দিয়েছে, তার কী স্বার্থ? আমার যতটা মনে পড়ে, মোবাইল ফোনটা আমি সিএনজিতে ফেলে আসি। সেটা ড্রাইভারের হস্তগত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ফোন হারানোর অল্প সময়ের মধ্যে রিং করি। তখনই ফোন বন্ধ পেয়েছি। লং জার্নি করে এসে এত দ্রুত কি সে অন্য যাত্রী তুলেছে? ড্রাইভারের হাবেভাবে তেমনটা মনে হয়নি। সেক্ষেত্রে ড্রাইভার ছাড়া আর কারও কাছে ফোন যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ড্রাইভারই কি ছবিটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে? যদিও তার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছে। তার ভাবগতিকও খুব সুবিধার মনে হয়নি।

কিন্তু দিলেও এত দিন পর কেন দেবে? নাকি মোবাইল ফোন সে কারও কাছে বিক্রি করে দিয়েছে? কেউ যদি কিনে থাকে, সেইবা কেন এত দিন পর ছবি দেবে? দিলে হয়তো নিছক মজা করার জন্য দিতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের ছবির তো খুবই ডিমান্ড। লাইক বা ভাইরাল হওয়ার আশায় দিতেই পারে। সঙ্গত কারণেই এই হট ছবি ভাইরাল হতে সময় নেয়নি। সবই বুঝলাম, কিন্তু এত বছর পর কেন? এই হিসাব কিছুতেই মিলছে না।

ছবিটি দেখার পর আমার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কী করবো বুঝতে পারছি না। রাত গভীরতর হতে চলেছে। ঘুমাচ্ছি না কেন স্ত্রী একবার জানতেও চেয়েছে। তারপর পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি ফেসবুক তন্ন তন্ন করে আমাদের ছবিটা পাগলের মতো খুঁজতে থাকি। কেন জানি না আমার ফ্রেন্ডলিস্টে থাকা সবার প্রোফাইলে একে একে ঢুঁ মারতে থাকি। সেও তো দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। একটা পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে মোবাইল ফোন আর লাইট বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ি। কিছুতেই ঘুম আসে না। এপাশ ওপাশ করতে থাকি। মাথার মধ্যে অনুভব করতে থাকি ভিমরুলের কামড়। ঘুমহীন কেটে যায় রাত।

সকালে বিছানা থেকে উঠে মোবাইল ওপেন করতেই বুকের মধ্যে প্যালপিটেশন হতে থাকে। ভাইরাল হওয়া ছবিটি পরিচিত কয়েকজন ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপ আর মেসেঞ্জারে পাঠিয়েছে। সঙ্গে মন্তব্যসহ নানান রকম ইমোজি। বুঝতে পারলাম, পদ্মা নদীর পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। শারীরিকভাবে অসুস্থতা অনুভব করতে থাকি। রাত জাগার ধকল নিয়ে তাড়াহুড়ো করে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাই। পথিমধ্যে একটা ওষুধের দোকানে গিয়ে প্রেসার চেক করাই। সেখানেও সুসংবাদ নেই। যে আমার সারা জীবন লো প্রেসার, প্রায়শই মাথা ঝিমঝিম করা নিয়ে ভুগতে হয়েছে, তার কিনা হাই প্রেসার! এক রাতের মধ্যে এতটা উত্থানপতন? তার মানে এই চাপ নিতে পারছি না। আসলে পারবো কীভাবে?

সামান্য যে কোনও বিষয় একবার ভাবনার মধ্যে ঢুকলে তা থেকে নিস্তার নেই। আর এটা তো তোলপাড় হওয়ার মতো ঘটনা। এমন ঘটনা সামাল দেওয়া কি আমার কর্ম? মাথার মধ্যে সারাক্ষণই কুট কুট করতে থাকে দুশ্চিন্তার ঘুণপোকা। সবাই জেনে গেলে কী হবে? বাসায় কী বলবো? আত্মীয় স্বজনদের? বন্ধু-বান্ধবদের? অফিসে? কোনও সমাধানই পাচ্ছি না। কার সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করা যায়? করলে কি এর কোনও সমাধান আছে? আচ্ছা, আমি কি একাই হয়রানি হচ্ছি? সায়ন্তনী কি এটা জানতে পেরেছে? জানলে তার কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে?

নানান রকম ভাবনায় দোল খাচ্ছিলাম, কোনও কূল-কিনারা পাচ্ছিলাম না। ঠিক তখনই সায়ন্তনী ফোন করে। এ যেন অনেকটা টেলিপ্যাথির মতো। দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী দীর্ঘ বরষ মাস পর। কোনও রকম বাতচিত ছাড়াই সরাসরি জানতে চাইলো, ছবিটা কি দেখেছো?

ভাবখানা এমন, যেন আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। কণ্ঠে কোনও উচ্ছ্বাস নেই। উত্তাপ নেই। উদ্বেগ নেই। কোনও ভাবান্তর নেই। আর ছবিটা যে আমি দেখবো, এ বিষয়েও সে যেন এক প্রকার নিশ্চিত। আমি একবুক অস্থিরতা নিয়ে জবাব দিলাম, দেখেছি। তারপর স্বগতোক্তির মতো করে বিষণ্ণ কণ্ঠে বললাম, এত এত বছর পর কে আমাদের এমন বিপদে ফেলতে চাইছে?

সায়ন্তনী চট করে বললো, কারও স্বার্থ আছে বলেই এমনটা করেছে। তোমরা পুরুষরা তো স্বার্থ ছাড়া কিছু করো না।

একটু দমে গিয়ে বললাম, কার স্বার্থ থাকবে? স্বার্থ উদ্ধার করতে হলে তো আমাদের কারও না কারও সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে হবে। যে ছবিটা দিয়েছে, মনে হয় না সে আমাদের চেনে। আর আমাদের সম্পর্কে কিছু জানারও প্রশ্নই আছে না।

নির্লিপ্ত কণ্ঠে সায়ন্তনী বললো, তুমি কী করে এতটা নিশ্চিত হলে আমাদের চেনে বা জানে না?

আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, আমাদের চেনে! তা কীভাবে সম্ভব? তুমি কি সেই সিএনজিওয়ালার কথা বলছো?

না, তার এত সাহস হওয়ার কথা নয়। আমরা যেদিন মাওয়া ঘাট থেকে ঘুরে আসি, সেদিন যে লোক আমাদের দেখে ফেলে, এটা তার কীর্তি।

আমি বললাম, তার কারণেই তো আমাদের সম্পর্কটা টিকলো না। কিন্তু সে এই ছবি পেলো কোথায়?

আমরা চলে যাওয়ার পর সে সিএনজির ড্রাইভারকে তার বাসায় নিয়ে যায়। ড্রাইভারের কাছে আমরা কোথায় কী করেছি, তার বিস্তারিত খোঁজ-খবর নেয়। সে সময় ঘটনাচক্রে তার কাছে তোমার মোবাইল ফোন পেয়ে যায়। ড্রাইভারকে ভালো অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বিদায় করে। তোমার মোবাইল ফোন থেকে ছবিগুলো উদ্ধার করে তারপর থেকে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। নিজেকে তার কাছে সমর্পণ করা ছাড়া আমার উপায় ছিল না। এভাবে বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছিল। আমিও আর পারছিলাম না। কদিন আগে আমার সঙ্গে তার বড় ধরনের একটা ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে। তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তোমার-আমার ছবিটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। এ বিষয়টি আমি সামাল দিতে পারবো কিনা জানি না। তুমি যে সমস্যায় পড়বে, সেটা বুঝতে পেরে তোমাকে ফোন দিলাম। পুরো ঘটনাটি তোমাকে জানালাম। এখন তুমি কী করবে আমি জানি না। তবে এটা জেনে রাখ, লোকটি মোটেও সুবিধার নয়। তার হাত অনেক লম্বা। প্রয়োজন পড়লে চরম কিছু করতেও দ্বিধা করে না।

সায়ন্তনীকে নিয়ে আমার যে সংশয় ছিল, তা এখন পুরোপুরি কেটে গেছে। আমি ভেবেছিলাম, তার হৃদয়ে আমার কোনও স্থান নেই। দীর্ঘ দিনের মৌনতার পর ফোন করে এই ধারণাটি সে ভেঙে দিয়েছে। আমাকে যদি নাই ভালোবাসবে, তাহলে ফোন করার প্রশ্নই আসতো না। সে তো আমাকে ফোন না করলেও পারতো। বুঝতে পারছি, আমাকে এক রকম নির্ভরতা দেওয়ার জন্য ফোনটা করেছে।

ভাইরাল হওয়া ছবির পরিণতি নিয়ে এই মুহূর্তে আমি ভাবছি না। ভাবছি, আমাদের পুরানো সেই ভালোবাসা নিয়ে। দুজনের নিবিড় সম্পর্কটা এত দিন পর সর্বত্রই চাউর হয়েছে, সেটাতে তো আর আমাদের কিছু করার নেই। কিন্তু আমরা যে একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবাসতাম, সেটা তো আর মিথ্যে ছিল না। সায়ন্তনীর ফোন আমাকে যেন সেই দিনগুলোকে ফিরিয়ে দিয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন