নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না। চারপাশে মেঘের ছাউনি। ঘন জলধরের আচ্ছাদনে এক প্রকার বন্দি। জগতসংসার থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। সংযোগহীন। নিজেকে খুব অসহায়, অবলম্বনহীন মনে হতে থাকে। কেঁপে উঠে বুকের ভিতর। এ কোথায় এলাম? কেউ কি নেই? সঙ্গীরা সব গেল কোথায়? কেমন দিশেহারা লাগতে থাকে। এমনটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেরার পথের সন্ধান করতে থাকি। যেদিকে যাই পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। বিভ্রান্তিতে পড়ে যাই। পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বেপরোয়াভাবে ছুটতে থাকি। হঠাৎ কার সঙ্গে যেন ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। চোখের পলকে কেউ একজন আমাকে জড়িয়ে ধরে। কোনো কিছু বুঝতে পারছি না। কেমন একটা অসাড় অবস্থা। কোনো বোধ-বুদ্ধি কাজ করছিল না। কেউ একজন আমাকে আস্তে-ধীরে দাঁড় করিয়ে বলেন, আরেকটু হলে মহা সর্বনাশ হতে যাচ্ছিল। কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারি তিনি একজন নারী। আবছা একটা অবয়ব দৃশ্যমান। কিন্তু মুখের আদল স্পষ্ট নয়। তখনো আমাকে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে রাখেন। তারপর বললেন, হাঁটতে অসুবিধা হবে না তো? আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। সেটা সহসা কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। মুখে কোনো কথা সরছিল না। তিনি আমাকে নিয়ে মেঘের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকেন। কেমন এক স্বপ্নের জগৎ মনে হতে থাকে। বেশ কিছুটা পথ হাঁটার পর চারপাশটা স্পষ্ট হতে থাকে। কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁয় আমরা বসি। মেঘের ঘোমটা সরিয়ে এবার তাকে পরিপূর্ণভাবে দেখার সুযোগ হয়। আমার সামনে যেন মেঘের দেবী। শুভ্রতায় মোড়ানো। পরনে সাদা সালোয়ার কামিজ। মানানসই ওড়না। দীর্ঘ চুল কোমরের নিচে নেমে গেছে। মুখাবয়বে লাবণ্য লেগে আছে। চোখে-মুখে ভোরের টাটকা সজীবতা। ঠোঁটে ছড়ানো মৃদু হাসি। যথেষ্ট স্মার্ট। ঝকঝকে। মেয়েদের সঠিক বয়স বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে ত্রিশের সীমানা যে অনেক আগেই ছাড়িয়েছেন, সেটুকু অনুমান অন্তত করাই যায়। যেন মেঘের দেশে মেঘবতী কোনো নারী। সব মিলিয়ে মুগ্ধ করার মতো আকর্ষণ ক্ষমতা। মনে মনে তার সৌন্দর্যের তারিফ করছিলাম।
কী হয়েছিল আপনার?
তার প্রশ্নে চটকা ভেঙে যায়। ধাতস্থ হয়ে বললাম, কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাই। প্রকৃতপক্ষে আমি বোধকরি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম।
তাই বুঝি? আপনার কথা শুনে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'কপালকুণ্ডলা' উপন্যাসে নবকুমারের উদ্দেশ্যে কপালকুণ্ডলার বলা ‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?' উক্তিটি মনে পড়ে যাচ্ছে।
দ্বিধা নিয়ে বললাম, তেমনটা হয়তো নয়। তবে আমি আসলেই পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
তাই বলে এভাবে পাগলের মতো ছুটতে হয়? আর একটু হলে তো পপাত ধরণিতল। শত শত ফুট নিচের একদম গহিনে চিরতরে হারিয়ে যেতেন।
আপনি না থাকলে তো সেটাই সম্ভবত হতে যাচ্ছিল। শেষ মুহূর্তে অলৌকিকভাবে রক্ষা করলেন। সৃষ্টিকর্তা বোধকরি আমাকে রক্ষার জন্য আপনাকে পাঠিয়েছিলেন। আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।
কৃতজ্ঞতা জানানোর কিছু নেই। ভাগ্যিস আপনি আমার সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছিলেন। আমি তো পাহাড়ের ঢালে বসেছিলাম। ধাক্কা খেয়ে ব্যালেন্স হারিয়ে আত্মরক্ষার জন্য আমি আপনাকে জড়িয়ে ধরি। তা না হলে আমিও আপনার সঙ্গে কোথায় হারিয়ে যেতাম। এ কথা বলে হাসি দিয়ে ভরিয়ে তোলে চারপাশ। দেখেন, এখন কত মজা করে হাসছি। অথচ আরেকটু এদিক-সেদিক হলে কোথায় হতো আমাদের ঠাঁই? জীবন আর মৃত্যু কী সুন্দর পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করে। তাই না?
সেটা তো এখানে আসার পথে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছি।
সেটা আবার কেমন?
রাঙামাটির সাজেকের রূপের পসরার কথা কতভাবেই না শুনেছি। কিন্তু আসার পথে যে ভয়ংকর সৌন্দর্য অবলোকন করতে হয়, সে কথা কেউ আমাকে বলেনি। বললে আসতাম কি না সন্দেহ।
কী বলেন! প্রকৃতির অপার্থিব এই সৌন্দর্য আপনার পছন্দ নয়?
তা নয়। এখানে না এলে ঐশ্বরিক এক বৈভব থেকে বঞ্চিত হতাম। কিন্তু আসার সময় গা শিহরানো যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা মোটেও প্রত্যাশিত ছিল না।
কী অভিজ্ঞতা হয়েছে?
মানুষ হিসেবে আমার কিছু অপূর্ণতা আছে। তার মধ্যে হাইফোবিয়া অন্যতম। হাজার হাজার ফুট খাড়া পাহাড় বেয়ে যেভাবে ‘চান্দের গাড়ি’ এসেছে, প্রতিটি মুহূর্ত যেন মৃত্যুর হাতছানি অনুভব করেছি।
আমার কাছে তো খুব রোমাঞ্চকর মনে হয়েছে। ভয়ের অনুভূতি হলেও সেটা আমি বেশ উপভোগ করেছি।
স্বাভাবিক মানুষের তা করারই কথা। আর আপনি তো অসম্ভব সাহসী। আপনার সাহসের প্রশংসা করতেই হয়।
কী এমন সাহস দেখালাম?
যেভাবে আপনি আমাকে পতন থেকে রক্ষা করলেন, সেটা কি কম সাহসের?
ঘটনাচক্রে এমনটি হয়েছে। আমার সাহসের কিছু ছিল না।
এই ভোরবেলা আপনি যেভাবে পাহাড়ের ঢালে একাকিনী বসে ছিলেন, তাতেও বোঝা যায় আপনি যথেষ্ট সাহসিনী। তবে আমি অবাকও হয়েছি। এভাবে কেউ একা বসে থাকে?
হেলিপ্যাডের এই জায়গাটা আমার খুব পছন্দের।
স্থানটা আমারও খুব পছন্দের। আগের দিন বান্ধবীদের সঙ্গে এসেছিলাম। আজ ওরা আসতে রাজি হয়নি। কাছেই আমাদের কটেজ। তাই একা একাই চলে এসেছি। বসে বসে প্রকৃতির অকৃপণ শোভা ও মাধুর্য অনুভব করছিলাম। অবশ্য এক ধরনের শূন্যতার অনুভূতিও হচ্ছিল। ভাবছিলাম জীবন-জগৎ নিয়েও। আর তখনই ঘটনাটা ঘটে যায়।
আমরা এসেছি অফিসের একটা কর্মশালায় অংশ নিতে। যদিও উদ্দেশ্য, রথ দেখা আর কলা বেচা। হেলিপ্যাড থেকে মেঘের সান্নিধ্য নিবিড়ভাবে অনুভব করার জন্য সঙ্গীদের সাথে এসেছিলাম। তারা কখন চলে যায়, টের পাইনি। একটা পর্যায়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে ঘাবড়ে যাই। নিজেকে একা মনে হওয়ার পর বিহ্বল হয়ে পড়ি। এমনটি মনে হলে আমার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এলোমেলোভাবে চলতে গিয়ে আপনার মগ্নতা নষ্ট করে দিই।
আমি আরও আগেই এসেছিলাম। তখন উঠব উঠব করছিলাম।
মেঘবতী, আপনার নিশ্চয়ই প্রাতরাশ সারা হয়নি। এই রেস্তোরাঁয় খিচুড়ি রান্না হয়েছে। তার সুঘ্রাণটা দারুণ। খেতে মজা না হয়ে পারে না। দাঁড়ান, অর্ডার দিয়ে আসি।
আপনারটা অর্ডার দেন। আমার জন্য বান্ধবীরা অপেক্ষায় থাকবে।
আমার কলিগরাও তো অপেক্ষা করবে। তাতে কি? একবেলা নিজের স্বাধীনমতো খাওয়ার আলাদা একটা আনন্দ আছে। তা ছাড়া যে ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল, কেউ আর আমাদের দেখা পেত কি না সন্দেহ। আসুন না, দুজনে একসঙ্গে পেটপূজা করে তা উদযাপন করি।
খিচুড়ির অর্ডার দেওয়ার পর মেঘবতী জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা আপনি আমাকে মেঘবতী নামে ডাকলেন যে!
আপনার নাম তো আমি জানি না। মেঘের রাজ্যে এসে যেভাবে পরিচয় হলো, এ ছাড়া কী নামে আর ডাকতে পারি ম্যাডাম?
আমি ক্যামেলিয়া।
চমৎকার। ফুলের নামে নাম। নামের সঙ্গে চেহারার বেশ সাদৃশ্য আছে।
এর মানে কি?
মানেটা হলো, এখন সন্ধ্যাবেলা হলে কবি শামসুর রাহমানের মতো করে বলা যেত,
‘সন্ধ্যাবেলা ক্যামেলিয়া হাতে নিয়ে বলতেই পারো, ফুল তুই আমার/তবু ফুল থাকবে নীরব নিজের সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে।'
বাহ। আপনি তো দারুণ রোমান্টিক।
কিছু মনে করবেন না ম্যাডাম। না বলে পারছি না। এমন একটা পরিবেশ, এমন একটা নাম, এমন একজন সুন্দরী মানবীর সংস্পর্শে এলে যে কেউ রোমান্টিক হতে বাধ্য। আর ঘুরতে এলে সবার মন হয়ে যায় আকাশের মতো বিস্তৃত।
এ কথা শুনে প্রাণখুলে হাসতে থাকে ক্যামেলিয়া। তার হাসিটা অনেক সুন্দর। মনের সব আবিলতা নিমেষেই দূর হয়ে যায়।
এমন সময় উপস্থিত হন কাছাকাছি বয়সের তিনজন নারী। ক্যামেলিয়ার কাছে এসে বললেন, তোকে আমরা খুঁজে খুঁজে হয়রান। আর তুই এখানে বসে দিব্যি আড্ডা মারছিস?
ক্যামেলিয়া কিছু বলার আগেই বললাম, দোষটা আমার। আমি উনাকে বসিয়ে রেখেছি। তার কাছে চিরজীবনের জন্য ঋণী হয়ে গেছি। ঋণ তো আর শোধ করতে পারব না। তাই আপনাদের বান্ধবীর সান্নিধ্যে ঋণের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে চলেছি। এই ঋণ শোধ করার ইচ্ছেও নেই। বরং তার কাছে চিরকাল ঋণী হয়ে থাকতে চাই।
আমার কথার কিছুই বুঝতে না পেরে তারা একে অপরের দিকে তাকায়।
আপনারা হয়তো আমার কথা শুনে আমাকে ছিটগ্রস্ত ভাবছেন। সেটাই ভাবার কথা। সাধারণত এভাবে কথা বলি না। আজ আবেগতাড়িত হয়ে বলছি। কেন এই আবেগ, সেটা আপনাদের বান্ধবীর কাছেই জানতে পারবেন।
এ কথা শুনে তাদের চোখে-মুখে খেলে যায় বিস্ময়। বুঝতে পারি, তাদের কৌতূহল অনেক বেড়ে গেছে।
ক্যামেলিয়া তাদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। ঝিলমিল, পারভীন আর রাফিয়া। চার বান্ধবীই চাকরিজীবী। আপাতত কোনো বন্ধন নেই। ঝাড়া হাত-পা হয়ে ঘুরতে এসেছেন। পরিচয় পর্ব সারা হতেই ফের দেখা হওয়ার কথা বলে তারা বিদায় নিয়ে চলে যায়। তারপর তাদের কারও সঙ্গে আর দেখা হয়নি। কারও কোনো কন্ট্রাক্ট নম্বর না থাকায় যোগাযোগেরও সুযোগ ছিল না। এরপর অনেক দিন পেরিয়ে যায়। ক্যামেলিয়া হয়ে যায় স্মৃতির অংশ।
একদিন হঠাৎ ফেসবুকের টাইমলাইনে ভেসে উঠে ক্যামেলিয়াদের চার বান্ধবীর হাস্যোজ্জ্বল ছবি। ছবির মানুষদের চিনতে মোটেও বেগ পেতে হয় না। সাজেকের কংলাক পাহাড়ের শীর্ষে তোলা ছবিটিতে সবাই দেখাচ্ছেন ভিক্টরি চিহ্ন। পেছনে মেঘ আর পাহাড়ের লুকোচুরি। আলাদাভাবে নজর কাড়ে ক্যামেলিয়া। তার চোখ দুটি যেন হাসছে। ছবিটি দেওয়া হয়েছে ক্যামেলিয়ার বান্ধবী ঝিলমিলের টাইমলাইনে। টাইমলাইনটি স্ক্রল করতে করতে দেখতে পাই একটা স্ট্যাটাসে লেখা, ‘আমরা চার বান্ধবী ঘুরতে গিয়েছিলাম মেঘের রাজ্য সাজেকে। মেঘ আর পাহাড়ের সান্নিধ্যে আমরা যেন ফিরে গিয়েছিলাম কিশোরী বেলায়। বেশ মজা করছিলাম। বিশেষ করে ক্যামেলিয়া যেন চঞ্চলা চড়ুই পাখি হয়ে যায়। এমনিতেই ও আমাদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল, উচ্ছল ও স্ফুর্তিবাজ। কিন্তু কিছুদিন আগে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে ওর ব্যক্তিগত জীবনটা ওলটপালট হয়ে যায়। কেমন যেন বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে। মূলত ওকে কিছুটা মানসিক শান্তি দেওয়ার জন্য আমরা এই প্রোগ্রাম করেছিলাম। সাজেকে গিয়ে ওর মনের বিষাদ অনেকটাই কেটে যায়। মেতে ওঠে দারুণ হাসি-খুশিতে। একদিন তো হেলিপ্যাড থেকে গড়িয়ে পড়তে থাকা এক ভদ্রলোককে ও কীভাবে যেন বাঁচিয়ে দেয়। এ ঘটনা ওকে দারুণভাবে উদ্বেলিত, উজ্জীবিত করে। কষ্টকর হলেও পরদিন আমরা ১৮০০ ফুট উঁচু কংলাক পাহাড়ে ওঠি। এটা ছিল আমাদের জন্য গৌরবময় একটি ঘটনা। নিজেদের বেশ দিগ্বিজয়ী মনে হতে থাকে। পাহাড় থেকে নামার সময় হঠাৎ বৃষ্টি নামে। পিচ্ছিল হয়ে যায় পথ। আমরা একটু রয়েসয়ে নামতে থাকি। কিন্তু কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে দুরন্ত হরিণীর মতো নামতে থাকে ক্যামেলিয়া। আমরা ওকে সাবধানে নামতে বললে ও খিলখিল করে হাসতে হাসতে ছুট লাগায়। তারপর আমাদের চোখের সামনে ছিটকে পড়ে পাহাড়ের গহিনে। তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। যে ক্যামেলিয়া আগের দিন একজন মানুষকে রক্ষা করেছে, সে পর দিন নিজেকে রক্ষা করতে পারল না। নাকি সে নিজেকে রক্ষা করতে চায়নি। আমি জানি না, ক্যামেলিয়া কেন এমন করল?”
স্ট্যাটাসটি পড়ার পর কষ্টকর অনুভূতি হতে থাকে। স্মৃতি হয়ে যাওয়া ক্যামেলিয়া যেন আমাকে চিরদিনের জন্য তার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন