পৃষ্ঠাসমূহ

মেঘালয়ের কোলে জোছনা ও জোনাকি

এই শহর আমাকে ক্লান্ত করে তোলে। বিষণ্ন করে তোলে। নানা জট, নানান জটিলতা আর সম্পর্কের টানাপড়েনে বড্ড হাঁপ ধরে যায়। মনের মধ্যে সর্বদাই একটা...

শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০২২

টেন্ডুলকার যেদিন শেষ ওয়ান ডে ক্রিকেট খেলেন

 



তুমি এখন কোথায়? মাঠে?

আরে না। অফিসেই তো আছি। 

এখনো অফিসে! খেলা দেখতে যাওনি? 

যেতে ইচ্ছে করছে না গো। বরং খেলতে ইচ্ছে করছে। 

মানে কি? আজ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যেকার হাইভোল্টেজ ক্রিকেট ম্যাচ। সবার দৃষ্টি এখন সেদিকে। আমিও তো টিভিতে খেলা দেখছি। আর এমন উত্তেজনাকর ম্যাচ তুমি দেখতে যাওনি? এমনটা তো ভাবতেই পারছি না। তুমি তো কখনো এমন খেলা মিস করো না। ঘটনাটা কী? 

মনটা কেন যেন উদাস হয়ে আছে। খেলা নিয়ে উৎসাহ পাচ্ছি না। কোথায় যেন ছন্দ কেটে গেছে। সত্যি বলতে কি এই ম্যাচের পরিবর্তে আমার উত্তেজনা ধাবিত হয়েছে তোমার দিকে। তোমার সঙ্গেই ম্যাচ খেলতে ইচ্ছে করছে।

কী আবোল-তাবোল বকছো? আমার সঙ্গে ম্যাচ খেলতে ইচ্ছে করছে! আমি কি ক্রিকেটার নাকি তুমি ক্রিকেটার? মানে কী?

খেলার তো নানান প্যাটার্ন আছে। তোমার-আমার জন্য যেটা যুৎসই, সেটাই তো খেলবো। বুঝতে চেষ্টা করো, তোমার সান্নিধ্যের চেয়ে আমার কাছে রোমাঞ্চকর আর কিছু নেই। তোমাকে নিয়ে মনের মধ্যে যে কি তীব্র উঁচাটন চলছে, বোঝাতে পারবো না। তুমি তো জানো, আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে আবেগী মন। তার অবাধ্য হতে পারি না। আজ মিরপুরে গেলে মোটেও স্বস্তি পাবো না। খেলা দেখেও আনন্দ পাবো না। মন খারাপ হয়ে যাবে। তাহলে গিয়ে কী হবে? তোমাতে মজেছে প্রাণ, বুকের ভিতর করছে টনটন। 

এ তো মারফতি কথা। তোমার যত সব বাহানা। আজ কি মাথায় পাগলামি ভর করেছে? আমি জানতাম তুমি এখন মাঠে থাকবা। জাস্ট তোমাকে হাই-হ্যালো বলার জন্য ফোন করেছি। আমার সান্নিধ্য তুমি পাবে কীভাবে? ফোনেও তো বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবো না। তাছাড়া আমার বুঝি বাসায় কাজ নেই? 

এই ভর দুপুর বেলা তোমার কী কাজ তা কি আমি জানি না? তোমার প্রতিদিনের রুটিন আমার চেয়ে বেশি কে জানে টুনটুনি পাখি? বাসায় তো নিশ্চয়ই এখন একাই আছো। তুমি ফোন না করলেও আমি এখনই তোমাকে মেসেজ পাঠাতাম। 

তাহলে তুমি স্টেডিয়ামে যাচ্ছ না? খেলা কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। টস জিতে পাকিস্তান ব্যাট করছে। 

খেলা যখন কেউ না কেউ ব্যাট তো করবেই। চলো আমরাও টস করি। 

তোমার কথার কোনো আগামাথা বুঝতে পারছি না। আজ তোমার কী হয়েছে, কে জানে। আমাদের আবার কীসের টস?

আগে শোনো, তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে৷ আমরা এখন একটা খেলা খেলবো। এই খেলার নিয়ম হচ্ছে, টসে যদি আমি জিতি, তুমি আমার অফিসে চলে আসবে। আর যদি হেরে যাই, তোমার কাছে আমি যাবো।

না, না। কী সব উল্টাপাল্টা কথা। এটা কী কোনো খেলা? তোমার মাথায় যত্ত সব আজগুবি চিন্তা-ভাবনা ঘুরপাক খায়। টস-ফসের মধ্যে আমি নেই। এ ধরনের ঝুঁকি নিতে পারবো না। আমি কোথাও যেতে পারবো না। তোমাকেও আসতে হবে না। তোমার মনগড়া ইচ্ছে চাপিয়ে দিলেই হলো!

আহ্ সোনাবাবু, এমন করো না। এই দিন তো সব সময় আসবে না। আমার অফিসে আমি ছাড়া কেউ নেই। রাস্তাঘাটও একদম ফাঁকা। তোমার আসতে একদমই সময় লাগবে না। সহজেই চলে আসতে পারবে।

সহজেই চলে আসতে পারবে মানে? আমি কি আসতে চেয়েছি নাকি টসে হেরে গেছি?

তা অবশ্য হারোনি। তবে টসের কথা বাদ দাও, সিদ্ধান্তটা আমাকে নিতে দাও। অন্য সব দিন তো তোমার কথাই মেনে চলি। আজ অন্তত আমার কথা শোনো। তুমি চলে আসো। কোথাও যানজট নেই। তাড়াতাড়ি আসতে পারবে।

তুমি বললেই হলো। নিজেই নিজের খেলার নিয়ম ভাঙছো। এটা আবার কেমন খেলা? শোনো, ফালতু কথা রাখো। খেলা দেখতে দেও। পাকিস্তানের উদ্বোধনী দুই ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ হাফিজ আর নাসির জামসেদ কিন্তু দারুণ খেলছে। দ্রুতলয়ে এগিয়ে চলেছে রানের গতি। 

লক্ষীসোনা, তুমি আসো, আমরাও ভালো খেলতে চেষ্টা করবো।

এই ফাজিল, তুমি কী বলতে চাইছো? মাথা কি আউলা-ঝাউলা হয়ে গেছে? 

কাছে আসলেই তো সব জানতে পারবে। 

তুমি তো একটা বদ। কী মতলব আঁটছো, কে জানে। বলছি না, আমি আসতে পারবো না। 

সোনামণি, বাইরে তাকিয়ে দেখো, চৈত্রের এই পড়ন্ত দুপুরে একদমই রোদ নেই। ছায়ায় ঢেকে আছে চারপাশ। কী মায়াময় পরিবেশ। প্রকৃতি তোমাকে বরণ করে নিতে চাইছে। তোমার আসতে একটুও কষ্ট হবে না। মনটা তোমার সান্নিধ্য খুব খুব করে চাইছে। বউ, আমাকে বিমুখ করো না।

বউ বউ করো না। বাসায় এখন কেউ নেই। এখন বের হওয়ার প্রশ্নই আসে না। 

ফারিয়া তো একটু পর স্কুল থেকে এসে পড়বে। তারপর না হয় রওয়ানা দাও। 

মেয়েকে একা বাসায় রেখে আসতে পারবো না। এতদিন তো এসেছো। আজ আবার কী হলো? 

বাচ্চা মেয়েকে কি একা রেখে আসা যায়? কীভাবে আসি তা তো তোমার অজানা নয়। প্রতিবারই কাউকে না কাউকে ডেকে এনে ম্যানেজ করতে হয়। আজ সবাই খেলায় মগ্ন। কাউকে ডাকা যাবে না। আর তোমার অফিস তো কাছেও না। এত দূরে যাওয়াও সম্ভব নয়।

বললাম তো, আজ বেশি সময় লাগবে না। একটা সিএনজি নিয়ে চট করে চলে আসো। 

এইভাবে তোমার অফিসে যাওয়াটা মোটেও শোভনীয় নয়। ডেটিং করতে কি কেউ অফিসে যায়? কখন কে দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি।

আমি তো আগে কখনো তোমাকে অফিসে আসতে বলিনি। আজ বুঝে-শুনেই আসতে বলছি। তুমি এলে আমার অফিসটাও তোমার দেখা হয়ে যাবে। আর তোমাকে নিবিড়ভাবে দেখতে পারবো আমি। 

এমন আদিখ্যেতা করছো কেন? আমাকে কখনো দেখোনি?

আরে অফিসে তো দেখিনি। এই দেখার আলাদা একটা মজা আছে। রোমাঞ্চ আছে। তোমাকে তো নানাভাবে দেখতে ইচ্ছে করে। 

আর কাকে কাকে এই অফিস দেখিয়ে মজা নিয়েছো?

কী যে বলো না। আর কাকে দেখাবো? তুমিই হবে প্রথম। 

তোমার সাহস কিন্তু দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে অফিসে দেখা করার ঝুঁকি কেউ নেয়? 

তোমার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি।

কচু পারো। শুধু কথার ফুলঝুরি। 

লক্ষী বউ আমার, এমন কথা বলতে পারলে? 

যা সত্য তাই তো বললাম। বাহ্, পাকিস্তানের দুই ওপেনারই সেঞ্চুরি করেছে। ওয়ান ডে ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানদের এমন কৃতিত্ব এই প্রথম। তাই না? 

হতে পারে। চলো, আমরাও আজ এমন একটা নজির গড়বো, যা হবে আমাদের জীবনে প্রথম। 

কীসের নজির?

দুই ব্যাটসম্যানই ভারতের বিপক্ষে তাঁদের প্রথম সেঞ্চুরি করেছে। অন্য দলের বিপক্ষে হাফিজ আগে তিনটি করলেও জামসেদের এটি অভিষেক সেঞ্চুরি। আমাদের তো এমন সুযোগ নেই। তবে কিছু একটা নিশ্চয়ই করতে পারবো। যা আমাদের জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

দুজনের সেঞ্চুরি অবিকল আমাদের সম্পর্কের মতো। তুমি আগে তিনটা প্রেম করেছো। আমার ক্ষেত্রে তুমিই প্রথম। 

কীসের মধ্যে কি পান্তা ভাতে ঘি। কোথায় আমি তিনটা প্রেম করলাম?

দেখো, আমার কাছে লুকিয়ো না। তোমার অতীতের অনেক খবর আমি জানি। তুমি তো দুষ্টের শিরোমণি লঙ্কার রাজা/চুপি চুপি খাও তুমি চানাচুর ভাজা। তুমি যে ডুবে ডুবে জল খাওয়া লোক, সেটা কি আমি জানি না? সবকিছু যেনেও কেন যে তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি?

তুমি অকারণেই আমাকে লেগ পুলিং করছো। সংসারের বাইরে আমার একটাই প্রেম। একটাই ভালোবাসা। আর সেটা হলো তুমি। তুমিও যেমন, আমিও তেমন।

মোটেও না। এ বিষয়ে তুমি আমার চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে আছো। তোমার মায়াবী স্পিনের ঘূর্ণি দিয়ে এর আগের কত জনের হৃদয় বধ করেছো, তার পুরো হিসাব তো আর আমার জানা নেই।

তোমার এই কথা একদমই ঠিক না। তুমি তো জানো, আমি সহজে সবার সঙ্গে মিশতে পারি না। কেউ এগিয়ে না এলে কথাও বলতে পারি না। ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতে নামলে নিজেকে মানিয়ে নিতে বেশ সময় লেগে যায়। 

সেঞ্চুরি তো ঠিকই মারতে পারো। তাই না? 

সেটাইবা পারলাম কোথায়? তবে এটা ঠিক, মানিয়ে নিতে পারলে রান তুলতে তেমন একটা সমস্যা হয় না। তোমার সঙ্গে যেমন স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাট করতে পারি। এমন ব্যাটিং উইকেটের সুবিধা আমাকে আর কে দেবে? আমার জীবনের পরম সৌভাগ্য যে তোমাকে পেয়েছি। 

তুমি তো আস্ত একটা ছুপা রুস্তম। মিষ্টি মিষ্টি কথা তো ভালোই বলতে পারো। এমন কথা শুনলে মেয়েদের কি না পটে উপায় আছে? আমি তো মূলত তোমার কণ্ঠ শুনেই ফিদা হয়ে যাই। 

দেখো, শচীন টেন্ডুলকার যেমন রান করতে ভালোবাসে, মুত্তিয়া মুরালিধরন যেমন উইকেট নিতে ভালোবাসে, আমিও তেমনি তোমাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। এমন ভালোবাসা আমার জীবনে কখনও আসেনি। এটা তোমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। 

চারপাশে তো জন্টি রোডসের মতো ফিল্ডাররা সতর্কভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তারা তো ক্যাচ বা রান আউট করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ওয়ানডে ক্রিকেটে আউট হলে পুনরায় ব্যাট করার সুযোগ থাকে না। আমাদেরও ভাগ্যেও তেমনটাই হবে। আর এই খেলায় সামাজিক স্বীকৃতি নেই। আমরা কোনোভাবে কট হলে কী অবস্থা হবে, সেটা কি বুঝতে পারছো না? মহা কেলেঙ্কারির একশেষ হবে। 

তা তো জানি। আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান। তাছাড়া নিন্দার কাঁটা যদি না বিধিল গায়ে/প্রেমের কি সাধ আছে বলো।

তুমি তো চলো হুজুগে। আগপিছ কিছু দেখো না। বিপদের কথাও ভাবো না। কোনো অঘটন ঘটলে তুমি না হয় সব ম্যানেজ করে নিতে পারবে। আলগোছে দুধের সরটুকু খেয়ে মুখ মুছে নিপাট ভদ্রলোক সাজবে। আমার পরিণতি কী হবে বুঝতে পারো?

তোমার কথা শুনে বুকের মধ্যে বাজছে, পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া?/যব পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া?/পেয়ার কিয়া তো চোরি নাহি কি, পেয়ার কিয়া/পেয়ার কিয়া তো চোরি নাহি কি/চুপ চুপ আয়ে বর্না কিয়া? এ তো চিরকালের কথা। তা নিয়ে আগাম ভেবে আর কী করবে? তবে যা কিছু ঘটুক না কেন আমি তোমার সঙ্গে আছি। থাকবো। আমার ওপর এই আস্থা নিশ্চয়ই তোমার আছে।

জানি না। বিপদে পড়লে কী হবে কে জানে? তখন সবার অবস্থা হয়, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। এই একটু লাইনে থাকো তো। বোধহয় ফারিয়া এসেছে। গেট খুলে দিয়ে আসি। 


হ্যালো। 

হু। 

কী করো?

কিছুই করছি না। তোমার সঙ্গে করার অপেক্ষায় আছি। 

অসভ্য একটা।   

লক্ষীবাবু, আর দেরি করো না। জলদি জলদি চলে আসো।

তুমি এমনভাবে কথা বলো, যেন আমার কোনো বন্ধন নেই। ঝাড়া হাত-পা। চাইলেই যখন-তখন হুট করে তোমার কাছে ছুটে আসতে পারি। আমার তো একটা সংসার আছে। নাকি?

তা তো জানি। একটু ম্যানেজ করে আসো না বাবু।

তুমি মনে করো সব কিছু খুব সোজা। তুড়ি বাজালেই সব হয়ে যায়। আমাকে কত কিছু যে ভেবে চলতে হয়, তা তুমি বুঝতে চাও না। 

বুঝবো না কেন? ফিল্ডারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকানো তো সহজ কাজ নয়। কিন্তু এত দিনে তো তুমি অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠেছো। তোমার তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। 

তোমার যত অবান্তর কথা। তাই যদি হতো, তাহলে তো অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যানরা প্রতি ম্যাচেই সেঞ্চুরি হাঁকাতে পারতো। তাই না?

তোমাকে কেন এত ভালো লাগে জানো?

হঠাৎ আবার ভালো লাগার কী হলো?

তোমার মধ্যে আছে একজন অধিনায়কের বিচক্ষণতা। মাঠে ও মাঠের বাইরে খুব চমৎকারভাবে ম্যানেজ করতে পারো। তুমি একজন দক্ষ অলরাউন্ডারও। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং-এ তোমার জুড়ি মেলা ভার।

থাক থাক। আমার আর গুণকীর্তন করতে হবে না। অনেক করেছো। তোমার লোপ্পা বলে আমি প্রলুব্ধ হচ্ছি না। দেখছো না, ভারতীয় স্পিনারদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন না ইউনিস খান। ছক্কা না মেরেও খুব সাবলীলভাবে ব্যাট করে রানের গতি ঊর্ধ্বমুখী রেখেছে। আজ মনে হয় ভারতের খবর আছে। পাকিস্তান বড় ইনিংস গড়তে যাচ্ছে।

তুমি তো দেখি ইদানীং ক্রিকেটের দারুণ অনুরাগী হয়ে ওঠেছো। ভালো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও করতে পারো। 

দেখতে হবে না কার সঙ্গে পেয়ার-মহব্বত করছি।

আমি কিন্তু ক্রিকেটের টেকনিক্যাল বিষয় তেমন বুঝি না। তবে কমনসেন্স বলছে, ভারত কিন্তু সহজে ম্যাচ ছেড়ে দেবে না। ঢাকার মাঠে দু’দলের পরিসংখ্যানে ভারত এগিয়ে আছে। এরআগে তারা পাঁচটিতে আর পাকিস্তান তিনটিতে জিতেছে। যদিও দু’দলের সর্বশেষ ম্যাচে জয়ী হয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু গত বছর বিশ্বকাপ জয়ের পর ভারতীয় দলটির আত্মবিশ্বাস এখন উঁচুতে। অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে গৌতম গম্ভীর, শচীন টেন্ডুলকার, বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, সুরেশ রায়নার সমন্বয়ে দুর্ধর্ষ ব্যাটিং লাইনআপ। আর এই এশিয়া কাপে ফর্মের তুঙ্গে আছে কোহলি। সে একাই খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে৷ 

তোমার মতো আর কি।

আমি আবার কী করলাম? 

তুমিও তো দারুণ ফর্মে আছো। না হলে আমাকে অফিসে আমন্ত্রণ জানানোর দুঃসাহস পাও কী করে?

তুমিই তো আমার সাহস। তোমার সাহসে বলীয়ান হয়ে। অ্যা-ই জানু, পাকিস্তানের ইনিংস তো শেষ হতে চললো। তুমি রওয়ানা দিচ্ছ না কেন?

প্লিজ জানটু আজকে থাক। আরেক দিন না হয় আসবো।

সোনাবাবু, এমন করো না। আজকের দিনটাতে অন্তত আমাকে আশাহত করো না। না এলে খুব কষ্ট পাবো। 

তুমি কেন যে এমন করো? কিছু বুঝতে চাও না। আচ্ছা দেখি, কাউকে ম্যানেজ করে বাসায় আনতে পারি কি-না। না পারলে আসতে পারবো না।

তুমি চাইলেই পারবে। তুমি তো গুগলি বলে ওস্তাদ। এই মোক্ষম অস্ত্র দিয়ে সহজেই ব্যাটসম্যানকে বোকা বানিয়ে দিতে পারো। 

ঘোড়ার ডিম। ফোন রাখছি। একটু পর তোমাকে জানাচ্ছি। 

আচ্ছা, সোনামণি।

হ্যালো। ফোন ধরতে এত সময় লাগে? কার সঙ্গে কী করো?

কার সঙ্গে কী করবো? আমার জীবনে তুমি ছাড়া আর কে আছে বলো? এই ফাঁকে ওয়াশরুমে গিয়ে একটু ওজন কমালাম।

এই শোনো, এখন কিন্তু ড্রেস বদলাতে পারবো না। যা পরে আছি, তাই পরেই আসছি। 

লাগবে না। তোমাকে যে কোনো ড্রেসেই সুন্দর লাগে। আর ড্রেস না থাকলে আরো বেশি সুন্দর লাগে। 

এই পাজি, ইতরামো করবে না। আরেকটা কথা, তুমি আমার সঙ্গে কোনো বদমাইশি করবে না। এই শর্ত মানলে আসবো নতুবা আসবো না। মানবে তো শর্ত? 

তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে/ভালোবাসবে ওগো শুধু মোরে/তাই চম্পা বকুল করে গন্ধে আকুল.......

তোমার মনে এখন খুব স্ফূর্তি তাই না? দাঁড়াও, আমি এসে তোমার স্ফূর্তি বের করছি।

কীভাবে করবে? শুয়ে, বসে নাকি দাঁড়িয়ে? 

তুমি না একদম নষ্ট হয়ে গেছো। সারাক্ষণই তোমার মুখে অসভ্য কথাবার্তা। কোনো লাগাম নেই। আমি কিন্তু সিএনজিতে। রাস্তায় তো গাড়ির সংখ্যা খুব কম। লোক চলাচলও বেশি নয়। খুব দ্রুতই চলে আসছি।

বলেছিলাম না। তুমি তো আমার কথা বিশ্বাস করতে চাও না। এমন একটা ক্রিকেট ম্যাচের আকর্ষণ কে আর মিস করবে বলো? এ কারণে লোকজন ঘর হতে বের হয়নি। টিভির সামনে নিমগ্ন হয়ে আছে। এজন্যই আজ তোমাকে আসতে বলা। আসো তুমি। আমি তোমাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য অফিসের গেটে দাঁড়িয়ে আছি।

থাকো। আশেপাশে পরিচিত কেউ আছে কি-না খেয়াল রেখো। 


দেখছো, কত তাড়াতাড়ি চলে এসেছো। 

ইশ্, এভাবে যদি প্রতিদিন চলাচল করা যেত! 

টুনটুনি, তোমাকে কিন্তু অন্য রকম লাগছে। 

কী রকম?

গোপন অভিসারে আসা লাস্যময়ী নায়িকার মতো। যেন আদর পাওয়ার জন্য আকুল হয়ে আছো। 

এইসব অভিসন্ধিমূলক কথা বলবে না। তোমার মন খারাপ করতে চাইনি বলে চলে এলাম। অফিসটা তো বেশ ভালোই। চারপাশে নিরিবিলি। লোকজন সব কোথায়? 

সবাই খেলা দেখতে গেছে। তাছাড়া অফিস টাইম তো পেরিয়ে গেছে। কেন, এই নির্জনতা তোমার ভালো লাগছে না? 

তা বলছি না। অফিসের পরিবেশ এমন হয়, আমার জানা ছিল না। খেলার কী অবস্থা? 

তুমি যখন এসেছো, শুরু করতে দেরি হবে না। 

অ্যাই বদমাশ, আমি ক্রিকেট ম্যাচের কথা বলছি।

তাই বলো। আমি তো ভেবেছি, তোমার বুঝি তর সইছে না। পাকিস্তান ছয় উইকেটে তুলেছে তিনশ’ ঊনত্রিশ রান।

পাকিস্তানের বিপক্ষে এত রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড ভারতের নেই। তাই না? ঢাকার মাঠেও কোনো দলের এত রান চেজ করার রেকর্ড নেই। খেলা কি জমবে নাকি একতরফা হবে? কী মনে হয় তোমার?

তুমি যে পরিসংখ্যানের কথা বললে তাতে করে ভারতের জন্য এটা বড় একটা চ্যালেঞ্জ। যদিও ক্রিকেটে কোনো কিছু অসম্ভব নয়। কেউ একজন দাঁড়িয়ে গেলে ম্যাচটা জমবে ভালো। এখন এই ক্রিকেটের চিন্তা বাদ দিয়ে চলো আমরা আমাদের ম্যাচটা জমিয়ে তুলি।

সরো, একদম অসভ্যতামি করবে না। এমনিতেই এভাবে আসাটায় আমার মন সায় দেয়নি। তারপর তুমি এমন করলে আমি কিন্তু এখনই চলে যাবো।

আহ্ রাগ করছো কেন। তোমাকে এভাবে কাছে পেয়েছি, একটু ওয়ার্মআপ তো করতে দেবে। ম্যাচ খেলার বিষয়ে না হয় পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। 

তোমারে তো আমি রগে রগে চিনি। বসতে দিলে শুতে চাও। 

এমনটা তো শুধু তোমার সঙ্গে করি। আর কারো সঙ্গে তো এমন করি না। তবে একটা মনোবাসনা পূরণ করার জন্য আজ এত পরিকল্পনা করে তোমাকে আসতে বলেছি। দিনটি স্মৃতিপটে খোদাই করে রাখতে চাই। এজন্য তোমার সহযোগিতা চাইছি। 

আমি তো তোমাকে আগেই বারণ করে দিয়েছি, বদখত কোনো কাজ চলবে না। তোমার কোনো মনোবাসনাও পূরণ করতে পারবো না। 

তা তো জানি, বারণ তুমি করবেই। বোলার ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়ে দিতে চাইবে আর ব্যাটসম্যান বোলারের ওপর চড়াও হবে, এটাই তো রীতি। তা না হলে তো খেলায় মজা পাওয়া যায় না। একতরফা খেলায় কোনো আনন্দ নেই।

খলের তো ছলের কোনো অভাব হয় না। এই টিভিটা ছাড়ো তো। ভারত কি ব্যাটিং শুরু করেছে?

হু। আজকে বোধহয় মোহাম্মদ হাফিজের দিন। দ্বিতীয় বলেই গৌতম গম্ভীরকে পত্রপাঠ বিদায় করে দিয়েছে। 

ভারত ভালোই চাপে পড়ে গেছে। এই চাপ কাটিয়ে ওঠা এত সহজ হবে না। অ্যাই চন্ডু, তুমি কি আমাকে ভারত মনে করছো নাকি? এত চাপাচাপি করছো কেন? হতচ্ছাড়া একটা। কোনো মাত্রাজ্ঞান নেই। কখন যে কে এসে পড়বে। জানালার পর্দা ভালোভাবে টেনে দিয়ে আসো। 

আহ্ সোনা, তুমি কত ভালো। তাই আমার জগতটা হয়ে গেছে আলো। 

তা তো বলবেই। তোমার তো বদগিরি ভালো লাগে। 

টেন্ডুলকারের মুখাবয়বে কেমন যেন বিষণ্নতা ছড়িয়ে আছে। কিন্তু কোহলিকে বেশ ডেসপারেট মনে হচ্ছে। প্রফুল্ল মেজাজেই ব্যাট করছে। বড় টার্গেট চেজ করতে হবে, তা নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে না। 

তোমারও তো কোনো দুর্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। ভাবটা এমন, যেন নিজের বাড়িতেই আছো। কোনো হুঁশজ্ঞান নেই। অথচ যে কোনো মুহূর্তে বিপদ আসতে পারে।

খেলা কোথায় হচ্ছে, সেটা তো কোনো বিষয় নয়। খেলায় বিপদ আসতেই পারে। তা নিয়ে ভেবে তো খেলা থেকে বিরত থাকা যাবে না। তবে খেলাটাও একটা সৃজনশীল কাজ। খেলতে হয় অভিনিবেশ সহকারে। দুশ্চিন্তা করলে তো মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায়। খেলায় ছন্দপতন ঘটে। দেখলা না, মনোনিবেশ করতে না পারায় শূন্য রানে আউট হয়ে গেল গৌতম।

তোমার তো দেখি টেস্ট ম্যাচ খেলার মেজাজ। কিন্তু আসল কাজের সময় তো ছটফট করো। আজ এত সময় নেই। উঠো উঠো। 

উঠছিরে বাবা। কিন্তু খেলাটা তো ভালো জমলো না। গৌতম গম্ভীরের মতো পরিণতি হবে, বুঝতে পারিনি। আমার এখন একটা হিন্দি গানের লাইন মনে পড়ছে, ‘ম্যায় আনাড়ি তু খিলাড়ি’। আসলেই নিজেকে আনাড়ি মনে হচ্ছে। 

যত ঢঙের কথা। এবার চলো তো। রাত হয়ে যাচ্ছে।

টেন্ডুলকার সহজাত ভঙ্গিমায় ফিফটি করে চলে গেল। 

হায়! টেন্ডুলকার আউট! ওয়ানডে ক্রিকেটে সেঞ্চুরির ফিফটি আর হলো না।

সাঈদ আজমলের দোসরা ঠিকমতো বুঝতে পারেনি। স্লিপে ক্যাচ দিয়েছে। 

যাই বলো না কেন, মন এক জটিল রহস্যের আধার। যত বড় ব্যাটসম্যান হও না কেন মনঃসংযোগ করতে না পারলে খেলায় সুবিধা করতে পারবে না। 

এ কথা বলছো কেন? টেন্ডুলকার তো খুব একটা খারাপ খেলেনি। এই চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সেও ব্যাটিংয়ে কোনো জড়তা নেই। এখনো দলের অন্যতম স্তম্ভ। দেখলা না তাঁকে আউট করার পর পাকিস্তান দলের যেন ম্যাচ জয়ের উচ্ছ্বাস। তবে টেন্ডুলকার আর কিছুক্ষণ থাকলে ভারত স্বস্তিতে থাকতে পারতো। 

শুধু টেন্ডুলকারের কথা বলছি না। এই মুহূর্তে মনের মধ্যে দ্বৈত অনুভূতি কাজ করছে। নিজের তো বটেই,  টেন্ডুলকারের জন্যও। হয়তো অনেক প্রত্যাশা, অনেক প্রস্তুতি কিংবা অনেক আয়োজন করা হলো৷ ভিতরে ভিতরে টগবগানি। ছটফটানি। রগরগানি। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে মনটা দপ করে নিভে গেল। তখন সবকিছু কেমন ম্রিয়মাণ হয়ে যায়। জীবন তো আসলেই এমনই। কখন জ্বলবে, কখন নিভে যাবে, নিশ্চিত করে বলা যায় না। তাই না?

হঠাৎ দেখি দার্শনিক হয়ে গেলে! চলো চলো। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। 

হুম, চলো। কোহলি তো একাই ফাটিয়ে দিচ্ছে। কিছু একটা করে ফেলবে বলে মনে হচ্ছে। রোহিত শর্মা অবশ্য ভালোই সাপোর্ট দিচ্ছে। 

সাপোর্ট দিলেই কেবল জ্বলে ওঠা যায় না। খেলায় ভালো করতে হলে কোহলির মতো একাগ্রতা ও গভীর মনঃসংযোগ থাকতে হয়। না হলে চুপসে যেতে হয়। কোনো কাজে তোমার মতো অস্থির হলে চলে না। 

তা তো অবশ্যই। কিন্তু সবাই তো আর বিরাট কোহলির মতো ড্যাশিং ব্যাটসম্যান হতে পারে না।

জান, তোমার কি কোনো কারণের মন খারাপ হয়ে গেছে? তোমাকে এত নিষ্প্রভ লাগছে কেন? টেলিফোনে তো তোমাকে দারুণ প্রাণচঞ্চল লাগছিল। নিশ্চয়ই খুশি হতে পারোনি। আসলে সব দিন তো সবকিছু ঠিকমতো হয় না। মনের মধ্যে অস্থিরতা থাকলে কোনো কাজ ঠিকভাবে সম্পন্ন করা যায় না। যে কারণে হোক আজ হয়তো মনঃসংযোগ ব্যাহত হয়েছে। যেমনটা প্রত্যাশা করেছিলে, তেমনটা হয়নি। আরেক দিন নিশ্চয়ই হবে। এ নিয়ে মন খারাপ করার কী আছে?

তোমার কথাই ঠিক। না হওয়ার কারণ তো একটা আছেই। তোমাকে বলেছিলাম না আজকের দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে চাই। এ কারণে তোমাকে আসার জন্য এত পীড়াপীড়ি করেছি। কেন করেছি জানো? আমার দিকে মনোযোগী হওয়ায় তুমি হয়তো খেয়াল করতে পারোনি। আজ শেষ ওয়ানডে ক্রিকেট ম্যাচ খেললো শচীন টেন্ডুলকার। 

তাই না-কি? আর এমন একটা ম্যাচ তুমি দেখতে গেলে না! আমাকেও ভালোভাবে দেখতে দিলে না। অনেক বড় একটা ঘটনা থেকে বঞ্চিত হতে হলো। 

আসলে আমি ইচ্ছে করেই খেলা দেখতে যাইনি। এই ম্যাচটা সামনা-সামনি দেখতে চাইনি। যে কোনো বিদায় আমাকে মথিত করে। আর টেন্ডুলকারের মতো একজন ক্রিকেটারের বিদায় খুব কষ্টকর। এই কষ্টটা তোমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চেয়েছি। অদ্ভুত ব্যাপার কি জানো, টেন্ডুলকার শূন্য দিয়ে শুরু করেছিলেন ওয়ানডে ক্রিকেট। সেদিন কি তিনি ভাবতে পেরেছিলেন কেমন হবে তাঁর ক্যারিয়ার? পারেননি। কিন্তু শূন্যতাকে তিনি যেভাবে পূর্ণতা দিয়েছেন, তার কোনো তুলনা চলে না। ২২ বছরের বেশি বর্ণাঢ্য ওয়ানডে ক্রিকেট ক্যারিয়ার। তা কানায় কানায় পরিপূর্ণ। গত ম্যাচেও বাংলাদেশের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেঞ্চুরির শতক পূরণ করেন। তার মতো জাত ক্রিকেটার সহসা দেখতে পাওয়া যায় না। এই প্রজন্মে এমন একজন ক্রিকেটারকে পেয়েছে, তা অত্যন্ত সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর কত কত স্মৃতি। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে, আর কখনো রঙিন পোশাকে উইলো হাতে তাঁকে দেখা যাবে না। অবসান ঘটলো গৌরবময় এক অধ্যায়ের। সেটাও কি-না ঢাকার মাঠে! তাঁর বিদায়ে অনেকটাই রঙ হারাবে ক্রিকেটের ক্যানভাস।  

বয়সের কারণে টেন্ডুলকার এখন অনেকটাই অস্তমিত সূর্য। এখন সময় বিরাট কোহলিদের। এটাই তো জগতের নিয়ম। তাই না? 

এই নিয়ম অনুসারে আমরাও জানি না, আমাদের এই সম্পর্কের পরিণতি কী? জীবনের বাঁকে বাঁকে কত যে রহস্য ছড়ানো। তার হদিস আমরা কতটুকু জানি? তবে মানুষ বেঁচে থাকে স্মৃতি নিয়ে। টেন্ডুলকারের শেষ ওয়ানডে ম্যাচটির কথা যখন আমাদের স্মৃতিতে ভেসে ওঠবে, তখন আমরা কে কোথায় থাকবো জানি না। কিন্তু এই দিনটির কথা তুমি কিংবা আমি কখনো কি ভুলতে পারবো?

বুধবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেন


ভরা বর্ষার মতো যেন তাঁর কণ্ঠসুধা। বর্ষায় নদীর পানি যেমনি উপচে উপচে পড়ে, তেমনিভাবে তাঁর গলায় আপ্লুত হয়েছে সুরের উচ্ছ্বাস। বাঁধনহীন হয়ে ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশে ভেসে ওঠেছে ইন্দ্রধনু। তাঁর গান কোথাও বাজলে চারপাশটা ঝলমল করে। ভরিয়ে দেয় সুরের ঝর্ণাধারায়। সমস্ত কিছুকে আড়াল করে দেয়। সুরের ঝংকারে সরগরম করে দেয় নিস্তব্ধ দুপুর কিংবা মায়াবী সন্ধ্যা। ধুপের মতো ভেসে ওঠে ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতি।


হয়তো কিছুই নাহি পাবো

তবুও তোমায় আমি দূর হতে ভালোবেসে যাব

.........

ধুপ চিরদিন নীরবে জ্বলে যায়

প্রতিদান সে কি পায়

এভাবে আকুল হয়ে গাইতে থাকলে না পাওয়া সেই ভালোবাসা কি আনমনা করে দেয় না? স্মৃতিপটে মর্মরিত হয় ফেলে আসা দিনগুলো। আনন্দময় ক্ষণগুলোও বেদনা হয়ে আর বেদনার মুহূর্তগুলো আনন্দ হয়ে সৌরভ ছড়িয়ে দেয়। 


কিছুক্ষণ আরও না হয় রহিতে কাছে

আরও কিছু কথা না হয় বলিতে মোরে


এই গান যখন শুনতে পাই, বুকের মধ্যে কেমন কেমন করতে থাকে। প্রিয় মানুষ ছাড়া এমনভাবে কে আর মিনতি করবে? হায়! হাল আমলে এমনভাবে কেউ আর নিবেদন করে না। সবটাই যেন স্মৃতির অংশ হয়ে গেছে। আর সেই স্মৃতি জাগিয়ে দেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।

যেন কোনো সুদূরকাল থেকে বেজে চলেছে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানগুলো। চিরায়ত সব গান। এখন হয়তো তাঁর গান সেভাবে শোনা হয় না। কিন্তু কাছে বা দূরে কোথাও যখন বেজে ওঠে, কেড়ে নেয় যাবতীয় মনোযোগ। তখন হৃদয় দিয়ে শুনতেই হয়। তা যে মরমে গিয়ে পৌঁছায়। সুচিত্রা সেনের মায়াবী সৌন্দর্য আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠমাধুর্যের সম্মিলনে যেন রূপকথার জগতে নিয়ে যেত। সমবয়সী এই দুই শিল্পীর যোগসূত্রে বাংলা চলচ্চিত্র সন্ধান পেয়েছিল স্বর্ণযুগের। কালের নিয়মে এই জুটিটা অনেক আগেই টুটে গেছে, তারপরও তারা ছিলেন। সুচিত্রা সেন চলে গেছেন কয়েক বছর আগে। তখন আবেগময় কণ্ঠে সন্ধ্যা বলেছিলেন 'শরীর চলে গেল, কণ্ঠ পড়ে রইল'। এ থেকে দুজনের সম্পর্কের বুননটা সহজেই অনুধাবন করা যায়। এবার সন্ধ্যা পেরিয়ে পাড়ি দিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। কণ্ঠও আর রইলো না। রইলো কেবল নস্টালজিয়া।

১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২

মঙ্গলবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

আত্মসম্মান

  


এই দুর্দিনে বিকাশ অ্যাকাউন্টে এতগুলো টাকা কে পাঠালো? কারও টাকা কি ভুল করে চলে এলো? সেটার সম্ভাবনাই বেশি। তাকে টাকা পাঠাতে পারে, এমন কারও কথা তার অন্তত জানা নেই। আর পাঠালে তো তাকে আগেই জানিয়ে দিত। তাকে তো কেউ কিছু জানায়নি। বরং স্বভাব বিরুদ্ধভাবে আকার-ইঙ্গিতে খুবই ঘনিষ্ট কয়েকজনের কাছে নিজের সমস্যা ও সংকটের কথা বলেছিল। নিরূপায় হয়ে আপৎকালীন কিছু টাকা ধার চেয়েছিল। কোনো রকম সহযোগিতা তো পাওয়াই যায়নি, উল্টো যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এমন অবস্থায় এতগুলো টাকা কোথা থেকে এলো? এর কোনো হদিস মিলছে না। আর ভুল করে যদি টাকা চলেও আসে, তাহলে তো অবশ্যই তাকে ফোন করার কথা। এখনও কেউ ফোন করেনি। অবশ্য সে জন্য কিছু সময় লাগতে পারে। যাকে টাকা পাঠানোর কথা, সে যখন না পাওয়ার বিষয়টি জানাবে, তখন হয়তো প্রাপকের হুঁশ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আরও অপেক্ষা করা যেতে পারে। এমনটাই ভেবে নেয় মুহিবুর।

জীবনে কখনও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি সে। মোটামুটিভাবে খেয়ে পড়ে দিনগুলো চলে যাচ্ছিল। উপচে পড়ার মতো কিছু ছিল না। আবার খুব বেশি সংকটও ছিল না। মাঝেমধ্যে অনটনে পড়তে হয়েছে। তা যেভাবে হোক সামলানো গেছে। মধ্যবিত্ত পরিবারে যেমনটা হয় আর কি। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার পর জীবনটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। প্রথম দিকে বৃত্তের পরিধি একটু একটু করে সংকুচিত হতে থাকলেও ভেবেছে, একটা সময় এই সমস্যা কেটে যাবে। ভাবনার সঙ্গে বাস্তবতা মিলছে না। সমস্যা নিরসন তো হচ্ছেই না, দিনে দিনে তা বেড়েই চলেছে। 

মুহিবুর যে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিল, সেখানকার পরিস্থিতি খারাপ না হলেও খামখেয়ালিভাবে হাতেগোনা যে কয়েকজনকে ছাঁটাই করা হয়, সে তাদের একজন। করোনার মধ্যেও কাজ করতে করতে সে অসুস্থ হয়ে যায়। আর অসুস্থ হলে এখন সবার মধ্যে একটা ভাবনাই কাজ করে। যদিও তার কিছু সিম্পটন করোনার মতো মনে হয়। যে জন্য তার করোনা পরীক্ষা করার আগেই সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। অফিস থেকে তাকে ছুটিতে থাকতে বলা হয়। পরীক্ষায় তার রেজাল্ট নেগেটিভ আসে। সুস্থ হয়ে অফিসে যোগাযোগ করলে তাকে বলা হয় যোগদানের কথা জানিয়ে দেওয়া হবে। তিন দিন পর মৌখিকভাবে জানানো হয়, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তার আর এই প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন নেই। 

এমন কিছুর জন্য মুহিবুর একদমই প্রস্তুত ছিল না। তবে কেন তার প্রয়োজন নেই, সে অনুমান করতে পারে। চাকরির ধারাবাহিকতা ও বয়সের দিক দিয়ে সে ছিল সবার সিনিয়র। এটা ছিল বড় একটা ফ্যাক্টর। তাছাড়া সে কারও সাতপাঁচে থাকতো না। অফিসের কোথায় কী হচ্ছে, তার খোঁজখবরও খুব একটা রাখতো না। সহকর্মীরা তাকে নিরীহ ও সজ্জন ভদ্রলোক হিসেবে সম্মান করতো। নিজের কাজটা মন দিয়ে করার ব্যাপারে সে কখনও কার্পণ্য করতো না। বুঝতে পারে, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা সহকারে কাজ করলেও অভ্যন্তরীণ দলাদলির কারণে তার ওপর খড়গটা নেমে এসেছে। কারও পক্ষের না হলে, কারও তোষামোদ না করলে কিংবা ক্ষমতার দাপট দেখাতে না পারলে কোথাও টিকে থাকা কঠিন। এই অপারগতাই হয়ে উঠে অযোগ্যতার মাপকাঠি। 

দীর্ঘ দিন একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিল, সেখান থেকে অব্যাহতি দিলেও তাকে একটি টাকাও দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে দেনদরবার করাটা তার কাছে রুচিবহির্ভূত মনে হয়েছে। মনে করেছে, এত বড় একটি প্রতিষ্ঠান, তাকে যদি ঠকিয়ে ভালো থাকতে পারে, থাকুক। অবশ্য শুভাকাক্সক্ষী কেউ কেউ তাকে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছিল। মামলার মতো একটি জটিল প্রক্রিয়ায় সে জড়াতে চায়নি। সে বরাবরই নির্ভেজাল থাকতে চেয়েছে। কিন্তু চাইলে কি আর নির্ভেজাল থাকা যায়? 

চাকরিটা হারিয়ে অথৈ সাগরে পড়ে যায় মুহিবুর। সময়টা এখন এমন, নতুন চাকরি পাওয়া আর হাতে চাঁদ পাওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। একটা সময় কর্মক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার মূল্য দেওয়া হতো। আর এখন অভিজ্ঞ হলে সে হয়ে যায় অচল মুদ্রার মতো। প্রতিদিনই কেউ না কেউ চাকরি হারাচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেকেই সান্ত¡না দেয়। আশ্বস্ত করে। কিন্তু কোথাও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। জমানো কিছু টাকা ছিল, তাই ভেঙে ভেঙে কোনো রকমে চলছিল। সেটাও ফুরিয়ে গেছে। সন্তানদের স্কুল-কলেজ বন্ধ। পড়ালেখা অনিশ্চিত হয়ে পড়লেও কোনো খরচ দিতে হচ্ছে না। সে দিক দিয়ে খানিকটা বাঁচোয়া। 

এই ঢাকা শহরে একটা পরিবার নিয়ে কত দিন এভাবে চলা যায়? সংসারে স্ত্রী, দুই সন্তান, বাবা-মা। আর সবকিছু বাদ দিলেও খাওয়া-দাওয়া, বাড়ি ভাড়ার ব্যয় কীভাবে মিটানো যাবে? অনেকেই টিকতে না পেরে গ্রামে চলে গেছে। তার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। নিজের অসহায়ত্বের কথা সবাইকে তো মুখ ফুটে বলাও যায় না। অবশ্য বললেও কোনো উপকার হবে বলে মনে হয় না। খুব কাছের মানুষদের কাছে জীবনে প্রথম কিছু টাকা লোন চেয়েছিল। কেউই সাড়া দেয়নি। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এখন অন্য কারও কাছে হাত পাতলে কী আর হবে? সে ক্ষেত্রে সাহায্যের জন্য ভিক্ষা করা ছাড়া তো বিকল্প পথ নেই। সেটাইবা কীভাবে সম্ভব?

জীবনে সে বড় কিছু চায়নি। পরিবার-পরিজন নিয়ে আত্মসম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকাটাই তার কাছে হয়ে উঠে সম্মানজনক। এই আত্মসম্মানের জন্য কারও কাছে কখনো আপস করেনি। এই একটা কারণে অনেকের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তাতে তার কিছু এসে যায়নি। সে তার মতো করে চলেছে। তার চোখের সামনে পরিচিত কত জন রাতারাতি অর্থ-কড়ি, গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়েছে। কীভাবে হয়েছে, সেটাও দেখেছে। সেই পথ অনুসরণ করলে হয়তো সেও বিত্তশালী হওয়ার রাস্তায় হাঁটতে পারতো। আর কিছু না হোক, অন্তত স্বাচ্ছন্দ্যে তো থাকা যেত। তেমনটা সে হতে চায়নি। এখন বুুঝতে পারে, জীবনে অনেক ভুল করেছে। এখন তো আর এই ভুল পরিমার্জন করার সুযোগ নেই। সময় গড়িয়ে গেছে। বয়স বেড়েছে। এখন মনে হচ্ছে, জীবনে কোনো সিদ্ধান্তই সে ঠিকঠাক মতো নিতে পারেনি। 

দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন কিংবা সমাজে বিশিষ্ট, এমন অনেকের সঙ্গে পেশাগত জীবনে মুহিবুরের পরিচয় হয়েছে। ঘনিষ্টতা হয়েছে। তাদের কারও কারও পছন্দের তালিকায় সে ছিল। এ কারণে অনেকেই তাকে পাওয়ারফুল মনে করে। কিন্তু কখনোই সেই সম্পর্ক ভাঙিয়ে কোনো সুবিধা নেওয়ার কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। কাছের কিংবা দূরের অনেকেই কাজ হাসিলের জন্য চাপাচাপি করেছে। তারপরও নিজেকে বরাবরই সংযত রেখেছে। আসলে তার মন-মানসিকতার সঙ্গে খাপ না খেলে সে কোনো কিছু করতে আগ্রহী নয়। সেটা সে পারেও না। 

তার মানে এই নয় যে এই জীবনে যা যা করেছে, সবটাতে মনের মিল ছিল। তা তো আর সম্ভব নয়। মন সায় না দিলেও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে ছোটোখাটো অনাকাক্সিক্ষত কিছু কাজ তো করতে হয়েছে। সে কারণে অসহায়তা আছে। আত্মগ্লানি আছে। মর্মযাতনা আছে। তারপরও বুকের মধ্যে কিছুটা অহংকার রয়ে যায়। সেটাই তার বেঁচে থাকার পাথেয়। এই করোনাকালে সেটুকু বোধকরি এখন বিসর্জন দেওয়ার সময় এসেছে। 

ভালোবাসার সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায় তার আত্মঅহমিকা। 

তাবাসসুমের সঙ্গে বিয়েটা হলো না নিছক তার গোঁয়ার্তুমির কারণে। সচ্ছল পরিবারের মেয়ে। দেখতে সুন্দর। পড়ালেখায়ও তুখোড়। তার জন্য অনেক ছেলেই দিওয়ানা ছিল। অথচ তার মতো একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেকে কী কারণে যেন তাবাসসুমের ভালো লেগে যায়। সেও তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু চলাফেরা করতে গিয়ে নিজের অর্থনৈতিক দুর্বলতা একটু একটু করে তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখন থেকেই মনের মধ্যে একটা টানাপোড়েন চলতে থাকে। চাকরিটাও আশানুরূপ হয়নি। এই চাকরি দিয়ে তাবাসসুমের পারিবারিক স্ট্যাটাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা তার পক্ষে মোটেও সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে সে একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যায়। সে জানতে পারে, তাবাসসুমের পরিবারও এই সম্পর্কটা মেনে নিতে সম্মত নয়। তারা তাবাসসুমের ওপর বেশ চাপও সৃষ্টি করে।

মেয়েটা তাকে অসম্ভব ভালোবাসতো। সে পারিবারিক সমর্থন ছাড়াই বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করে। তার মন তাতে সায় দেয়নি। এই বিষয় নিয়ে তাবাসসুমের সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ হয়। তার মনোভাব ছিল এমন, বিয়ে হয়ে গেলে তার পরিবার মেনে নিতে বাধ্য হবে। মুহিবুর বলেছিল, মেনে নিলেও ব্যবধান তো ঘুচবে না। তাবাসসুম তাকে আশ্বস্ত করেছিল, এ নিয়ে তোমার ভাবনার কিছু নেই। তোমাকে তো শশুরের ওপর নির্ভরশীল হতে হচ্ছে না। তুমি চাকরি করছো। আমিও সহসাই ভালো কোনো চাকরি পেয়ে যাব। তখন আর তোমার মানসিক যন্ত্রণা থাকবে না। 

তাবাসসুমের চাকরিটাই তার মানসিক অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বড় একটা প্রতিষ্ঠানে যোগ দেয় সে। দু’জনের বেতনের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। পর্যায়ক্রমে তা বাড়তেই থাকবে। আর সে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়বে৷ তখনই সে সিদ্ধান্ত নেয়, সে কখনোই তাবাসসুমের যোগ্য হয়ে উঠতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে সম্পর্কটার ইতি টেনে দেওয়াই উভয়ের জন্যই মঙ্গল হতে পারে। এই সিদ্ধান্তটা কার্যকর করার ক্ষেত্রে সে কোনো দ্বিধা করেনি। চট করে তার সামনে একটা সুযোগও এসে যায়। চাকরিতে যোগদানের পর পরই ট্রেনিংয়ের জন্য তাবাসসুমকে বিদেশে পাঠানো হলে সে এই ফাঁকে সংসার জীবন বেছে নেয়। তাবাসসুমের সঙ্গে আর কখনও যোগাযোগ রাখেনি।

পুরানো দিনের স্মৃতি এখন মুহিবুরের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। কিন্তু ঘরে বসে নিরিবিলি স্মৃতিচারণ করবে, সেই সুযোগও নেই। অভাবের সংসারে চিল্লাপাল্লা লেগেই থাকে। এমনিতেই করোনাকালে বাসার বাইরে যাওয়ার নানান বিধিনিষেধ রয়েছে। তাছাড়া তার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। এক রকম বন্দি জীবন। সব মিলিয়ে বেদিশা অবস্থা। কিছুক্ষণ আগেও বাসা থেকে তাগাদা দিয়ে বলা হয়েছে, ঘরে চাল-ডাল একদমই নেই। তার পকেটে টাকাও নেই। অথচ তার বিকাশ অ্যাকাউন্টে অনেকগুলো টাকা পড়ে আছে। তার টানাটানির সংসারে এই টাকা দিয়ে সহজেই একটা মাস চালিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু টাকাটা কার, সেটা তো সে জানে না। না জেনে সেই টাকা কীভাবে খরচ করবে? খরচ করার পর টাকা ফেরৎ চাইলে সে তো দিতে পারবে না। 

এখন সে কী করবে? কথায় আছে, অভাবে স্বভাব নষ্ট। স্বভাব কি নষ্ট করে ফেলবে? আপাতত সে কি এই টাকা দিয়ে সংসার চালিয়ে নেবে? পরেরটা না হয় পরে বিবেচনা করা যাবে। এছাড়া তো গত্যন্তর নেই। ক্ষুধা পেটে তো বুদ্ধি-বিবেচনা কাজ করে না। মাথার মধ্যে উল্টাপাল্টা চিন্তাভাবনা ঘুরপাক খেতে থাকে। আচ্ছা, কেউ কি তাকে পরীক্ষা করছে? অদৃশ্য থেকে হয়তো ভাবছে, তোমার না এত আত্মসম্মান? এখন কী করবে? আত্মসম্মান ধুয়ে ধুয়ে পানি খাবে? দেখি, এখন তুমি কী করো?

অনেক ভাবনা-চিন্তা করার পর যে নাম্বার থেকে টাকাটা এসেছে, সেখানে রিংব্যাক করে মুহিবুর। ফোন ধরার পর সে বলে, এই নাম্বার থেকে আমার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হয়েছে, কে পাঠিয়েছে বলতে পারবেন? জবাবে জানানো হয়, আমাদের প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা লেনদেন হয়, কে কাকে টাকা পাঠায়, সেটা আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এই কথা বলে ফোন কেটে দেয়। 

পরের মাসেও অন্য একটা নাম্বার থেকে একই পরিমাণ টাকা মুহিবুরের অ্যাকাউন্টে জমা হয়। সঙ্গে সঙ্গে সে রিংব্যাক করে। জবাবে বলা হয়, কে পাঠিয়েছে, বলতে পারবে না। মুহিবুর বললো, এই মাত্র টাকা পাঠানো হয়েছে। আর আপনি বলতে পারছেন না? জবাবে বললো, আপনি টাকাটা এখন পেয়েছেন। আমাদের কাছে হয়তো আগেই টাকা জমা দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে সিরিয়াল অনুসারে আপনাকে পাঠাতে কিছু সময় তো লেগেছে। সেটা কি মনে রাখা সম্ভব? তাছাড়া অনেকেই নিজেদের পরিচয় আড়াল করে টাকা পাঠান। আমরা তার পরিচয় জানাতে পারি না। 

এ তো অদ্ভুত এক গোলকধাঁধা। প্রতি মাসে নির্ধারিত পরিমাণ টাকা পাঠানো হচ্ছে। মুহিবুর জানতেও পারছে না। টাকা না থাকায় সংসার চালাতে পারছে না, এখন টাকা পেয়েও মোটেও স্বস্তি পাচ্ছে না। একটা অস্বস্তি তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করতে থাকে। এই দুঃসময়ে কে এভাবে নিঃশব্দে ত্রাতা হয়ে তার পাশে দাঁড়ালো? কোনোভাবেই সে হিসাব মিলাতে পারছে না।

হঠাৎ একদিন মুহিবুরের ফোনে একটা মেসেজ আসে, আমাকে তুমি ভুলে গেলেও আমি তোমাকে ভুলতে পারিনি। তোমার সব খোঁজখবর রাখার চেষ্টা করি। তোমাকে আমার চেয়ে ভালো আর কে চেনে? তোমার অন্তরটাকে তো আমি পড়তে পারি। তুমি এখন যে কারণে অস্থির হচ্ছো, তা লাঘব করার জন্য এই মেসেজ পাঠাতে হলো। না হলে তো ঠিকমতো ঘুমাতে পারছো না। তুমি আমাকে ফাঁকি দিয়ে সটকে পড়েছো, সেই কষ্ট আমার চিরকাল রয়ে যাবে। তবে আমি তো তোমার দূরের কেউ নই। যার সঙ্গে হৃদয়ের লেনদেন হয়েছে, তাকে আমি অন্তরে লালন করে আসছি। আমি শারীরিকভাবে তোমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছি। তবে মানসিকভাবে তোমার কাছেই আছি। এখন তো আমাকে তোমার স্রেফ বন্ধু ভাবতে নিশ্চয়ই সমস্যা নেই। বন্ধুই তো বন্ধুর বিপদে হাত বাড়িয়ে দেয়। তাই না? আশা করি, এতে তোমার আত্মসম্মান ক্ষুণœ হবে না। এটুকু জেনে রাখ, এই আত্মমর্যাদা আছে বলেই তোমাকে ভালোবেসেছি। সেটা কেউ খর্ব করুক, তা আমি কখনও চাইতে পারি না। তবে একটাই অনুরোধ, আমাকে তুমি কখনও দূরের ভেবো না। অন্তত বন্ধু হয়েই থাকতে দাও।

তাবাসসুমের মেসেজ পেয়ে মুহিবুরের বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে রাশি রাশি মেঘ। এই মেঘ থেকে কি বৃষ্টি ঝরবে নাকি আড়ালে থাকা রোদ ঝলমল করে উঠবে, সে ঠিক বুঝতে পারে না।

শুক্রবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

আর দেখা হবে না


তাঁর সঙ্গে আগের মতো আর নিয়মিত যোগাযোগ হতো না বললেই চলে। নাগরিক ব্যস্ততা, যানজটের কোলাহল, শারীরিক অসুস্থতা, করোনাকাল মিলিয়ে না চাইলেও একটা দূরত্ব গড়ে ওঠে। সর্বোপরি এক অপরের সঙ্গে ব্যবধান বাড়িয়ে দেয় ফেসবুক। সামাজিক এই যোগাযোগ মাধ্যমটা বড্ড অদ্ভুত কিসিমের। পার্থিব আর অপার্থিবের মধ্যে পার্থক্যটা ঘুচিয়ে দিতে চায়। সম্পর্কের মধ্যে কেমন একটা ক্যামোফ্লাজ তৈরি করে দেয়। সামাজিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলে শারীরিক উপস্থিতি না থাকলেও মনে হয় পরস্পরের কাছাকাছিই আছি। হাত বাড়ালেই স্পর্শ করা যাবে। তিনি ফেসবুকে বেশ সক্রিয় থাকতেন। প্রতিনিয়তই তাঁর স্পন্দন অনুভব করতে পারতাম। যে কারণে মনে হতো, তিনি খুব নিকটেই আছেন। প্রকৃতঅর্থে নিকটে না থাকলেও তাঁর সঙ্গে বরাবরই নৈকট্য ছিল। 

‘ক্রীড়াজগত’ পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে যোগ দেওয়ার সময় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সচিব ছিলেন এ এস এম আলী কবীর। বিধিবদ্ধ চাকরির প্রতি আমার এক ধরনের অনীহা ছিল। যাহোক, চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর সেই অনীহাটুকু কাটিয়ে উঠতে মোটেও অসুবিধা হয় নি। এর কারণ, খুব সহজেই তিনি আমাকে আপন করে নেন। তিনি হয়ে উঠেন পরম নির্ভরতা। কোনও সমস্যাই কাছে ঘেঁষতে দেন নি। ছাতা হয়ে ছিলেন মাথার ওপর। প্রাতিষ্ঠানিকতার সঙ্গে সৃজনশীল কাজের যে বিরোধ, তা তিনি কখনই বুঝতে দেন নি। যখনই যা করতে চেয়েছি, তিনি বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। প্রচলিত ধারার বসদের মতো তিনি ছিলেন না। যে কোনও কাজ যাতে সাবলীলভাবে সম্পন্ন হয়, বুদ্ধি বা পরামর্শ দিয়ে তিনি সহায়ক ভূমিকা পালন করতেন। সৃজনশীল কাজের প্রতি তাঁর যথেষ্ট অনুরাগ ছিল। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নিজেও জড়িয়ে ছিলেন সৃজনশীল কাজে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। কাব্যচর্চা করতেন। বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখি করতেন। রচনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ। এই ঘরানার মানুষদের সঙ্গে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। 

দীর্ঘ চাকরি জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। অনেকের সঙ্গে মিশেছেন। তবে ক্রীড়াঙ্গনের প্রতি তাঁর আলাদা একটা মমত্ববোধ গড়ে ওঠে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে দুই দফায় সচিব থাকাকালে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে নিজেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ফেলেন। এই জগতের মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁর ছিল আত্মিক এক বন্ধন। গুরুত্বপূর্ণ অনেক দায়িত্বে থাকলেও ক্রীড়াঙ্গন থেকে কখনও দূরে সরে থাকেন নি। মোটামুটিভাবে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে সুখে-দুঃখে, হাসি-কান্নায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সভাপতি হওয়ার পর ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে যোগাযোগের পরিধি বৃদ্ধি পায়।   সামাজিক, পেশাগত পরিমণ্ডলে তো বটেই, ক্রীড়াঙ্গনে তাঁর ছিল অসম্ভব জনপ্রিয়তা। তিনি নিজেও ছিলেন মজলিশী স্বভাবের মানুষ। পছন্দ করতেন খানাপিনা, আড্ডা। সর্বদা প্রাণোচ্ছ্বল বাতাবরণে থাকতে ভালোবাসতেন। জোছনা, পাহাড়, নদী তাঁকে অসম্ভব টানতো। 

তাঁর স্নেহ, ভালোবাসা থেকে কখনই বঞ্চিত হই নি। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে কর্মরত থাকলেও বরাবরই যোগাযোগটা ছিল। আমার খোঁজ-খবর নিতেন। তাঁর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগটা অনিয়মিত হলেও একটা বিশ্বাস অটুট ছিল, একজন অভিভাবক হয়ে তিনি আছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান। টেলিফোনে যখন শেষবার কথা হয়, তখন তিনি জানিয়েছিলেন, এই জানুয়ারিতে বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশনের কার্যালয় এনএসসি টাওয়ারে স্থানান্তর করা হচ্ছে। টাওয়ারে অফিস নেওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, ক্রীড়াঙ্গনের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থান করা। যাতে ক্রীড়াঙ্গনের সবার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করা সহজ হয়। শুনে খুশি হয়েছিলাম। বলেছিলাম, যাক, এখন থেকে আপনার সঙ্গে নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ হবে। নিয়মিত তো দূরে থাক, আর কোনও দিনই তাঁর সঙ্গে দেখা হবে না।

১১ জানুয়ারি ২০২২

সুরের ঈশ্বরী

 


'বাচপান কি মোহাব্বত কো দিল সে না জুদা কারনা.......' 

আমি ঠিক জানি না, কোন সুদূর থেকে বেজে উঠতো এই গান। গানের অর্থ বুঝতাম না। শিল্পী চিনতাম না। কোনো কিছুই জানতাম না। কিন্তু সুরের মায়াজালে বিভোর হয়ে যেতাম। বুকের মধ্যে কেমন যেন আবেশ ছড়িয়ে দিত। যেন মেঘ হয়ে ভেসে যেতাম। যেদিন এই গানটি প্রথম শুনেছি, সেদিন থেকে বুকের মধ্যে কেন যেন না পাওয়ার একটা বেদনা অনুভূত হয়। এ গানটি কুয়াশার মতো জড়িয়ে আছে স্মৃতির কুহকে। এ গান যেন জন্মান্তরের। কে যেন হৃদয়ের সবটুকু আকুতি দিয়ে মিনতি জানাচ্ছেন। সেটি হয়ে ওঠেছে সর্বজনীন, সর্বকালীন, সর্বসাধারণের । আজও এ গানটি যখন শুনি, তখনও বুকের মাঝে একই রকম অনুভূতি হয়। এ গান যেন চিরদিনের। চিরকালের। চিরজনমের।

তারপর তো জানতে পারি এ গানের শিল্পী লতা মঙ্গেশকর। এই গানের আগে ও পরে তাঁর রয়েছে কালজয়ী অসংখ্য গান। সেই গানগুলোও একইভাবে আপ্লুত করে। ছুঁয়ে যায় হৃদয়। তবে সত্যিকার অর্থে আমার হৃদয় দুলিয়ে দেয়, 'মন ডোলে মেরা তান ডোলে/মেরা দিল কা গয়া কারার রে/ইয়ে কোন বাজায় বাঁশুরিয়া'। তিনি তো গানের সমুদ্র। সব ছাপিয়ে কী কারণে যেন এ গানটির কথাই এই মুহুর্তে খুব বেশি বেশি মনে পড়ে যাচ্ছে। কোনো কারণ নেই। মানুষের সব কার্যকরণের কোনো হেতু থাকে না। অবশ্য এই গানে এমন একটা সম্মোহন আছে, তাতে সহজেই নেচে ওঠে মনপ্রাণ। আর সুর তো মোহগ্রস্ত করে রাখে। বীণ বাজিয়ে যেভাবে সম্মোহিত করা হয়, তাতে সাপ তো বটেই, মানুষের পক্ষে সুস্থির থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। জাদু, মায়া আর মুগ্ধতায় মাখামাখি হয়ে আচ্ছন্ন করে দেয়। তাঁর কণ্ঠ কখনও দানাদার মিছরির মতো মিষ্টতা ছড়িয়ে দেয়। আবার কখনও ধারালো ছুরির মতো হৃদয়ে বিদ্ধ করে। তবে গান মানেই কেন যেন মনে হয় লতা মঙ্গেশকরের কথা। তাঁর যে কণ্ঠমাধুর্য তা হয়ে ওঠেছে চিরকালীন এক নিদর্শন। 

তাঁর গাওয়া বাংলা গান তো বুকের মধ্যে জ্বালিয়ে দেয় ভালোবাসার ধুপ। একটা সময় তাঁর গান শুনে মন যে কোথায় হারিয়ে যেত, তার হদিস পেতাম না। 'প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে/আমারই এ দুয়ারও প্রান্তে/সে তো হায়, মৃদু পায়/এসেছিল পারি নি তো জানতে'। আসলেই কি এসেছিল? তা বুঝতে না পারাটা অনন্ত এক আক্ষেপ হয়ে আছে। 

সেই শৈশব থেকে লতা মঙ্গেশকরকে হৃদয়পটে স্থান দিয়েছি। ভালোবেসেছি তাঁর গান। নিখাদ সেই ভালোবাসা। তাঁকে কখনও আলাদা করে ভাবি নি। কী করে ভাববো? তিনি আমাদের সুরে সুরে যেভাবে কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছেন, তার কোনো তুলনা হয় না।

তিনি তো সুরের ঈশ্বরী। কত কত আগে থেকে তাঁর সুরের জাদু দিয়ে আমাদের সম্মোহিত করে রেখেছেন। এই ভুবনকে যাঁরা সুরময় করতে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে দেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। মন কেমন করা সেই গানগুলো মনে পড়ে যাচ্ছে। অনেক দুঃখের মুহুর্তে কোনো কোনো গান সান্ত্বনা দিয়েছে। লাঘব করে দিয়েছে কষ্টগুলোকে। আবার আনন্দময় মুহূর্তের সঙ্গী হয়েছে তাঁর গান। কত গান, কত শত গান, কত সহস্র গান। তাঁর সুরের সুরা পান করলে সেই নেশা কখনো ছেড়ে যায় না। এখনও চিরায়ত সেই গানগুলো শুনলে বুকের মধ্যে কেমন কেমন করে। 

হায়! থেমে গেছে সেই কিন্নরীকণ্ঠ। যেন মৃত্যু হয়েছে সুরের আত্মার। যেখান থেকে আর কোনো সুর ভেসে আসবে না। তবে যে সুর তিনি ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন, তা কখনও থেমে যাবে না।

৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২

বৃহস্পতিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০২২

সাগর সৈকতে

 


সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে 

তোমার কপালে ছোঁয়াবো গো

ভাবি মনে মনে

আকাশের নীল থেকে তারার কান্তি এনে

তোমার নয়নে ছড়াবো গো 

ভাবি মনে মনে

সাগরের তীর থেকে...

প্রাণ-মন উজাড় করে কে গাইছে এই গান? যেন কেউ একজন আমাকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছে প্রিয় এই গানটি। অদ্ভুত এক ভালো লাগায় বুকের মধ্যে উথালপাথাল করতে থাকে। খালি গলায় গাইলেও কেমন একটা সম্মোহন সৃষ্টি করেছে কণ্ঠমাধুর্য। এমন পরিবেশে এই গান বোধকরি বুকের গভীর থেকে সহজাতভাবেই উঠে এসেছে। পূর্ণিমার প্রভাবে সাগরে যেমন প্রবলভাবে জোয়ার আসে, তেমনিভাবে কণ্ঠে সুর থাকলে গান তো সহজাতভাবে গাইতে ইচ্ছে করবেই। চারপাশটা কী মায়াময়। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে চাঁদের আলো। সমুদ্রের ঢেউয়ে ঝিকমিক করছে আলোর রোশনাই। আলো আর আঁধারের সমন্বয়ে অলৌকিক এক আবহ। গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেন সংগত করে চলেছে সাগরের ঢেউ। সবুজ জলরাশির গম্ভীর সুরেলা কলধ্বনি। 

ক্রমান্বয়ে রাতের গভীরতা বেড়ে চলেছে। লোক চলাচল হ্রাস পেলেও পুরোপুরিভাবে নিরিবিলি বলা যাবে না। সমুদ্রের নির্জনতা একান্তভাবে অনুভব করার জন্য অনেকেই এসেছেন। সত্যি সত্যি মিষ্টি মিষ্টি হাওয়া এসে জুড়িয়ে দিতে থাকে অন্তঃকরণ। কেউ কেউ ছাতার নিচে আরামচেয়ারে বসে আছেন। সেখান থেকেই ভেসে আসছে সুরেলা গান। কোলাহলমুক্ত পরিবেশে গানটা অনেকটা দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। পষ্ট শোনা যেতে থাকে গানের কলি। কেমন আচ্ছন্ন করে দেয়। 

গানের কণ্ঠ খুবই পরিচিত মনে হতে থাকে। অবশ্য এই গান শাহনাজ রহমতুল্লাহর কণ্ঠে জনপ্রিয়তা পেলেও অনেকেই গেয়েছেন। সে কারণে চেনা চেনা মনে হতেই পারে। তারপরও কেন যেন অনেক বছর আগে একজনের কণ্ঠে এই গান শোনার স্মৃতি মনে পড়ে যায়। সেই গানের স্রোতা ছিলাম একমাত্র আমি। অবশ্য আরও ছিল গাছপালা, পাখপাখালি, ঝিরিঝিরি বাতাস আর বছিলা ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা নদী। নদীতে চলাচল করছিল যাত্রীবাহী নৌকা। হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পাওয়া যায় মালামাল বহনকারী বার্জ বা কন্টেইনার। বিকেল গড়িয়ে গেলে ডুবতে থাকা সূর্য ছড়িয়ে দেয় তার অপরূপ মাধুর্য। পরিপার্শ্বটাকে মাখিয়ে দেয় সোনা রঙে। কী যে অদ্ভুত লাগে। 

ঢাকার সন্নিহিত গ্রামীণ এক দৃশ্যপট। আমার আর সুরভির পছন্দের একটা জায়গা। সুযোগ পেলেই সেখানে আমরা ছুটে যেতাম। সেদিন আমরা নৌকায় করে নদীর ওপারের দ্বীপের মতো এলাকায় অবস্থিত বিশাল ইটের ভাটায় যাই। জনবিরল সেই দ্বীপে আমরা প্রজাপতির মতো ইচ্ছেপাখি হয়ে ছোটাছুটি করি। তখন তো যা কিছু করি, তাই লাগে ভালো। কোনও ভয়ডর কাজ করতো না। আশেপাশে তেমন কেউ ছিল না। তারপরও আমার কানে কানে লাজুককণ্ঠে সুরভি বলে, তার খুব হিসি পেয়েছে। সেখানে তো আর ওয়াশরুম থাকার প্রশ্নই আসে না। কী করা যায়? 

এরআগে কখনও এমন সমস্যায় পড়ি নি। তাকিয়ে দেখি, চারপাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ইটের পাঁজা। ভাবলাম, এরচেয়ে ভালো আড়াল হয় না। সুরভিকে তা বলতেই কিছুতেই রাজি হতে চায় না। কিন্তু এছাড়া তো উপায় নেই। গরজ বড় বালাই। অগত্যা সেই প্রাকৃতিক পরিবেশে ঠেকার কাজ চালাতে হয়। গার্ড হিসেবে আমাকে রাখতে হয় তীক্ষ্ণ নজরদারি। কল্লোলিত ঝর্ণাধারা ইউরিয়া সার হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। 


চাপমুক্তির একটা আলাদা আনন্দ আছে। নৌকায় ফেরার সময় আমার কাঁধে মাথা রেখে আপন মনে গান গাইতে থাকে সুরভি। সাগরের তীর থেকে...। নিবিড় সেই মুহূর্তে নদীটাকেই আমার কাছে সাগর মনে হতে থাকে। সেদিন মনে হয়েছিল, স্বর্গসুখ কি এমন হয়? তখন নেমে এসেছে অন্ধকার। জোনাকি হয়ে জ্বলতে থাকে দূরের আলো। আকাশে তারার মেলা। নিস্তব্ধতার মাঝে বৈঠা বাওয়ার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। কেমন যেন মাদকতাময় পরিবেশ। সব মিলিয়ে মনে হতে থাকে, যেন নন্দনকাননে কিন্নরীকণ্ঠে কেউ গান গাইছে। সেই থেকে গানটা আমার বুকের ভিতর চিরদিনের মতো স্থায়ী হয়ে যায়। 

সুরভির সঙ্গে আমার ছিল গভীর গোপন প্রেম। তার সবচেয়ে যা ভালো লাগতো, আমার পছন্দ-অপছন্দকে সে যথেষ্ট গুরুত্ব দিত। জীবনে যা কখনও করে নি, আমার কারণে তা করতে মোটেও কার্পণ্য করতো না। সেই সময় মূলত আমাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় তার জীবন। গানের প্রতি আমার আকর্ষণের কারণে গানের চর্চা শুরু করে। লালমাটিয়া গার্লস কলেজে রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সংগীতের স্কুল 'সুরের ধারা'য় ভর্তি হয়। যত সহজে বলা হলো, ব্যাপারটা তত সহজ ছিল না। পারিবারিক বিধিনিষেধ ছিল। কিন্তু আমার জন্য সে কোনো কিছুই পরোয়া করতো না। 'সুরের ধারা'য় কোর্স কমপ্লিট না করেই তালিম নেয় আধুনিক গানের। এর কারণ, আমি তা পছন্দ করতাম। কিন্তু সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তার সংগীতশিল্পী হয়ে ওঠা হয় নি। 

তার মধ্যে ছিল একটা খামখেয়ালিপনা। কখন কী সিদ্ধান্ত নেবে, তা আগের মুহূর্তেও বুঝতে পারা যেত না। পথ চলতে চলতে হঠাৎ হারিয়ে যেত। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা মোটেও সহজ ছিল না। আমি তাকে অসম্ভব ভালোবাসতাম। এ কারণে তার বায়নাক্কা মেনে নিতাম। তারপরও তার মন রক্ষা করা যায় নি। গান যেমন হুট করে ছেড়ে দিতে একটুও ভাবে নি, তেমনিভাবেই আমার সঙ্গে সম্পর্কটা কাট অফ করতে একদমই দ্বিধা হয় নি। কেন সম্পর্ক অটুট রাখে নি, তার কোনও কার্যকারণ জানি না। সেদিন উপলব্দি হয়, বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না, দূরেও ঠেলিয়া দেয়।

একটা পর্যায়ে তার হয়তো ইচ্ছে হয়, আমার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়ার। তার ইচ্ছে হবে, সেটা বাস্তবায়িত হবে না, তা তো হতে পারে না। ওয়ান ফাইন মর্নিং আমি আবিষ্কার করি, তার নামের পাশে সবুজ বাতি আর তো জ্বলে না। জ্বললেও আমি তা দেখতে পাই না। তার জীবন থেকে আমি একদমই নেই হয়ে যাই। কেন, কী কারণে আমাকে বাতিল করে দেওয়া হয়, তার জবাব আজও পাওয়া হয় নি। তবে অস্বীকার করবো না, তাকে কখনও ভুলতে পারি নি। 

মুক্তা যেমন শুক্তিরও বুকে থাকে, তেমনিভাবে আগলে রেখেছি তার সান্নিধ্যের মধুময় স্মৃতি। যখনই কোথাও তার মতো কাউকে কিংবা অবিকল তার ভঙ্গিমা দেখতে পাই, বুকটা কেমন উচাটন উচাটন করতে থাকে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সবটাই হয়ে যায় মরীচিকা। আর কখনও তার নাগাল পাওয়া হয় নি। এই বিভ্রান্তি নিয়ে তাকে প্রতিনিয়ত খুঁজে চলি। তার কণ্ঠে শোনা গান হররোজ শুনি। কেউ যখন সেই গান গায়, আমি কান পেতে রই।

অনেক বছর পর কক্সবাজারে এসেছি। সব কেমন বদলে গেছে। সৈকত শহরের সেই বর্ণিলতা অনুভব করতে পারছি না। সবুজের গহীনতা নেই। শহরটি যেন রূপ নিয়েছে আবাসিক এলাকায়। হোটেল, মোটেল, রিসোর্টগুলোতে নান্দনিক সৌন্দর্যের বালাই নেই। অধিকাংশই গড়ে তোলা হয়েছে আবাসিক ভবনের মতো করে। তা দেখে প্রাথমিক অবস্থায় বোঝার উপায় নেই এটি সৈকত শহর। কেবল সমুদ্রের কাছে গেলেই তা অনুধাবন করা যায়। দিনের বেলায় জনাকীর্ণ সৈকতে সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে আসার খুব একটা সুযোগ পাওয়া যায় না। এত এত মানুষের ভিড়ে সমুদ্র দূরের হয়ে থাকে। 


যতই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে থাকে, ততই যেন মায়াবিনী হয়ে ওঠে সমুদ্র। ধরা দেয় নানান রূপে। রহস্যময়তার চাদরে মুড়ে দেয় চারদিক। সূর্য ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে দৃশ্যমান হয় অপার্থিব সৌন্দর্যের এক আধার। সেই সৌন্দর্যকে স্মৃতিময় করার জন্য  মুহুমুর্হু জ্বলতে থাকে মোবাইল বা ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। কারও হাতে সূর্য। কারও আঙুলে সূর্য। কারও মাথায় সূর্য। নানান ভঙ্গিমায় সূর্যাস্তকে বন্দী করা হয়। কতভাবেই না গোধূলিকে ধরে রাখার কসরত চলতে থাকে। আমরাইবা পিছিয়ে থাকি কেন? আর সৈকতের পেশাদার ফটোগ্রাফারদের ক্রমাগত তাগাদা তো আছেই। 

আগে সৈকতের ফটোগ্রাফাররা ছবি তুলে প্রিন্ট করে হোটেলে পৌঁছে দিত। সেই সিস্টেম আর নেই। এখন ছবি তোলার পর ডাটা কেবল কিংবা পেন ড্রাইভ দিয়ে ছবি মোবাইল ফোনে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়। বেশি টাকা পাওয়ার জন্য ঘন ঘন ক্যামেরার শাটার টিপে গাদা গাদা ছবি ধরিয়ে দেয়। একই ভঙ্গিমায় অনেক ছবি তোলা হয়। কার্যত কিছু করার থাকে না। অবশ্য প্রিন্ট কপি ছবির গুরুত্ব আগের মতো আর নেই। এখন ছবি তোলা হয় মূলত একবার দেখা কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপলোড করার জন্য। প্রতিনিয়ত জমা হয় হাজার হাজার ছবি। তার মধ্যে পুরনো ছবির তেমন আর কদর থাকে না।


ব্যস্ততার কারণে কক্সবাজারে তোলা অসংখ্য ছবি ঢাকায় ফিরে আসার আগে আর দেখার সুযোগ হয় নি। অনেক দিন পর ছবিগুলো দেখার সময় চমকে যাই। সেই ছবিগুলোর মধ্যে নানান ভঙ্গিমায় জ্বল জ্বল করতে থাকে সুরভি। কত দিন পর তাকে দেখলাম। ফটোগ্রাফার তার ক্যামেরা থেকে ডাটা কেবল দিয়ে আমার মোবাইলে যে ছবিগুলো দেয়, তাতে শুধু আমাদের ছবি নয়, ভুল করে অন্য অনেকের ছবিও দিয়ে দিয়েছে। সেই ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে সৈকতে ভ্রমণরত সুরভি। তবে খুব কাছাকাছি হলেও ক্ষণিকের জন্য তার সঙ্গে সরাসরি দেখা হলো না। বুকের মধ্যে সুরের হাহাকার ছড়িয়ে দিতে থাকে তার কণ্ঠে গাওয়া গান, সাগরের তীর থেকে...

মঙ্গলবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২২

ভুলতে চাইলেও ভোলা যায় না

 


জানো, ব্যাংকে কাজের এমন চাপ, অনেক সময় প্রস্রাব পর্যন্ত করতে যেতে পারি না।

তাই বুঝি? এ বিষয়ে আমার একটা পরামর্শ আছে। অবশ্য তুমি তো আর মার্কিন কণ্ঠশিল্পী সোফিয়া উরিস্তার মতো সাহসী হতে পারবে না। সেক্ষেত্রে তো তুমি তোমার পুরানো ফর্মুলা কাজে লাগাতে পারো।

সোফিয়া উরিস্তাটা আবার কে? সে কী করেছে? আর পুরানো ফর্মুলাইবা কোনটা?

সোফিয়া গান গাওয়ার সময় চাপ সইতে না পেরে এক ভক্তকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে প্রকাশ্যে তাঁর মুখে হিসি করেন। আর ফর্মুলার কথা মনে নেই তোমার? নেত্রকোনায় থাকতে বদনায় হিসি করে রেখে দিয়েছিলে না? ব্যাংকে তো বদনায় হবে না। একটা বালতি রাখতে পারো।

এই বয়সেও তোমার বদগিরি গেল না?

দেখ, বয়সের আর কী দোষ? মনের বয়স তো আর বাড়ে না। মন যদি আগের মতোই থাকে, তাহলে বদগিরি যাবে কীভাবে? তাছাড়া তুমিও তো কম বদ ছিলে না। না হলে অন্যকে নাজেহাল করার জন্য কেউ কি বদনায় হিসি করে রাখে?

তুমি তো পুরানো কাসুন্দি ভুলতেই পারছো না। আমার তো সেসব স্মৃতি কিছু মনে নেই। তুমি মনে না করালে আর কখনও মনে পড়তো কিনা সন্দেহ। 

তুমি তো সব কিছু অনায়াসেই মুছে ফেলতে পারো। আমি চাইলেও পারি না। যেমন পারি নি তোমাকে ভুলে যেতে। তোমার সব কিছুই আমি পরম যত্মে সযতনে সাজিয়ে রেখেছি। হতে পারে কোনও স্মৃতি কিংবা ফ্রেমবন্দি কোনও মুহূর্ত। 

শোনো, যা চলে গেছে, তা তো গেছেই। আর কখনই ফিরে আসবে না। তাহলে সাজিয়ে রেখে কী লাভ? 

সে তুমি বুঝবে না। সেই অনুভূতি তোমার নেই।

বুঝলাম আমার নেই। তোমার বুঝি খুব অনুভূতি আছে?

দুঃখটাই তো এখানেই। তুমি সেটা বুঝতে পারলে না। আমি জানি না, আর কীভাবে তোমাকে বোঝানো যাবে?

কীভাবে তুমি বুঝিয়েছো যে আমি বুঝতে পারলাম না? ব্ল্যাকবোর্ডে এঁকে এঁকে বোঝালে না হয় হৃদয়ঙ্গম করতে পারতাম।

তুমি যে আমার হৃদয়ে চিরদিনের জন্য স্থান করে নিয়েছো, এটা কি তুমি বুঝতে পারো না?

মুখে মুখে বললেই বুঝি অনুভূতি হয়ে যায়? 

আমি তো হৃদয় দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করি।

তাহলে এতগুলো বছর চলে গেল। কেন যোগাযোগ করো নি?

আমি তো বরারবই যোগাযোগ করতে চেয়েছি। কিন্তু তুমি তো আমাকে কখনও সুযোগ দাও নি। একবারও আমার দিকে ফিরে তাকানোর চেষ্টা করো নি। তোমার গণ্ডি তো এখন অনেক বড়। কর্পোরেট জগতের মানুষ। অর্থে, বিত্তে ঝলমল করে তোমার চারপাশ। তাছাড়া এখন তোমার সঙ্গে যাদের চলাফেরা কিংবা তোমাকে যারা ঘিরে রেখেছে, তাদের ব্যুহ ভেদ করার সুযোগ কোথায়? তুমিই তো আবার সাবধানে থাকতে বলেছো। নতুবা বড় ধরনের কিছু ঘটে যেতে পারে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছো। 

তাহলে পুরানো গীত গেয়ে এখন আর কী লাভ?

আমি আসলে তোমাকে কখনোই ভুলতে পারি নি। পারবোও না। আমার জীবনে সত্যিকার ভালোবাসা তুমি। যেভাবে হোক, আমাদের মধ্যে যে নিবিড় বন্ধন গড়ে উঠে, তা তো অস্বীকার করা যাবে না। আমি অন্তত পারি না। প্রতি মুহূর্তে তুমি থাকো আমার হৃদয়জুড়ে।

হৃদয়জুড়ে কীভাবে আছি? তার কি কোনও চিহ্ন আছে?

তুমি তো বিষয়টাকে তামাশা মনে করছো। আমার কাছে আমাদের সম্পর্কটা অমলিন হয়ে আছে। তোমার সঙ্গে তো অনেক দিন যোগাযোগ নেই। দেখা করার উপায় নেই। কথাও হয় না। কিন্তু আমি প্রতিনিয়ত তোমাকে দেখতে পাই। তোমাকে অনুভব করি। কল্পনায় তোমার সঙ্গে কথা বলি। আমি যা কিছুই লেখালেখি করি না কেন, তার কেন্দ্রবিন্দুতে থাক তুমি।

তাতে কী এমন মহা উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে? তুমি তো লেখালেখি করো আমাকে ঝামেলায় ফেলার জন্য। মনে করো, আমি কিছুই বুঝতে পারি না?

মোটেও না। তোমাকে কেন ঝামেলায় ফেলবো?

তোমার লেখায় সব কিছু খুব স্পষ্ঠ হয়ে ওঠে। তারপর লেখায় যেভাবে ছবি ব্যবহার করো, তাতে তো না বোঝার কোনও কারণ নেই। একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলে যে কেউই আমাকে চিনতে পারবে।  

আমি যা যা লেখালেখি করি, যেখানে যেখানে প্রকাশ করি, তোমার চেনাজানার গণ্ডির কারও চোখে পড়ার তেমন সুযোগ নেই। 

তুমি কীভাবে নিশ্চিত হলে?

সেটুকু তো অন্তত বুঝি। তারা যাতে না বুঝতে পারে, সেজন্য আমি নানান কৌশল অবলম্বন করি।

তুমি কি সবাইকে তোমার মতো বুদ্ধু মনে করো নাকি?

তা করবো কেন? অবশ্য কোনও কোনও লেখা আমার পরিচিতজনরাই পড়ে। তারা বোধহয় কেউ কেউ তোমাকে চিনতে পারে। 

মানে কী? কারা চিনতে পারে?

আমার কোনও একটা লেখা পড়ে বাসা থেকে মন্তব্য করা হয়েছে, আমি তোমাকে ভুলতে পারি নি। আর এই কারণে নষ্ট হয়ে গেছে তার জীবন। 

কী বলছো তুমি?

আমি যে তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি, সেটা আমি মোটেও অস্বীকার করি না। করতে চাইও না। তা সবাইকে জানিয়ে দিতে আমার কোনও কার্পণ্য নেই। আমার লেখা পড়ে সেটা তোমার না বোঝার কারণ নেই। 

সেটা না হয় বুঝলাম। তার সঙ্গে জীবন নষ্ট হওয়ার কী সম্পর্ক? 

তোমার সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ দিন তার সঙ্গে আমার কথা বন্ধ থাকে। এরপর থেকে তার সঙ্গে আমার কোনও রকম শারীরিক সম্পর্কও নেই। 

একদম বাজে কথা। এটা আমি বিশ্বাস করি না।

আর কিছু যা হোক, আমি পারতপক্ষে মিথ্যা বলি না। আর এই মিথ্যা বলে তো আমার কোনও লাভ নেই। তোমার যদি কোনো সুযোগ থাকে, তুমি যাচাই করে নিতে পারো।

তা কীভাবে হয়? তাহলে শারীরিক সম্পর্ক কীভাবে মিটাও?

তোমার মাধ্যমে।

আমার মাধ্যমে! হাউ ইট পসিবল?

অবশ্য তোমার তো তা বুঝতে পারার কথা নয়। তোমাকে তো কাছাকাছি পাই না। তাতে কী? সেক্ষেত্রে কল্পনায় তোমার সাহায্য নিতে হয়। তোমার সঙ্গে ফিজিক্যাল রিলেশন আর তোমার ছবিগুলো আমাকে উদ্দীপ্ত করে। 

তুমি আসলে অসভ্য একটা লোক। এখনও ভালো হলে না। কেন যে এমন করো?

তুমি আমার অস্তিত্ব জুড়ে যেভাবে মিশে আছো, তোমাকে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারি না। বছরের পর বছর তোমাতে উপগত হচ্ছি। উত্তেজনা অনুভব করি। অথচ তুমি একটুও অনুভব করতে পারো না। এরচেয়ে কষ্টের আর কী আছে? 

আমি কি স্বর্গের দেবী নাকি? তুমি কী করছো না করছো, আমি দূর থেকে তা কীভাবে অনুভব করবো? যত্ত সব আজগুবি কথা। আচ্ছা, তুমি না হয় নিজের ওপর নির্ভরশীল। আরেকজন কী করে? 

সে খোঁজখবর আমি রাখি না। জানিও না।

এটাও কি বিশ্বাসযোগ্য? 

বিশ্বাস করবে না অবিশ্বাস করবে, সেটা তোমার ওপর নির্ভর করে। আমি একবিন্দু বানিয়ে বলছি না।


এই শোনো, কী খাবে বলো? 

তুমি তোমার পছন্দসই অর্ডার দাও। 

অনেক দিন পর দেখা। কী খাও, কী খাও না, তা তো জানি না। আমার পছন্দের খাবার খেতে পারবে তো?

না পারার কী আছে? অবশ্য এটাও ঠিক, এখন অনেক কিছুই হিসাব-নিকাশ করেই খাওয়া উচিত। কিন্তু তোমার ব্যাপারটা অন্য। একসময় তোমার শরীরের তিতকুটে পানীয় পর্যন্ত খেয়েছি। আর এখন পছন্দের খাবার খেতে পারবো না?

তোমার বদস্বভাব একদমই পাল্টায় নি। সব কিছু মনে করে রেখেছো!

রাখবো না! তা কী কখনও হয়? তোমাকে যতটা পেয়েছি, যেভাবে পেয়েছি, সেটাই ছিল আমার জীবনের স্মরণীয় অধ্যায়। তা কী করে ভুলবো বলো?

সব ঢঙের কথা। এইসব ফালতু কথা রাখো। বারবিকিউ চিকেন আর ফ্রাইড ভেজিটেবল অর্ডার দিচ্ছি। 

দিতে পারো। অর্ডারের ধরন দেখে বুঝতে পারছি, বেশ স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছো। কিন্তু এত দূর এলে কেন? 

বনানী কি খুব দূরে নাকি? 

আমার জন্য দূর তো বটেই। খুব একটা আসা হয় না। তবে তোমার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে পারছি, তুমি এদিকে নিয়মিতই আসো।

অফিসের কারণে মাঝে-মধ্যে আসতেই হয়।

তোমার জগতটা অনেক বদলে গেছে। কত জায়গায় তোমাকে যেতে হয়। কত কিছুই না করতে হয়।

মানে কী?

কিছুই না। 

মনে হচ্ছে, তোমার কথার মধ্যে একটা অন্য রকম ইঙ্গিত আছে। 

তুমি এখন অনেকের হয়ে গেছো। কষ্টটা হলো, তুমি শুধু আমার নও। তোমার একটা ক্ষোভ ছিল, সম্পর্কের দিক দিয়ে আমি তোমার চেয়ে এক কদম এগিয়ে ছিলাম। এখন তোমার তো মাল্টিপল সম্পর্ক। আমাকে ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গেছ।

দেখ, উল্টোপাল্টা কথা বাদ দাও। এত বছর পর আমরা একত্রিত হয়েছি, দিনটা তিক্ততায় ভরিয়ে দিও না।

আসলে আমি এটা কোনোভাবেই মানতে পারি না। আমি তোমাকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছি। তাহলে কেন আমাকে দূরে সরে যেতে হলো?

অতীত নিয়ে টানাটানি করে কোনো লাভ নেই। তাতে মন খারাপ হয়ে যায়। বরং বর্তমান সময়টাকে উপভোগ করার চেষ্টা করো। 

সেটা যদি পারতাম, তাহলে তোমাকে কবেই ভুলে যেতাম। তোমার ভালোবাসা হৃদয়ে বহন করে নিয়ে জীবনটাকে ক্ষয়ে যেতে দিতাম না। 

ক্ষয়ে যেতে দিতে না, এর অর্থ কী? আমি কি তোমাকে বলেছি, আমাকে স্মরণ করে মৈথুন করে নিজেকে ক্ষয় করো। তুমি যা যা করো, সবই করো তোমার মেজাজ-মর্জি মতো। অকারণে আমাকে দোষারোপ করবে না।

মৈথুন করে ক্ষয় হওয়ার কথা তো বলি নি। সেটা করি নিজের শারীরিক চাহিদা পরিপূরণ করার পাশাপাশি তোমাকে নিবিড়  ভাবে অনুভব করার জন্য। তাতে কী ক্ষয় হয় বা হয় না, তা তো আমার জানা নেই। আসলে তোমার সান্নিধ্য না পাওয়াটাই আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে। তোমাকে ছাড়া কেমন যেন ছন্ন ছাড়া হয়ে গেছি। আর কোথাও মন বসে না। 

তোমার এসব মারফতি কথা বাদ দাও তো। 

মোটেও মারফতি কথা নয়। তোমাকে পেয়ে আমার জীবনটা হয়ে উঠে আনন্দময়। সেই আনন্দটুকু দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কিন্তু দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার পর থেকে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হই। আমি একদমই ভালো নেই। আমার মনের কথা বলার মতো কেউ নেই। আমি একদমই একা হয়ে গেছি। তোমাকে যেভাবে পেয়েছি, তেমনভাবে আর কাউকে পাওয়া সম্ভব নয়। 

এসব আবোল-তাবোল কথা বন্ধ করো তো৷ তোমার এই পুরানো প্যাঁচাল শুনতে ভালো লাগছে না।

তুমি কেন এত নির্দয় বলো তো? এতটা সহানুভূতিহীন হলে কী করে? জীবনের অনেকগুলো মূল্যবান দিন আমাদের হাসি-আনন্দে কেটেছে। আমার ধারণা, এমন দিন তোমার জীবনে আর কখনও আসে নি। সেই দিনগুলো তোমার কাছে কোনও গুরুত্ব নেই?  

যখন দিনগুলো ছিল, তখন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই দিনগুলো এখন অতীত হয়ে গেছে। তা নিয়ে জাবর কেটে কী আর হবে? জীবন কখনও থেমে থাকে না।

তা হয়তো থাকে না। জীবন যাদের কাছে প্রতিনিয়ত নতুন নতুনভাবে ধরা দেয়, তাদের কাছে জীবন গতিময়। অতীত তাদের স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু আমার জীবন তো তোমার কাছে থেমে আছে। সেখান থেকে আমি আর এগিয়ে যেতে পারি নি। পারার চেষ্টাও করি নি। 

সে তো তোমার সমস্যা। তাতে আমার কী করার আছে? 

তা ঠিক, তোমার কিছু করার নেই। তবে একটা জীবন যখন আরেকটা জীবনের কাছে বাঁধা হয়ে যায়, তখন কি সব কিছু এড়িয়ে থাকা যায়? 

তোমার কথাবার্তার মধ্যে কেমন একটা দার্শনিকসুলভ ভাব। দেখ, এখন আমাদের বয়স বেড়েছে। দুজনের সংসার আছে। সন্তান আছে। সন্তানরাও বড় হয়েছে। এখন কি আর আমাদের ফেলে আসা সম্পর্ক নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক? 

এই কথা কি কেবল আমার জন্য প্রযোজ্য?

তা নয়। কিন্তু তুমি আমাদের সম্পর্কের মধ্যে যেভাবে হাবুডুবু খাচ্ছ, তা কি ঠিক? 

ঠিক-বেঠিক বিবেচনা করে আমি কখনও জীবন যাপন করি নি। আমাকে নিয়ন্ত্রণ করে মন। তার নির্দেশনায় চলি। 

এখন মনটাকে থিতু করার চেষ্টা করো। 

আর যা কিছু পারি না কেন মনকে থিতু করার শক্তি আমার নেই। 

শোনো, তোমার সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে। 

জরুরি কথা!

দেখ, এখন আর আমাদের পাগলামি করার বয়স নেই। এই বয়সে এমন কিছু করা উচিত হবে না, যাতে সবার কাছে হাসি-তামাশার পাত্র হই। তোমার কাছে আমার অনুরোধ, তুমি আমাকে ভুলে যাও। প্লিজ, আমাকে কথা দাও, আমাকে নিয়ে আর পাগলামি করবে না। 

এইজন্য বুঝি তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছো?

এছাড়া তো উপায় ছিল না। আমাদের ভালোবাসার দোহাই লাগে, আমার মাথা ছুঁয়ে কথা দাও, তুমি আমাকে নিয়ে আর কিছু লিখবে না। 

ঠিক আছে, কথা দিলাম। 

সত্যি কথা দিলে তো? আমি জানি, কথা দিলে তুমি বরখেলাপ করবে না। 

তুমি বললে তাই কথা দিলাম। কিন্তু কথা রাখতে পারবো কিনা জানি না। কারণ, আমি আমার ভালোবাসাকে অস্বীকার করতে পারবো না। তোমাকে ছাড়া আমি কিছুই ভাবতেই পারি না।