ইন্টারনেটের দুনিয়ায় পুরো পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়। তারপরও কথা থেকে যায়, মুঠোটা কতটুকু উম্মুক্ত করা হয়েছে? অর্থাৎ আমাদের কতটা জানতে দেওয়া হয়? সহজাতভাবেই অনুধাবন করা যায়, পুরোপুরি নিশ্চয়ই নয়। যাঁরা এটা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁদের জানা-শোনার পরিধি স্বাভাবিক কারণেই অনেক বেশি। তাঁরা তো আর সব কিছু উম্মুক্ত করে দেবেন না। ব্যবসায়িক কারণে তাঁরা একটু একটু করে মুঠোটা আলগা করেন। আর নিরাপত্তা কিংবা অন্য কোনো কারণে অনেক কিছু হয়তো আড়াল রাখা কিংবা গোপনে নজরদারি করা হয়। সার্চ ইঞ্জিন গুগল কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক যা ক্ষমতা রাখে, তা তো রীতিমতো বিস্ময়কর। এটা মনে হতেই পারে, কারো কাছে যদি মোবাইল নাও থাকে, তাঁর অবস্থান তো খুবই মামুলি ব্যাপার, তিনি প্রতি মুহুর্তে কী করছেন, সেটা জানতে পারা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এমনকি প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে তাঁর কার্যক্রমের ফুটেজ সংরক্ষণ করা যায়। যখন যাঁরটা প্রয়োজন হচ্ছে, তাঁরটা হয়তোবা নেওয়া হচ্ছে। গুগল দিয়ে যদি সারা দুনিয়া ঘুরে আসা যায়, তাহলে আরো কত কিছু করা সম্ভব, সেটা লেখার অপেক্ষা রাখে না। স্যাটেলাইট দিয়ে কত কত দূরকে কাছে নিয়ে আসা হচ্ছে। আর কাছকে অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের চলাচলকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা কী আর এমন কঠিন? যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা ‘নাসা’ এবং প্রযুক্তির আবাসভূমি হিসেবে পরিচিত ‘সিলিকন ভ্যালি’তে নিত্য-নতুন কী কী সংযুক্ত হচ্ছে, আমরা তার কতটুকু জানি? তারা যতটুকু জানায়, তার বাইরে তো জানার সুযোগ নেই। আমরা যা কল্পনা করি, সেটা হয়তো তাদের কাছে বাস্তব।
ইন্টারনেট প্রযুক্তির বয়স খুব বেশি দিনের নয়। এখনই যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে মানবজাতিকে, আগামীতে কী হতে পারে, সেটা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। তখন তো ব্যক্তিগতভাবে এত প্রযুক্তিরও প্রয়োজন পড়বে বলে মনে হয় না। সব কিছু পরিচালিত হতে পারে ইশারা-ইঙ্গিতে। ভাষাগত কোনো সমস্যাই থাকবে না। নিয়ন্ত্রণ করবে দেহের ভিতর বা বাইরে থাকা এক চিলতে চিপস বা সফটওয়্যার। সেটাই হবে সব ক্ষমতার উৎস।
তবে আমার কেন যেন মনে হয়, আমাদের ফেলে আসা জীবনের ‘ফুটেজ’ও পুনরুদ্ধার করাও অসম্ভব হবে না। এখন যেমন ইউটিউবে পছন্দমাফিক কত কিছু দেখা যায়। আগামীতে এমনও হতে পারে, হয়তো পূর্ব পুরুষদের কারো কোনো ফুটেজ দেখতে মন চাইলো, সহজেই তা দেখা যাবে। কী আলাপ করছেন, সেটাও শোনা যাবে। প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শনের মাধ্যমে যেভাবে পৃথিবী বা মানবসভ্যতার ইতিহাস অনুসন্ধান করা হয়, তখন ফুটেজ দিয়ে তা সহজেই করা সম্ভব হতে পারে। যদিও ইউটিউবে ফুটেজ কাউকে না কাউকে আপলোড করতে হয়। কিন্তু আগামীতে যে ‘ফুটেজ’ পুনরুদ্ধার করা যাবে, তা হতে পারে ন্যাচারাল। তার আপলোডার তো প্রকৃতি স্বযং। বিষয়টা হয়তো অবাস্তব মনে হচ্ছে। এখন আমরা ইন্টারনেট, গুগল বা ফেসবুক যেভাবে ব্যবহার করছি, পঞ্চাশ বছর আগে এটা কি বাস্তব হিসেবে কেউ ভাবতে পেরেছিলেন?
আগামীতে এমনও হতে পারে, জন্মের পর সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে ভার্চুয়াল বা ভি. ভ্যাকসিন দেওয়া হবে। এই টিকা দেওয়া হলে আলাদাভাবে কোনো কিছু সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়বে না। খুবই ছোট দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, বিদেশে যেতে পাসপোর্ট তো দূরে থাক, বিদ্যমান নিরাপত্তা ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হবে না। অফিস-আদালতের বিদ্যমান অবকাঠামো ও সিস্টেম একদমই থাকবে না। চিকিৎসকের কাছে যাবার প্রয়োজন পড়বে না। এই কার্যক্রম তো আমরা এখনই কিছুটা দেখতে পাচ্ছি। করোনা তো বটেই, যে কোনো ভাইরাস শরীরে অনুপ্রবেশ কিংবা দেহের কোথাও সামান্য গড়বড় করলে অনায়াসেই বুঝতে পারা যাবে। সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। প্রত্যেকের আইডি হিসেবে ব্যবহৃত হবে ভার্চুয়াল ভ্যাকসিন বা ভি.ভি. নাম্বার। টিকা দেওয়ার সময় এ নাম্বারটি সরবরাহ করা হবে। সেটা দিয়েই সারা যাবে যাবতীয় কাজ-কর্ম।ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কতটা থাকবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। যদিও এখনই তো গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। সবটাই তো জানতে পারছি না। কিছুটা পারছি। হাতে একটা মোবাইল থাকলে, ফেসবুক কিংবা কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংযুক্ত এবং গুগল কিংবা কোনো সার্চ ইঞ্জিনে ঢুকলেই নজরদারির আওতায় চলে যেতে হয়। গুগল বা ফেসবুক তো এখনই মানুষকে চিনতে পারে। তাঁর মন পড়তে পারে। কণ্ঠ বুঝতে পারে। এখন যেমন গুগল, ফেসবুক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রত্যেক নাগরিকের অনেক গোপন তথ্য সংরক্ষণ করা হয়, তখনও হয়তোবা তেমনটি হতে পারে। এ নিয়ন্ত্রণ থেকে পুরোপুরিভাবে মুক্তি পাওয়া সহজ হবে না। কিন্তু কেউ বিদেশে গেলে, চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ কিংবা অফিস-আদালত করলে সেক্ষেত্রে যেখানে যতটুকু তথ্য জানানোর প্রয়োজন হবে, ততটাই জানানোর ব্যবস্থা হয়তো থাকবে। সেভাবেই নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হবে। সেটা করা হবে ব্যবসায়িক কারণেই। আর সব কিছু যদি উম্মুক্ত হয়ে যায়, তাহলে মানুষের গোপনীয়তা বলতে কিছুই থাকবে না। তা যদি না থাকে, সেটা হবে নতুন এক জগত। গোপনীয়তামুক্ত সেই জগত কেমন হতে পারে, তা নিয়ে অবশ্য নতুন করে ভাবতে হবে। তবে সেটাও নেহাত মন্দ নয়। এখন হয়তো কিছু মানুষ বেশিরভাগের গোপনীয়তা জানছেন। তখন সবাই সবারটা জেনে যাবেন।
সবাই মিলে সমস্বরে গাইতে পারবো,
আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার
রাজত্বে---
কিন্তু সেটা কি কোনো রাজা হতে দেবেন?
২২ এপ্রিল ২০২০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন