পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

রবিবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৬

যখন এ মনে প্রশ্নের ঝড়

শব্দ কিংবা বাক্যরা কখনো কি বুকের মধ্যে বরফের মতো জমাট বেঁধে যায়? অনুভূতি কি শূন্য হয়ে যায়? অনুভবের তার কি বাজে বেসুরো হয়ে? আমি ঠিক বুঝতে পারি না। এমন হচ্ছে কেন? কেমন যেন শব্দহীন, বাক্যহীন, অনুভূতিহীন, অনুভবহীন হয়ে পড়েছি। কিছুই যেন আমাকে স্পর্শ করছে না। সব কিছু কেমন যেন নিশ্চল, নিস্তব্ধ, নিস্তরঙ্গ হয়ে পড়েছে। চারপাশটা একদমই এলোমেলো হয়ে গেছে। এ জীবনে কত কত ঘটনা ঘটেছে। কাছের মানুষরা আঘাত দিয়েছেন। ভালোবাসার মানুষ অকারণেই দূরে সরে গিয়েছেন। প্রিয়জনরা অকালেই চলে গেছেন। সেই কষ্ট, সেই আঘাত, সেই শূন্যতা কখনোই কাটিয়ে ওঠা যায় নি। এখনও তার রেশ রয়ে গেছে। কিন্তু মনেরদুনিয়া এভাবে কখনও টালমাটাল হয় নি। এভাবে আমূল কেঁপেও ওঠি নি। যেন ভূমিকম্পে উলট-পালট হয়ে গেছে ভিতরভূমি। এটা কি মানবিক ভূমিকম্প? যে কারণে বদলে গেছে মনোজগত। বদলে গেছে চিন্তা-ভাবনা। বদলে গেছে জীবন। যদিও ঠিক সময়ে ঘুম থেকে ওঠছি, নির্ধারিত সময়ে অফিস যাচ্ছি, কাজও করছি। তারপরও নিজেকে খুঁজে পাচ্ছি না। নিজের কাছে নিজেকেই অচেনা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কেমন যেন শিকড়হীন হয়ে পড়েছি। কোনো কিছু গুছিয়ে ভাবতে পারছি না। লিখতে পারছি না। কী বোর্ডের সঙ্গে মস্তিস্কের সংযোগ ঘটাতেও পারছি না। অনেকগুলো দিন পেরিয়ে এসেছি। তারপরও যেন নিরালোক থেকেও বের হতে পারছি না। ‘নাইন ইলেভেন’ যেভাবে পাল্টে দিয়েছে দুনিয়াকে, তেমনিভাবে ‘সেভেন ওয়ান’ বাংলাদেশের মনোজগতে এঁকে দিয়েছে একটা বিভাজন রেখা। এই বাংলাদেশ যেন আর সেই বাংলাদেশে নেই।

মনের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে নিরন্তর প্রশ্ন। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলায় দোল খেতে হচ্ছে। সংশয় দেখা দিয়েছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে। কাউকে যেন আর দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করার সুযোগ নেই। দূরের মানুষরা তো বটেই, কাছের মানুষরাও বোধকরি এখন দূরের হয়ে গেছেন। বুকের মধ্যে কুরে কুরে খাচ্ছে অবিশ্বাস আর সন্দেহ। ভয়ের একটা চোরাস্রোত সংগোপনে বয়ে চলেছে। পারিবারিক বন্ধনের ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছে দ্বিধা-দ্বন্ধ। পিতা, মাতা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী, পুত্র, কন্যার মধ্যে একটা ব্যবধান তৈরি করে দিয়েছে। একে অপরকে দেখছেন গোয়েন্দার দৃষ্টিতে। সবার নিভৃত জগতটা প্রশ্নহীনভাবে এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। দায়, দায়িত্ব আর জবাবদিহির প্রশ্নে পাশ কাটিয়েও যাওয়া যাবে না। এ কেমন জীবনের সামনে আমরা দাঁড়িয়ে?

সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে এত বড়  ফাটল দেখা দিয়েছে, সেটা এরআগে এতটা নগ্নভাবে বুঝতে পারা যায় নি। এটা তো আমরা অনুধাবন করতে পারছিলাম, ইন্টারনেট বা ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডয়ের কারণে নাগরিক জীবনে একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা আর বিচ্ছিন্নতাবোধ বাড়ছে। বাড়ছেও পারস্পরিক দূরত্বও। কিন্তু রক্ত সম্পর্কীয়রা যে এত অচেনা, এত দুর্বোধ্য, এত দূরে চলে গেছেন, সেটা যেন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে গুলশানে জঙ্গি হামলা। এমন হামলা হয়তো অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ ইতোপূর্বে অনেক নৃশংস হামলাই আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু ১ জুলাই যেভাবে হামলা চালানো হয়, যেভাবে হত্যাকা- সম্পন্ন করা হয়, সর্বোপরি যাঁরা এই হামলায় অংশ নেন, পুরো প্যাকেজটি আমাদের চেনা ছকের একদমই বাইরে। প্রকৃতঅর্থেই দারুণভাবে চমকে দিয়েছে। ঘাবড়ে দিয়েছে। কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। এটি ছিল অভাবনীয়, অচিন্তনীয়, অবিশ্বাস্য। এত দিন দূরের পৃথিবীতে এমনটি হতে দেখেছি। সেটি যে নিজের সীমানায় এমনভাবে বিস্ফোরণ ঘটাবে, তারজন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আসলে বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো কিছুকে দূরের ভাবার সুযোগ নেই। এড়িয়ে যাওয়াও যাবে না।

সুযোগ নেই গুলশান হামলাকেও এড়িয়ে যাবার। এটি বুঝিয়ে দিয়েছে আমরা কেউই আর নিরাপদ নই। সেটা ঘরের বাইরে তো বটেই। ঘরের ভিতরেও।
ঘরের বাইরে পা ফেলার সময় যেমন সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে, তেমনিভাবে ঘরের ভিতরেও অনুসন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে তাকাতে হচ্ছে। এমনটি কখনো কল্পনা করা যায় নি। অবিশ্বাস, সন্দেহ আর সংশয়ের যে ভ্রুণ বুকের মধ্যে বেড়ে ওঠছে, তার থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কী?
(১৩ জুলােই ২০১৬)।       

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন