পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

শুক্রবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২১

অদ্ভুত সেই কণ্ঠসুধা


সংবাদপত্রের বার্তা বিভাগে কাজ করায় টেলিফোনকে একটা উপদ্রবের মতো মনে হয়। হবেই না কেন? পুরো নিউজ সেকশনে ফোন একটাই। রাজ্যের যত ফোন রিসিভ করতে হয় জুনিয়রদের। রীতিমতো টেলিফোন অপারেটরের কাজ করতে হয়। কত রকম যে ফোন কলের বাহার। রিসিভ করতে করতে ক্লান্তি লাগে। ঢাকার বাইরে থেকে রিপোর্টারদের পাঠানো রিপোর্ট লেখা তো আছেই, সেটা তো ডিউটির অন্তর্ভুক্ত। কোনো কোনো রিপোর্টার আছেন, তাদের থামতে ইচ্ছে করে না। যেন পুরো পত্রিকায় তার রিপোর্ট প্রকাশিত হবে। নিউজপ্রিন্টের কাগজে ইকোনো বলপেন দিয়ে লিখতে লিখতে হাতের আঙুল টনটন করে, সহজে রেহাই পাওয়া যায় না। 

এর বাইরে তিন তলা অফিসের যে যেখানে কর্মরত, তাদের খবর পাঠিয়ে ডেকে আনা, অফিসে উপস্থিত না থাকলে সংবাদ পৌঁছে দেওয়া, নানান জনের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবদিহি করাসহ আগড়ুম-বাগড়ুম লেগেই থাকে। এ কারণে অনেকেই পারতপক্ষে টেলিফোন থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেন। টেলিফোন বাজলে এ ওর মুখের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করেন। শিফট-ইনচার্জ হুঙ্কার ছাড়লে তখন বাধ্য হয়ে ধরতে হয়। সেক্ষত্রে বয়সের দিক দিয়ে কনিষ্ঠ হওয়ায় এড়ানোর সুযোগ থাকে না। 

একদিন বিকেলের শিফটে কাজ করছি। এই শিফটে কাজের চাপ অপেক্ষাকৃত কম। শিফট-ইনচার্জ ছাড়া সাধারণত একজনই থাকেন। সঙ্গত কারণেই ফোন আসার পর আমাকেই রিসিভ করতে হয়। বিরক্তি নিয়ে একটা ফোন রিসিভ করি। মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া হয়ে যায় বিরক্তি। অদ্ভুত সুন্দর কণ্ঠের এক মেয়ের ফোন। এমন মায়াবী কণ্ঠের কোনো মেয়ের সঙ্গে আমি জীবনেও কথা বলিনি। তার কণ্ঠের মাধুর্যে আমি একরকম হিপটোনাইজ হয়ে যাই। তার কোনো কথাই আমি শুনতে পাচ্ছিলাম না। তার কণ্ঠসুধায় আমি যেন কোন অতলে ডুবে যেতে থাকি। কিছুটা সময় যাওয়ার পর ধাতস্থ হই। ততক্ষণে অপর প্রান্তে নিঃশব্দের হাহাকার। আমার সাড়া না পেয়ে ফোন রেখে দিয়েছে। আমার বুকের ভিতর কেমন কষ্টকর অনুভূতি হতে থাকে। নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে। কণ্ঠের সম্মোহনে এতটাই নিমজ্জিত হয়ে যাই, কোনো প্রতিত্তোর দিতে ভুলে যাই। 

কিছুক্ষণ কথা বলার তো সুযোগ ছিল। তাহলে ভালো লাগা নিয়ে কণ্ঠের নানান রূপান্তর অনুভব করতে পারতাম। মন খারাপ করে কাজে মনোযোগ দিতে সচেষ্ট হই। কিন্তু কণ্ঠটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। কানের মধ্যে ছড়িয়ে আছে সুরেলা আমেজ। মানুষের কণ্ঠ এত মিষ্টি হয়! ইশ্ আরেকবার যদি শুনতে পারতাম। এমন সময় আবার ফোন বাজে। আমি চট করেই ফোন রিসিভ করি। এত দ্রুত কখনো ফোন রিসিভ করেছি বলে মনে পড়ে না। শিফট-ইনচার্জ ওয়াহিদ ভাই আমার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকান। তখন কি আমার সে সব বিবেচনা করার বোধ আছে। আমি গদগদ কণ্ঠে বললাম, হ্যালো। ওপাশ থেকে কোনো উত্তর নেই। কেউ একজন ফোন ধরে আছে, সেটা বুঝতে পারছি। আমি হ্যালো হ্যালো করতেই থাকি। বিরক্ত হয়ে ওয়াহিদ ভাই ফোন রেখে দিতে বলেন। তবুও আমি রাখছি না। বেশ কিছুক্ষণ পর শুনতে পাই কাঁচের চুড়ি ভাঙ্গার মতো রিনঝিন হাসি। 

তারপর সেই মোহনীয় কণ্ঠে বললো, এখন কেমন লাগে?

একটু ভড়কে গিয়ে বললাম, কেমন লাগে মানে?

আপনি ফোন ধরে কোনো জবাব না দিয়ে তখন চুপ করে থাকলেন কেন? তাই আমি এবার শোধ নিলাম। বুঝলেন মিস্টার।

আমি ব্যাকফুটে খেলার মতো করে বললাম, দেখুন আমি তো আর ইচ্ছে করে নীরব হয়ে যাইনি। এরজন্য তো আপনি দায়ী। 

মেয়েটা অবাক হয়ে বললো, আমি দায়ী! আজিব কথা! 

ওয়াহিদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কণ্ঠ একটু নিচুতে নামিয়ে বললাম, আমি তো ভেবেছি, স্বর্গ থেকে কোনো অপ্সরী আমার সঙ্গে কথা বলছেন। কণ্ঠের জাদুতে আমি এমনই মুগ্ধ হয়ে যাই, কথা বলতেই ভুলে যাই। কোনো মানবীর কণ্ঠ এত আবেদনময়ী হতে পারে, আমার অন্তত জানা ছিল না।

হাসির ঝরনাধারায় আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে মেয়েটি বললো, সত্যি বলতে কি আমার কণ্ঠ নিয়ে অনেক প্রশংসা শুনেছি। কিন্তু আপনি যেভাবে মুগ্ধতা প্রকাশ করলেন, এভাবে কেউ করেনি। আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন তো। 

বিস্ময় নিয়ে বললাম, আমি সুন্দর করে কথা বলি! এমন স্বীকৃতি জীবনে এই প্রথম পেলাম। ওয়াহিদ ভাই একটু পর পর আমার দিকে তাকাতে থাকেন। বুঝলাম, অকারণে এই কথা বলাটা তার পছন্দ হচ্ছে না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেয়েটিকে বললাম, যাকগে, আপনি কীজন্য ফোন করেছিলেন? 

মেয়েটি বললো, আসলে ফোনটা রং নাম্বার হয়ে গেছে। তবে আপনার সঙ্গে কথা বলতে পেরে ভালো লাগছে। এটা কি আপনার বাসার নাম্বার? 

আমি বললাম, জি না। এটা একটা সংবাদপত্রের অফিস। 

খানিকটা উৎফুল্ল কণ্ঠে মেয়েটি বললো, তাই! আপনি কি সাংবাদিক? 

বললাম, হ্যাঁ।

চমৎকার তো। দীর্ঘ দিনের একটা ইচ্ছে পূরণ হলো। সংবাদপত্রের প্রতি আমার অপরিসীম কৌতূহল। কিন্তু কোনও সাংবাদিককে আমি জীবনেও দেখিনি। কথা বলারও সুযোগ হয়নি। দারুণ ব্যাপার না? 

মোটেও দারুণ ব্যাপার নয়। সাংবাদিকদেরও আপনার মতো দুই হাত দুই পা। আলাদা কিছু নয় ম্যাডাম।

দুষ্টুমি করে মেয়েটা বললো, তাই বুঝি! আমি তো ভেবেছিলাম, তাদের চার হাত চার পা। 

বললাম, ফাজলামো করেন?

কোনও উত্তর না দিয়ে মেয়েটা একটানা হাসতে থাকে। হাসি থামার পর বললো, পত্রিকার ফোন নাম্বারটা কি পাওয়া যাবে? 

বললাম, মাথা কি বিগড়ে গেল নাকি? আপনি তো পত্রিকার নাম্বারেই কথা বলছেন।

সেটা তো আপনার কাছে জানলাম। তবে আমি যে নাম্বারে কথা বলার জন্য ফোন করেছি, এটা তো সেই নাম্বার নয়। হয় ভুল করেছি নতুবা ভুল নাম্বারে চলে গেছে? তখন কেটে দিয়ে রিডায়াল করেছিলাম। আপনার নাম্বার তো আর জানি না। নাম্বার দিতে কি আপত্তি আছে? 

আরে না, আপত্তি কেন থাকবে? এটা গোপনীয় কিছু নয়। এই নাম্বার তো প্রতিদিনই পত্রিকায় ছাপা হয় ২ ৩ ৫ ৩ ৪ ১। 

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আচ্ছা, আমি যদি এই নাম্বারে ফোন করি, তাহলে কি আপনার সঙ্গে কথা বলা যাবে? 

বললাম, তেমন সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। 

মেয়েটা আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলো, কেন? কেন?

আমাদের ডিউটির তো নির্ধারিত সময় নেই। কোনও সপ্তাহে সকালে, কোনও সপ্তাহে বিকেলে, কোনও সপ্তাহে রাতে। আপনি আমাকে পাবেন কীভাবে? 

ভারি মজার চাকরি তো! তাহলে আপনাকে পাওয়ার উপায় কী? 

কেন বলুন তো?

মেয়েটা বললো, আপনার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগলো। তাই আবার কি কথা হতে পারে না?

বললাম, তা হতে পারে। সেক্ষেত্রে এই নাম্বার ছাড়া তো উপায় নেই। 

ইতোমধ্যে অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেছে। কাজ রেখে কথা চালিয়ে যাওয়ায় ওয়াহিদ ভাই ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। আমি বললাম, এখন তাহলে রাখি। এই বলে ফোন রেখে দেই।  

তারপর অনেক দিন পেরিয়ে যায়। মেয়েটির সঙ্গে আর কথা হয়নি। আমি মেয়েটার নাম জানি না। ফোন নাম্বারও জানি না। মেয়েটাও আমার নাম জানে না। ভেবেছি, ভোকাট্টা ঘুড়ির মতো ওড়ে চলে গেছে। বেশ কিছু দিন পর আবার বিকেলের শিফটে কাজ করছিলাম। একদিন সেই মেয়েটা ফোন করে আমাকে পেয়ে যায়। 

আমি রিসিভ করতেই কিছুটা রাগত স্বরে বলে, আপনি এমন কেন?

বললাম, কেমন?

সেদিন আপনি আপনার নামটা পর্যন্ত বলেননি।

অদ্ভুত কথা। আপনি জানতে না চাইলে আমি কি সেধে সেধে নাম বলবো? 

অভিমানের গলায় মেয়েটি বললো, এরমধ্যে আপনাকে আমি অনেক দিন ফোন করেছি। কিন্তু নাম না জানায় আপনার কথা কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারিনি। আমাকে কত হয়রান হতে হয়েছে। ভাগ্যিস এখন পেয়েছি। আপনার নামটা বলেন তো। আমি হেলেন।

মজা করে বললাম, বাহ্, হেলেন অব ট্রয়?

আপনার মুণ্ডু। বললাম, হেলেন। উনি চলে গেছেন গ্রিক পুরাণে। আগে আপনার নামটা বলেন তো। পরে খেয়াল থাকবে না। নইলে আবার ভোগান্তি পোহাতে হবে। 

নিজের নাম জানিয়ে বললাম, আপনি আমাকে এই ফোনে কখনও খোঁজ করবেন না।

হেলেন বললো, কেন খুঁজবো না?

আপনি আমাকে খোঁজ করলে সহকর্মীরা অন্য কিছু ভাবতে পারে। 

কী যে বলেন না। আপনাকে কি কেউ খুঁজতে পারে না?

তা অবশ্যই পারে। কিন্তু আপনার বিষয়টি ভিন্ন। 

কি অবাক করা কথা। সবাই খুঁজতে পারবে। আমি পারবো না। 

দেখুন, এটা আমার কর্মস্থল। আপনি যদি এভাবে খোঁজাখুঁজি করেন, আমার রেপুটেশন খারাপ হয়ে যাবে। 

হেলেন বললো, তাই বুঝি? ঠিক আছে, একটা শর্ত মানলে খুঁজবো না। শর্তটা রাখবেন কিনা বলেন? 

বললাম, শর্তটা আগে শুনি তো। তারপর না রাখারাখির প্রশ্ন। 

আমার ফোন নাম্বারটা রাখুন। এখন থেকে আপনি আমাকে ফোন করবেন।

দেখুন, এই ফোন দিয়ে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব নয়। অফিসের ফোন কোনোভাবেই এনগেজড করে রাখা যাবে না।

তাহলে আপনার সঙ্গে কথা হবে কী করে?

বললাম, কথা তো হয়েছেই। আর কী কথা?

আশ্চর্য মানুষ তো আপনি। আমার কণ্ঠ শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন আর এখন আমি যেচে কথা বলতে চাইছি, আপনি আমাকে একদম পাত্তাই দিচ্ছেন না। ব্যাপারটা কী?

ব্যাপারটা আসলে কিছু না। যা কিছু ভালো লাগে, তার সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। না হলে মাধুর্যটুকু থাকে না।

তাহলে তো পৃথিবীতে ভালো লাগা থেকে কোনও সম্পর্কই স্থাপিত হতো না। সম্পর্ক হলে তিক্ত হতেও তো বেশি সময় লাগে না। নির্ভেজাল কোনও সম্পর্ক কি আছে? মানুষ তো এটা মেনে নিয়েই সম্পর্ক গড়ে। যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে হেলেন। 

বললাম, আপনার কথা অস্বীকার করছি না। তবে সেটা তো আলাদা প্রসঙ্গ। 

কেন আলাদা প্রসঙ্গ?

আপনার কণ্ঠ আবেদনময়ী, তা শুনলে অভিভূত হতে হয়। কিন্তু আপনার সঙ্গে যদি নিয়মিত কথা হয়, তাহলে এই মুগ্ধতা থাকবে না। আমি এমনটা চাই না।

তার মানে আপনি আমার কণ্ঠ আর কখনও শুনতে চাইছেন না।

বললাম, আমি কি তাই বলেছি?

আপনার সঙ্গে যোগাযোগ না হলে তার অর্থ তো তাই দাঁড়ায়। 

মাঝে-মধ্যে তো কথা হতেই পারে। আপনি আজকে আমাকে যেভাবে যোগাযোগ করলেন, সেভাবেই না হয় কথা হবে।

এটা কীভাবে হয়? আমি অন্যদের কাছে আপনার ডিউটির সময় জেনে নিয়ে ফোন করবো, এটা কি শোভনীয় হবে? 

এছাড়া তো আমি বিকল্প দেখছি না। 

আপনি তো দেখি খুবই নিরস মানুষ। প্রথম দিন কথা বলে যা ভেবেছিলাম, এখন তেমন মনে হচ্ছে না। 

কেন, কী ভেবেছিলেন?

রেগেমেগে হেলেন বললো, ঘোড়ার ডিম ভেবেছি।

বললাম, রাগলেও তো আপনাকে বেশ ভালোই লাগে। একটা অনুরোধ কি করতে পারি?

হেলেন তাৎক্ষণিকভাবে খুশি হয়ে বললো, বলেন, কী অনুরোধ? 

আপনি আবৃত্তির চর্চা করেন কিনা জানি না। আপনি যদি আবৃত্তি করেন, তাহলে ক্যামেলিয়া মোস্তফা, প্রজ্ঞা লাবণীর মতো বিখ্যাত হতে পারবেন। আপনি কি আমার এই অনুরোধ রাখবেন? 

আপনি অনুরোধ করেছেন, সেটাই আমার কাছে অনেক বড় কিছু। কিন্তু আবৃত্তি কতটা কি করতে পারবো, জানি না। তবে চেষ্টা করে দেখবো। 

এরপর থেকে হেলেনের সঙ্গে আমার নিয়মিত কথা হয়। সে-ই ফোন করে৷ বিকেল ছাড়া অন্য সময় কথা বলার খুব একটা সুযোগ থাকে না। কাজের অনেক চাপ থাকে৷ তাকে বোঝাতে পারি না। দিনে দিনে সে অনেক ডেসপারেট হয়ে উঠতে থাকে। কোনও কিছুর তোয়াক্কা করে না। আমার অবস্থানটা একদমই বুঝতে চায় না। অফিসের সহকর্মীরা এই কথা বলার বিষয়টা নিয়ে সরস আলোচনা করে। দেখা হলে কেউ না কেউ মুচকি হাসি দিয়ে জানায়, আমাকে একটা মেয়ে খোঁজ করেছিল। বুঝতে পারি, তাদের অপার কৌতূহল। মুখে লেগে থাকা রহস্যময় হাসিতে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অনুকূল মনে হয় না। বিব্রত বোধ করতে থাকি। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার সহজ উপায় খুঁজে পাই না। আমি একদিন বাধ্য হয়ে হেলেনকে বললাম, তুমি কি চাও, ততদিনে সম্পর্কটা তুমির পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, আমি চাকরি ছেড়ে দেই?

সে উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো, কেন? কেন? 

আমি বললাম, পুরো অফিসে আমাকে নিয়ে কানাঘুষা চলছে। এভাবে তো আমার পক্ষে চাকরি করা সম্ভব নয়। 

তাহলে আমি কী করবো? আমি তো তোমার সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারবো না।

তুমি তো শুধু কথা বলতে চাও, তাই তো? 

হেলেন বললো, হ্যাঁ।

তাহলে তোমাকে আমি একটা ফোন নাম্বার দিচ্ছি। এই নাম্বারে ফোন করলে তুমি আমার সঙ্গে কথা বলতে পারবে। তবে শর্ত হলো, তুমি কখনও আমাকে অফিসে ফোন করতে পারবে না। এই শর্তে রাজি আছো?

তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারলেই হলো। আমি যে কোনও শর্তেই রাজি।

আমি সামাজিক একটা সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে। সেখানে প্রতিদিন একবার যেতে হয়। নিরূপায় হয়ে সেই সংগঠনের ফোন নাম্বারটি হেলেনকে দেই। ফোন করলে কথা চালিয়ে যেতে হয়। আর যা হোক অফিসের ফিসফাস থেকে তো মুক্তি পাওয়া যায়। এভাবে অনেকগুলো দিন চলে যায়। কিন্তু সম্পর্কটা শুধু কথা বলার মধ্যে সীমিত রাখতে চায় না হেলেন। কেমন একটা অন্তরঙ্গতার দিকে নিয়ে যেতে থাকে। আমি যতই আগল দেওয়ার চেষ্টা করি না কেন, তাকে আটকে রাখা যায় না। বুঝতে অসুবিধা হয় না, কী কারণে যেন আমাকে তার হৃদয়ে ঠাঁই দিয়ে ফেলেছে। আমার প্রতি বেশ মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। একটা পর্যায়ে দুজনের সম্পর্কটাকে স্থায়িত্ব দেওয়ার কথা বলতে থাকে। আমি তাকে নানাভাবে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করি। কিন্তু কোনোভাবেই তার মনোভাব পরিবর্তন করা যায় না। 

বিয়ে-সংসার ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে একদিন আমি তাকে বললাম, আমার যা আয়-রোজগার তাতে সংসার চালিয়ে নেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই। 

আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, তোমার চাকরি না করলেও চলবে। আমি আয় করে সংসার চালিয়ে নেব। 

আমি বললাম, এটা কী করে হয়?

সে দৃঢ়তার সঙ্গে বললো, ছেলেরা যদি উপার্জন করে সংসার চালাতে পারে, তাহলে মেয়েরা কেন পারবে না?

এর কোনও সদুত্তর আমার কাছে ছিল না। তাছাড়া এভাবে সংসার করার কথা বলায় অনেকটা হতভম্ব হয়ে যাই। তখন তাকে বাধ্য হয়ে বললাম, প্রথম থেকেই আমি তোমাকে এড়িয়ে যেতে চাইছি। তুমি বুঝেও বুঝতে পারছো না। আসলে আমার অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে অ্যাফেয়ার আছে। 

সে রাগত স্বরে বললো, তুমি আমাকে এড়ানোর জন্য এই গাল-গল্প মারছো। আমি তা একদমই বিশ্বাস করি না।

বললাম, আমি একটুও মিথ্যা বলছি না। তোমাকে আমি কীভাবে বিশ্বাস করাবো? 

হেলেন বললো, আমি সেই মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাই। তুমি তার ফোন নাম্বার আমাকে দাও। 

বললাম, এটা তো মোটেও সম্ভব নয়। 

কেন সম্ভব নয়? আমি একবার তার সঙ্গে কথা বলে সম্পর্ক আছে কিনা সেটা যাচাই করতে চাই। যদি তেমন কিছু হয়ে থাকে, তাহলে না হয় অন্য চিন্তা করবো। 

তুমি চাইলেই তো হবে না। সেটা আরও জটিলতার সৃষ্টি করবে। তেমন ঝুঁকি আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। 

হেলেন অভিমানী কণ্ঠে বললো, জটিলতা-তটিলটা বুঝি না। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। 

বললাম, এটা কেমন কথা? তুমি আমাকে কখনও দেখনি। আমার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানো না। আর বলছো, আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।  

কথাই তো একজন মানুষকে চিনতে পারার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আমি তোমার সঙ্গে ফোনে কথা বলে যা বোঝার বুঝে নিয়েছি। তোমাকে আমার আর বুঝতে হবে না। 

এটা কী ধরনের পাগলামি? একজন মানুষকে না দেখে না জেনে সম্পর্ক গড়তে চাইছো, এটা হয় নাকি কখনও?

হেলেন বললো, মানুষের মন চিনতে হলে দেখা-সাক্ষাৎ খুব প্রয়োজনীয় নয়। প্রতিদিন কত বিয়ে-শাদি হচ্ছে, তাদের অনেকের মধ্যে তো কথা পর্যন্ত হয় না, বাসর রাতেই স্বামী-স্ত্রীর প্রথম দেখা হয়। আর তুমি চাইলে তো আমাদের যখন-তখন দেখা-সাক্ষাৎ হতেই পারে। চলো, আমরা দেখা করি।

আমি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বললাম, আরে না না। দেখা-সাক্ষাতের প্রয়োজন নেই। আমি আসলে এই সম্পর্কটা চাইছি না। কারণ, আমি তো আরেক জনকে কথা দিয়েছি। কথা দিয়ে আমি তার খেলাপ করতে পারবো না। 

আবেগময় কণ্ঠে হেলেন বলে, এটা তোমার মনগড়া কথা। আর জেনে রাখ, তুমি আমার জীবনে না এলে আমি এই জীবন রাখবো না।

আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, এই সব কী বলছো তুমি? 

দৃঢ়তার সঙ্গে হেলেন বললো, আমি যা বলছি, তার কোনো নড়চড় হবে না। 

বললাম, তুমি এমনটা বলতে পারো না। সম্পর্ক কি জোর-জবরদস্তি করে হয়? আমি তো তোমাকে কখনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ার কথা বলিনি। ভালোবাসার কথাও বলিনি। তুমি চেয়েছো বলে কথা বলি।

এত দিন যেভাবে কথা বলছি, তা থেকে কি তুমি কিছুই বুঝতে পারোনি?

বুঝতে পারা না পারার কিছু নেই। আমার সঙ্গে তোমার তো শুধু কথা বলার সম্পর্ক। এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবার সুযোগ নেই। এখন বুঝতে পারছি, এভাবে কথা বলাটা আমার উচিৎ হয়নি। 

হেলেন বললো, সম্পর্ক কি এক জায়গায় থেমে থাকে? সম্পর্ক তো জলের মতো। গড়াতে থাকে। কথা বলা দিয়েই তো সম্পর্ক হয়। তারপর তা ঘনিষ্ঠতার দিকে গড়ায়। 

বললাম, তা তো হতেই পারে। সেটা তো দুজনের সম্মতির ভিত্তিতে হয়। তাই না? ঠিক আছে এখন রাখি। আমাকে অফিসে যেতে হবে। 

এরপর কিছু দিনের জন্য আমাকে হঠাৎ করে দেশের বাইরে যেতে হয়। যে কারণে হেলেনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। তাকে জানিয়েও যাওয়া হয়নি। দেশে ফেরার পর জানতে পারি, আমার খোঁজে সে অফিসে গিয়েছিল। কীভাবে কীভাবে ঠিকানা সংগ্রহ করে আমার সংগঠনের অফিসেও যায়। আমার সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করে। অথচ সে কাউকেই চেনেও না। একটা মজার ঘটনাও ঘটে। সংগঠনের অফিসে গিয়ে একজন সদস্যের কাছে আমার ছবি দেখতে চায়। আমাদের সংগঠনের একজন প্রবীণ সদস্য আছেন, তাঁকে সবাই দুলা ভাই সম্বোধন করে ডাকেন। ওই সদস্য মনে করেন, বোধকরি সে বুঝি তার কথা বলছে। তিনি দেওয়ালে ঝুলানো বয়স্ক সেই সদস্যের ছবি দেখিয়ে দেন। তাতে করে হেলেন একটু হোঁচট খায়। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলায় দোল খেতে থাকে। 

তবে সে পণ করে এসেছিল, আমার সঙ্গে দেখা না করে ফিরবে না। আমি যে দেশে নেই, সে কথা জানতে পারেনি। কয়েক দিন নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে আমার দেখা না পেয়ে বিফল মনোরথে ফিরে যায়। কেউ কেউ তাকে নিয়ে হাসি-তামাশার মাধ্যমে মজা নেওয়ার চেষ্টা করে। এক ধরনের অপমানও করে। তাতে সে মনে বড় আঘাত পায়। আমি কিছু দিন টেলিফোন থেকে দূরে সরে থাকি। সবাইকে বলে রাখি, আমাকে কোনও মেয়ে খোঁজ করলে যেন বলে দেয়, আমি নেই। আমি জানি না এরমধ্যে হেলেন আমাকে আর খোঁজ করেছে কিনা। 

একটা সময় হেলেনের চ্যাপ্টারটা ক্লোজ হয়ে যায়। তবে মানুষের মন তো। ক্লোজ হলেও সহজেই তো ভুলে যাওয়া যায় না। তার জন্য ভিতরে ভিতরে একটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজ করতে থাকে। প্রতিদিন সংবাদপত্র হাতে নিয়ে সবার আগে নারায়ণগঞ্জের খবর তন্ন তন্ন করে খুঁজতাম। কোনও অঘটনের অপেক্ষা আমাকে অস্থির করে রাখতো। এইভাবে দিন-মাস-বছর গড়িয়ে যায়। জীবন থেকে হারিয়ে যায় হেলেন নামের সুকণ্ঠি সেই মেয়েটি। অথচ আমি সায় দিলে সেই মেয়েটি হতে পারতো আমার জীবনসঙ্গী। কিন্তু তার কোনও অস্তিত্ব আর আমার জীবনে নেই। 

অনেক বছর পর একটা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমাকে যেতে হয় নারায়ণগঞ্জে। সেই অনুষ্ঠানে একটা মেয়ের আবৃত্তি শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। অনুষ্ঠান শেষে মেয়েটির কাছে গিয়ে তার কণ্ঠের প্রশংসা করি। তার কাছে জানতে পারি মায়ের উৎসাহে সে নিজেকে আবৃত্তি শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলছে। তার পাশে বসে ছিলেন এক ভদ্রমহিলা। মেয়েটি সেই ভদ্রমহিলাকে নিজের মা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। সে সময় মেয়েটাকে কেউ একজন ডেকে নিয়ে গেলে ভদ্রমহিলা ফ্যাসফ্যাসে গলায় আমাকে বলেন, কেমন আছেন? আপনাকে এই জীবনে কখনও দেখতে পারবো, এটা ভাবতেও পারি নি। এই দেখায় জীবন সার্থক না হলেও চোখের তৃষ্ণা অন্তত মিটলো।

অবাক হয়ে বললাম, আপনি আমাকে চেনেন! 

চিনতে পেরেছি বলেই তো এত কথা বলছি। অনুষ্ঠানে আপনাকে যেভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, তাতে চিনতে সমস্যা হয়নি। আমি হেলেন। আপনার ভাষায় হেলেন অব ট্রয়।

তার কথায় আমি চমকে ওঠি। ধাতস্থ হয়ে বললাম, আপনার কণ্ঠের এই অবস্থা কেন?

সে আমার ভাগ্যের লিখন। আপনার সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করতে না পেরে নিজের জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করি। আমার সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। বেঁচে গেলেও হারিয়ে ফেলি আমার সেই কণ্ঠস্বর। তাতে অবশ্য আমার কোনও আফসোস নেই। যে আমার কণ্ঠ পছন্দ করতো, তাকেই যখন এই জীবনে পেলাম না, তাহলে আর তা থাকলো কি থাকলো না, সে নিয়ে মাথা ঘামাই নি। 

নিজের অপরাধ বোধটাকে আড়াল করার জন্য বললাম, আপনার মেয়ে তো অবিকল আপনার কণ্ঠ পেয়েছে। 

মুখে হাসি ছড়িয়ে দিয়ে হেলেন বলেন, এটাও বোধকরি সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমা। আমার কণ্ঠ কেড়ে নিয়ে তা আমার মেয়ের মাধ্যমে ফিরিয়ে দিয়েছে। সে কারণে আমার ভালোবাসার মানুষের একটা অনুরোধ আমি রক্ষা করতে না পারলেও মেয়েকে দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

আমি নির্বাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। তার দুই চোখে টলমল করছে অশ্রু। তা কি দুঃখের নাকি সুখের, আমি ঠিক বুঝতে পারি না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন