![]() |
বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভায় বাঁ থেকে তৃতীয় ফরিদা ইয়াসমিন, পঞ্চম কবি সোহরাব হাসান, দুলাল মাহমুদ ও কবি সানাউল হক খান |
সংবাদপত্রের নিউজ টেবিল মানে কার্যত একটা ভাবগম্ভীর পরিবেশ। খুব বেশি কথাবার্তা বলা যাবে না। কাজ করতে হবে নিঃশব্দে। না হলে কাজে মনোযোগ থাকবে না। ভুল-ভ্রান্তি হয়ে যেতে পারে। যেন পরীক্ষার হল। আশির দশকের শুরুর দিকেও এমন একটা মনোভাব দেখেছি। লেখালেখি কিংবা আড্ডা দিতে যাবার সুবাদে বিভিন্ন সংবাদপত্রে যেতাম। তখন দেখতাম, রিপোর্টিং ডেস্কে প্রাণের উত্তাপের কমতি নেই। একটা হৈ-হুল্লোড় লেগেই থাকতো। কিন্তু নিউজ ডেস্কে সবাই মাথা গুঁজে কাজে ডুবে আছেন। যেন এ কাজ করা না হলে পৃথিবীর বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। কর্মরতরা কথা বলতেন চেপে চেপে। মেপে মেপে। এমন একটা ধারণা নিয়ে আমি ১৯৮৫ সালের মার্চে দৈনিক 'বাংলার বাণী' পত্রিকায় শিক্ষানবীশ সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেই। ভিতরে ভিতরে একটা টেনশন তো ছিলই। কিন্তু প্রথম দিনই আমার এই ধারণাটা একদম ভেঙেচুরে দেন সেই সময়ের পালাপ্রধান বা শিফট-ইন-চার্জ। তিনি কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান। তাঁর কাজের ধরন দেখে আমার আগেকার উপলব্ধি ভুল প্রমাণিত হয়। একটি দায়িত্বশীল পদে থেকেও তিনি প্রচলিত ধারায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, জীবনকে এত কঠিনভাবে নেওয়ার কিছু নেই। জীবনে হাসি থাকবে। আনন্দ থাকবে। প্রাণোচ্ছ্বলতা থাকবে। তার মধ্যেই কাজ করতে হবে। তবে কাজটাকেও তুচ্ছ মনে করা যাবে না। সেটাও করতে হবে যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়ে। এই জীবনদর্শন নিজে যেমন মেনে চলেছেন, অন্যকেও অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁর সংস্পর্শে এসে কতজন বদলে ফেলেছেন জীবনধারা।
তাঁর অট্রহাসিতে সরগরম থাকতো পুরো নিউজ রুম। শুধু নিউজ ডেস্ক কেন, একই কক্ষে কাছাকাছি অবস্থানে বসতো সম্পাদকীয়, রিপোর্টিং ও সংশোধনী বিভাগ। তাঁর হাসি ছড়িয়ে পড়তো চারপাশে। এমনকি পৌঁছে যেত সম্পাদকের কক্ষ অব্দি। রিপোর্ট লেখার সময় মন বসাতে ব্যর্থ হয়ে সিনিয়র রিপোর্টার দাউদ ভূঁইয়া কিংবা সুভাষ চন্দ বাদল চিৎকার করে ওঠতেন। সম্পাদকীয় লেখায় মনোনিবেশ করতে না পেরে নিজেদের রুম থেকে বের হয়ে আসতেন যুগ্ম-সম্পাদক আজিজ মিসির কিংবা সহকারী সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এমনকি কখনো কখনো সম্পাদক শেখ ফজলুল করিম সেলিমও। তিনি তাঁদের এমন উত্তর দিয়ে দিতেন, তাঁরা হাসতে হাসতে চলে যেতেন। আবার কখনো তাঁদের কথায় সাময়িক বিরতি দিলেও ফর্মে ফিরে আসতে সময় নিতেন না। এরপর আর কেউ কিছু বলতেন না। কিছু মনেও করতেন না। সবাই জানতেন তিনি এমনই। একটু বোধকরি পাগলাটে কিসিমের। কখনো অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন। কখনো প্রাণখোলা হাসিতে উদ্ভাসিত হচ্ছেন। দমবন্ধ করা পরিবেশ মোটেও পছন্দ করতেন না। তাঁর কারণেই নিউজ টেবিলটাই হয়ে ওঠতো আড্ডার কেন্দ্রস্থল। সারাক্ষণই তাঁর মধ্যে থাকতো একটা ছটফটানি। যেন সৃষ্টির উল্লাসে ফুটছেন। কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়,
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মাের চোখ হাসে মাের
টগবগিয়ে খুন হাসে।
এত কথা। এত হাসি। এত আড্ডা। কিন্তু কাজ করতেন কখন? এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন রীতিমতো ম্যাজিসিয়ান। যে কোনো কাজ তিনি এত দ্রুত করতে পারতেন, এমনটি আমি অন্তত দেখিনি। সম্পাদনার কাজ তো বটেই, অনুবাদ ও লেখালেখিও খুব তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতেন। সকালের শিফটে আন্তর্জাতিক এবং বিকেলের শিফটে মূলত প্রেস রিলিজের কাজ হতো। দেখা যেত, কাজের মাঝপথেই তিনি ডামি প্রস্তুত করে ফেলেছেন। রাতের শিফটে ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কাজ হতো প্রথম পৃষ্ঠার। তাতে কি? ত্বরিৎ গতিতে কাজ শেষ করার ক্ষেত্রে তাঁর কোনো জুড়ি ছিল না। শুধু তাই নয়, চটজলদি সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, দিতেও পারতেন। তিনি শিফট-ইন-চার্জ থাকলে নির্ভার থাকতেন বার্তা বা নির্বাহী সম্পাদক। একজন সাংবাদিক কতটা দক্ষ, সেটা বোঝা যায়, তিনি কত দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে তিনি অনন্য এক দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। আমার ধারণা, তিনি ইংলিশ কবি ও সাহিত্য সমালোচক ম্যাথিউ আর্নল্ড-এর উদ্ধৃতি 'জার্নালিজম ইজ লিটারেচার ইন এ হারি' মেনে চলতেন। কাজের ক্ষেত্রে তিনি যেমন সুদক্ষ, তেমনিভাবে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসায় অতুলনীয়। তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, 'মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় কোন আকাশ নেই'। সহযোগিতা ও সহানুভূতি প্রদানের ক্ষেত্রেও তিনি অকৃত্রিম। এটা বুঝতে অসুবিধা হতো না যে, তিনি ছিলেন অফিসে সবচেয়ে জনপ্রিয়। পিয়ন থেকে শুরু করে সম্পাদক পর্যন্ত সবাই তাঁকে সমীহ করতেন, পছন্দ করতেন এবং ভালোবাসতেন। যে কোনো সমস্যায়, সংকটে বুদ্ধি ও পরামর্শের জন্য তিনি ছিলেন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। এ কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বার বার তাঁকে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের 'বাংলার বাণী' পত্রিকার ইউনিট চিফ হতে হয়েছে। তিনি চাইলে সাংবাদিক ইউনিয়নের বড় নেতা হতে পারতেন। কিন্তু তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন পেশাকে। সত্যিকার অর্থে তিনি একজন পরিপূর্ণ পেশাদার সাংবাদিক।
তিনি যখন দৈনিক দেশ পত্রিকায় কর্মরত, তখন তাঁকে প্রথম দেখি। সেগুনবাগিচায় পরবর্তীকালে যে ভবনে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়, সেখানেই ছিল পত্রিকার কার্যালয়। তাঁর মাথায় ছিল কিউবার বিপ্লবের অন্যতম নায়ক চে গুয়েভারার মতো একটা ক্যাপ। মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলেন। তাঁর সঙ্গে তখন পরিচয় ছিল না। তবে কবি হিসেবে চিনতাম। তাঁর কবিতায় পাওয়া যায় এক ধরনের কোমল পেলবতা। মায়াবী ভালোবাসা। বিপ্লবী স্পন্দন। বোধকরি বুকের মধ্যে লালন করেন বিপ্লবী চে'র রোমান্টিকতা। কবিতায়ও তার প্রতিফলন দেখা যায়। যদিও সাংবাদিকতার কাজে এত বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় যে, কবিতা লেখার নিভৃত জগত পাবেন কখন? তাঁকে দুই হাতে সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, নিবন্ধ, প্রবন্ধ লিখতে হয়। বক্তব্য রাখতে হয় বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে। তারপরও হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পাওয়া যায় তাঁর মন কেমন করা কবিতা।
পুরোদস্তুর নিউজম্যান হিসেবে তিনি বিভিন্ন প্রচারবহুল সংবাদপত্রে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। 'জনপদ' দিয়ে শুরু করে 'দেশ', 'গণকণ্ঠ', 'বাংলার বাণী', 'আজাদ', 'ভোরের কাগজ', 'সংবাদ', 'যুগান্তর' হয়ে 'প্রথম আলো'। পালন করেছেন বার্তা সম্পাদকের মতো গুরু দায়িত্ব। সাহিত্য ও ফিচার পাতার সম্পাদক হিসেবেও তিনি তাঁর মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বর্তমানে যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে কর্মরত আছেন দৈনিক 'প্রথম আলো' পত্রিকায়। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ ও যুক্তিসঙ্গত বিশ্লেষণ কলামিস্ট হিসেবে তাঁকে আলাদাভাবে পরিচিতি দিয়েছে।
![]() |
দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার অনুষ্ঠানে কবি সোহরাব হাসানের সঙ্গে |
কবি সোহরাব হাসানের সংস্পর্শে যাওয়া, তাঁকে গুরু হিসেবে পাওয়া যে কোনো নবীন সাংবাদিকের জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার। তিনি সহজেই নতুনদের আপন করে নিতে পারেন। কাজের দীক্ষা দিতে পারেন, কাজটা আদায় করে নিতে পারেন। তাঁর সঙ্গে যাঁরা একবার কাজ করেছেন, তাঁকে ভুলতে পারার কথা নয়। তাঁর অগণন ভক্ত-অনুরাগী। তাঁর কাছে সাংবাদিক হিসেবে অনেকের যেমন হাতেখড়ি হয়েছে, তেমনিভাবে তিনি গড়ে তুলেছেন অসংখ্য লেখক। শুধু সাংবাদিকতার পেশায় নয়, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনেও তাঁর গুনগ্ৰাহীর কমতি নেই। অন্তরঙ্গতার ছোঁয়া দিয়ে সর্বত্রই তিনি নিজের অবস্থান গড়ে নিতে পারেন। মাতিয়ে রাখতে পারেন। তিনি কোনো আড্ডায় থাকবেন আর সেখানে হাসি শোনা যাবে না, এমনটি হতেই পারে না। যদি তেমনটি হয়, সেটা বোধকরি আড্ডা নয়, শোকসভা জাতীয় কিছু হবে।
রাজনীতির প্রতি তিনি আলাদা একটা টান অনুভব করেন। কাজে, আড্ডায়, আলোচনা সভায় সরব থাকলেও তাঁর কান সজাগ থাকে রাজপথের দিকে। সেখানে ছুটে যাওয়ার তাগিদ বোধ করেন। তাঁর বুকের মধ্যে ছটফট করে দীর্ঘশ্বাসের পাখি-
'তোমরা কেউ আমার কষ্ট বুঝলে না, হয়তো আমিও তোমাদের অনুভবের সাগর ছুঁতে পারেনি। অনুতাপহীন মানুষের দেশে আমি দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেঁচে আছি।'
একদিন সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্ন অনেকটাই ম্লান ও মলিন হয়ে গেছে। রাজপথের বন্ধুরা ঘরমুখী হয়ে যাওয়ায় রক্তক্ষরণ হয় তাঁর বুকের মধ্যে। স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা কিছুতেই সইতে পারেন না। ফুল ও পাথরের গল্প নিয়েই কাটে তাঁর জীবন।
বন্ধুরা ঘরে ফিরে গেছে
আপনাপন নারীর কাছে বড় সুখী তারা
যাদের চালচুলো নেই; বাউন্ডেলে চেহারা
ইদানিং তারাও সান্ধ্য-আসরে গরহাজির
আউল বাউল বেশ ছেড়ে হয়েছে একান্ত ঘরমুখী
একদা রাজপথ যার ঠিকানা ছিল
তারা আজ মিছিলের ভাষা ভুলে গেছে
আমরা সবাই সুখ খুঁজি ব্যক্তিগত প্রেম ও বিশ্বাসে।
একদিন স্বপ্নময় মনে হত
রঙিন প্ল্যাকার্ড হাতে রাজপথ জুড়ে মানুষের মােহন মিছিল
সহস্র কোরাস কণ্ঠে স্বপ্নের জাগরণ ধ্বনি ছিল
ছন্দ ছিল, সাম্য ছিল জীবনের প্রতি পংক্তিতে
কোলাহল বুকে নিয়ে কত রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি
অন্ধ আবেগে আকাশকে টেনে নিয়েছি হাতের মুঠোয় পাথরকে ফুল করে কত দিন সাজিয়েছি মালা
হৃদয়ের বাগান থেকে ফুল ঝরে গেছে
মানুষ নিরেট পাথর।
হৃদয়ের বাগান থেকে ফুল ঝরে গেলেও তিনি নিরেট পাথরে পরিণত হননি। তাঁর বুকের মধ্যে বয়ে চলে ভালোবাসার ফল্গুধারা। অসহায় মানুষদের দেখলে তাঁর হ্নদয় কাঁদে। কারও দুঃখ-কষ্ট তিনি সইতে পারেন না। সর্বহারাদের প্রতি রয়েছে তাঁর নিরন্তর সহানুভূতি। যাঁরা তাঁর কাছাকাছি হয়েছেন, তাঁরাই সেটা অনুভব করতে পারেন। তিনি যে অবস্থানে থাকুন না কেন, কাছের এবং দূরের সবার খোঁজ-খবর রাখার চেষ্টা করেন। সবাই যাতে ভালো থাকে, মনে-প্রাণে সেই কামনা করেন। স্বার্থপর এই সময়ে একজন সোহরাব হাসান ব্যতিক্রম হয়ে আছেন।
(১৯৫৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ঝালকাঠির শৌলজালিয়ায় সোহরাব হাসানের জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক। ১৯৮৪ সালে প্রথম প্রকাশিত অগ্নিবারুদেমেশা কাব্যগ্রন্থ 'বাতিল রাজদণ্ড'। প্রকাশিত গ্ৰন্থের মধ্যে রয়েছে কাব্যগ্রন্থ 'কালো বারুদ শাদা গোলাপ', 'সুন্দর তোমার সর্বনাশ', 'শূন্যতার কাছে প্রার্থনা', 'ভুল করে বেঁচে আছি', 'যে আগুনে পুড়ছে বাংলাদেশ', 'প্রেমের কবিতা', গদ্যগ্রন্থ 'মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি', 'রাষ্ট্র ও সংখ্যালঘু', 'মুজিব ভুট্টো মুক্তিযুদ্ধ', 'আদমজীর আয়নায় স্বদেশের মুখ', 'জঙ্গিবাদ ও যুদ্ধাপরাধ', 'শেখ মুজিব : স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা', 'পাকিস্তাননামা', 'রাজনীতি কার নীতি', 'নেই গণতন্ত্রের দেশে', '২০১৮ নির্বাচনের আগে পরে', 'স্মৃতিতে আগষ্ট', '১৯৭১ : বাংলাদেশের শত্রু মিত্র', 'রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র ১৯৫১' প্রভৃতি। সম্পাদিত গ্ৰন্থ 'তৃতীয় বিশ্বের কবিতা', 'বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশীদের ভূমিকা'। লেখক মোরশেদ শফিউল হাসানের সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গল্প সংকলন 'মানুষের মৃত্যু হলে', 'আহমদ ছফা স্মারকগ্ৰন্থ'।)
১০ সেপ্টেম্বর ২০২০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন