বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিরা সব উড়াল পাখি হয়ে যায়। চাইলেও ধরে রাখা যায় না। ধূসর পাণ্ডুলিপি হয়ে যায় জীবনের আনন্দ-বেদনার মুহুর্তগুলো। কিন্তু খুব অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কেন জানি কাছের স্মৃতিরা দূরে সরে যায়। আর দূরের স্মৃতিরা কাছে চলে আসে। কেন এমন হয়, আমার ঠিক জানা নেই। সেই কত কাল আগে পেরিয়ে এসেছি শৈশব আর কৈশোরের নির্মল ও সারল্যময় দিনগুলো। অথচ মনে হয়, এই তো সেদিন। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে সোনাঝরা সেই দিনগুলোকে। আর শৈশবকাল মানেই তো প্রধানত স্কুলজীবন। আমার স্কুলজীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অপার্থিব ও নিস্কলুষ সব টুকরো টুকরো স্মৃতি। পিছন ফিরে তাকালে এখনও দেখতে পাই, নিপাটসাদা শার্ট আর নীল হাফ প্যান্ট পরে হেঁটে চলেছি সুবোধ বালক আমি। পরিপাট্যের মোটেও কমতি নেই। নারিকেল তেল দেওয়া চকচকে কালো চুল যত্ম করে আঁচড়ানো। হাতে বই-খাতা-কলম। শিক্ষার সন্ধানে, জ্ঞানের সন্ধানে, জীবনদর্শনের সন্ধানে পাঠশালার পানে ছুটে চলেছি। হায়! মেধাহীন আমি কোনো পাঠই নিতে পারি নি।
খুব বেশি দূরে ছিল না স্কুল। বাসা থেকেই দেখা যেত। এমনকি শুনতে পারা যেত স্কুলের ঢং ঢং ঘণ্টাধ্বনিও। তখন তো আর এত কোলাহল ছিল না। ছিল না এত এত মানুষ। তবে পড়ালেখার প্রতি কোনো কালেই ঝোঁক না থাকলেও স্কুলে সময়মতো পৌঁছানোর ব্যাপারে একটা তাগিদ অনুভব করতাম। দেরিতে পৌঁছালে সাজা পাওয়ার ভয় তো ছিলই। তবে আমাকে অসম্ভব টানতো চারপাশের সবুজনিসর্গ, টলটলে পুকুর আর প্রাণোচ্ছ্বল বন্ধুত্ব। পাখির কলকাকলিও কম আকর্ষণ করতো না। আমাদের স্কুলের অবস্থান তো আর যে সে এলাকায় নয়। ‘সেকেন্ড ক্যাপিটাল’-এর বিদ্যালয় বলে কথা! চাইলেই দেয়াল টপকে পৌঁছে যাওয়া যেত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ক্লাস করার সময় হঠাৎ হঠাৎ মনোযোগ কেড়ে নিত বিভিন্ন দেশের উদ্দেশ্যে আকাশে ডানা মেলা নানান আকারের, নানান রঙের, নানান শব্দের উড়োজাহাজ। কখনো-সখনো স্যারের বকুনিতে মুগ্ধতার ধ্যান ভাঙতো।
তখন অবশ্য জানতাম না ‘ফার্স্ট ক্যাপিটাল’ আসলে কোনটি ছিল? তারপরও রূপান্তরিত ‘সেকেন্ড ক্যাপিটাল’এর বাসিন্দা হিসেবে এক ধরনের গর্ব অনুভব করতাম। যদিও ‘দ্বিতীয় রাজধানী’র অভিধাও তত দিনে বদলে গেছে। সেটি হয়ে গেছে একটি দেশের পূর্ণাঙ্গ রাজধানী। তার ব্যাপ্তিও বেড়েছে। তারপরও কারো কারো কাছে শের-এ-বাংলা নগর দীর্ঘ দিন ‘সেকেন্ড ক্যাপিটাল’ হিসেবেই বিবেচিত হতো। এর কারণ হতে পারে, সমগ্র পাকিস্তানের ‘দ্বিতীয় রাজধানী’ হিসেবে এ এলাকার আলাদা একটা অহংকার, আভিজাত্য ও গৌরব ছিল। গৌরব হারিয়ে গেলেও তার নস্টালজিয়া কি আর এত সহজেই কাটিয়ে উঠা যায়? পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ইসলামাবাদকে ‘ফার্স্ট ক্যাপিটাল’ হিসেবে গড়ে তোলার পর একটা ভারসাম্যমূলক নীতির অংশ হিসেবে ১৯৬২ সালের সংবিধানে শের-এ-বাংলা নগরকে ‘সেকেন্ড ক্যাপিটাল’ হিসেবে ঘোষণা দেন। এর নামকরণ করা হয় তাঁরই নামে ‘আইয়ুব নগর’। পুরো ঢাকাকে বাদ দিয়ে কেবল ‘আইয়ুব নগর’কে ‘দ্বিতীয় রাজধানী’ ঘোষণা করাটা বোধকরি কোনো চাণক্য নীতির অংশ ছিল। পরিসর ছোট হলেও একটি রাজধানীর জন্য যে সব অফিস-আদালত-বাসভবন অপরিহার্য, তা নির্মাণ করার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। ‘দ্বিতীয় রাজধানী’ হিসেবে গড়ে তোলার আগে এ এলাকাটি ছিল বিস্তীর্ণ কৃষি খামার। তাতে ছিল নানান রকম ফসলের সমারোহ। অবশ্য কিছুটা হলেও এখনও তার রেশ রয়ে গেছে। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বহুকাল আগে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের গড়ে তোলা কৃষি ইনস্টিটিউট (বর্তমানে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়), খামারবাড়ি, কৃষি সংক্রান্ত বিভিন্ন অবকাঠামো। ‘সেকেন্ড ক্যাপিটাল’ গড়ে তোলার অংশ হিসেবে শুরুতে ২০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। পরবর্তীকালে আরো ৮০০ একর জমি অধিগ্রহণের ঘোষণা দেওয়া হয়। সবার আগে শোভা হিসেবে নির্মাণ শুরু হয় ন্যাশনাল পার্লামেন্ট হাউজ, আজকের জাতীয় সংসদ ভবন।
জগতবিখ্যাত আমেরিকান ভাস্কর লুই কানের পরিকল্পনায় জাতীয় সংসদ ভবনকে কেন্দ্র করে একটি আধুনিক ও পরিকল্পিত শহর গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। মূলত জাতীয় সংসদ, পিডব্লুউডি, হাসপাতালের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বসবাসের জন্য নির্মাণ করা হয় বিভিন্ন ক্যাটাগরির কলোনি। তারই ধারাবাহিকতায় কলোনির বাসিন্দাদের সন্তানদের জন্য গড়ে তোলা হয় একটি সরকারি বালক এবং একটি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়। রাজনৈতিক পালাবদলে স্বাধীনতার পর ‘আইয়ুব নগর’-এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘শের-এ-বাংলা নগর’ এবং বালক বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় ‘শের-এ-বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়’। পুরো এলাকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্কুলটিতেও দেওয়া হয় লুই কানের নান্দনিক স্পর্শের ছোঁয়া। লাল সিরামিক ইটের নকশায় এল আকৃতির দোতলা স্কুল ভবনটি আলাদা সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয়। এখন অবশ্য এর অবয়বে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।
যদিও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হওয়ায় পর শের-এ-বাংলা নগরের প্রতি ফোকাসটা আগের মতো আর থাকে নি। নেহাতই রাজধানীর আরো একটি এলাকা হিসেবেই এটি বিবেচিত হয়।তবে এলাকাটি ছিল অনেক বেশি খোলামেলা। পরিকল্পিত নগরের সব সুযোগ-সুবিধা নিয়ে গড়ে উঠতে থাকে আবাসিক এলাকাটি। সে পরিকল্পনা থমকে গেলেও ঢাকার অন্যান্য এলাকার মতো এখনও এ আবাসিক এলাকাটি খুব বেশি ঠাসবুনোট হয় নি। তবে একটু একটু করে ঘিঞ্জি হয়ে ওঠছে। আশপাশের এলাকায় গড়ে তোলা হচ্ছে ইট-বালু-সিমেন্টের অপরিকল্পিত জঙ্গল। হারিয়ে ফেলছে তার নান্দনিক সৌন্দর্য। স্কুলটিকেও ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলছে বহুতল ভবনের ছায়া। তারপরও বিদ্যালয়টিকে এখনও পুরোপুরিভাবে আড়াল করতে পারে নি। কিন্তু মেট্টোরেল চালু হওয়ার পর স্কুলের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বোধকরি বদলে যাবে।
শের-এ-বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমাদের গৌরবের নিশান ছিল সেফটিপিন দিয়ে বুকপকেটে আঁটা মনোগ্রাম সম্বলিত ব্যাজটি। তবে তা নিয়ে কিছুটা দুঃখবোধও ছিল। স্থান সংকুলান না হওয়ায় এ ব্যাজে স্কুলের নামটি সংক্ষেপে লেখা থাকতো শে.বা.ন.স.উ.বা. বিদ্যালয়। দুষ্টু ছেলের দল এর অর্থ বানিয়েছিল ‘শেয়াল, বানর, নরাধম সব উল্লুকের বাচ্চা’। আর যাই হোক, এমন সম্বোধন আমাদের কানে মোটেও মধুর লাগতো না। সেই বাচ্চা বয়সে এ কারণে মন খারাপ হয়ে যাওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক।
স্কুল থেকেই জীবনে প্রথম বনভোজনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তখন আমরা ছিলাম নিচের ক্লাসের ছাত্র। সম্ভবত গাজীপুরের চন্দ্রায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই প্রথম জীবনে অন্য রকম এক মজা পেয়েছিলাম। এরপর অনেকবার বনভোজনে গিয়েছি। কিন্তু স্কুল থেকে যাওয়া বনভোজনটির আনন্দময় স্মৃতি এখনও উদ্বেলিত করে।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবির আন্দোলনে বলতে গেলে অচল হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকাসহ পুরো দেশ। আসলে এ নিয়ে আন্দোলন এরআগেও হয়েছে। তখন এতটা সাড়া জাগাতে পারে নি। মুরাদ নামে শের-এ-বাংলা নগর সরকারি বালক বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে দ্রুতগতির একটি গাড়ি ধাক্কা দিয়ে অনেক দূর টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলে ঘটনাস্থলেই তাঁর মর্মান্তিকভাবে মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় আশেপাশের স্কুলের ছাত্ররা রাস্তায় নেমে এসেছিলাম। তখন বোধকরি আমি শের-এ-বাংলা নগর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখার ছাত্র ছিলাম। তখন তো মিডিয়ার এমন রমরমা ছিল না। ছিল না ভার্চুয়াল দুনিয়া। যে কারণে আমাদের আন্দোলন সর্বত্র চাউর হয় নি। সম্ভবত সেই আন্দোলনের পর ওই রাস্তায় স্পিডব্রেকার নির্মাণ করা হয়। মুরাদ স্মরণে তাৎক্ষণিকভাবে শ্যামলী থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সড়কটির নাম স্বতস্ফূর্তভাবে দেওয়া হয়েছিল মুরাদ স্মৃতি সরণি। এ নামটি অনেক দিন পর্যন্ত বহাল ছিল। পরবর্তীকালে সরকারিভাবে এ সড়কের নামকরণ করা হয়েছে বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ সরণি। কালের অতলে হারিয়ে গেছেন আমাদের স্কুলের ছাত্র মুরাদ।
স্কুলে যাওয়ার পরও মনটা পড়ে থাকতো বাইরের জগতে। পাঠ্য বইয়ের পরিবর্তে বাইরের বিষয় আমাকে অসম্ভব টানতো। তখন তো ছিল ঘুড়ি উড়ানোর প্রচণ্ড নেশা। নীল আকাশে শুধু ঘুড়িই উড়াতাম না, সেইসঙ্গে উড়তো কত কত স্বপ্ন। ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে অনেক সময় স্কুলের সময় হয়ে যেত। মনের সুখে উড়তে থাকা ঘুড়িটাকে নামিয়ে আনতে কিছুতে মন সায় দিত না। নাটাইটা বাসার ভিতরে রেখে জানালার সঙ্গে উড়ন্ত ঘুড়ির সুতো শক্ত করে বেঁধে দিয়ে একান্ত নিরুপায় হয়ে চলে যেতাম স্কুলে। ঘুড়ির সঙ্গে বাঁধা থাকতো আমার চঞ্চল মনটাও। স্কুলে যেতে যেতে ফিরে ফিরে তাকাতাম। ক্লাস করার ফাঁকে ফাঁকে দেখতে পেতাম ঘুড়িটা নিঃসঙ্গভাবে দিব্যি উড়ছে। সেটিও কম রোমাঞ্চকর ছিল না।
স্কুলের সামনে পসরা সাজিয়ে বসে থাকতেন আইসক্রিম, চটপটি, ঝালমুড়ি, আচারওয়ালারা। তাঁদের সঙ্গে এক ধরনের আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠেছিল। সেই বন্ধন দীর্ঘ দিন অটুট ছিল। ক্লাসে যাওয়া-আসার পথে মজাদার এই খাদ্যদ্রব্যের জন্য মনটা কেমন উঁচাটন হয়ে থাকতো। তখন তো আর পকেটে পয়সা থাকতো না। চাইলেই ইচ্ছে পূরণের সুযোগ ছিল না। তারপরও মাঝে-মধ্যে এর কোনো একটি আইটেমের স্বাদ নিতে না পারলে কেমন যেন আলুনি আলুনি লাগতো।কোনোভাবে পয়সা ম্যানেজ করতে পারলে এর স্বাদ নিতে একটুও ভুল করতাম না। কী যে তৃপ্তি নিয়ে খেতাম। সেই সোয়াদের কোনো তুলনা হয় না। সে কথা ভাবলে এখনও জিবে জল এসে যায়।
স্কুলে ঢোকার পর প্রতি মুহুর্তে ঘণ্টা বাজার অপেক্ষায় থাকতাম। তবে টিফিনের ঘণ্টা শোনার জন্য অনেক বেশি উন্মুখ হয়ে থাকতাম। বুকের মধ্যে কী যে আকুলি-বিকুলি করতো। এক একদিন এক এক পদের টিফিনগুলোকে মনে হতো স্বর্গ থেকে আনা কোনো সুখাদ্য। অবশ্য কোনো কোন দিনের টিফিন একদমই পছন্দ হতো না। এ নিয়ে সম্মিলিতভাবে উষ্ণাও প্রকাশ করতাম। স্কুলেরএকটি ঘণ্টা মানেই তো ছুটির অপেক্ষা। টিফিনের পর সেই অপেক্ষা যেন কিছুতেই ফুরাতে চাইতো না।
বুকের মধ্যে আনচান করতো, ‘কখন ছুটি হবে, কখন বাজবে সেই ঘণ্টা’। প্রতীক্ষিত সেই ঘণ্টা বেজে উঠার পর কত না মধুর মনে হতো। একসময় তো স্কুল থেকে পুরোপুরিভাবে ছুটি হয়ে যায়। অনেকগুলো বছর একই লক্ষ্য নিয়ে একই ছাদের নিচে থাকা বন্ধুরা সব এলোমেলো হয়ে যাই। কে যে কোথায় হারিয়ে যায়। জীবনের বিস্তৃত আঙিনায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ায় দেখা-সাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে। কখনো কখনো মনে হয়, ইস! হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো স্কুলের সেই ঘণ্টাধ্বনি যদি বেজে উঠতো, তাহলে বন্ধুরা সব স্কুলে ফিরে গিয়ে কলতানিতে মেতে উঠতে পারতাম। এমনটি তো আর কখনও হবে না।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে টানা পাঁচ বছর একটির পর একটি সিঁড়ি টপকে ১৯৮১ সালে স্কুল থেকে একেবারেই বিদায় নিতে হয়। সে বছরের ৯ মার্চ বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমাদের উদ্দেশ্যে পড়া মানপত্র লেখা হয়েছিল, ‘কালের প্রবাহধারায় এক চিরন্তন নিয়মে তোমাদেরকে আমাদের মাঝ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। বৈচিত্রময় জীবনের সোনালী সূর্যের প্রত্যাশায় এতদিন কঠোর সাধনা করেছ। আজ সেই অনাগত দিন তোমাদের দ্বারপ্রান্তে। নতুন দিনকে বরণ করতে যাচ্ছ তোমরা। স্বাভাবিক কারণেই আমাদের ছাড়তে হবে তোমাদের। তাই তোমাদের বিদায় সম্ভাষণ জানাতে আমরা সমবেত।
তোমাদের বিদায় দিতে আমরা ভীষণভাবে ব্যথিত। শ্রেণী কক্ষের অটল গাম্ভীর্যের বাইরে বিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে কলকাকলীতে মুখরিত হয়েছে আমাদের দিনগুলো। একটানা বেশ ক’টা বছর কেটেছে এক সাথে। তোমাদের সাহচর্য আমাদের মুগ্ধ করেছে। কর্মতৎপরতা ও প্রেরণা জুগিয়েছে সকল কাজে। তাই এই বিদায়ক্ষণে নীরব বেদনায় আমাদের হৃদয় বিষাদময় হয়ে উঠেছে।
বিশাল জাগতিক আহ্বানে সারা দিতে যাচ্ছ তোমরা। এখন আর পিছনে ডাকা নয়। এগিয়ে চল দৃঢ় প্রত্যয় আর দৃঢ় শপথে। এতদিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বাধÑরচনা করা এক সুন্দর জীবন।’
হৃদয়ের সবটুকু আন্তরিকতা আর ভালোবাসা দিয়ে বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আমাদের মঙ্গল কামনা করা হয়েছিল। বিদায়ের সেই মুহুর্তে মনে হয়েছিল, বিশাল জাগতিক আহ্বানে সারা দিয়ে দৃঢ় প্রত্যয় আর দৃঢ় শপথে জীবন চলার পথে এগিয়ে যাবো। এখন তো বুঝতে পারছি, সেই প্রত্যাশা মোটেও পূরণ করতে পারি নি। পারি নি সুন্দর জীবন গড়ে তুলতেও। আমি তো বরাবরই ছিলাম ব্যাকবেঞ্চার। কখনই সামনের সারিতে যেতে পারি নি। এখনও তেমনটি রয়ে গেছি। সবার মেধাতো আর সমান নয়। চাইলেও ইচ্ছেমতো কিছু করতে পারা যায় না। আমিও পারি নি। এ না পারার ব্যর্থতার গ্লানি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জীবনটাকে আবার নতুনভাবে সাজাতে পারলে মন্দ হতো না। এ কারণে ইচ্ছে করে সেই স্কুল জীবনে ফিরে যেতে। যেখানে বুকের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয় জীবন গড়ার মূলমন্ত্র। তখন তো না বুঝে সেই মন্ত্র অবহেলা করেছি। এখন মনে হয়,নিজেকে সত্যিকার অর্থে যোগ্যতর হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষকদের উপদেশগুলো অক্ষরে অক্ষরে প্রতিপালন করলে কত না ভালো হতো। বয়সের এই প্রান্তে এসে এমন উপলব্ধি হলেও চাইলেই তো আর সেই জীবনে ফিরে যাওয়া যাবে না।কী এক আশ্চর্য ব্যাপার, জীবনে প্রথম স্কুলে যাই কাঁদতে কাঁদতে। স্কুল ছেড়ে এসেছি হাসতে হাসতে। আর এখন জীবনের উপান্তে দাঁড়িয়ে স্কুলের সেই জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য বুকের মধ্যে অনুভব করছি এক ধরনের হাহাকার। হায়! জীবন যে কত রহস্যময়। তার তল আজও খুঁজে পেলাম না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন