পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

রবিবার, ২০ নভেম্বর, ২০১৬

প্রতিশোধ




১.
ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমে মানিক মিঞা এভিনিউর গোল চক্করের কাছে দাঁড়িয়ে কুল কুল করে ঘামতে থাকে আবির। অনেকক্ষণ রিক্সা না পেয়ে আস্তে-ধীরে চড়ছিল মেজাজ। দুপুরের এই সময় রিক্সা-বদলি হওয়ায় প্রায়শই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ভারি বিশ্রী ব্যাপার। হেঁটে রওয়ানা দেবে কিনা ভাবতে থাকে। উপর থেকে তাকে দেখলে যতটা শান্ত-শিষ্ট মনে হয়, আসলে তেমনটি সে নয়। কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করা তার ধাতে নেই। রিক্সা না পেয়ে হেঁটে গন্তব্যস্থানে যাওয়া তার কাছে মামুলি ব্যাপার। বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করে যথারীতি হাঁটতেই থাকে। কিছুটা পথ হাঁটার পর আচমকা পাশে এসে দাঁড়ায় টকটকে লাল রঙের একটি টয়োটা গাড়ি। গা ঘেঁষে দাঁড়াতেই মেজাজ আরো বিগড়ে যায়। যুৎসই একটা খিস্তি ঝাড়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে, ড্রাইভিং সিটে বসা সুদর্শন এক যুবক। তার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। চোখে কালো রঙের গাঢ় সানগ্লাশ। ছোট করে ছাঁটা চুল। হাল ফ্যাশনের হালকা নীল গেঞ্জি গায়ে।
কিরে দোস্ত, চিনতে পারছিস না?
বলেই সানগ্লাশটা খুলতেই যুবকটিকে আবিরের চেনা চেনা মনে হতে থাকে। কোথায় যেন দেখেছে। একটা ধন্দে পড়ে যায়। তার স্মৃতিশক্তি এত বেশি দুর্বল কোনো কিছুর ধারণক্ষমতা খুবই কম। সহজে কোনো কিছু মনে করতে পারে না। এজন্য জীবনে তাকে অনেক বার সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কিরে শালা, চিনলি না। আমি মোহন। এবার আর চিনতে ভুল হয় না। অনেক দিন পরে দেখা। স্কুল জীবনের বন্ধু। স্কুল ছাড়ার পর এই প্রথম দেখা হলো। কম দিন তো আর পার হয়নি। চেহারা-ছুরতও অনেক বদলে গেছে। এ কারণে চিনতে একটু বেগ পেতে হলো।
কিরে, কই যাবি? এই ভর-দুপুরে হেঁটে হেঁটে যাস কই?
আগের জায়গায় আছিস নাকি? ওঠ, গাড়িতে ওঠ। বাসায় পৌঁছে দেই।
একটুখানি উসখুস করলেও গাড়িতে ওঠে পড়ে আবির। দীর্ঘ প্রায় দশ বছর পর দেখা হওয়ায় কথার ফোয়ারা যেন ছুটতে থাকে। মোহন আগে থেকেই খুব মিশুক। যে কোনো আসর সহজেই মাতিয়ে তুলতে পারে। অপরিচিতকে আপন করে নেওয়ার সহজাত ক্ষমতা আছে। কথায় কথায় অনেক কিছু জানা গেল। মোদ্দা কথা হলো, ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার পর ইউ.এস.এ চলে যায়। জমিয়ে ব্যবসা করছে। সেখানকার গ্রিন কার্ড হোল্ডার। বাবা-মায়ের পীড়াপীড়িতে বিয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকায় এসেছে। বিয়েও ঠিক-ঠাক। সপ্তাহখানেক পর বিয়ের অনুষ্ঠান। গাড়ীতে রাখা বিয়ের একটি কার্ড দিয়ে আমন্ত্রণ জানালো। বিয়েতে থাকার সম্মতি আদায় করে নেয়। মোহনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওর উন্নতির কথা চিন্তা করছিল আবির। কি ছিল আর এখন কী হয়েছে? এক সময়কার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর পরিবর্তনে ভালই লাগলো।

২.
আবির বিয়েতে যাবে না ভেবেছিল। কথা দেওয়ায় না গিয়ে পারলো না। বিশাল আয়োজন। পাত্রী পক্ষের অঢেল ঐশ্বর্য প্রকাশ পাচ্ছিল। ঢাকার এলিটদের মধ্যে অনেককে দেখা গেল। বিয়েতে বেশ ক’জন পুরানো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়ার পর বন্ধুরা মিলে মোহনের বউকে দেখার জন্য যায়। এ বিষয়ে আবিরের কোনো আগ্রহ না থাকলেও বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে তাকেও যেতে হয়। পাত্রীকে দেখে তার দেহের রক্ত চলকে ওঠলো। শরীরটা অবশ অবশ লাগতে থাকে।
বছর চারেক আগের হলেও এখনও তার বুকে ভিডিও ক্যাসেট হয়ে আছে সেদিনের সেই ঘটনাটি। গণভবন এলাকার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরতে একটু রাত হয়ে যায়। শীতের কারণে সন্ধ্যা রাতটাকে একটু গভীর মনে হতে থাকে। কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ। রাস্তায় লোক চলাচল নেই বললেই চলে। গণভবন থেকে যে রাস্তাটা কৃষি কলেজের পাশ দিয়ে গেছে, সেটা এমনিতে নির্জন। রিক্সা না পেয়ে হেঁটে হেঁটে আসছিল আবির। উল্টো দিক থেকে আসা একটি প্রাইভেট কার আচম্বিতে তার পাশে ব্রেক কষতেই বুকটা দুরু দুরু করে ওঠে। যদিও সাথে তেমন কিছু নেই। বাপের দেওয়া সিকো ফাইভ ঘড়ি আর খুচরো কিছু টাকা-পয়সা ছাড়া। তবে প্রাণটা নিয়ে একটু ভয় খেয়ে যায়। জানের মায়া বলে কথা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই কালো আলখেল্লায় ঢাকা তিন জন নেমে এসে তাকে ঘিরে ধরে। দু’জনের হাতে পিস্তল। আরেক জনের হাতে চকচকে একটি ক্ষুর। গাড়ি স্টার্ট দেওয়া অবস্থায় ড্রাইভিং সিটে বসে আরেক জন। রীতিমতো ফিল্মি স্ট্যাইল। ভয়ে সিটিয়ে যায় আবির। আগন্তুকদের তিন জন ধাক্কা মেরে তাকে গাড়ীর পিছনের আসনে বসিয়ে দেয়। পিস্তলধারী দু’জন তার দুই পাশে বসে থাকে কোমরে পিস্তল ঠেকিয়ে। পুরো বিষয়টি ঘটতে থাকে একদমই নিঃশব্দে। আদেশ-নির্দেশ যা কিছু হচ্ছিল আকার-ইঙ্গিতে।
পলকের মধ্যে গাড়ি চালিয়ে দেয়। গাড়ীর রঙিন কাঁচ ওঠানো থাকলেও সামনের আসনে বসা ক্ষুরধারী একটি কালো কাপড় দিয়ে আবিরের চোখ বেঁধে দেয়। তারপর তিন জনে মিলে তার হাত দু’টিকে পিছমোড়া করে বাঁধে। চার জনের একজনও কোনো কথা বলছিল না। যা বলছিল পিস্তল আর ক্ষুর। চোখ ও হাত বাঁধা থাকায় বসতে কষ্ট হওয়ায় একটু নড়াচড়া করতেই পেটের কাছে শক্ত কিছু দিয়ে সজোরে আঘাত করতেই কুঁকড়ে যায় আবির।
তাদের উদ্দেশ্য কি, ঠিক বুঝতে পারে না। তাকে নিয়ে অনাহুত বেশ কিছুক্ষণ ঘোরঘোরির পর এক সময় বুঝতে পারে, গাড়িটি বোধহয় কোনো বাড়ির সীমানায় ঢুকলো। গাড়ি থেকে তাকে নামিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানো হলো। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আবিরের চিরদিনের অভ্যাস সিঁড়ি দিয়ে গুনতে গুনতে ওঠা। একুশটি সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে। হঠাৎ একটি কুকুরের কর্কশ চিৎকারে বুকটা দারুণভাবে কেঁপে ওঠে। ওকে একটি ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করার শব্দ পেল। এরপর একটি বিছানায় তাকে শুইয়ে দিয়ে প্রথমে পা দু’টিকে, তারপর হাত দু’টিকে বিছানার চারপাশে শক্তভাবে বাঁধা হতেই সম্মিলিতভাবে মেয়েলি কণ্ঠ শুনতে পায়। ওর বোধশক্তি লোপ পাওয়ায় ও আসলে কোনো কিছু বুঝে ওঠতে পারছিল না। একটা রহস্যের মধ্যে হাবুডুবু খেতে থাকে।
এক ঝটকায় মুখের বাঁধন খুলে দিতেই দেখতে পেলো, প্যান্ট-শার্ট পরা অদ্ভুত সুন্দর চার জন স্মার্ট তরুণী তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। সে কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে থাকলো ফ্যাল ফ্যাল করে। ঘটনার আকস্মিতায় ও আসলে বিমূঢ় হয়ে যায়। অদূরে ভয়ঙ্কর চেহারার কালো কুচকুচে একটি অ্যালসেশিয়ান কুকুর তীক্ষè দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। সুযোগ পেলেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায়। ঘরটা দামি আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। দরজা-জানলা বন্ধ। ভারী পর্দা নামানো থাকায় বাইরের কোনো কিছু ঠাওর করা যাচ্ছিল না। সারা বাড়ি কেমন যেন চুপচাপ। কোথাও কোনো সাড়া-শব্দ নেই। দেওয়াল ঘড়ির মিষ্টি শব্দে বুঝতে পারলো রাত বাড়ছে।
এরপরের ঘটনার জন্য আবির মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ঘরে রাখা ফ্রিজ থেকে দু’টি বোতল ও গ্লাস বের করা হলো। লেবেল দেখে হুইস্কির বোতল চিনতে অসুবিধা হলো না। চার জনে চিয়ার্স বলে একটু একটু করে হুইস্কি পান করতে থাকে। সঙ্গে গরুর ভুনা মাংস। আবিরকে পেট ভরিয়ে হুইস্কি পান করানো হয়। একটু একটু করে দুলে ওঠতে থাকে ও। এ সময় ভিসিআরে চালিয়ে দেওয়া হয়। তাতে থ্রি এক্সের রমরমা নীলাভ দৃশ্যাবলী। একটি দৃশ্যে এক তরুণকে নিয়ে চার তরুণীর শারীরিক পীড়ন। তরুণের বুকফাটা আর্তনাদে তাদের বিকৃত উল্লাসকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল। দৃশ্যটা সইতে না পেরে চোখ সরিয়ে নেয় আবির। মাথাটা ঝিম ঝিম করতে থাকে। তারপরের ঘটনার জন্য ও মোটেও প্রস্তুত ছিল না। ভিসিআরে দেখা দৃশ্যের মতো অবিকল ঘটে যায় বাস্তবে। দৃশ্যপটের নায়িকাদের মধ্যে একজন বললেন, এ হলো প্রতিশোধ। এতদিন ছেলেরা মেয়েদের ওপর জোর-জবরদস্তি, নিপীড়ন, শ্লীলতাহানি করে এসেছে। মেয়েরা সহ করেছে মুখ বুজে। এখন থেকে এর জবাব দেওয়া হবে।
তারপর তাকে কীভাবে বাসা থেকে বের করে আনা হয়, তা একটুও বুঝতে পারে নি। শরীরে কোনো অনুভূতি ছিল না। যখন কিছুটা হুঁশ হয়, নিজেকে সেই রাস্তার ধারে দেখতে পায়। রাত তখন অনেক গভীর। পকেটে হাত দিয়ে দেখে পাঁচ শত টাকার আনকোরা চারটি নোট।

৩.
কিরে! ঝিম মেরে আছিস কেন? ভাবীর সঙ্গে একটু কথা-টথা বল। তুই শালা আগের মতো চুপচাপ রয়ে গেলি। বন্ধুদের কথাগুলো কানে যেতেই স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করলো আবীর। নববধূর দিকে তাকিয়ে সেদিনের কথা বলা মেয়েটির ছবি ভেসে ওঠলো। তারপর নববধূর দিকে তাকিয়ে বুকের মধ্যে জমিয়ে রাখা ভিডিও ক্যাসেটটা মুছে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। সিঁড়ির একুশটি ধাপ বেয়ে নামতে নামতে তার মুখে ফুটে ওঠলো এক টুকরো মৃদু হাসি।    

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন