পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১

অন্তহীন চলার পথ আর মানসিক প্রশান্তি

বুকের মধ্যে একটা মারাত্মক রোগ পুষে রেখে আমি জীবন যাপন করছি। আমার এ রোগটির কথা খুব একটা কেউ জানেন না। আমাকে দেখে সেটি বোঝার উপায়ও নেই। ‘অস্থিরতা’ নামক সেই রোগটি আমাকে কোনো কিছু সুস্থিরভাবে করতে দেয় না। এটা নিয়ে আমি অবশ্য কখনো কোনো চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হইনি। তবে এই রোগটি থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা সহজাত সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। 

আমাকে প্রায়শই বিকেলে বেসরকারি পরিবহনে পল্টন থেকে নাবিস্কো যেতে হয়। এই রুটে কোনো গাড়ি পাওয়া কি যে কঠিন, সে ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব না। টিকিট কেটেও গাড়ি মেলে না। ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে যেভাবে গাড়িতে উঠতে হয়, সেটা রীতিমত মল্লযুদ্ধকেও হার মানায়। মল্লযুদ্ধের কিছু নিয়ম-কানুন আছে। এখানে তার কোনো বালাই নেই। বিধ্বস্ত অবস্থায় গাড়িতে উঠার পর দম নিতে বেশ কষ্ট হয়। মুরগি যেভাবে চাপাচাপি করে খাঁচায় বন্দি করে নেওয়া হয়, তারচেয়েও কঠিন অবস্থায় যেতে হয়। বসার তো প্রশ্নই আসে না, দাঁড়িয়ে থাকার পর বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়। একজনের পা আরেকজনের পায়ের ওপরে, একজনের হাত আরেকজনের ঘাড়ে। কুংফু জাতীয় নানা প্যাঁচ তো আছেই। লাগামহীন মন্তব্য না শোনাটা ভাগ্যের ব্যাপার। কারো সাত-পাঁচে না থেকেও শুনতে হতে পারে কটু বাক্য। কখনো-সখনো পরিস্থিতি হয়ে উঠে উত্তপ্ত। 

গাড়ির মধ্যে এত কিছু হয়ে হচ্ছে, গাড়ির কিন্ত কোনো হেলদোল নেই। জায়গা থেকে খুব একটা নড়ে না। কোনো কোনো সময় ইঞ্চি ইঞ্চি মেপে এগুতে থাকে। আবার কোনো কোনো সময় থম্ মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। যেন গাড়ির যাত্রী সবাই চলেছে অচিন কোনো পথে। যে পথের কোনো গন্তব্য জানা নেই। সময় জানা নেই। শুধুই অপেক্ষা আর অপেক্ষা। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যথা তো মামুলি ব্যাপার। সারা শরীরও কঁকিয়ে উঠে ব্যথায়। যারা বসে থাকেন, তারাও স্বস্তিতে থাকেন না। কিছুক্ষণ পর পর দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গেন। কতক্ষণ আর চুপচাপ বসে থাকা যায়? গরমে ডিম সিদ্ধ হওয়ার মতো হয়ে যায় সবার অবস্থা। কেউ কেউ সইতে না পেরে গন্তব্য আসার অনেক আগেই নেমে যান। গাড়িতে উঠাটা যত কঠিন, নামাটাও তত সহজ নয়। কেউ যখন নামতে যান, তখন অবশ্য সবাইকে কম-বেশি যোগব্যায়ামের কসরত করতে হয়। 


এই জীবনের সমস্ত সিগনাল পেরিয়ে যাওয়া সম্ভব, কিন্তু মগবাজারের সিগনাল অতিক্রম করা এত সহজ নয়। সেটা করতে পারাটা অনেক পুণ্যির কাজ। অন্তহীন সময় হাতে নিয়ে এখানে অপেক্ষা করতে হয়। এই সিগনালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে জমজমাট ব্যবসা। নানা রকম পানীয়, খাদ্যসামগ্রীর পাশাপাশি কত কিছুই না বেচাকিনি হয়। গরমের দিনে হাতপাখা আর রোজার দিনে ইফতারির চাহিদা অনেক বেশি। সময় বয়ে যেতে থাকে দ্রুত। আকাশে চলতে থাকে মেঘ-রোদের খেলা। সিগনাল বাতিও লাল হয়। হলুদ হয়। সবুজও হয়। সব কিছুর বদল হতে থাকে। কিন্তু গাড়ির সারি অনড়, অটল। কোনো ভাবান্তর নেই। 

একটা সময় অন্তহীন এই অপেক্ষার অবসান ঘটে। মগবাজারের সিগনাল অতিক্রম করার সময় গাড়ি যাত্রীদের মনে পুলসিরাত পেরিয়ে যাওয়ার স্বস্তি দেখা যায়। যেন জীবনে বড় কিছু একটা অর্জন হলো। অর্জন তো বটেই। আমিও তো এই অর্জনের সুফল পাচ্ছি। এই পথ দিয়ে চলাচলের সময় মনের মধ্যে আসে অনেক পরিবর্তন। রাগ-ক্ষোভ-অভিমানগুলো ভিতরে ভিতরে দীর্ণ হতে থাকে। যে আমি একটুতেই অস্থির হয়ে উঠি, সেও ক্রমশ মিইয়ে যেতে থাকি। চিত্তচাঞ্চল্য দূর হয়ে যেতে থাকে। অজান্তেই গুনগুন করে গান গাইতে থাকি, ‘গাড়ি চলে না, চলে না রে, গাড়ি চলে না’। আশপাশের সবাই হয়ত আমাকে পাগল ঠাওরায়। আর আমি মনে মনে বলি, ওম্ শান্তি। ওম্ শান্তি। ওম্ শান্তি। 

একদিন-দু’দিন নয়, দিনের পর দিন এই অবস্থার মধ্য দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। কী পরিমাণ ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও সহ্যশক্তি থাকলে প্রতিদিন এই মর্মযাতনা পলে পলে অনুধাবন করা যায়। জীবনের জটিলতা এড়িয়ে একটু স্থিরতা, একটু স্বস্তির জন্য যোগব্যায়ামসহ কতজনে কত কিছুই করছেন। তাদের এত কিছু করার দরকার নেই। তারা যদি একটু কষ্ট করে একটা দিন পল্টন থেকে নাবিস্কো পর্যন্ত বাসে চলাচল করেন, তাহলে মনের অস্থিরতা একদমই দূর হয়ে যাবে। তারাও আমার মত পাবেন মানসিক শান্তি। তখন হয়ত তারাও একবুক প্রশান্তি নিয়ে নচিকেতার মত বলবেন, ‘অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন‘।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন