জরুরি টেলিগ্রাম পেয়ে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই ভোর বেলা একাকি ছুটতে হলো কৌশিককে। একাকি শব্দটি মনের কোনায় ভেসে ওঠতেই মনে পড়ে যায় শুচির মুখ। একা একা ও কোথাও যায় নি শুনে শুচির সে কি হাসি। একবার সংসদ চত্বরে অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর সময় বাদাম খেতে খেতে কি প্রসঙ্গে যেন কথাটি ওঠেছিল। শুচির হাসি শুনে আশ-পাশের লোকজন ওদের দিকে তাকাতেই কৌশিকের চোখ-মুখ লাল হয়ে যায়। এরপর খুঁটিনাটি কিছু হলেই শুচি মজা করার জন্য ওকে ‘খোকনসোনা’ ব’লে ক্ষেপায়। সত্যি বলতে কি- এই চব্বিশ বছর বয়সেও একা একা তার দূরে কোথাও যাওয়া হয় নি। যাতায়াতের ঝুট-ঝামেলা তো আছেই, সেইসঙ্গে কোথাও একা একা গিয়ে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটাও একটা সমস্যা। কিন্তু এ যাত্রায় আর কোনো উপায় ছিল না। যাবার সময় অসুবিধায় যাতে না পড়তে হয়, সেজন্য আগে-ভাগেই কমলাপুর রেল স্টেশন রওয়ানা হওয়ার কথা ভেবেছিল। বাসা থেকে বের হতে হতে খানিকটা দেরি হয়ে যায়। তারপর ট্র্যাফিক সিগনাল আর যানজট মাড়িয়ে স্টেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে বেশ বিলম্ব হয়ে যায়। এমনটি হওয়ায় নিত্যসঙ্গী চাপা টেনশন তার বুকে সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে। ট্রেনের টিকিট পাবে কিনা এই সংশয়টা বুকের মাঝে পেন্ডুলামের মতো অতিমাত্রায় দোল খেতে থাকে। এমনিতেই সামান্য কারণেই কৌশিক টেনশনে ভোগে। যদি কেউ একবার বলে, কৌশিক তোর সঙ্গে কথা আছে। ব্যস, হয়ে যায় তার দফারফা। কথাটা না শোনা পর্যন্ত তাকে পেয়ে বসে একরাশ অস্থিরতায়। আর এই দূরের পথ জার্নি করার কথা শোনার পর তাকে উৎকণ্ঠায় পেয়ে বসে। এখন যদি টিকিট না পায়, তাহলে মুশকিলে পড়তে হবে। অথচ তাকে যে করেই হোক যেতেই হবে।
যা আশঙ্কা করেছিল, তাই ঘটলো। কাউন্টারে ঊর্মি-নিশিথার কোনো টিকিট পাওয়া গেল না। প্রায়শই কৌশিকের নেতিবাচক চিন্তাগুলো সত্য হয়ে যায়। যে কোনো কাজের ক্ষেত্রেই তার মনের মাঝে ঠাঁই করে নেয় নেতিবাচক ভাবনা। একজন মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ অনুযায়ী সে ইতিবাচক ভাবার চেষ্টা করেও তা কার্যকর করতে পারে না। এই মুহুর্তে অস্ফুট স্বরে নিজেকে একটা গাল দিলো। কী করবে ভেবে না পেয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়েছিল কৌশিক। এমন সময় দেবদূতের মতো একজন তার সামনে এসে হাজির।
স্যার, টিকিট লাগবে?
ব্ল্যাকারকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। তার কাছ থেকে চড়া দামে টিকিট কেটে ট্রেন ছাড়ার অল্প কিছুক্ষণ আগে কৌশিক নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসলো। কিন্তু তখনও সে হ্যাঙওভারটা কাটিয়ে ওঠতে পারছিল না। জানলার পাশে বসেও ট্রেনের দুলুনির সঙ্গে সঙ্গে দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতা মগজের কোষে কোষে জটলা পাকাতে থাকে। একা জার্নি না করার অভিজ্ঞতা না থাকাটা তো আছেই, একই সঙ্গে রাঙ্গামাটি গিয়ে অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কায় একটা উদ্বেগ তার চোখে-মুখে স্পষ্ঠ হয়ে ওঠে।
চলমান ট্রেনের খোলা জানলায় জীবনানন্দীয় দৃশ্যপট ব’য়ে গেলেও মনটা অশান্ত থাকায় কোনো রকম অনুভূতি তার হৃদয়ে ছাপ ফেলছিল না। অথচ খোশ-মেজাজে থাকলে এই মুহুর্তে কৌশিকের বুকের মাঝে গুঞ্জরিত হতো প্রিয় কবির কবিতার প্রিয় পংক্তিমালা। সব কিছু মিলিয়ে কৌশিক বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে যায়। আচানক, সামনে বসা অচেনা এক ভদ্রলোকের কথায় চটকা ভেঙে চাইতেই দেখে অনেকগুলো চোখ তার দিকে ফেরানো। এতে একটু লজ্জা পেয়ে যায়। পাশেই বসা এক ভদ্রলোক। কিছুটা স্থূলাকায়। গম্ভীর প্রকৃতির। কোনো অফিসের বস বস চেহারা। তার উল্টোদিকে হাস্যোজ্জ্বল আরেক জন ভদ্রলোক। বয়স ৩৩/৩৪ হতে পারে। চোয়ালটা ভাঙা। চোখ দু’টো দাবানো। যেন গর্তের মাঝে বসিয়ে রাখা হয়েছে। পিটপিটে চাইনি। পরনে ঝকমকে সাফারি। বুঝতে বেগ পেতে হলো না, এই ভদ্রলোকই তাকে বিব্রত অবস্থায় ফেলেছেন। ভদ্রলোকের পাশে অর্থাৎ তার সামনে জানলার পাশে বসা একজন মহিলা। হাবভাবে মনে হলো, ভদ্রলোকের স্ত্রী। কিন্তু জুটি হিসেবে তার চোখে বেমানান লাগলো। মহিলার সঠিক বয়স আন্দাজ করা কঠিন। তবে ২৬/২৭ বছর হতে পারে। মুখশ্রী বেশ সুন্দর। সাজগোজেও পরিচর্যার ছাপ। মুখে আলতো হাসি ছড়ানো। চোখের দিকে এক পলক তাকিয়ে কৌশিকের বুকটা ধক করে ওঠে। চোখ দু’টি যেন তার দিকে খিলখিলিয়ে হাসছে। নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে পরিবেশটাকে বুঝতে চেষ্টা করলো। বুঝতে পারলো, ভদ্রলোক তাকে কোনো প্রশ্ন করেছেন এবং তার জবাবের অপেক্ষায় সকলেই। একটি অস্বস্তি তাকে ঘিরে ধরলো। কী করবে বুঝতে না পেরে একটু বোকা বোকা হেসে বললো-আমাকে কিছু বললেন? তার কথায় ভদ্রমহিলার ঠোঁটে হাসির একটা ছোট্র ফোয়ারা বয়ে গেল। শান্ত দীঘিতে ছোট্র ঢিল ছুঁড়লে যেমনটি হয়। এই হাসি তার সংকোচ আরো বাড়িয়ে দেয়। নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার কথা ভাবলো সে। কিন্তু বুঝতে দেরি হলো না- ভুল জায়গায় এসে পড়েছে। জ্যামিতিক সমান্তরালে বসলেও সাফারি পরা ভদ্রলোক কৌণিকভাবে তারসঙ্গে আলাপচারিতা চালাতে লাগলো। সম্ভবতঃ পাশের ভদ্রলোকের সঙ্গে সুবিধা করতে না পেরে তাকেই পেয়ে বসেছেন। তবে ভদ্রলোকের কথায় সম্মোহনী শক্তি আছে বলতে হবে। ট্রেন গাজীপুর যাবার আগেই ভদ্রলোক কৌশিকের সঙ্গে খাতির জমিয়ে ফেললেন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে চুপচাপ স্বভাবের কৌশিকের ভূমিকা শ্রাবকের। কখনো সে মাথা দুলিয়ে কিংবা মুচকি হেসে ভদ্রলোকের কথায় সায় দিচ্ছিল। আর মাঝে মাঝে আড় চোখে ভদ্রমহিলাকে দেখছিল। কখনো-সখনো তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছিল।
ভদ্রলোক কথায় কথায় জানালেন, ভদ্রমহিলা তার স্ত্রী। কৌশিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর নিজের ব্যক্তিগত জীবনের ফিরিস্তি দিতে শুরু করেন। চট্টগ্রামেই বসবাস। সেখানেই ব্যবসা। নিজের চেষ্টায় ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছেন। বিয়ে করেছেন প্রেম করে। সেও হয়ে গেছে সাত/আট বছর। কোনো সন্তান-সন্তদি হয় নি। ঝাড়া হাত-পা। ঢাকায় বেড়াতে এসেছিলেন। এও জানালেন, কৌশিকের মতো দেখতে তার একজন শালা আছে। ভদ্রলোকের স্ত্রীও এ কথায় সায় দিলেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে ট্রেনের মধ্যেই কৌশিককে খাতির-যত্ম শুরু করে দেন। বুফে-কারের কর্মচারীরা এলে নানা রকম খাদ্যের অর্ডার দিলেন। কৌশিক কয়েকবার বারণ করা সত্ত্বেও তাদের আপ্যায়ন থামে না। নাস্তার দাম দিতে গিয়ে ইতোমধ্যে একবার দুলাসুলভ ধামকিও খেতে হয়েছে।
ট্রেন চট্টগ্রামের কাছাকাছি আসার পর চকিতে কৌশিকের মাথায় চিন্তার টেউ খেলে যায়। তখন বিকেল গড়িয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে আজ তার রাঙ্গামাটি যাওয়া হবে না। পাঁচটার পর রাঙ্গামাটি যাওয়া বন্ধ। রাতটা তাকে হোটেলেই কাটাতে হবে ব’লে ভাবছিল। অথচ তার হোটেলে থাকার একদমই অভ্যাস নেই। কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই। ট্রেনটা থামতেই ভাবনাটা ঝেড়ে ফেলে মনে মনে হোটেলে ওঠার প্রস্তুতি নিয়ে নেয়।
স্টেশন থেকে বের হয়ে হয়ে সহযাত্রী ভদ্রলোক ও তার স্ত্রীর কাছ কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার কথা ভাবছিল। সে মুহূর্তে ভদ্রলোক কৌশিকের বাহু আশ্লেষে জড়িয়ে ধরিয়ে বললেন, মতলব কি?
ট্রেনে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপের সময় কৌশিক তার গন্তব্যের কথা জানিয়েছিল। তাই বললো, রাতটা হোটেলে কাটিয়ে ভোরেই রাঙ্গামাটি ছুটবো। ভদ্রলোক কিছুটা ভারিক্কি চালে বললেন, দুলাভাইয়ের বাসা থাকতে হোটেলে কেন? মতলব খারাপ নাকি? এ কথায় ভদ্রলোকের স্ত্রী হাসতে লাগলো। কৌশিক বিব্রত বোধ করলো। সে অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভদ্রলোকের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু কোনোভাবেই ছাড়া পেল না। একান্ত নিরূপায় হয়ে তাদের সঙ্গে তাকে যেতে হলো। এটাও তারজন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন