পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

মঙ্গলবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৬

রাজা নেই, রাজত্ব নেই, আছে শুধু রাজপ্রাসাদ



কোথায় যে ইতিহাসের কী উপাদান লুকিয়ে আছে, আমরা অনেকেই জানি না। না জানার কারণে আমাদের আড়ালে রয়ে যায় অমূল্য সব সম্পদ। অনেক সময় হারিয়েও যায়। ধসে যায়। বিলুপ্তও হয়ে যায়। প্রত্মতাত্ত্বিক সম্পদকে সব দেশেই যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়। এমনভাবে সংরক্ষণ করা হয়, যা হয়ে ওঠে দর্শনীয়। তা দেখার জন্য দূর দূরান্ত থেকে অনেকেই ছুটে যান। সেখান থেকে তুলে আনেন অনেক হারিয়ে যাওয়া তথ্য ও ইতিহাস। আর কিছু না হোক, অন্তত চোখের দেখায় তো পরিতৃপ্ত হওয়া যায়। পাওয়া যায় গৌরবময় অনুভূতি। সেদিক থেকে আমরা বেশ পিছিয়ে আছি। আমাদের দেশেও রয়েছে অনেক প্রত্মতাত্ত্বিক সম্পদ। কিন্তু সংরক্ষণ ও পরিচর্যা না করায় অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। এখনও বিনষ্ট হচ্ছে। এমনটি চলতে থাকলে আমরা খুইয়ে ফেলবো আমাদের অনেক অমূল্য সম্পদ। আমাদের গৌরবময় ইতিহাস। আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। পুঠিয়া রাজবাড়ি দেখার পর আমার মনে হয়েছে, প্রত্যন্ত একটি এলাকায় আড়াল পড়ে আছে ঐশ্বর্যময় ইতিহাসের অনেক মূল্যবান উপকরণ। যার গুরুত্ব হয়তো আমরা এখনও বুঝতে পারি নি। কবে যে পারবো?


ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক দিয়ে যাওয়ার পথে বাঁ দিকে ত্রিমোহিনী জামে মসজিদের পাশ দিয়ে কিছুটা পথ যাওয়ার পর রাজবাড়ি চিনতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। ভবনগুলোর আকার আর আকৃতি দেখলে কেমন যেন রোমাঞ্চকর ও শিহরণজাগানো অনুভূতি হয়। বিরান প্রান্তরে সব দাঁড়িয়ে আছে একবুক হাহাকার নিয়ে। পুরাকীর্তির অধিকাংশই ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। শত শত বছর আগের ভবনগুলো মলিন। বিধ্বস্ত। বিমর্ষ। বিষণ্ন। যেখানে রাজা নেই। রাজত্ব নেই। রাজস্ব নেই। নেই প্রাণের উত্তাপ। জায়গায় জায়গায় ফাঁটল ধরেছে। ভেঙে গেছে পাঁজর। খুলে খুলে যাচ্ছে ইট-সুরকি। বেআবরু হয়ে যাচ্ছে আস্তরগুলো। দিনের বেলায়ই কেমন যেন একটা অশরীরী পরিবেশ। গা ছমছম করে। আর রাতের বেলার অনুভূতি কেমন হবে, সেটা ভাবতেই পারছি না।
গাইডের পরিবেশিত তথ্যে একটু একটু করে উম্মোচিত হতে থাকে অজানা ইতিহাস। চারপাশেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পুরাকীর্তির সব নিদর্শন। এত এত মূল্যবান স্থাপনা একই চত্বরে আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। যদিও সংরক্ষণ করা হচ্ছে রাজবাড়িসহ ১৪টি স্থাপনা। বাদবাকি নির্দশন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অথচ কত আগের ঐতিহাসিক জনপদ। মোগল সম্রাট আকবরের আমলে প্রতিষ্ঠিত হয় পুঠিয়া রাজবংশ। এর জমিদার ছিলেন বার ভুঁইয়াদের একজন। এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা পীতাম্বর। পীতাম্বরের মৃত্যুর পর তাঁরই অনুজ নীলাম্বর জমিদার হন। তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে রাজা উপাধি লাভ করেন। এরপর বিভিন্ন জনের শাসনামলে নানা স্থাপনা, বেশিরভাগই মন্দির নির্মাণ করা হয়। ১৮৯৭ সালে ভয়াল ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুঠিয়া রাজবাড়ির অধিকাংশ অবকাঠামো।


পুঠিয়া রাজবাড়ির বর্তমান প্রাসাদ নির্মাণ করেন রাজবংশের সর্বশেষ উত্তরাধিকারী মহারানি হেমন্তকুমারী দেবী। ১৯৪২ সালে তিনি পরলোকগমন করার পর রাজবাড়ির আকর্ষণ ও জৌলুশ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেতে থাকে। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর এই রাজবাড়ি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। এ কারণে অযত্ম আর অবহেলায় এর সৌন্দর্য অনেকখানি নষ্ট হয়ে যায়। বেহাত হয়ে যায় জমিদারদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র।  
পুঠিয়া রাজবাড়ি চত্বরটি চতুর্ভুজ আকারের। এই সীমানার মধ্যে বেশ কয়েকটি ভবন ও মন্দির। পুরো এলাকার চারপাশে পরিখা। মূলত নিরাপত্তা বেষ্টনি হিসেবে এটি খনন করা হয়। প্রধান ভবন পুঠিয়া রাজবাড়ি কমপ্লেক্সের অবকাঠামো ও স্থাপত্য সহজেই নজর কেড়ে নেয়। দ্বিতল বাড়ি হলেও বেশ উঁচু। সুউচ্চ ফটক। এটি পাঁচআনি জমিদার বাড়ি নামে পরিচিত। বড় বড় স্তম্ভের উপর ভবনটি বাইরে থেকে দেখলে চারতলার মতো মনে হয়। বিশাল এই ভবনে দু’একটি পুরানো ভারী সিন্দুক ছাড়া সরঞ্জামাদি কিছুই নেই। লুঠপাট করে পুরোপুরি শূন্য করে ফেলা হয়েছে। খাঁখাঁ করছে বড় বড় কক্ষগুলো। তবে সম্প্রতি সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর পরিদর্শন করার পর ভবনের সংস্কার কাজ চলছে।

রাজবাড়ি সংলগ্ন গোবিন্দ মন্দিরটির বয়স চার শতাধিক বছর। একটু উঁচু বেদির উপর বর্গাকারে নির্মিত। মন্দিরের কেন্দ্রস্থলে একট কক্ষ। চার কর্নারে চারটি ছোট কক্ষ। পোড়ামাটির চিত্রফলক দিয়ে সাজানো। মারাত্মক ভূমিকম্পেও এ মন্দিরটি রয়ে যায় অক্ষত। তাতে রয়েছে কয়েক শ’ বছর আগের টেরাকোটা কাজ। মন্দিরগাত্রে খোদাই করা সনাতন ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী, যুদ্ধ, রাধা-কৃষ্ণের প্রেমলীলা, হাতি, ঘোড়া, পালকি, তীর, ধনুক, শিকার দৃশ্য। আছে মোগল আমলের ক্যালিগ্রাফিও।
ছোট আহ্নিক মন্দিরে একাধিক খিলান দরজা। দোচালা আকৃতির ছাদ বাঁকানো। কার্নিশসমূহে পোড়ামাটির চিত্রফলক। শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবনলীলা, লতাপাতা, জীবজন্তু।


ছোট শিব মন্দিরটি বর্গাকারে নির্মিত। ছোট আকৃতির এ মন্দিরের কার্নিশ বাঁকানো। দেয়ালে পোড়ামাটির চিত্রফলক।
শ্যামসাগর দীঘির পশ্চিম পাড়ে বড় আহ্নিক, ছোট গোবিন্দ গোপাল মন্দির নামে পাশাপাশি তিনটি মন্দির। এই মন্দিরগুলো চারআনি মন্দির নামে পরিচিত। বড় আহ্নিক মন্দিরে পাশাপাশি তিনটি কক্ষ। তাতে পোড়ামাটির চিত্রফলক। তাতে শোভা পাচ্ছে রামচন্দ্রের সঙ্গে রাবণের যুদ্ধের কাহিনী, মোগল যুদ্ধের সাঁজোয়া বাহিনীর চিত্র, হিন্দু দেব-দেবীর প্রতিকৃতি, শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারানির সাথে গোপীগণের বৃন্দাবনলীলা।
একই চত্বরে ছোট গোবিন্দ মন্দির। আছে পোড়ামাটির চিত্রফলক। কার্নিশ ধনুকের ন্যায় বাঁকানো। চূড়া আকৃতির ছাদ।
গোপাল মন্দিরটি দোতলা। কোনো অলঙ্করণ নেই।  
দোল মন্দিরটি চার তলা বিশিষ্ট। গম্বুজাকৃতির চূড়া। পুঠিয়ার পাঁচআনি জমিদার ভূবেন্দ্রনারায়ণ রায় ১৭৭৮ সালে এটি নির্মাণ করেন। প্রবেশ পথ অনেক। খানিকটা গোলকধাঁধার মতো।


বড় শিব মন্দিরের সুপ্রশস্ত সিঁড়ি। চারপাশে টানা বারান্দা। পাঁচটি করে খিলান প্রবেশ পথ। উত্তর পাশে দীঘিতে নামার জন্য বাঁধানো ঘাট। প্রবেশ পথে বেলে পাথরের চৌকাঠ। চৌকাঠগুলো ফুল আকৃতির নকশা দিয়ে অলঙ্কৃত। পিরামিড আকৃতির চূড়া। পাঁচআনির জমিদার বাড়ি ১৮২৩ সালে রানি ভূবনমীয় দেবী নির্মাণ করেন। এ কারণে মন্দিরটি ভূবনেশ্বর মন্দির নামেও পরিচিত। ১৮৩০ সালে স্থাপন করা হয় বড় আকৃতির কালো পাথরের শিবলিঙ্গ। ১৯৭১ সালে এটি ভেঙে ফেলার জন্য পাকিস্তানি সৈন্যরা সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগ করে। কিন্তু বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েও সামান্য একটু আঁচড় কাটা ছাড়া তেমন কিছু করতে পারে নি। এখনও মন্দিরটিতে যথারীতি পূজা-অর্চনা করা হয়।
সামনে গোবিন্দ সরোবর। শানবাঁধানো ঘাটে বসে অবলোকন করা যায় চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য। শিব মন্দিরের চূড়ায় ওঠার কোনো সিঁড়ি নেই। তবে লোহার চেইন ঝুলানো আছে। সেটি বেয়ে ওঠা যায়। এর কারণ অবশ্য জানা যায় নি।   জগন্নাথ বা রথ মন্দির অষ্টকোণাকারে নির্মিত। চারপাশে টানা বারান্দা। ৮টি পিলার। জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। ১৮৩০ সালে রানি ভূবনময়ী নির্মাণ করেন। রাজবাড়ির আঙ্গিনায় আছে দোতলা হাওয়া খানা। একটি পুকুরের মাঝখানে। অবকাশযাপন করার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। কৃষ্ণপুর মন্দির পোড়ামাটির ফলক দিয়ে নির্মিত। খিতিশ চন্দ্রের মঠ নামে পরিচিত হলেও সেটি আসলে শিব মন্দির। ছোট আকারের। কেষ্ট খেপার মঠ বর্গাকারে নির্মিত।


১৪টি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ছাড়াও আছে হেমন্ত কুমারীর বাসভবন, রানির ঘাট, চারআনি বাড়ি, কাছারি বাড়ি। এছাড়া পাঁচ আনি রাজবাড়ির পূর্ব-উত্তর দিকে জমিদার আমলে নির্মিত বেশ কিছু ইমারত আছে। রাজ পরিবারের কর্মচারীদের আবাসন। জরাজীর্ণ এবং পরিত্যক্ত।
১৮৯৫ সালে নির্মিত হয় হেমন্ত কুমারীর বাসভবন। দেয়ালে লতাপাতার নকশা। বর্তমানে সরকারি দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গোবিন্দ সরোবরের সঙ্গে সংযুক্ত বিশাল শান বাঁধানো রানির ঘাট। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।
চারআনি রাজবাড়ি শ্যামসাগর দীঘির দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। সেখানে আছে রাজপ্রাসাদের বিভিন্ন অফিস ভবন, কর্মচারীদের আবাসস্থল, হাতিশাল, ঘোড়াশাল। সবই ধ্বংসের পথে। ১৯৭১ সালে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাছাড়া অনেক স্থান দখল হয়ে গেছে।
সেই আমলে প্রত্যন্ত এলাকায় যে সব উপকরণ ও সরঞ্জাম দিয়ে এই রাজপ্রসাদ গড়ে তোলা হয়েছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। দূর-দূরান্ত থেকে তা বহন করে এনে দুর্গম অঞ্চলে রাজকীয় সৌধ গড়ে তোলাটা নিশ্চয়ই সহজ ছিল না। অবশ্য পাশ দিয়ে পদ্মা নদী প্রবাহিত হওয়ায় পরিবহন নিয়ে বড় কোনো সমস্যায় পড়তে হয় নি। আর রাজা বা জমিদারের হুকুম প্রতিপালন করার জন্য দরিদ্র প্রজারা তো ছিলই। পুঠিয়া এলাকাটি যে বেশ সম্ভ্রান্ত ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেটি সহজেই অনুধাবন করা যায়। রাজবংশের অনেক কিছু বিলীন হয়ে গেলেও এর গরিমা কিন্তু হারিয়ে যায় নি। এটিকে সংস্কার করা হলে এর জেল্লা, এর নান্দনিক সৌন্দর্য ও এর আকর্ষণ অনেকটাই পুনরুদ্ধার করা যায়। সেটি করা হলে পুঠিয়া রাজবাড়ি হতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম একটি দৃষ্টিনন্দন পর্যটন কেন্দ্র।
   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন