পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

রবিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৬

মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে

ষড়ঋতুর এই দেশে প্রকৃতির রঙ বদলে গেলে বুঝতে পারা যায়- এসেছে নতুন ঋতু। প্রতিটি ঋতুরই আছে আলাদা রঙ, আলাদা বৈচিত্র্য, আলাদা মেজাজ। তবে বসন্ত একদমই অন্যরকম। আকাশে হেসে ওঠে শুক্লপক্ষের পঞ্চমী চাঁদ। চাঁদের হাসি বাঁধ ভাঙে, উছলে পড়ে আলো। যত দূরে চোখ যায় রোমান্টিক নীলের উচ্ছ্বলতা। সঙ্গে মাতাল করা সমীরণ। তার বেশ, ভূষণে বাহারি রঙের সাজ। মুখে হাসি, বুকে সুর। মনে ফাগুনের দোলা। চিরকালের বাউল। ঋতুরাজ বসন্ত এলে চারপাশের রঙই শুধু পাল্টে যায় না, পাল্টে যায় মানুষের মনও। যখন দখিনা বাতাস বইতে থাকে, ফুলের সুবাস নাকে লাগে আর পাখির সুরেলা কণ্ঠ কানে বাজতে থাকে, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না, বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। বুকের মধ্যে শীষ দিতে থাকে ভালোবাসার দুষ্টু কোকিল। শরীর-মনে বয়ে যায় সুখের শিহরণ। বসন্ত তো সুখের, আনন্দের, অনুভবের। বসন্ত আসে শীতের ঝরা পাতা আর রিক্ততাকে দূর করে। শীতের হুল ফোটানো কামড় সরিয়ে দিয়ে আনে এক ধরনের স্বস্তি। ফুলে ফুলে সেজে ওঠে চারপাশ। পাখিরা গান গায় আপন মনে। আনে উৎসবের বর্ণিল মেজাজ। সব বয়সী মানুষকে উজ্জীবিত করে তোলে। প্রকৃতি যখন রূপে, রঙে সেজে ওঠে, তখন সবচেয়ে আকর্ষণীয় মৌসুম এই বসন্ত। গাছে গাছে কচি পাতা। নবীন পাতায় প্রাণের ছোঁয়া। তার প্রকাশ ঘটে মৃদুমন্দ হাওয়া এসে দুলিয়ে দিতে থাকলে। বসন্তে নারীরা সাজে অলঙ্কারে, ফুলের মালায়, বর্ণিল কাপড়ে। তাদের বুকের মধ্যে ওড়ে সুখের প্রজাপতি।
বসন্তের নতুন সাজ, নতুন পরিচ্ছদ সবচেয়ে বেশি রাঙিয়ে দেয় কবি, গীতিকার ও শিল্পীদের হৃদয়। বসন্তকে নিয়ে কত কবিতা, কত গান! কাব্যের সুষমা আর সুরের ঝরনাধারায় প্লাবিত হয় মানুষের হৃদয়। বাংলায় বসন্তে নতুন মাত্রা যোগ করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শান্তিনিকেতনে রঙে, সুরে, নৃত্যে, স্তোত্রে বসন্তকে বরণ করে নেয়ার প্রথা চালু করেন এই চিরপ্রেমিকবর। তখন থেকেই বাংলা ও বাঙালিদের কাছে বসন্ত হয়ে ওঠে উৎসব। নাগরিক জীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ সর্বজনীন বসন্ত উৎসব। রবীন্দ্র সঙ্গীত, গীতিনাট্য বসন্ত উৎসবকে দিয়েছে নতুন ব্যঞ্জনা। বসন্ত এক স্বতঃস্ফূর্ত উৎসব। তাতে প্রাণে প্রাণ যোগ করে প্রকৃতি ও মানুষ। সহজাতভাবে পরিস্ফুটিত হয় ফুল, পাখি, নারী। সুরে, ছন্দে, আনন্দের রিনিক-ঝিনিক মাদল বাজায় বসন্ত।
 
বসন্তের রঙ বোধহয় হলুদ। তার সঙ্গে আছে লাল ও কমলার নিবিড় বন্ধন। শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া ছড়িয়ে দেয় ভালোবাসার আবীর। আর আম গাছে মুকুল। জানিয়ে দেয়- মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে। এসো, মিলি প্রাণের উৎসবে। বসন্তকে বরণ করে নেয়ার জন্য এখন চলে নানা প্রস্তুতি, নানা আয়োজন। মাঘের শীত ঘুম পাড়িয়ে রাখলেও ফাল্গুনের প্রথম দিনের ভোরে ঘরের বাইরে পা দিলে বাসন্তী হাওয়া এসে দুলিয়ে দিয়ে যায় হৃদয়, আহা আজি এ বসন্তে/কত ফুল ফোটে/কত বাঁশি বাজে/কত পাখি গায় গান...। চারপাশে বাসন্তী রঙের ছড়াছড়ি। অপরূপ সাজে নর-নারীরা। মেয়েদের পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি। কপালে লাল টিপ। ম্যাচিং করে হাতভর্তি কাঁচের চুড়ি, গলায় পুঁতির মালা। চোখে, ঠোঁটে, মুখে, এমনকি হাতের ব্যাগেও রঙের প্রলেপ। হারিয়ে যেতে বসা খোপায় বা বিনুনিতে গাঁদা ফুলের মালা। খোপা না থাকলে দু’একটি গোলাপ বা বেলী গুঁজে দেয়া হয় চুলে। আজকাল তো ফুলেরও নানা বাহার। তাজা কিংবা শুকনো দেশী ও বিদেশী কত না ফুল! কিশোরী, তরুণীরা তো এমনিতে ফুটে থাকে ফুল হয়ে, তাদের সঙ্গে সব বয়সী নারীই হয়ে ওঠেন এক ঝলক হলুদ গাঁদা ফুল। একদম বাসন্তী সাজে সাজা সম্ভব না হলে হলুদের কাছাকাছি বসন কিংবা শরীরের কোথাও না কোথাও একটুকরো হলুদ নিশানা থাকেই। সে শাড়ি হোক কিংবা সালোয়ার-কামিজ। হালে বাঙালিরা ফ্যাশন সচেতন হয়ে ওঠায় বসন্তের পোশাক-আশাকে লেগেছে নানা নকশা ও অলপনার বাহার। কারো কারো হাতে থাকে ফুল। সে সঙ্গে লেগে থাকে মুখভর্তি বাঁধনহারা হাসি। ছেলেরাও এখন আর পিছিয়ে নেই। তাদের পরনে থাকে নানা রঙের পাঞ্জাবী ও ফতুয়া। কেউ কেউ হাতে জড়িয়ে নেন বেলী কিংবা গাঁদা ফুলের মালা। বসন্ত সত্যি সত্যিই মনটা রাঙিয়ে দিয়ে যায়, বুকের মধ্যে ছড়িয়ে দেয় ভালোবাসার পরশ।
শহর এলাকায় পাখির কূজন শোনা বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাই পাখি দেখতে অনেকেই ছুটে যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অথবা পাখি ডাকা কোনো গ্রামে। বিস্ময়কর হলেও বসন্ত এলে কোলাহলমুখর এই ঢাকা শহরেও হঠাৎ হঠাৎ শোনা যায় কোকিলের কুহুতান। ইস্কাটন গার্ডেন, রমনা পার্ক, বোটনিক্যাল গার্ডেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোনো কোনো বৃক্ষশোভিত এলাকায় ফাগুনে জানান দেয় তাদের অস্তিত্ব। দেহ-মনে যৌবন এলে যেমন তা লুকিয়ে রাখা যায় না, ফাগুন এলে কোকিলের পক্ষে আড়ালে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
বাঙালির বসন্তে যোগ হয়েছে একুশ। এই ফাগুন মাসে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে বাঙালি। থোকা থোকা ফুল হয়ে ফুটে আছেন রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকত। সেই বায়ান্ন থেকে প্রতি বছর ফিরে ফিরে আসে রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। ফাল্গুন তাই শোককে শক্তিতে পরিণত করার মাসও। বাংলা ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গকারী অমর শহীদদের প্রতি বিনীত ও চেতনার অগ্নিমশালকে প্রজ্বলিত করার জন্য আসে ফাল্গুন। একুশের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে বাংলা একাডেমীর গ্রন্থমেলা। স্বাধীনতার পর প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে আয়োজিত গ্রন্থমেলা বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অংশ হয়ে উঠেছে। এ মেলায় পাওয়া যায় সৃষ্টিশীলতার স্পন্দন। শুধু বইমেলাকে কেন্দ্র করে মানুষের যে ঢল নামে এবং তাতে পাওয়া যায় যে প্রাণের ছোঁয়া, এর সঙ্গে যেমন জড়িয়ে আছে একুশের চেতনা, তেমনিভাবে আছে বসন্তের উতাল হাওয়ায় ঘর থেকে বের হওয়ার আমন্ত্রণবার্তাও।
সাম্প্রতিক সময়ে বসন্তে সংযোজন ঘটেছে ভালোবাসা দিবস। বসন্তকালে হওয়ায় বাঙালি লুফে নিয়েছে এ দিনটিকেও। মন কেমন করা ঝিরিঝিরি উদাসী হাওয়া, পাখ-পাখালির কুঞ্জন, হাজারো রঙয়ের খেলা নিয়ে প্রকৃতির যে আনন্দভোজ, তাতে ভালোবাসা থাকবে না, তা কী করে হয়? ‘ভ্যালেনটাইন্স ডে’ না থাকলেও বসন্ত তো ভালোবাসারই দিবস। এখন হয়তো তার সঙ্গে যোগ হয়েছে লাল শাড়ি, গোলাপ, বই, কার্ড, শোপিস, গয়না, মগ, চকলেট, গানের সিডি কিংবা ডিভিডি। হৃদয় বিনিময়ের এসব উপকরণ না থাকলেও বসন্ত এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বুকের মধ্যে উথলে ওঠে ভালোবাসার রঙধনু। বসন্ত তো ভালোবাসারই ঋতু।   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন