পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

রবিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৬

সৃষ্টিশীল একজন মানুষের নীরব প্রস্থান

আগস্ট এলেই বুকটা বড্ড কেঁপে ওঠে। বড় নিষ্ঠুর এই মাস। কাকে কখন ছিনিয়ে নেবে, সেই আতঙ্কে থাকতে হয়। নেয় এমন সব ব্যক্তিত্বকে, যারা আমাদের দেখান আলোর পথ। তেমনি একজন ব্যক্তিত্ব চলচ্চিত্রকার আখতারুজ্জামান। ২৩ আগস্ট অনেকটা নীরবে, নিভৃতে চলে গেলেন সৃষ্টির নেশায় মশগুল থাকা এই মানুষটি। তেমনভাবে আলোচিত নন, তবে আলোকিত একজন মানুষ। তাকে যারা চেনেন কিংবা তার কাজের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা জানেন, শিল্পের প্রতি তার ছিল কী প্রগাঢ় আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও ভালোবাসা। আত্মমগ্ন ও অভিমানী এই মানুষটি কখনোই প্রচারের আলোয় থাকেননি। কত কত জনকে পৌঁছে দিয়েছেন খ্যাতির সিংহাসনে, আর দূর থেকে তা দেখে মিটি মিটি হেসেছেন। নিজে কখনো সিংহাসনে বসতে চাননি। আত্মমর্যাদাশীল এই মানুষটি অনেক সুযোগ থাকার পরও কখনোই কারো কাছে করুণা চাননি। তেমনটি করলে তিনি হতে পারতেন আলোচিত ও ঐশ্বর্যম-িত। যতটুকু করেছেন, সবটাই নিজের যোগ্যতা আর সামর্থ্য দিয়ে। যতটা করেছেন, তারচেয়ে অনেক বেশি করার স্বপ্ন নিয়ে ছটফট করতেন। সেটা করতে না পারার অসহায়তা তাকে অস্থির করে রাখতো।
বাংলার বাণী ভবন থেকে প্রকাশিত হত ‘সাপ্তাহিক সিনেমা’। চলচ্চিত্র বিষয়ক এ পত্রিকাটি নতুন করে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৮৫ সালে পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক হয়ে আসেন আখতারুজ্জামান। ‘সাপ্তাহিক চিত্রালী‘র সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তখন তার বেশ সুখ্যাতি। তার নেতৃত্বে শুরু হয় ‘সিনেমা’ পত্রিকার নবযাত্রা। সেই নবযাত্রার তার সঙ্গে ছিলেন ফাল্গুনী হামিদ, শামীম আলম দীপেন, শাহনেওয়াজ করিম, মুজতবা সৌদ, গুলজার, খান আখতার হোসেন, অশোক দত্ত, মৃদুল সাহা। ১৯৮৭ সালে কর্মরত ছিলাম ‘দৈনিক বাংলার বাণী’ পত্রিকায়। এরশাদ সরকার রাজনৈতিক কারণে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। আমরা সবাই হঠাৎ বেকার হয়ে যাই। ‘বাংলার বাণী’তে কর্মরত আমরা কেউ কেউ ‘সিনেমা’ পত্রিকাটির সঙ্গে সম্পৃত্ত হই। সে সময় তাকে কাছ থেকে দেখার ও জানার কিছুটা সুযোগ হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি যখন ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকায় যোগ দেন, তখন তাকে পাই আরো কাছে। একটু একটু করে চিনতে পারি আত্মকেন্দ্রিক ও লাজুক স্বভাবের এই মানুষটিকে। একজন উদ্যমী, সৃষ্টিশীল, মেধাবী ও প্রাণোচ্ছ্বল মানুষ বলতে যেমনটি বোঝায়, তিনি ছিলেন তেমনই। আপনভোলা, আনমনা এই মানুষটিকে মগ্নচৈতন্যে কী যেন শিস্ দিয়ে যেত। কাজ করতে করতে হঠাৎ কোথায় যেন ডুব দিতেন। হয়ে যেতেন অন্য এক জগতের বাসিন্দা। তার মিষ্টি হাসিটি যে কারোই মন জয় করে নিত। বুকের মধ্যে বসবাস করতো একজন রোমান্টিক প্রেমিক পুরুষ। কাজপাগল এই মানুষটিকে খুঁজে পাওয়া যেত তার কাজে, কর্মে, সৃষ্টিশীলতায়। সব সময় বিভোর থাকতেন সৃষ্টির আনন্দে। পত্রিকার মেক-আপ, গেট-আপ বর্ণিল করার ব্যাপারে তার জুড়ি মেলা ছিল ভার। চলচ্চিত্র সাংবাদিক হয়েও চটকদার কোনো কিছুতেই বিশ্বাসী ছিলেন না। গসিপ দিয়ে পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর পক্ষপাতি ছিলেন না। ছিলেন না বলেই চলচ্চিত্র অঙ্গনের সবাই তাকে সমীহ করতেন। আপন ভাবতেন। অনেকেই ছুটে আসতেন তার পরামর্শ ও সহযোগিতার জন্য। তার সঙ্গে যারা মিশেছেন, তাকে যারা দেখেছেন, তাকে ভালো না বেসে পারেননি। নিখাদ একজন আত্মভোলা মানুষ ছিলেন তিনি। কোনো আত্মঅহমিকা ছিল না। তিনি ছিলেন নির্ভেজাল ও নির্বিরোধী।
১৯৪৬ সালের ১০ ডিসেম্বর নরসিংদীতে আখতারুজ্জামানের জন্ম। সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে সাংবাদিকতা করেছেন বিভিন্ন পত্রিকায়। তবে চলচ্চিত্রের প্রতি ছিল তার একটা ভালোবাসার টান। এ কারণেই চলচ্চিত্রের অন্যতম পুরনো পত্রিকা ‘চিত্রাকাশ’ দিয়ে তার হাতেখড়ি হয় ১৯৬৬ সালে। এরপর কাজ করেছেন  পিপল, নেশন, দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক চিত্রালী, সাপ্তাহিক সিনেমা, দৈনিক বাংলার বাণী, দৈনিক মুক্তকণ্ঠ, দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায়। তবে চলচ্চিত্র সাংবাদিক হিসেবেই তার পরিচিতি। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস)-র সাধারণ সম্পাদক হন। লেখার হাতটি ছিল অসম্ভব মিষ্টি। যা লিখতেন তাতে পাওয়া যেত ভিন্ন রকমের আমেজ। চলচ্চিত্রের প্রতিই ছিল তার অনুরাগ ও আবেগ। এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। সাংবাদিকতার পাশাপাশি নতুন কিছু করার আশায় নির্মাণ করেছেন সিনেমা। ১৯৮৩ সালে বন্ধু সাংবাদিক রফিকুজ্জামানকে নিয়ে যৌথভাবে নির্মাণ করেন ‘ফেরারী বসন্ত’। এ ছবিটি শ্রেষ্ঠ পরিচালকসহ বাচসাসের ছয়টি পুরস্কার পায়। পরের বছর এককভাবে পরিচালনা করেন ‘প্রিন্সেস টিনা খান’। এটি শ্রেষ্ঠ পরিচালকসহ বাচসাসের আটটি পুরস্কার লাভ করে। এরপর নির্মাণ করেন লেখক মঞ্জু সরকারের উপন্যাস ‘নগ্ন আগন্তুক’ অবলম্বনে ‘একাই এক শ’। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ছবিটি আজও মুক্তির আলো দেখতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে তার জীবনের সেরা ছবি লেখিকা সেলিনা হোসেনের কাহিনী অবলম্বনে ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’। সরকারি অনুদানে নির্মিত হয় ছবিটি। কাহিনী বিন্যাসে গতিময়তা, সুঅভিনয় ও নির্মাণক্ষেত্রে সার্বিক নৈপুণ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্র তীরবর্তী মানুষের জীবনকে সঠিক ও পরিচ্ছন্নভাবে তুলে ধরার জন্য ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ সেরা ছবি হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়। এছাড়া সেরা পরিচালক, সেরা কাহিনী ও সেরা চিত্রগ্রাহক বিভাগেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় এই ছবিটি। একইসঙ্গে পায় বাচসাসের ১০টি পুরস্কার। এত এত পুরস্কার পাওয়ার পরও চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য তিনি কারো আমন্ত্রণ পাননি। যে কারণে নিজেও আর সেভাবে তাগিদ অনুভব করেননি। কারো কাছে ধর্ণা দেওয়া তার স্বভাবের সঙ্গে যায় না। এ কারণে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন মেধাবী চলচ্চিত্রকার হয়েও তাকে চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে নির্বাসনে থাকতে হয়। দীর্ঘ সময় চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও একদমই চুপচাপ বসে থাকেননি। বেশ কয়েকটি নাটক ও টেলিফিল্ম নির্মাণ করেছেন। জড়িয়েছেন শিক্ষকতার সঙ্গে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। চলচ্চিত্র নিয়ে তার স্বপ্ন ও কল্পনা চারিত করেছেন তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ে। এ সময় তার সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়। যখনই দেখা হয়েছে দেখেছি, হাতে কোনো না কোনো বই। দারুণ পড়–য়া ছিলেন তিনি। জানা-শোনার পরিধি ছিল অনেক। প্রচলিত ছকের চলচ্চিত্র ধারার প্রতি তার আগ্রহ ছিল না। সব সময় ভিন্নধর্মী কিছু করতে চাইতেন। চলচ্চিত্র তাত্ত্বিক হিসেবে তার একটা সুখ্যাতি ছিল। তার মুখে অহরহই শুনতাম আলফ্রেড হিচকক, সের্গেই আইনস্টেইন, চার্লি চ্যাপলিন, ফেদরিকো ফেলিনি, আকিরা কুরোসাওয়া, ইনগমার বার্গম্যান, জাঁ রেঁনোর মত দুনিয়া কাঁপানো চলচ্চিত্রকারদের নাম। তার সঙ্গে নিয়মিত আড্ডা দিতে আসতেন ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’ খ্যাত শেখ নিয়ামত আলী, ‘সুরুজ মিঞা’ খ্যাত কাজল আরেফিন, সুরকার শেখ সাদী খানের মত ব্যক্তিরা।
চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে দূরে থাকলেও তিনি কখনো থেমে থাকেননি। ভেতরে ভেতরে চলতে থাকে তার প্রস্তুতি। দীর্ঘ মানসিক প্রস্তুতির পর সরকারি অনুদান নিয়ে শুরু করেছিলেন ‘সূচনা রেখার দিকে‘। ছবিটির ৯০ ভাগ কাজ শেষ করেছিলেন। অসুস্থতার কারণে বাকিটা করতে পারেননি। ছবিটাই শুধু অসম্পূর্ণ রয়ে গেল না, সেসঙ্গে অসম্পূর্ণ থাকলো তার অনেক স্বপ্ন। আমরা হারালাম একজন স্বাপ্নিক ও সৃজনশীল মানুষকে।
(২০১১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন