পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২১

কেমন যেন বেভুল হয়ে যাই

 

বয়সকে কি থামিয়ে রাখা যায়? এখন অব্দি তেমন কোনো দৃষ্টান্ত দৃশ্যমান নয়। বয়সের ক্রমবৃদ্ধি হওয়াটা স্বাভাবিক ও অনিবার্য এক প্রক্রিয়া হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে শরীরের বিভিন্ন কোষ। তার প্রতিফলন ঘটতে থাকে দেহে, মনে, মগজে। এর ছাপ ক্রমশ স্পষ্ঠ হয়ে উঠে শরীরের বিভিন্ন অংশে। সময় কেড়ে নেয় শারীরিক সক্ষমতা। গড়মিল হতে থাকে অভ্যন্তরীণ কল-কব্জায়। কমিয়ে দেয় চলার গতি। হ্রাস পেতে থাকে চিন্তাশক্তি। দুর্বল করে দেয় স্মৃতিশক্তিও। একজন মানুষকে অচল ও অক্ষম করে দেওয়ার মোক্ষম অস্ত্র হলো বয়স। মার্কিন কবি টি. এস. এলিয়ট লিখেছেন, I grow old ... I grow old ...I shall wear the bottoms of my trousers rolled. সঙ্গত কারণেই পরিণত বয়সে প্রায়শই ভুল-ভাল হতে থাকে। যদিও আমার স্মৃতিশক্তি কখনই প্রখর নয়। অনেক কিছুই মনে রাখতে পারি না। আর এখন তো সব এলোমেলো হয়ে যায়। চেনা মানুষকে অচেনা মনে হয়। অচেনা মানুষকে লাগে চেনা চেনা। শিল্পী শ্যামল মিত্রের গাওয়া গানের ভাষায়, ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা’। একটুতেই গুলিয়ে ফেলি অনেক কিছুই। এ কারণে সত্যিকার অর্থেই আতান্তরে পড়ে যাই।

যে মানুষগুলোর সঙ্গে দীর্ঘদিন চেনাজানা, হয়তো ইদানীং দেখা-সাক্ষাৎ খুব কম হয়, কিন্তু আত্মিক বন্ধন তো অটুট রয়ে গেছে। এ বন্ধন তো একান্তই মনের ব্যাপার। যোগাযোগ না থাকলেও বুঝতে পারি, আমার প্রতি তাঁর বা তাঁদের স্নেহ, ভালোবাসা ও সহানুভূতির কোনো কমতি নেই। এমন সহানুভূতিশীলদের সংখ্যা হয়তো খুব বেশি নয়। বেশি না হওয়ার দায় অবশ্য আমারই। সবার সঙ্গে আমি প্রাণ খুলে কথা বলতে পারি না। মিশতেও পারি না। আমার প্রতি সহানুভূতিশীলদের বাইরে যাঁরা আছেন, সেভাবে হয়তো তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্টতা বা সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, কিন্তু তাঁদেরও তো অনেক দিন ধরে চিনি বা জানি। প্রায় প্রত্যেকের কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্য মুখস্থ। কেউ কেউ তো নিজ গুণে মহিম্বান্বিত। তাঁরা আমাকে নিয়ে কী ভাবেন, তা অবশ্য জানি না। তাঁদেরকে তো আমার দূরের ভাবার কোনো কারণ নেই। কাছের পরিমণ্ডলেরই মনে করি। এ পরিমণ্ডলের কেউ যখন হঠাৎ চলে যান, তখন বিরাট একটা শূন্যতা তৈরি হয়। এত এত দিন ধরে চেনা মানুষটার অনুপস্থিতিতে বুকের মধ্যে কেমন কেমন লাগে। কাছের মানুষ হিসেবে সেটাই তো স্বাভাবিক। প্রকৃতির সহজাত নিয়মে তারপর একসময় এ শূন্যতাকে মানিয়ে নিতে হয়। এছাড়া তো আর গত্যন্তর নেই। বেশ কিছুদিন চলে যাওয়ার পর একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকি। ইদানীং এটি বেশি হচ্ছে। হুট করে হয়তো মনে হয়, আচ্ছা, অমুককে তো অনেক দিন দেখি না, তিনি কেমন আছেন? হঠাৎ হয়তো তাঁকে দেখার জন্য এক ধরনের আকুলতা কাজ করে। পরে হয়তো জানতে পারি, তিনি তো আর ইহলোকে নেই। আবার এমনও হয়, জীবিত আছেন, কিন্তু অনেক দিন দেখা হয় না, তখন মনে হয়, তিনি কি বেঁচে আছেন? কেমন একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যাই। নিজেকে তখন খুব অসহায় মনে হয়। আসলে বয়স বাড়তে থাকলে কোনো কিছু আর ঠিকঠাক মতো নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আমেরিকান কবি ডোনাল্ড হলের মতে, To grow old is to lose everything.

আমার মোবাইলের কললিস্টে এমন অনেকেই আছেন, তাঁরা আর জীবিত নেই। কিন্তু আমার কাছে তাঁরা জীবন্তই রয়ে গেছেন। সে নামগুলো ডিলিট করতে একদমই ইচ্ছে করে না। যাঁরা একসময় সক্রিয় ও সজীব ছিলেন, ছিলেন আমার চেনা গণ্ডির মধ্যে, তাঁদেরকে কি চাইলেই মুছে ফেলা যায়? যে কারণে প্রতিদিন এ নামগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলে মনে হয়, তাঁরা বোধকরি আছেন আগেরই মতোই। হারিয়ে যাওয়া এ মানুষগুলোর সঙ্গে আমার হয়তো মোবাইলে কালেভদ্রে কথা হতো কিংবা একদমই হতো না, তারপরও তাঁদের অস্তিত্বকে আমি অস্বীকার করতে পারি না। কখনও কখনও মনে হয়, তাঁকে ফোন করলে শুনতে পাবো আলাপিত সেই কণ্ঠ। ভেসে উঠবে পরিচিত সেই অবয়ব। বাস্তবে সেই কণ্ঠ শুনতে পাই না। সেই অবয়বও দেখতে পাই না। এ কেবলই বিভ্রম। এ বিভ্রম আমি কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারি না। যতই দিন যাচ্ছে, ততই এ বিভ্রান্তি আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেধে ফেলছে। আমি তার থেকে কোনোভাবেই মুক্তি পাচ্ছি না। কেমন যেন দিশেহারা লাগে।

আর এমনটি মূলত জাতীয় প্রেস ক্লাবের আমার পরিমণ্ডলকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। এ ক্লাবের সঙ্গে যতটা বন্ধন গড়ে উঠেছে, আর কোনোকিছুর সঙ্গে ততটা বোধকরি নয়। দেখতে দেখতে ক্লাবের সদস্য হিসেবে পেরিয়ে এসেছি তিন দশকেরও বেশি সময়। এক জীবনে এটি নেহাত কম সময় নয়। এ সময় কত জনের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে। হৃদ্যতা হয়েছে। কত জন জীবন থেকে হারিয়েও গেছেন। যদিও অন্তর্মুখী স্বভাবের কারণে সবার সঙ্গে যে আমার ঘনিষ্টতা হয়েছে, তা হয়তো বলা যাবে না। সম্পর্ক গড়ে না উঠলেও তাঁদের মুখগুলো তো আমি চিনি। তাঁরাও হয়তো আমাকে চেনেন। এটিইবা কম কি? অসংখ্য মানুষের ভিড়ে একজীবনে কজনের সঙ্গেইবা সম্পর্ক হয়? প্রতিনিয়ত দেখা হয়? প্রখর স্মৃতিধর না হলে কজনকেইবা মনে রাখা সম্ভব? এমনকি খুব কাছের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গেও সাধারণত খুব একটা দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। তাঁরাও ধীরে ধীরে মনের আড়ালে চলে যান। কিন্তু জাতীয় প্রেস ক্লাবের সঙ্গে সম্পর্কটা তেমন নয়। এর সঙ্গে যে আত্মার বন্ধন। যেখানে গেলে পাওয়া যায় এক বুক স্বস্তি। এ ক্লাবের সঙ্গে যাঁরা জড়িয়ে আছেন, তাঁরা তো আমার স্বজনের চেয়ে কোনো অংশে কম নন। চেনা মুখগুলোর সঙ্গে অনেক সময় দেখা হয়। আবার অনেকের সঙ্গে দীর্ঘদিন দেখা হয় না। নতুন সদস্যদের আগমন ঘটে। তাঁদের সঙ্গেও পরিচয় হয়। কখনো কথা হয়। অবশ্য পেশাগত কারণে কারও কারও সঙ্গে ক্লাবের বাইরেও দেখা-সাক্ষাৎ হয়। নিয়মিত কিংবা অনিয়মিত দেখা হওয়া মোটামুটি সবাই তো মুখ চেনা। তাঁদের তো কাছের পরিমণ্ডলের মনে না হওয়ার কারণ নেই। যে কারণেই হোক না কেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রেস ক্লাবের প্রতি নির্ভরতা আরো বাড়ছে। বাড়ছে স্মৃতির মৌতাত। নৈকট্য পেতে ইচ্ছে করে দীর্ঘদিনের সহযোগীদের। যত দিন বেঁচে থাকবো, তত দিন তো এ মানুষগুলোর সান্নিধ্যে কেটে যাওয়ার কথা।

আমি মানুষটা একদমই গুটিয়ে থাকা স্বভাবের। যে কারণে নিজ থেকে সবার সঙ্গে মিশতে পারি না। কিন্তু তারপরও অকারণেই অনেকের আশকারা পেয়ে যাই। তাঁরা আমাকে সহজেই আপন করে নেন। তাঁদের সংখ্যা হয়তো খুব বেশি নয়। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ হুট করে চলে গেলে ছোট হয়ে যায় আমার গণ্ডি। কেমন যেন রিক্ত হয়ে যাই। নিঃস্ব হয়ে যাই। এ রিক্ততা, এ নিঃস্বতা কখনো কখনো নৈর্ব্যক্তিক হয়ে যায়। মনে হয়, তাঁরা আছেন কাছে কিংবা দূরে। ক্লাবে গেলে হয়তো দেখা হয়ে যেতে পারে। দেখা হলে হাঁক দিয়ে উঠবেন পরম শ্রদ্ধাভাজন খ্যাতিমান সাংবাদিক এ. বি. এম. মূসা, কীরে তোরে দেখি না কেন? এমন অকৃত্রিমভাবে কে আর কুশল জানতে চাইবেন? তাঁকে ছাড়া কি প্রেস ক্লাব কল্পনা করা যায়? কেন যেন মনে হয়, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)-এর সাবেক মহাসচিব নিভৃতচারী আখতার আহমেদ খান ওয়াশিংটন বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রেস মিনিস্টার হিসেবে কর্মরত আছেন। যে কোনো দিন ফিরে আসবেন। এসে দিনমান আড্ডায় মশগুল হবেন। ফিনানসিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার সেলিম ভাই (আনিসুর রহমান) নিরিবিলি থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। আমাকে অসম্ভব পছন্দ করতেন। সে মানুষটি যে কোন ফাঁকে চলে গেছেন, আমি একদমই জানতেও পারি নি। এটি কেমন করে হয়? জানতে পারার পর অশ্রুসজল হয়ে উঠে চোখ। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। হায়! তিনি আর কোনো দিন বলবেন না, দুলাল, কেমন আছো? অবজারভার পত্রিকার আজিজ ভাই (আজিজুল হক) প্রায়শই আমার অফিসে আসতেন। বসবাস করতাম একই এলাকায়। সর্বশেষ যেদিন দেখা হয়, সেদিন বলেছিলেন, পরের সপ্তাহে তিনি অফিসে আসবেন। কিন্তু তিনি আর আসেননি। অথচ আমি তাঁর অপেক্ষায় থাকি। মনে হয়, তিনি একদিন ঠিকই এসে বলবেন, দুলাল, চা খাওয়ান। দেখা হলেই ক্রিকেটের খোঁজখবর জানতে চাইতেন ইউএনবি’র শেখ রকিবউদ্দিন। ক্লাবে গেলে হয়তো জানতে চাইবেন, তাঁর প্রিয় দল পাকিস্তানের সর্বশেষ হালহকিকত। আলতাফ মাহমুদ তো সারাক্ষণ ঝলমল করতেন। মুখে হাসি লেগেই থাকতো। দেখা হলে কুশল জিজ্ঞেস করবেন না, এটা তাঁর অভিধানেই ছিল না। খুব বেশিদিন হয়নি চলে গেছেন অনেকের প্রিয়ভাজন, অনেকের শ্রদ্ধাভাজন বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক শাহ আলমগীর ভাই। তিনি যে নেই, এটি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না। মনে হয়, পরম নির্ভরতা হয়ে তিনি আশে-পাশেই আছেন। দেখা হলেই বলে উঠবেন, কী খবর তোমার? এ রকম অনেকের কথাই খুব মনে পড়ে। তাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে টুকরো টুকরো কত স্মৃতি। তাঁরা চলে গিয়েও যেন রয়ে গেছেন। যে কারণে একটা বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। 

ইদানীং বড় বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছে করোনাভাইরাস। এই অতিমারি জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে কতগুলো মাস। এমনকি দূরত্ব সৃষ্টি করেছে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সঙ্গেও। ক্লাবে গিয়ে আড্ডা মারা তো দূরে থাক, থাকতে হয়েছে রীতিমতো ঘরবন্দি। এই সময়ে যেন ঘরের বাইরে কোনো স্মৃতি নেই। বলতে গেলে কেমন একটা বিস্মৃত সময় কেটেছে। সবচেয়ে কষ্টকর হলো, করোনাকালে হারিয়ে গেছেন ক্লাবের বেশ কয়েকজন সদস্য : রওশনউজ্জামান, আবু জাফর পান্না, মোহিতুল ইসলাম রঞ্জু, আসলাম রহমান, কামাল লোহানী, কবি মাসুক চৌধুরী, খন্দকার মোজাম্মেল হক, ফারুক কাজী, ডি. পি. বড়ুয়া, রাশীদ-উন-নবী, আবদুল্লাহ এম. হাসান, ফজলুন নাজিমা খানম, কাজী শামসুল হুদা, আবদুস শহিদ, রাহাত খান, ফেরদৌস আহমেদ কোরেশি, নুরুদ্দীন ভূঁইয়া, ফকির আবদুর রাজ্জাক, আবুল হাসনাত। তাঁদের সবাই ছিলেন চেনা-পরিচিত। কেউ ছিলেন সহকর্মী। কেউবা ছিলেন ঘনিষ্টজন। তাঁরা যে নেই, এ কথাটা একদমই বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। সামাজিক দূরত্বের মধ্যে চলে যাওয়ায় মনে হচ্ছে, তাঁরা আছেন আগের মতোই। ক্লাবে গেলে হয়তো দেখা হয়ে যাবে। 


জানি, সবটাই মায়া। সবটাই মরীচিকা। যে মানুষগুলো চলে গেছেন, তাঁদের সঙ্গে আর কখনও কথা হবে না। দেখাও হবে না। আমার খোঁজখবরও জানতে চাইবেন না। যে চলে যায়, সে কি আর কখনও ফিরে আসতে পারে? পারে না। এটি ভাবলেই বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে। অস্থির অস্থির লাগে। তাঁদের স্মৃতিগুলো বেদনাতুর করে তোলে। প্রিয় এ মানুষগুলো চলে গিয়ে আমাকে কেমন যেন বেভুল করে দিয়েছেন। এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারি না, সত্যি সত্যিই কি তাঁরা চলে গেছেন নাকি আগের মতোই আছেন?

১৫ নভেম্বর ২০২০

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন